বাঙালীর খণ্ডিত জাতীয়তা: দেশভাগ ও প্রাদেশিক পেক্ষাপট

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

দ্বাদশ পর্বের পর

যুক্তফ্রন্ট (১৯৫৪) গঠন:

এরপর দ্রুত পালা বদলের বছর ১৯৫৪। ভাষা-রাজনীতিগত অস্থিরতায় প্রাদেশিক নির্বাচনের পরিস্থিতি তৈরি হল। এ কে ফজ়লুল হকের নেতৃত্বে গঠিত হল যুক্তফ্রন্ট। এই যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগের জোট তুলে নেয় পরবর্তী পর্যায়ে ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের ভার তথা ক্ষমতা। শুধু ভাষা নয়, এই জোটের দাবি ছিল বৃহত্তর প্রাদেশিক স্বায়ত্ত্বশাসন, যে প্রস্তাবকে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ তীব্র নিন্দা জানায়। নির্বাচনকে সামনে রেখে যুক্তফ্রন্ট যাতে আন্দোলনের আর কোনও সুযোগ না পায়, সেজন্য মুসলিম লীগের প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে। তাই ২১ ফেব্রুয়ারির শহীদ দিবসের আগে যুক্তফ্রন্টের একাধিক নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার হয়।
অন্যদিকে ভাষা সংক্রান্ত অচলাবস্থা কাটাতে করাচিতে মুসলিম লীগের সংসদীয় কমিটির একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বোগুড়ার সভাপতিত্বে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বাংলাভাষাকে উর্দুর সমমর্যাদা দিয়ে যুগ্ম রাষ্ট্রভাষা করা হবে। ১৯৫৪ সালের ৭ মে বাংলাকে একটি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হয় মুসলিম লীগ। এই সিদ্ধান্তের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের ছয়টি ভাষাকে একই মর্যাদা দেওয়ার দাবি ওঠে। আবদুল হক (“বাবা উর্দু” নামে পরিচিত) এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান। তাঁর নেতৃত্বে ২২ এপ্রিল করাচিতে এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিল আয়োজিত হয়। প্রায় ১ লক্ষ মানুষ মিছিলে অংশ নিয়ে মুসলিম লীগের এই সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে। অশান্তির জেরে সেখানে সিন্ধি ভাষায় প্রকাশিত দৈনিক ‘আল ওয়াহিদ’ পত্রিকার অফিস ভস্মীভূত হয়। অন্যদিকে ২৭ এপ্রিল বাংলার পাশাপাশি অন্যান্য ভাষাকে সমমর্যাদা দেওয়ার দাবিতে সমাবেশ হয়। এই উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়। গণপরিষদ (constituent assembly) নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট এবার সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। সঙ্গে ছিল আওয়ামি লীগ। মুসলিম লীগ পরিত্যক্ত হুসেন শাহ সোহ্‌রাবর্দি তখন আওয়ামি লীগের নেতা। মুসলিম লীগ তার নগণ্য আসন নিয়ে উড়ে যায়, আর প্রধানমন্ত্রীর মসনদে বসেন কলকাতা বাঙালী গণহত্যার নায়ক সোহরাবর্দি।

যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এসেই বাংলা একাডেমী গঠন করে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলা ভাষা সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সংরক্ষণ গবেষণা ও মান উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করবে বলে গঠনতন্ত্রে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় আসার কিছুদিনের মধ্যেই পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মালিক গোলাম মাহমুদ ১৯৫৪ সালের ৩০ মে তারিখে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকার বাতিল ঘোষণা করে দেন। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন যুক্তফ্রন্ট পুণরায় সরকার গড়লেও আওয়ামী লীগ মন্ত্রীপরিষদে যোগ দেয় না। ১৯৫৫ সালেই প্রধানমন্ত্রীর আলি বোগুড়ার উদ্যোগে ‘পূর্ববঙ্গ’-এর নতুন নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান’। সম্ভবত, ভাষার সংঘাতে হেরে গিয়েই উর্দুপন্থীরা নামকরণের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অঙ্গরাজ্য হিসাবে শিলমোহর মারার প্রয়োজন অনুভব করেছিল। ইতিমধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের ‘ডোমিনিয়ন’ থেকে প্রজাতন্ত্র বা ‘রিপাবলিক’ হিসাবে পাকিস্তান আত্মপ্রকাশ করেছে।
১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন মদতে ২১ ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। শহীদ মিনার নতুনভাবে তৈরি করার লক্ষে সরকারের পক্ষ থেকে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পুলিশের গুলিতে নিহত ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে পাকিস্তানের গণপরিষদের কার্যক্রম পাঁচ মিনিট বন্ধ রাখা হয়। সারাদেশব্যাপী পালিত শহীদ দিবসে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই বন্ধ ছিল। আরমানীটোলায় এক বিশাল সমাবেশের নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানীর। ২৯ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাকে স্বীকৃতি দিয়ে সংবিধান সংশোধন করা হয়। সংবিধানের ২১৪.(১) ধারায় উল্লিখিত হল – “ The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali.”

যুক্তফ্রন্টের শাসনেও প্রাদেশিক অস্থিরতার জেরে ১৯৫৮-য় সেনাপ্রধান আয়ুব খানের সামরিক আভ্যুত্থান হয়। যদিও ১৯৫৬ সালের পর সরকারি ভাষার বিতর্ক সম্পন্ন হয়, কিন্তু আইয়ুব খানের সামরিক শাসন পাকিস্তানের পাঞ্জাবি ও পশতুনদের দেনাগুলো বাঙালীদের ওপর জোর করে চাপিয়ে দেয়। জনসংখ্যায় বাঙালীরা বেশি হলেও সামরিক, বেসামরিক সরকারি ও রাজস্ব বিভাগে বাঙালীদের উপস্থিতি খুব কম। বাঙালীদের জন্য সরকারি সাহায্যের বরাদ্দও ছিল নগণ্য। আয়ুব খান পুনরায় উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেন। তবে প্রবল প্রতিবাদের মুখে ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি সামরিক শাসকগোষ্ঠী এক সরকারি বিবৃতি জারি করে এবং ১৯৫৬ সালের সংবিধানে উল্লেখিত দুই রাষ্ট্র ভাষার উপর সরকারি অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করতে বাধ্য হয়। কিন্তু জাতিগত বৈষম্যের অবসান হয় না, বরং পশ্চিম পাকিস্তানিদের আক্রোশ বেড়ে যায়।

ওদিকে ভাষা আন্দোলনের পর ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ’ও বাঙালী জাতীয়তাবাদকেই দলীয় কার্যক্রমের ভিত্তি করে দলের নাম থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে দেয়। পাঞ্জাবি পাকিস্তানিদের লাগাতার বিদ্বেষমূলক আচরণের ফলে বাঙালী পাকিস্তানিদের যে ক্ষোভ জমতে থাকে, তারই প্রভাবে আঞ্চলিক স্বার্থসংরক্ষণকারী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাঙালী জাতীয়তাবাদী দল আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের সমর্থন নিরঙ্কুশভাবে বাড়তে থাকে। এরই ফলশ্রুতিতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ভাষা আন্দোলনের পর আরও বড় অধিকার আদায় ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনই পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের রূপ ধারণ করে।

চলবে