হে প্রিয় বাঙালীরা, নির্ভয়ে বলো, “পুত্রান্ দেহি”

0
6592

কোলকাতার দ্য টেলিগ্রাফ হিন্দুদের মাঝে প্রচার অভিযান চালাচ্ছে যে দুর্গাপূজার অষ্টমীর পুষ্পাঞ্জলির সময় পুত্রান্ দেহি শব্দটি বদলে ফেলা হোক। এই  কথাটি নাকি নারীপুরুষ বৈষম্যের দ্যোতক। তাই মন্ত্রের এই কথাকটি তাঁরা সন্তানান্ দেহি করতে চান যাতে মানুষ কেবল পুত্র নয় পুত্রীর কামনাও করতে পারে। এই প্রবন্ধে আমরা দেখব, এই পরিবর্তন কামনা কেবল অপ্রয়োজনীয়ই নয়, ভ্রান্তিপূর্ণও বটে।

পুত্রান্ দেহি” মানেই আমাদের  পুত্রপুত্রী দাও।

পুত্রান্ দেহি” কথাটির দুটো অর্থ হয়।

  • আমাদের বহু পুত্র দাও।
  • আমাদের বহু পুত্রী ও পুত্র দাও।

বিষয়টি অবধান করতে সংস্কৃত ব্যাকরণের “একশেষ”  সূত্র বুঝতে হবে। পুংলিঙ্গের দ্বিবচনে এক স্ত্রী এবং এক পুরুষকেও বোঝায়। সেরকম পুংলিঙ্গের বহুবচনে বহু স্ত্রী এবং বহু পুরুষও বোঝায়।

প্রথমতঃ, পুংলিঙ্গের দ্বিবচনের উদাহরণ নেওয়া যাক। এক সুবিখ্যাত উদাহরণ হচ্ছে “হংসৌ” যার মানে দুইটি পুং হংস হতে পারে বা একটি হংস এবং একটি হংসী একত্রেও হতে পারে। অষ্টাধ্যায়ী ১.২.৬৭ এর টীকা করতে গিয়ে সিদ্ধান্তকৌমুদী বলে,

“হংসী চ হংসশ্চ হংসৌ” ( একটি হংসী এবং একটি হংস –  হংসৌ)। এইরকম আর একটি উদাহরণ হচ্ছে পুত্রৌ যার মানে হতে পারে দুই পুত্র বা একটি কন্যা এবং একটি পুত্র।

অষ্টাধ্যায়ী ১.২.৬৮ এর টীকা করতে গিয়ে সিদ্ধান্তকৌমুদী বলে,

“পুত্রশ্চ দুহিতা চ পুত্রৌ” (পুত্র এবং দুহিতা –  পুত্রৌ)।

এর প্রমাণ মেলে প্রাচীন সংস্কৃত শব্দকোষ অমরকোষে। অমরকোষের ২.৬.৩৭ বলে,

“পুত্রৌ পুত্রশ্চ দুহিতা চ” অর্থাৎ পুত্রৌ মানে একটি পুত্র এবং একটি কন্যা।

আরেকটি বিখ্যাত উদাহরণ হল, “পিতরৌ”। এর মানে দুই পিতা হয় বা  দুই পূর্বপুরুষ হয় অথবা মাতাপিতাও হয়।

আরেকটি উদাহরণ। রঘুবংশের প্রথম শ্লোকে কবিবর কালিদাস ব্যবহার করেছেন পিতরৌ:

“জগতঃ পিতরৌ বন্দে পার্বতী-পরমেশ্বরৌ।”

“জগতের মাতাপিতা পার্বতী এবং শিবকে আমি বন্দনা করি।”

এবার আসা যাক মিশ্রলিঙ্গাত্মক পুংলিঙ্গের বহুবচনের উদাহরণগুলিতে। যেমন হংসাঃ মানে বহু হংস এবং বহু হংসহংসী উভয়ই হতে পারে। তেমনি পুত্রাঃ মানে বহু পুত্র এবং বহু পুত্রপুত্রী উভয়ই হতে পারে।

উদাহরণস্বরূপ আসা যাক আবার সেই কবিবর কালিদাসের কুমারসম্ভব কাব্যের (১.২৭) ‘পুত্রবতঃ’ শব্দটিতে।   এর টীকায় মল্লিনাথ লিখছেন, “পুত্রাশ্চ দুহিতরশ্চ পুত্রাঃ … তেঽস্য সন্তীতি পুত্রবান্…তস্য পুত্রবতঃ”, অর্থাৎ “পুত্ররা এবং দুহিতারা – পুত্রাঃ….যাঁর পুত্রাঃ আছে তিনি পুত্রবান্….পুত্রবতঃ বোঝায় তাঁর সম্বন্ধীয় বোঝাতে।”

মল্লিনাথ কেবল বলছেন না যে পুত্রাঃ মানে পুত্রপুত্রীরা বোঝায়, উপরন্তু বলছেন পুত্রবান্ মানে বহু পুত্রপুত্রীর পিতাকে বোঝায়। পুত্রবানেরই ষষ্ঠী বিভক্তির একবচনে আসে পুত্রবতঃ।

যেরকম প্রথমা বিভক্তির বহুবচনের “পুত্রাঃ” বলতে বহু পুত্র এবং বহু পুত্রপুত্রী বোঝায়, তেমনি এই শব্দটির দ্বিতীয় বিভক্তির বহুবচনের  “পুত্রান্” বলতে “পুত্রদেরকে” এবং “পুত্রপুত্রীদেরকে”ও বোঝায়।

কাজেই “পুত্রান্ দেহি” বলতে “পুত্রপুত্রী দাও” বোঝায়। দ্য টেলিগ্রাফের প্রচার অভিযানের কথায় মজে মন্ত্র পরিবর্তনের কোন প্রয়োজন নেই। পুত্রান্ শব্দটির দ্বিতীয় অর্থটিই গ্রহণ করলেই চলবে।

শেষ কথা। “সন্তানান্ দেহি” অসার্থক। কারণ মন্ত্রের অনুষ্টুপ ছন্দকে তা ব্যাহত করছে। মূল শ্লোকের “পুত্রান্ দেহি ধনম্ দেহি”  (যাজ্ঞবল্ক্য  স্মৃতি,  ১.২৯১) এই পাদটিতে আটটি অক্ষর (syllable) আছে যেমনটি অনুষ্টুপ ছন্দে থাকে। “সন্তানান্ দেহি” করলে নয়টি অক্ষর হয়। কাজেই অনুষ্টুপ ছন্দ আর বজায় থাকে না।

 

নিত্যানন্দ মিশ্রের মূল প্রবন্ধটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত। লেখক ইনভেষ্টমেণ্ট ব্যাঙ্কার এবং বহু গ্রন্থের রচয়িতা। অনুবাদক বৈষ্ণবাচারী।