বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ ও বিজয়:

৯ই ডিসেম্বর এক বার্তায় গভর্নর মালিক পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতিকে বাইরের সাহায্য না পেলে যুদ্ধে জেতার সম্ভাবনা প্রায় নেই বলে জানান ও রাজনৈতিক সমাধানের পথ খুঁজতে বলেন। ১০ই ডিসেম্বর গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি ও মুখ্য সচিব পশ্চিম পাকিস্তানি অফিসার মুজাফ্‌ফর হোসেন ক্যান্টনমেন্টে জেনারেল নিয়াজ়ির সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেন এবং ঢাকায় জাতিসংঘের প্রতিনিধি পল মার্ক হেনরির কাছে ‘আত্মসমর্পণের’ আবেদনও হস্তান্তরিত হয়। তবে তাতে কৌশলে ‘আত্মসমর্পণ’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘অস্ত্রসংবরণ’ কথাটি ব্যবহার করা হয়। পরাজয় নিশ্চিত জেনে উদারতার ভানও ছিল এই আবেদনে – “যেহেতু সংকটের উদ্ভব হয়েছে রাজনৈতিক কারণে, তাই রাজনৈতিক সমাধান দ্বারা এর নিরসন হতে হবে। আমি তাই পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতির দ্বারা অধিকারপ্রাপ্ত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ঢাকায় সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাই। আমি শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যবস্থা নেয়ার জন্য জাতিসংঘকে আহ্বান জানাই।’ পাকিস্তানি মহলে বার্তাটি “মালিক-ফরমান আলি” বার্তা হিসেবে পরিচিত। পরদিন তা আবার প্রত্যাহারও করে নেওয়া হয়।

মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যরা ঢাকা ঘেরাও করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার জন্যে আহবান করে। মিত্রবাহিনী কর্তৃক গভর্নর হাউজে (বর্তমান বঙ্গভবন) বোমাবর্ষণের কারণে গভর্নর মালিকের নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের পুতুল সরকারও ইতোমধ্যে পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান হোটেল শেরাটন) আশ্রয় নেয়। সময় থাকতে শান্তিপূর্ণভাবে আত্মসমর্পণের আহবান জানিয়ে আকাশ থেকে অনবরত প্রচারপত্র ফেলা হতে থাকে।

উপায়ান্তর না দেখে নিয়াজি আবেদন করায় ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সকাল সাড়ে নয়টা পর্যন্ত ভারতীয় বিমান হানা স্থগিত রাখা হয়। পরদিন সকালে বিমান আক্রমণবিরতির সময়সীমা পেরোনোর কিছু আগে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি জাতিসংঘের প্রতিনিধি জন কেলির মাধ্যমে ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষকে অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির সময়সীমা আরও ছয় ঘণ্টার জন্য বাড়িয়ে অস্ত্রসমর্পণের ব্যবস্থার অনুরোধ করেন। এই বার্তা পাঠানোর কিছু আগেই অবশ্য ভারতীয় মেজর জেনারেল নাগরা তাঁর ও কাদের সিদ্দিকীর মিলিশিয়া বাহিনীকে সঙ্গে করে মিরপুর সেতুতে হাজির হন এবং নিয়াজ়িকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। নিয়াজ়ি রাজি হওয়ার পর সকাল ১০:৪০ মিনিটে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে নাগরার বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে। পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের দলিল এবং সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি চূড়ান্ত করার জন্য ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের চীফ অব স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকব মধ্যাহ্নে ঢাকায় এসে পৌঁছান। বিকেল চারটার আগেই বাংলাদেশ নিয়মিত বাহিনীর দুটি ইউনিটসহ মোট চার ব্যাটালিয়ন সৈন্য ঢাকায় প্রবেশ করে। সঙ্গে কয়েক সহস্র মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকার জনবিরল পথঘাট ক্রমে জনাকীর্ণ হয়ে উঠতে শুরু করে ‘জয় বাংলা’ মুখরিত মানুষের ভিড়ে। বিকেল চারটায় ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান ও ভারত-বাংলাদেশ যুগ্ম-কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, বাংলাদেশের ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন আব্দুল করিম খোন্দকার এবং ভারতের অপরাপর সশস্ত্রবাহিনীর প্রতিনিধিগণ ঢাকায় অবতরণ করেন।
মুক্তিবাহিনী এপ্রিল মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত টানা ন’ মাস লড়েও পাকিস্তানি তাণ্ডব বিন্দুমাত্র কমাতে পারেনি। কিন্তু ভারতীয় সামরিক শক্তি ময়দানে নামার ১৩ দিনের মাথায় ১৬ ডিসেম্বর বিকেলে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বাংলাদেশে দায়িত্বপ্রাপ্ত পাকিস্তানি ইস্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজ়ি হাজার হাজার উৎফুল্ল জনতার ভিড়ে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনীর পূর্ব রণাঙ্গনের প্রধান অধিকর্তা লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন। প্রায় ৯৩,০০০ পাকিস্তানি সৈন্য আত্মসমর্পণ করে, যা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সর্ববৃহৎ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। বাংলাদেশের মানুষের বহু আকাঙ্ক্ষিত বিজয় ধরা দেয় যুদ্ধ শুরুর নয় মাস পর। তবে ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করলেও সারা দেশে বাকি পাকিস্তানি সৈন্যকে অস্ত্রত্যাগ করাতে ২২ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। পাকিস্তানি বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের দিনই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণতম প্রান্তে প্রবেশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ ততদিনে পাকিস্তানের দখল থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত। নয় মাস ব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের অবসান ঘটে প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালী জাতির প্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’।

কিন্তু যে সেনানায়ক পূর্ব পাকিস্তানে দেশোদ্রোহী দমনের নামে অধীনস্থ সেনাদের নারী ধর্ষণ ও হাড় হিম করা খুনে প্ররোচনা দিতেন, তাঁর কেন শাস্তি হল না সেটা মস্ত বড়ো প্রশ্ন। আরও বড়ো প্রশ্নচিহ্নের সামনে খাড়া হতে হয় আত্মসমর্পণ পর্ব শুরু হতেই ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর পূর্ব ও পশ্চিম উভয় রণাঙ্গনে ভারতের পক্ষ থেকে এককভাবে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা কেন করলেন। বাংলাদেশের তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আবু সৈয়দ নজরুল ইসলামের ১৬ই ডিসেম্বরের চিঠিতে লেখা একতরফা যুদ্ধবিরতি না করার পরামর্শ না হয় যথাসময়ে শ্রীমতী গান্ধীর হাতে পৌছায়নি, কিন্তু দেশভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ভূত ও বর্তমান থেকে কি তিনি ভবিষ্যতের জন্য কোনও অশনিসংকেত পাননি? এর মূল্য এককভাবে ভারতকেই দিতে হয়েছে এবং আজও হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক কূটনীতি

ভারত প্রথমে মুক্তিবাহিনীকে সমর্থন জানায়। পরে মানবাতার খাতিরে প্রস্তাবিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রে প্রবেশাধিকার চায়। কিন্তু জাতিসঙ্ঘ সেই আবেদন নাকচ করে দিলে নিজের নিরাপত্তার খাতিরে সামরিক হস্তক্ষেপের অনুমতি চায়[10][11]। সেই সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সারা বিশ্বে ছুটে বেড়িয়ে মানবাধিকার রক্ষার জন বিশ্বজনমত গড়ে তোলেন[12]। পাকিস্তানি সরকারের অবদমন সত্ত্বেও খবর বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদ ধ্বনিত হতে থাকে। কিন্তু রাষ্ট্রসঙ্ঘের ওপর আমরিকার অন্যায় কর্তৃত্বের জন্য ২৫ মার্চ থেকে ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত হত্যালীলা অব্যাহত থাকে।
৪ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রতিনিধি হেনরি কিসিঞ্জার রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের (UN Security Council) অধিবেশনে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পেশের প্রস্তুতি নেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর এক বিবৃতিতে উপমহাদেশের সংঘাতের জন্য মুখ্যত ভারতকে দায়ী করে। অধিবেশন শুরু হবার পর মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, ভারত ও পাকিস্তানকে সেনা প্রত্যহার এবং সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘ মহাসচিবকে ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব রাখেন। সোভিয়েত প্রতিনিধি এই প্রস্তাবকে ‘একতরফা’ বলে অভিহিত করে ভেটো প্রয়োগ করেন। পোল্যান্ডও প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয়। ফ্রান্স ও ব্রিটেন ভোট দানে বিরত থাকে। পরের দিন ৫ ডিসেম্বরে পুনরায় অধিবেশন বসলে তাতে সোভিয়েত ইউনিয়ন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হিংসা অবিলম্বে বন্ধ করে সংঘর্ষের নিশ্চিত অবসানের জন্য ‘রাজনৈতিক নিষ্পত্তি’র প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে। একমাত্র পোল্যান্ড প্রস্তাবটি সমর্থন করে। চীন ভোট দেয় বিপক্ষে। অন্য সদস্যরা ভোটদানে বিরত থাকে। ঐ দিন আরও আটটি দেশের পক্ষ থেকেও যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে যে আর একটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, সেটিও ভারতের অনুকূলে ছিল না। এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন দ্বিতীয়বার ভেটো প্রয়োগ করে এবং ‘পূর্ব বাংলার জনগণের আইনসঙ্গত অধিকার ও স্বার্থের স্বীকৃতির ভিত্তিতে’ সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের পুনরায় দাবি জানায়। এই সংঘর্ষ সোভিয়েত সীমান্তের নিকটবর্তী হওয়ায় সোভিয়েত নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত বলে উল্লেখ করে এবং পরিস্থিতির অবনতি রুখতে বিবদমান দেশদুটির কারও হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার জন্য বিশ্বের সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানায়। রাষ্ট্রসঙ্ঘে ভারত কার্যত রাশিয়া ও পোল্যান্ড ছাড়া আর কোনও দেশকে পাশে পায়নি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি নিক্সন নয় মাস ধরে চলা বিভীষিকাকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে দায় এড়িয়ে গিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের পরাজয় সমাগত দেখে তৎক্ষণাৎ যুদ্ধবিমানবাহী জাহাজ (USS Enterprise) বঙ্গপোসাগারের দিকে রওনা করিয়ে দেন। ৬ ও ১৩ ডিসেম্বর সোভিয়েত নৌবাহিনীও ( Soviet Navy) পরমাণু ক্ষেপণাস্ত্র সমন্বিত দুটি নৌবহর ভ্লাডিভস্টক বন্দর থেকে রওনা করিয়ে দেয়। ১৮ই ডিসেম্বর থেকে ৭ই জানুয়ারি টানা তিন সম্তাহ মার্কিন Task Force 74-এর জাহাজকে ভারত মহাসাগরে আটকে রাখে।

নিক্সন শুধু নিজে পাকিস্তানের পৈশাচিকতাকে সমর্থন দেননি, চিনকেও ভারত আক্রমণে প্ররোচনা দিয়েছিলেন। কিন্তু চিন সেই প্ররোচনায় পা দেয়নি, কারণ ১৯৬২-র ইন্দো-চিন যুদ্ধে (1962 Sino-Indian War) চিন ভারতকে অতর্কিতে আক্রমণ করেও সম্পূর্ণ পর্যদস্ত করতে পারেনি, আর ১৯৭১-এ তো সোভিয়েত রাশিয়াকে পাশে পেয়ে ভারত পুরোদস্তুর সমর প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। তাই পাকিস্তানের পুরোনো বন্ধু চিন কৌশলগত কারণে যুদ্ধবিরতির জন্যে জন্য চাপ দেয়।

পাকিস্তানের হার যখন সুনিশ্চিত তখন ১২ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও বিদেশমন্ত্রী (Deputy Prime Minister and Foreign Minister) জ়ুলফিকার আলি ভুট্টো নিউইয়র্ক ছুটে যান জাতিসঙ্ঘে যুদ্ধাবসানের জন্য তদ্বির করতে। চারদিন ধরে আলোচনার পর যখন পাকিস্তানকে সামরিক সাহায্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, ততদিনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনার কাছে আত্মসমর্পণ করে ফেলেছে। ১৬ই ডিসেম্বর বঙ্গপোসাগরে মার্কিন যুদ্ধ-জাহাজ প্রবেশ করলেও যুদ্ধের মোড় ঘোরানোর উপায় ছিল না। হতাশায় ভুট্টো জাতিসঙ্ঘে নিজের বক্তৃতা অসমাপ্ত রেখেই সভা ত্যাগ করেন। যুদ্ধ শেষ হল ঠিকই, কিন্তু শ্রীমতী গান্ধীর আবেদনে সাড়া দিয়ে জাতিসঙ্ঘ আরও আগে হস্তক্ষেপ করলে নয় মাস ব্যাপী নৃশংস গণধর্ষণ ও গণহত্যা আটকানো যেত।

আর ভারত তো শরণার্থীদের আশ্রয় দান, প্রবাসী সরকার গঠনে সহায়তা থেকে মুক্তিবাহিনীর সংগঠন, প্রশিক্ষণ ও সমরাস্ত্র সরবরাহে বরাবর ছিল প্রত্যক্ষ সহায়ক ও দুর্ভোগের ভাগীদার। ১৯৭১-এর শেষভাগে সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন নিশ্চিত হওয়ার পর ভারত সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করে যার ফলে এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয় নি। সোভিয়েত দেশ নিজের ভেটো প্রয়োগ করে ও নৌবহর নিয়ে ভারত ও বাংলাদেশের পাশে না দাঁড়ালে পরিণাম কী হোত বলা মুশকিল। বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতেরও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন হোত কিনা সেই আশঙ্কাও অমূলক মনে হয় না। বিশ্বজনমত এই পৈশাচিক ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের বিপক্ষে থাকলেও আমেরিকার চাপে রাষ্ট্রসঙ্ঘ যে নিস্পৃহতা দেখায়, তা নিন্দার ভাষা নেই।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি

৪ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির জন্য অনুরোধ জানিয়ে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজ়রুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ যুগ্মভাবে ইন্দিরা গান্ধীকে একটি চিঠি পাঠান। প্রত্যুত্তরে শ্রীমতী গান্ধী লেখেন (বঙ্গানুবাদ): “সত্যের জয় হোক। প্রধানমন্ত্রী নয়াদিল্লি ডিসেম্বর ৬, ১৯৭১ প্রিয় প্রধানমন্ত্রী, মহামান্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আপনি ৪ঠা ডিসেম্বর আমাকে যে বার্তা পাঠিয়েছেন তাতে আমি ও আমার ভারত সরকারি সহকর্মীবৃন্দ গভীরভাবে অভিভূত হয়েছি। এই পত্র পাওয়ার পর আপনার বিচক্ষণ নেতৃত্বে পরিচালিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের অনুরোধ ভারত সরকার পুনরায় বিবেচনা করেছে। আমি সানন্দে জানাই যে, বর্তমানে বিরাজিত পরিস্থিতির আলোকে ভারত সরকার স্বীকৃতি অনুমোদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমি একটি অনুলিপি সংযুক্ত করছি। আপনার বিশ্বস্ত ইন্দিরা গান্ধী।”

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ দক্ষিণ এশিয়ার দুই দেশ ভারত ও ভুটান এদিন আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। তবে ভারতের কয়েক ঘণ্টা আগেই এই মর্মে ভুটানের পক্ষ থেকে তারবার্তার পৌঁছায়। ৬ই ডিসেম্বরে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে সার্বভৌম দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দেওয়ার পর বেলা এগারোটার সময় সেই বার্তা ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ মারফত ঘোষিত হয়। সংসদের বিশেষ অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রস্তাবে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, “বাংলাদেশের সব মানুষের ঐক্যবদ্ধ বিদ্রোহ এবং সেই সংগ্রামের সাফল্য এটা ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট করে তুলেছে যে তথাকথিত মাতৃরাষ্ট্র পাকিস্তান বাংলাদেশের মানুষকে স্বীয় নিয়ন্ত্রণে ফিরিয়ে আনতে সম্পূর্ণ অসমর্থ। বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা সম্পর্কে বলা যায়, গোটা বিশ্ব এখন সচেতন যে তারা জনগণের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটায়, জনগণকে প্রতিনিধিত্বকারী অনেক সরকারই যেমনটা দাবি করতে পারবে না। গভর্নর মরিসের প্রতি জেফারসনের বহু খ্যাত উক্তি অনুসারে বাংলাদেশের সরকার সমর্থিত হচ্ছে ‘পরিপূর্ণভাবে প্রকাশিত জাতির আকাঙ্ক্ষা বা উইল অব দ্য নেশন’ দ্বারা। এই বিচারে পাকিস্তানের সামরিক সরকার, যাদের তোষণ করতে অনেক দেশই বিশেষ উদগ্রীব, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণেরও প্রতিনিধিত্ব করে না।”

পাকিস্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু চিন ১৯৭২-এ বাংলাদেশ জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদের জন্য আবেদন করলে ভেটো দিয়ে তা খারিজ করে দেয়। ১০৭৫ সালের ৩১ আগস্টের আগে পর্যন্ত তারা বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম সত্তা মেনে নেয়নি।

চলবে