ভারতীয় নাগরিকত্ব কেবলমাত্র ভারতীয় ধর্মানুগামী  নিপীড়িত জনগণের জন্যই সীমাবদ্ধ থাকুক

0
622

“ইন্ডিয়া, যার অপর নাম ভারত” (“India, that is Bharat”) – যখন সংবিধান প্রণেতারা এই শব্দগুলি ক্রমানুসারে সংবিধানের প্রথম ধারায়  ব্যবহার করেছিলেন, তাঁরা বেশ কিছু বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন।

প্রথমত, ইন্ডিয়া আমাদের দেশ ভারতবর্ষের একটি নতুন নাম। ভারতবর্ষ হচ্ছে আমাদের সহস্রাব্দ প্রাচীন সভ্যতার জন্মভূমি যা মূলত চারটি প্রধান ধর্মের উৎপত্তি স্থল- হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ ও শিখ– যাহা আমাদের প্রাচীন সভ্যতার রীতিনীতি, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি সম্পর্কে অবহিত করেছিল।

দ্বিতীয়ত, ভারতবর্ষ হচ্ছে প্রাচীন সভ্যতার ধারক ও বাহক।

তৃতীয়ত, সংবিধানের ভূমিকায় দেশের একতা ও সংঘবদ্ধতার কথা (“unity and integrity of the Nation”) এমনি-এমনি বলা হয়নি। এই উপমহাদেশে সভ্যতার বিকাশের পর থেকেই স্থান-কাল ছাপিয়ে এক বিধির বাঁধনে বাঁধা পড়েছে এই দেশ – যুগ-যুগ ধরে।

ইন্ডিয়া যে একটি সভ্যতামূলক ধারণা থেকে উদ্ভূত জাতিসত্তা বা রাষ্ট্র (nation) সেই সম্পর্কে তাঁরা যে  জ্ঞাত, তা এইভাবে প্রকাশ করেছিলেন। এছাড়া এটাও বুঝিয়েছিলেন তাদের  সংবিধান প্রণয়নের বহু পূর্বেই ঐক্য ও অখণ্ডতার ধারণা সনাতন হিন্দু ধর্মে উল্লেখিত হয়েছে।

সুতরাং, সংবিধানের নৈতিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে আমাদের প্রাচীন সভ্যতা এবং তার মূল্যবোধকে জাতি ও জনগণের স্বার্থে পুনরায় সংহত করে যথাযথভাবে লালন-পালন করা। কারণ এগুলো অবলুপ্তির অর্থ ভারতবর্ষের বুক থেকে ভারতকেই মুছে দেওয়া যেহেতু কেবল ভৌগোলিক গণ্ডী একটি  রাষ্ট্র তৈরি করতে পারেনা।

হিন্দুরা সারাবিশ্বে প্রায় একশো কোটির  কাছাকাছি হলেও কোনো হিন্দু দেশ নেই।  একমাত্র ভারতবর্ষে হচ্ছে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ (ছোট্ট দেশ নেপাল ব্যতীত) এবং ভারতীয় ধর্মানুসারীদের (বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ছাড়া) একমাত্র স্বদেশভূমি।  বলাবাহুল্য,  ভারতীয় ধর্মানুসারীদের প্রতি ভারতরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা রয়েছে। এটি একটি রূঢ় বাস্তব যে হিন্দুরা (যার মধ্যে বৌদ্ধ, জৈন ও শিখ ধর্মাবলম্বীরা যুক্ত, সংবিধানের ২৫ নং ধারার  ২নং ব্যাখ্যানুসারে) ধর্মীয় নিপীড়ন ভোগ করে থাকে বেশ কিছু দেশে, তারা স্বাভাবিকভাবেই ত্রাণ ও আশ্রয় হিসেবে ভারতের দিকে চেয়ে থাকে যেহেতু তাদের (বৌদ্ধরা ছাড়া) অন্য কোথাও যাওয়ার কোন জায়গা নেই। যারা বহুদিন পূর্বে ভারতে চলে এসেছিল এবং দীর্ঘদিন ধরে ভারতের নাগরিকত্ব পাবার জন্য লড়াই করে যাচ্ছেন তাদের মর্যাদাপূর্ণ জীবনের  অপরিহার্য ব্যবস্থা করা  প্রয়োজন।

ট্রিপস (TRIPS) চুক্তি অনুযায়ী জড় পণ্যের পরিচিতি রক্ষার জন্য সংসদ ভৌগোলিক পণ্যসূচক (নিবন্ধকরণ ও সুরক্ষা) আইন, ১৯৯৯ কার্যকর করেছে। যদি ক্ষণস্থায়ী বস্তুগুলির প্রতি আমরা এত উদ্বিগ্ন হই, তবে ভারতবর্ষে উদ্ভূত ধর্মীয় ঐতিহ্যের ধারক ও বাহক এবং সহস্রাব্দ পুরনো ভারতীয় সভ্যতার বাহক নিপীড়িত মানুষের রক্ষার জন্য আমাদের সমতুল্য উদ্বেগ প্রদর্শন করা কি উচিত নয়? যেহেতু সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত নৈতিকতার ধারণা আমাদের সভ্যতার সম্পর্কিত বিষয়ের উপর নির্ভরশীল, সেখানে ভারতীয় ধর্মানুসারীরা, তাঁরা যেখানেই থাকুন, তাঁদের সুস্থ জীবনের দায়িত্ব শুধুমাত্র সাংবিধানিক দায়িত্ব নয়, সাংবিধানিক নৈতিকতাও বটে ।

বিজেপি তার ২০১৪ সালের নির্বাচনী ইস্তেহারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল “ভারত নিপীড়িত হিন্দুদের জন্য প্রাকৃতিক আবাসস্থল হবে এবং তাদের এখানে আশ্রয় নেওয়ার জন্য স্বাগত জানানো হবে।” তদনুসারে, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল, ২০১৬ ( Citizenship Amendment Bill 2016 বা CAB) সংসদে উপস্থাপন করা হলেও পরে তা বিলম্বিত হয়। আসামে যে চূড়ান্ত এন‌আরসি তালিকা প্রকাশ করা হয় সেখানে নাগরিকত্বের মর্যাদা নিয়ে বেশ কিছু ধোঁয়াশা রয়েছে। তাই নতুন এক Citizenship Amendment Bill বিল গ্রহণ করা আশু প্রয়োজন। এই প্রসঙ্গে বলা যায়,  সর্বপ্রথম  জরুরী বিষয় হলো ২০১৬ সালের ভুলত্রুটিগুলো সঠিকভাবে বোঝা দরকার যাতে ভালোভাবে সেগুলো অতিক্রম করা যায় এবং তার কারণে যেন গৃহীত নতুন আইন মামলা মোকদ্দমায় জড়িত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। দীর্ঘকাল ধরে নির্যাতিত ভারতীয় ধর্মে-বিশ্বাসীরা যাতে অতি দ্রুত নাগরিকত্ব লাভ করতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।

প্রথমতঃ, ২০১৬ সালে প্রথম যে CAB হয়েছিল তা কেবলমাত্র তিনটি দেশ আফগানিস্তান, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ধর্মীয় নিপীড়নের মোকাবিলা করেছে। এটা কখনোই বলা যায় না, ভারতীয় ধর্মানুসারীদের ওপর নিপীড়ন কেবলমাত্র এই দেশগুলোতেই হয় এবং এখানেই সীমাবদ্ধ থাকবে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, আমেরিকার হিন্দু সংস্থার রিপোর্টে বলা হয়েছে ,”আমেরিকার হিন্দু শিক্ষার্থীরা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে সামাজিকভাবে একঘরে বোধ করে এবং তারা ক্রমাগত শ্লেষ ও বিদ্বেষের শিকার হয়।” সুতরাং,  সব দেশের বর্তমান এবং তার পাশাপাশি ভবিষ্যতে সম্ভাব্য ঘটনাবলী মাথায় রেখে আইনটি কার্যকর করা উচিত ।

দ্বিতীয়ত, ২০১৬ সালের CAB তে এই তিনটি দেশের  সকল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে  অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যা পুরোপুরি নিরর্থক। কারণ ভারতীয় ধর্মে অবিশ্বাসীদের প্রতি ভারতরাষ্ট্রের কোনো সভ্যতাসূচক দায়দায়িত্ব নেই। আমরা ইহুদী ও জরাথ্রুস্টিয়ান (পার্সি) দের মতো অন্যদের কাছে মহানুভবতা প্রকাশ করেছি। তাঁরা ধর্মের কারণে নিপীড়িত হয়েছিলেন এবং অন্যত্র  চলে যাওয়ার মতো তাঁদের কোন বাসস্থান অবশিষ্ট ছিল না, আমরা তাঁদের আশ্রয় দিয়েছি। কিন্তু এই ঘটনা নিপীড়িত খ্রিস্টান ও মুসলমানদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় কারণ তারা যেকোন খ্রিস্টান বা খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং ইসলামিক দেশগুলিতে যথাক্রমে আশ্রয় নিতে পারে এবং নাগরিকত্ব লাভ করতে পারে। এই প্রসঙ্গ ইহুদীদের কথা বলা যায় যাদের বর্তমানে বসবাসের জন্য নিজস্ব দেশ রয়েছে-  ইসরায়েল। তদুপরি, অত্যাধিক জনবহুল দেশের জন্য আমরা অপ্রয়োজনীয় বোঝা বইতে পারি না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ২০১৯ সালের স্বাধীনতা দিবসের দিন জনবিস্ফোরণের  বিষয়টি যথাযথভাবে উপস্থাপনা করেছিলেন। নাগরিকত্ব কেবলমাত্র অত্যাচারিত ভারতীয় ধর্মানুগামী এবং জরাথ্রুস্টিয়ান  পার্সিদের  মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা বিচক্ষণতার পরিচায়ক।

তৃতীয়ত, বিশেষজ্ঞরা ২০১৬ সালের ক্যাবের সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। সুতরাং,  একটি বিল আইনে  রূপান্তরিত হয়ে গেলেও আদালতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে, যা  দীর্ঘদিনের অত্যাচারিত হিন্দুদের পক্ষে খুবই কম সহায়ক হবে। সুতরাং, নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের আগে সংবিধানের সংশোধন ভীষণ আবশ্যক।

চতুর্থত, যেহেতু ধর্মীয় নিপীড়ন নাগরিকত্ব প্রদানের ভিত্তি, তাই তাঁরা পরবর্তীতে যদি অভারতীয় কোন ধর্মে  ধর্মান্তরিত হয়ে যান, তবে তাঁরা সেই ভিত্তিকেই প্রত্যাখ্যান করবেন। সেক্ষেত্রে ভারতে এসে ধর্মান্তরিত হওয়ার পরিবর্তে তাঁদের নিজের দেশেই ধর্মান্তরিত হয়ে থেকে যাওয়া উচিৎ।  সর্বোপরি নিজের ধর্ম পরিচয় জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্ব অর্জন করা এবং তারপর আসল পরিচয় প্রকাশ করাএমন কিছু কঠিন কাজ নয়। অতএব কঠোর সুরক্ষা ব্যতীত একটি জনসংখ্যাতাত্ত্বিক আগ্রাসনের আইনি পথ তৈরী হয়ে যাবে। তাই ২০১৬ সালের CAB বিলের সংশোধন আবশ্যক।

এই কারণগুলো মাথায় রেখে সংবিধানে একটি নতুন ধারা ১১এ অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। কী করবে এই ধারা? এতে সংসদ ভারতের নাগরিকত্ব আইনে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে পারবে যাতে পৃথিবীর যেকোনো দেশে নির্যাতিত ও নিপীড়িত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ এবং পার্সিরা ভারতের নাগরিকত্ব পেতে পারে। তবে হ্যাঁ, এই ধারা প্রবর্তনের সময় এমন ব্যবস্থাও থাকবে যাতে এই ধারার কোনো অপব্যবহার না হয়। যদি কেউ এই ধারার অপব্যবহার করেন তাহলে যে রাষ্ট্র থেকে তিনি এসেছিলেন সেখানেই ফিরিয়ে দেওয়া হবে, এবং ‘শত্রু সম্পত্তি আইন’ অনুযায়ী এ-দেশে তাঁর যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত হবে।

এম নাগেশ্বর রাওয়ের লেখা মূল প্রবন্ধটি টাইমস অফ ইণ্ডিয়ায় প্রকাশিত। লেখক বরিষ্ঠ আই পি এস অফিসার। অভিমত ব্যক্তিগত। বাংলায় অনুবাদ করেছেন দীপান্বিতা।