প্রশ্ন: জামাতি ও বামাতির সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য তুলনা করো

উত্তর: 

এই প্রশ্নের উত্তর দিতে ‘জামাতি’ ও ‘বামাতি’ শব্দ দুটিকে আক্ষরিক অর্থে না লইয়া রূপকে ব্যাপকতর অর্থে ধরাই বেশি যুক্তিসঙ্গত। প্রথমটি ‘জামাত’ নামের ইসলামিক মৌলবাদী ও সন্ত্রাসবাসী সংগঠনকে বুঝাইলেও সামগ্রিকভাবে ইসলামি মৌলবাদের প্রতিনিধি স্থানীয় শব্দ ধরিয়া লওয়া হইল। আর বাম+অতি =‘বামাতি’ এই সন্ধিবদ্ধ পদটিকেও শুধু অতি বাম নকশাল বা মাওবাদীদের এদের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রাখিয়া সামগ্রিকভাবে বামপন্থী অর্থে ব্যবহার করা যাইতেই পারে। কারণ পারস্পরিক দ্বন্দ্ব থাকিলেও ভারতের মতো অসহিষ্ণু মৌলবাদী রাষ্ট্রের বিরোধিতায় সবকটি ইসলামিক দল যেমন এককাট্টা, অনুরূপে মাওবাদীদের দাপটে বৈধ বাম সরকারগুলি নাস্তানাবুদ হইলেও দক্ষিণপন্থী বিরোধিতায় বেআইনি মাওবাদীদেরও যে পরম সমর্থক হইয়া উঠে, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বুদ্ধা ইন ট্রাফিক জ্যাম’ চলচ্চিত্রটির প্রদর্শন বন্ধের তৎপরতা তাহার নজির রাখিয়াছে। অর্থাৎ ‘অতি’ বিশেষণ বা এখানে অনুসর্গটি প্রয়োজনে গজাইয়া উঠে, আবার সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে ক্ষমতা দখলের স্বার্থে ঝরিয়াও যায়।

আপাত দৃষ্টিতে কিন্তু জামাতি অর্থাৎ ইসলামি মৌলবাদের সহিত বামাতি বা কমিউনিস্ট চিন্তাধারার সংঘাতই অনিবার্য মনে হয়। কারণ কমিউনিস্টরা ধর্মকেই মানে না, ধর্ম তো জনগণের আফিম – সর্বনাশা মাদক। যে ধর্মে অতিরিক্ত গোঁড়ামি, তাহার সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সহাবস্থান তো অসম্ভব ব্যাপার। তাই বিংশ শতাব্দীতে পূর্বতন ইউএসএসআর এবং পূর্ব ইউরোপীয় সমাজতন্ত্রী দেশগুলিই মুসলিমদের সঙ্গে সংঘাতে জড়াইয়াছে বেশি। ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে কমিউনিস্ট দেশগুলো এতটুকু সহিষ্ণুতা দেখায় নাই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙিয়া রাশিয়া, বসনিয়া, হরজ়াগোবিনা ইত্যাদি দেশগুলো বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় দেখিয়াছি মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার গোলাগুলি বিনিময় নিত্ত-নৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। স্বাধীনতাকামী চেচেন জঙ্গিদের রাশিয়া কঠোরভাবে দমন করিয়াছে। আর এই সংঘর্ষে বাস্তুহারা মুসলিমদিগকে পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলোর কেহ আশ্রয় দেয় নাই, দিয়াছে গণতান্ত্রিক কিছু দেশ মানবাতার খাতিরে। তাদের অধিকাংশ যেমন ফ্রান্স বেলজিয়াম ইত্যাদি এখন তার প্রতিদান পাইতেছে। মাঝে মধ্যে বোমা বিস্ফোরণ ছাড়াও ঐ দেশগুলোর শত-শত কন্যা জেহাদিদের সেবায় প্রায়ই মধ্যপ্রাচ্যে চালান হইয়া যায়, বা উপযুক্ত মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের পর স্বেচ্ছাতেও জেহাদি আদর্শে ব্রতী হইয়া সিরিয়ায় গমন করে।

কিন্তু ভারতবর্ষে এর বিস্ময়কর ব্যতিক্রম, যেখানে দেশে বিশেষ করিয়া পশ্চিমবঙ্গে ইসলামি মৌলবাদ বামপন্থীদের প্রত্যক্ষ বন্ধুত্বে এমনভাবে শেকড় চারাইয়াছে, যে মুসলিম-তুষ্টি রাজ্য-রাজনীতির শাখা-প্রশাখায় শিরা-উপশিরায়। বর্তমানে নূন্যতম আড়াল না রাখিয়া যে ভাবে সরাসরি জামাত সিমি ইত্যাদি মৌলবাদী এমনকী জঙ্গি সংগঠনগুলোকে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়া চলিতেছে, তাহাতে সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হইলেও বামপন্থীদের তরফে সেই লইয়া কোনও অভিযোগ নাই। বরং তাহারা নিজেদের আরও বেশি মুসলিমপ্রেমী ও হিন্দুবিদ্বেষী, এমনকী ভারত বিদ্বষী প্রমাণ করিয়া হৃত জমি ফেরত পাইতে মরিয়া। এখানে ধর্মান্ধতা বিরোধী আদর্শ অপেক্ষা অধিক গুরুত্বপূর্ণ কমিউনিস্ট পতাকাবাহী তাদের দ্বিতীয় পিতৃভূমি চিন রাষ্ট্রটির ভারতবিরোধী ‘জামাতি’ দেশগুলো সম্পর্কে অবস্থানটি; ঠিক যেমন পবিত্র ভূমি পাকিস্তান স্থির করিয়া দেয় কাফের অধ্যুষিত হিন্দুস্তানের প্রতি ভারতীয় মুসলিমদের মনোভাব কেমন হইবে। দেখিয়া শুনিয়া মনে হয়, সারা বিশ্বের কমইউনিস্টরা জেহাদিদের প্রতি যে অবিচার করিতেছে, তার ক্ষতিপূরণ করার দায়িত্ব লইয়াছে ভারতীয় কমরেডরা।

সাদৃশ্য:

তলিয়ে দেখিলে ‘মাকর্সবাদ’ ও ‘মৌলবাদ’এর মধ্যে নীতিগত ও কাঠামোগত দূরত্ব খুব কম। নৈকট্যগুলি নিম্নরূপ:

(১) দুটোরই কারণ অর্থনৈতিক এবং উৎস দুটি পুস্তক। কমিউনিজ়মের গোড়ার কথা কার্ল মার্কস প্রণীত ‘দাস ক্যাপিটাল’ নামের একটি অর্থনীতির বই। আর ইসলামের জন্ম ‘কোরান’ নাম ধর্মপুস্তক, যাহার প্রণেতা হজরত মহম্মদও নিজের মশলার ব্যবসা নিষ্কণ্টকভাবে প্রসারের স্বার্থেই আরব দেশীয় উপজাতিগুলোকে ধর্মের নামে ঐক্যবদ্ধ করিয়াছিলেন।

(২) Islamic Fraternity-র প্রশ্নে যেমন সারা বিশ্বের মুসলমানরা এক, তেমন মার্কসবাদের খাতিরেও ভারতীয় বিশেষত বাঙালি কমিউনিস্টরা বিশ্বনাগরিক।

(৩) ইসলামিক মৌলবাদ যেমন সারা বিশ্বের মুসলমানদের এককাট্টা হইয়া ধর্মযুদ্ধে শামিল হওয়ার প্রেরণা দেয়, কমিউনিস্ট মৌলবাদও তেমন কাল্পনিক বিপ্লবের জন্য অনুপ্রেরণা দেয়।

(৪) ধর্মের খাতিরে মৌলবাদী মুসলিমরা যেমন ক্ষেত্রবিশেষে দেশদ্রোহিতাকেও পরম ধর্ম বলিয়া মনে করে, ‘মার্কসীয়’ আদর্শের খাতিরে তেমনি ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি কমিউনিস্টরা দেশ-বিরোধিতাকেই অবশ্য পালনীয় কর্তব্য জ্ঞান করে।

(৫) ব্যক্তিহত্যা ও সন্ত্রাস প্রসারের নীতিতেও যে আশ্চর্য মিল, তাহাও নকশাল হইতে ইসলামিক জঙ্গি সংগঠনগুলো প্রমাণ করিয়া দিয়াছে।

(৬) উভয়েই অনমনীয়। কার্ল মার্কস বা এঙ্গেলস বাঁচিয়া থাকিলেও নিজেদের তত্ত্বের এমন বিচিত্র সমর্থক দেখে উল্লসিত হইতেন কিনা সন্দেহ; বরং তাঁদের মতবাদকে অনমনীয়, অপরিপবর্তনীয়, অযুগোপযোগী ঈশ্বর উবাচ ‘বাইবেল’ বা ‘কোরান’ বানানো হইয়াছে দেখিলে নাস্তিক হিসাবে কষ্ট পাওয়ারই কথা। অনেককেই বলিতে শুনি, “মার্কস্‌বাদ একটি বিজ্ঞান’। তাঁহারা কি জানেন না, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও কোনও প্রচলিত তত্ত্ব নতুন আবিষ্কারের নিরিখে খারিজ হইতে পারে বা পুরোনো সূত্র সংশোধিত হইতে পারে? সমাজবাদ উন্নততর বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের একটা সামাজিক তত্ত্ব, কোনও স্বতোসিদ্ধ সূত্র বা নিয়ম (law) নহে। এর উদ্দেশ্য মহান, তবে তার প্রয়োগকে যে যুগোপযোগী হইতেই হবে, তাহা যুক্তিবাদী কমরেডদের মাথায় না রাখিলেও চলে।

(৭) দু ক্ষেত্রেই নেতারা জনসাধারণকে যাহা উপদেশ দেন, তাহা নিজেদের বা নিজের সন্তানদের বেলা প্রযোজ্য নহে। কট্টর মৌলবাদী নেতারা অনেকেই বিলাস ব্যসনে থাকে, শ্লীলতা নিয়ে কড়াকাড়িতে নারীকে আপাদমস্তক শৃংখলিত রাখে, অথচ সেই নারীকেই বহু পুরুষের ক্ষুধা মিটাইতে যৌন দাসত্বে বাধ্য করে। কাশ্মীরের হুরিয়ত নেতারা গরিব ছেলেদের পাথর ছোঁড়া, গোলাগুলিতে অনুপ্রেরণা দিলেও নিজেদের সন্তানদের বিদেশে রাখিয়া পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত করে। ওদিকে চাউসেস্কু হইতে জ্যোতি বসু হইয়া মায় কারাত দম্পতি পর্যন্ত, রাজকীয় বিলাসে ডুবিয়া থাকা সর্বহারা নেতারও অভাব নাই। পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক শিক্ষা হইতে ইংরিজি তুলিয়া পরম মাতৃভাষাদরদীগণের আপন সন্তানকে ইংরিজি মাধ্যম স্কুলে পড়ানোর নজিরও আছে। চিনে তো নারী নির্যাতন ও শিশু শ্রমিকের শোষণ খুব নিয়মিত ব্যাপার। এই সমস্ত সর্বহারার প্রতিনিধিরা ঠাণ্ডা ঘরে বসিয়া বোতলের পর বোতল বিলিতি ফাঁক করিতে করিতে বহুদিন পর্যন্ত অল্প শিক্ষিতদের মগজে শ্রেণী চেতনার বীজমন্ত্র ও অশিক্ষিতদের মগজে জঙ্গিপনার উৎসাহ ঢুকাইয়া দিতে দারুণ সফল। আবার ইহাও স্বীকার করিতে হয়, মদ না ছোঁয়া ধর্মভীরু মুসলমানের মতো ব্যক্তিগতভাবে সৎ নীতিবাগীশ বামপন্থীর নিদর্শনও খুব বিরল নহে।

(৮) ২০১৭-য় নির্বাচিত আমেরিকার রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তার কারণে কয়েকটি মুসলিম দেশের নাগরিকদের ভিসা বাতিল লইয়া বামাতিদের তুমুল শোরগোল, কিন্তু ঐ দেশগুলিতে সন্ত্রাসী কার্যকলাপ, নারকীয় নারী ও শিশু নিগ্রহ লইয়া কোনও মাথাব্যথা নাই। এটি শুধু ‘বামাতি’ বা ভারতীয় বামপন্থীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আর কোনও কমিউনিস্ট দেশের এমন সৃষ্টিছাড়া অবস্থান নহে, অন্তত নিজের দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়া তো নহেই।

(৯) চিন বর্তমানে আদৌ সাম্যবাদী আদর্শ অনুসরণ না করিলেও যেমন কমিউনিস্ট দেশ হিসাবে আমাদের বামাতিদের দ্বারা পূজিত, তালিবান বা ISIS ইত্যাদিরা ইসলামের নামে যথেচ্ছাচার চালাইয়াও জামাতিদের কাছে ইসলামের যথার্থ প্রতিনিধি। আর জামাতিদের এই ধর্মীয় গোঁড়ামি, মৌলবাদ বা লিঙ্গবৈষম্যে মদত দেওয়াকেই বামাতিরা ধর্মনিরপেক্ষতার মডেল সাব্যস্ত করিয়া রাখিয়াছে। মার্কসবাদ ও মৌলবাদের মতো এই মডেলও অপরিবর্তনীয়।

লক্ষনীয় ভারতীয় কমিউনিস্টরা স্বদেশের জাতীয়তাবোধে উগ্রতা বা ফ্যাসিজ়ম খুঁজে পান, কিন্তু ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদে পান না। তাই জিন্নাহ সুরাবর্দি বা ভাসানীর অখণ্ড বাংলার দুরন্ত সাম্প্রদায়িক আবেগে ইঁহারা আজও আপ্লুত। কাস্তে হাতুড়ি ব্যানারটুকু ধরিয়া রাখিয়া চিন পাকিস্তানকে সরাসরি ভারত বিরোধী নাশকতায় মদত দিয়া যাইতেছে। হয়তো, হয়তো কেন নিশ্চিত শুধু সেই কারণেই ভারতীয় কমরেডরা সন্ত্রাসবাদীদের স্বাধীনতা সংগ্রামী সাব্যস্ত করিয়া, এমনকী ভারত বিরোধী স্লোগান দিয়া খোলাখুলি তালিবানদের সমর্থক হইয়া গিয়াছে। ‘তালিবান’ শব্দটিও রূপকার্থে ব্যপ্ত।

তবে আশ্চর্যের ব্যাপার ভারতে নাশকতায় মদত দিলেও চিন যে নিজের দেশে ইসলামিক ধর্মান্ধতা তো বটেই মামুলি ধর্মাচারণ পর্যন্ত বরদাস্ত করে না, তাহার প্রমাণ উইগুর মুসলিম গোষ্ঠীকে কঠোরভাবে দমন হইতে আজান দেওয়া, রাস্তায় নমাজ় পড়া নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি দ্বারা বুঝাইয়া দিয়াছে। বর্তমান রাশিয়াও চেচেন জঙ্গি দমনে ও ইসলামি সন্ত্রাসবাদের প্রশ্নে অনমনীয়। তাহাদেরই অনুসারী হইয়া ভারতীয় কমিউনিস্টদের তাহা হইলে আপনার দেশে এই আত্মঘাতী অবস্থান কেন? এদেশের জামাতিরা জঙ্গি সংগঠনগুলো হইতে অর্থ পায়। তাহা হইলে কি সাদৃশ্য নম্বর দশ – বামাতিরাও তেমন কিছু পাইতেছে ধরিয়া লওয়া যায়?

বৈসাদৃশ্য: 

এতদ সাদৃশ্যের মধ্যে বৈসাদৃশ্য এযাবত একটিই উল্লেখ করিতে পারি। বৃহত্তর জামাতি গোষ্ঠী সামগ্রিকভাবে অদ্যাপি হীনবল হয় নাই, বরং দেশে দেশে আপনাদের অনিয়ন্ত্রিত প্রজনন ও জাতিগত নির্মূলীকরণ কর্মসূচি দ্বারা জ্যামিতিক অনুপাতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রসারণ অব্যাহত রাখিতে সক্ষম হইয়াছে। অন্যদিকে বামাতিরা কিছু জনজাতির বঞ্চনাকে আশ্রয়পূর্বক তাহাদের খেপাইয়া উদ্দেশ্যহীন জঙ্গি সংগঠন ব্যতীত মূল স্রোতের রাজনীতি হইতে প্রায় বিলুপ্ত হইতে বসিয়াছে। কে জানে, হয়তো এই কারণেই আপন আদর্শবিরোধী উগ্র ধর্মীয় মৌলবাদকে ধর্মনিরপেক্ষতার ছত্রছায়ায় প্রতিপালন করিয়া অস্তিত্বরক্ষার মরিয়া প্রচেষ্টা চালাইতে চাহিতেছে।