‘একুশে’র মিথ, ‘জয় বাংলা’র মিথ্যা – ৮

‘মুসলমান বাঙালিত্ব’-র নির্মাণকল্পে বিকৃত ইতিহাস, বিক্ষত ভাষা

0
5580

পর্ব ৮ – ‘মুসলমান বাঙালিত্ব’র নির্মাণকল্পে বিকৃত ইতিহাস, বিক্ষত ভাষা

(সপ্তম পর্বের পর)

পাকিস্তান আন্দোলনের বহু পূর্বে, উনিশ শতকের শেষ পাদ থেকেই বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে নিজেদের জাতিসত্তা বা আইডেন্টিটির প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দেয়, যার কেন্দ্রে ছিল তাঁদের ধর্মীয় সত্তা।[1] এর মধ্যে অস্বাভাবিকতা বা তথাকথিত নিন্দনীয় সাম্প্র্যদায়িকতার কিছু নেই; ভাষা দিয়ে হয় জাতির পরিচয়, এ বাঙ্গালীর ভ্রম। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

ভাষার ঐক্যে ন্যাশনাল ঐক্যবন্ধনের সহায়তা করে, সন্দেহ নাই; কিন্তু তাহাতে এক করিবেই, এমন কোনো জবরদস্তি নাই। য়ুনাইটেড স্টেটুস ও ইংলণ্ডের ভাষা এক, স্পেন ও ম্পানীয় আমেরিকার ভাষা এক, কিন্তু তাহারা এক নেশন নহে। […]

তাহা ছাড়া, ভাষায় জাতির পরিচয় পাওয়া যায়, কথাও ঠিক নয়। প্রুসিয়া আজ জর্মান বলে, কয়েক শতাব্দী পূর্বে স্লাভোনিক বলিত, ওয়েল্‌স্‌ ইংরেজি ব্যবহার করে, ইজিপ্ট আরবি ভাষায় কথা কহিয়া থাকে।[2]

তা সত্ত্বেও যে বাঙ্গালীর ভ্রান্তির নিরসন হয়নি, তার কারণ আমরা রাষ্ট্রতত্ত্ব (Theory of Nation and Nationalism) নিয়ে কোন গভীর অনুশীলন করিনি। এর ফলে জাতিশব্দকে আমরা বিবিধ অর্থে ব্যবহার করে থাকি, যেমন race, nation, country, ethnic community, caste, people ইত্যাদি। কোন জাতির রাজনৈতিক কর্মকান্ডের প্রথম ও শেষ কথা রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব বা স্বরাজ্য অর্জন এবং তাকে রক্ষা করা। তা সত্ত্বেও জাতি‘, ‘দেশ‘, ‘রাষ্ট্রএই পারিভাষিক শব্দ ত্রয়ীর পৃথক ও নির্দিষ্ট সংজ্ঞা তথা স্বচ্ছ ধারণা না থাকা আমাদের অপরিণত রাজনৈতিক চেতনার পরিচয়। এই ব্যর্থতা শুধু বাঙ্গালীর নয়, সমগ্র হিন্দু জাতির, যার মূল্য আমরা প্রতিনিয়ত দিয়ে চলেছি নিজেদের সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনে।

অগ্নি ও তার দাহিকা শক্তির মতো জাতি ও তার জাতিসত্তা অবিচ্ছেদ্য। এখানে আমরা যে জাতিসত্তার আলোচনা করছি তা ethnicity, রাষ্ট্রসত্তা বা nationality নয়, যদিও অনেক জাতির ক্ষেত্রে এই দুই সত্তা অভিন্ন।[3] জাতি গঠনের মৌলিক উপাদান ধর্ম, ভাষা ও বাসভূমি। জাতিসত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে এই তিনের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সাহিত্য, শিল্পকলা, আচারউৎসব সহ সংস্কৃতির বিবিধ ক্ষেত্রে, আবার অন্তঃসলিলা নদীর মতো সেই সত্তা প্রবাহিত হয় এসকল হতে উদ্ভূত সাধারণ মূল্যবোধ ও ইতিহাস চেতনায়। অঙ্কের সমীকরণের মতো লিখতে হলে:

জাতিসত্তা (ethnicity) = f(ধর্ম, ভাষা, বাসভূমি)

= সংস্কৃতি + মূল্যবোধ + ইতিহাস চেতনা

লক্ষণীয়, প্রত্যেক জাতির আদি সাহিত্যে, সঙ্গীতে, ভাস্কর্যে, বৃহৎ স্থাপত্যে, সর্বত্র ধর্মের সুস্পষ্ট প্রভাব তিন মৌলিক উপাদানের মধ্যে ধর্মের প্রশ্নাতীত প্রাধান্য সূচিত করে। জাতির মূল্যবোধও বহুলাংশে প্রভাবিত হয় ধর্মের দ্বারা। জাতিসত্তা গঠনের ভূমিকায় ধর্মের এই নিরঙ্কুশ প্রাধান্য কিন্তু কোন কাকতলীয় ঘটনা নয়, এর নেপথ্যে আছে মানব প্রজাতির জৈবিক ও সামাজিক বিবর্তনের ইতিহাস।  

হারারি তাঁর সুবিখ্যাত সেপিয়েন্স (Sapiens: A Brief History of Humankind) গ্রন্থে মানব সভ্যতার বিকাশে ধর্মের এই ভূমিকা নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন। মানব জাতির মধ্যে কল্পনা শক্তির বিকাশ জীবের বিবর্তন ও অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে ছিল একটি বিরাট ধাপ। কিন্তু মানব প্রজাতির, অর্থাৎ হোমো সেপিয়েন্সের (homo sapiens) আবির্ভাবের সময় থেকেই এই শক্তির স্ফুরণ হয়নি। আজ হতে ত্রিশ থেকে সত্তর হাজার বছর পূর্বে আমাদের কোষের মধ্যে কোন পরিব্যাক্তির (mutation) ফলে এই শক্তির প্রকাশ পায় যা আমাদের চেতনায় আনে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন বা ‘cognitive revolution’। এর ফলে বনের বাঘসিংহকে আমরা তখন আর পাঁচটা প্রাণীর মত শুধু ভয় করলাম না, অনেকটা সুন্দরবনের দক্ষিণরায়ের মতো তাকে এক পরিত্রাতা বনদেবতা রূপে দেখতেও শিখলাম। এইরূপে উৎপত্তি হল ধর্মের:

Legends, myths, gods and religions appeared for the first time with the Cognitive Revolution. Many animals and human species could previously say, ‘Careful! A lion!’ Thanks to the Cognitive Revolution, Homo sapiens acquired the ability to say, ‘The lion is the guardian spirit of our tribe.’[4]

অন্যান্য দর্শনের সাথে ধর্মীয় দর্শনের একটি মৌলিক পার্থক্য, এর কেন্দ্রে রয়েছে পরকালের ভাবনা — ঈশ্বরবাদী ও নিরীশ্বরবাদী তত্ত্বের অবতারণা তারই ফলশ্রুতি মাত্র। মৃত্যুর পর জীবের কি হয়? জন্মের পূর্বে সে কোথায় ছিল? কোন শক্তি আমাদের জন্মমৃত্যুকে পরিচালিত করে? একাধারে মৃত্যু ভয়ে ভীত এবং অমরত্বের অভিলাষী মানুষ যে নিজের নবলব্ধ কল্পনাশক্তির কারণে এইসব প্রশ্ন নিয়ে বিব্রত হবে, আবার সেই কল্পনাশক্তিকেই এই সকল প্রশ্নের মীমাংসায় নিয়োজিত করবে তা স্বাভাবিক। এইভাবে গড়ে উঠল এক একটি গোষ্ঠীর ধর্মীয় বিশ্বাস। একই বিশ্বাসের ভিত্তিতে, অনাত্মীয় বা অপরিচিত হওয়া সত্ত্বেও গড়ে উঠল আস্থা, সৌহার্দ্য, বৃদ্ধি পেল সাংগঠনিক শক্তি, জন্ম নিলো বৃহত্তর সাম্প্রদায়িক চেতনা, গড়ে উঠলো এক মানসিক পরিবার“[5] বা “imagined community”[6]। যতদিন কল্পনাশক্তির বিকাশ হয়নি, অগ্নি ও আদিম পাথুরে অস্ত্রের ব্যবহার জানা সত্ত্বেও পৃথিবীতে আমাদের প্রভুত্ব স্থাপন করার কোন সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু এখন সমষ্টিগত কল্পনার সাহায্যে মানব গোষ্ঠী বৃহৎ আকার ধারণ করতে সমর্থ হল, যা অন্যান্য জীবের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এইরূপ সঙ্ঘশক্তির দ্বারা মানব প্রজাতি প্রাণিজগতের উপর নিজের আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হল।

But fiction has enabled us not merely to imagine things, but to do so collectively. […] Such myths give Sapiens the unprecedented ability to cooperate flexibly in large numbers. Ants and bees can also work together in huge numbers, but they do so in a very rigid manner and only with close relatives. Wolves and chimpanzees cooperate far more flexibly than ants, but they can do so only with small numbers of other individuals that they know intimately. Sapiens can cooperate in extremely flexible ways with countless numbers of strangers. That’s why Sapiens rule the world, whereas ants eat our leftovers and chimps are locked up in zoos and research laboratories.[7]

কিন্তু মানুষ শুধু পশুপাখির উপর প্রভুত্ব করেই ক্ষান্ত থাকে নি, গোষ্ঠীতে ভাগ হয়ে সে লড়েছে একে অপরের সাথে, চেষ্টা করেছে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার। সেই আদিকাল থেকেই এই গোষ্ঠীবদ্ধতার পেছনে কাজ করেছে কোন না কোন ধর্মীয় বিশ্বাস। গোষ্ঠী থেকে উপজাতি, উপজাতি থেকে জাতি, এইভাবে ক্রমশ বিস্তৃত হয়েছে ধর্মীয় বিশ্বাসের বলয়, হয়ে উঠেছে জাতিগঠনের প্রধান ভিত্তি।

সুতরাং ভাষা প্রায় সম্পূর্ণভাবে বিস্মৃত হয়ে, বাসভূমি থেকে বিতাড়িত হয়েও, পিতৃপুরুষের ধর্ম এবং ফেলে আসা বাসভূমির স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরে জাতিসত্তাকে বাঁচিয়ে রাখা যায়, হাজার বছর ধরে যেমন রেখেছিল ইহুদিরা। ধর্ম ও বাসভূমি যেখানে অপরিবর্তিত, মাতৃভাষায় লিখিত এবং মুদ্রিত সাহিত্যে সমৃদ্ধ কোন জাতির ভাষা বরাবরের জন্য পরিবর্তিত হবার দৃষ্টান্ত অদূর অতীতে পাওয়া যায় না। কোন শক্তিশালী রাষ্ট্র এমন কোন জাতির উপর বিজাতীয় ভাষা চাপিয়ে দিলেও একটা সময়ের পর তাদের জাতিসত্তাই উদ্বুদ্ধ করেছে নিজেদের মাতৃভাষাকে স্বমহিমায় পুনর্স্থাপিত করতে, যেমন আমরা দেখছি প্রাক্তন সোভিয়েত প্রদেশগুলির ক্ষেত্রে। একদা অটোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত রোমানিয়া, বুলগেরিয়ার মতো ইউরোপের দেশগুলির ক্ষেত্রেও এই কথা প্রযোজ্য। নিজেদের দৈনন্দিন জীবনে হিব্রু ভাষার ব্যবহার ভুলে যাওয়া ইহুদিরাও ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর প্রাচীন হিব্রু ভাষার উপর ভিত্তি করে একটি আধুনিক হিব্রু ভাষার জন্ম দিয়েছে। আবার কোন জাতি যদি তার বাসভূমি ও ভাষা দুইই খুইয়ে নতুন বাসভূমিকে নিজের দেশ, নতুন ভাষাকে মাতৃভাষা বলে গ্রহণ করে, সেক্ষেত্রেও তারা নিজেদের জাতিসত্তাকে হারিয়ে ফেলে না। ইরান হতে পালিয়ে ভারতে শরণ নেওয়া পার্সিরা এর উজ্জ্বলতম দৃষ্টান্ত। আজ তারা ভারতীয় সমাজের মাঝে সম্পূর্ণভাবে অঙ্গীভূত হয়েও নিজেদের জাতিসত্তা হারিয়ে ফেলেনি। উনিশ শতকে একপ্রকার বাধ্যতামূলক শ্রমিক হিসেবে যাওয়া ফিজি, সুরিনাম, গায়ানা, ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে হিন্দু বংশোদ্ভবরাও ধর্মকে আঁকড়ে নিজেদের জাতিসত্তা অক্ষুন্ন রাখতে সমর্থ হয়েছে।

অন্যদিকে চীন, জাপান, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানুষ হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির (বৌদ্ধ মত যার অন্তর্গত — পরে আলোচনা করেছি) দ্বারা প্রভাবিত হলেও নিজেদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি হতে বিচ্যুত হননি, অর্থাৎ নিজেদের জাতিসত্তা হারাননি। কিন্তু আব্রাহামীয়, অর্থাৎ ইসলাম বা খ্রিষ্টান মতে ধর্মান্তরণ হলে বিদ্যমান জাতিসত্তার ঘটে সম্পূর্ণ বিনাশ। এটি সম্ভব হয় কারণ জাতিসত্তার প্রাণভোমরা হল জাতির ইতিহাস চেতনা, যেখানে মিশে আছে পূর্বপুরুষদের জন্য শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও অহংকার। কিন্তু ইসলাম ও খ্রিষ্টান শিক্ষার প্রভাবে পূর্বপুরুষরা  অপধর্ম বা “false religion”-এর অনুসারী, সেহেতু নরকগামী, এইরূপ ধারণা মজ্জাগত হওয়ায়[8] ধর্মান্তরিতদের সাথে তাদের পূর্বপুরুষদের ঘটে আত্মিক বিচ্ছেদ — snapping of all emotional and psychic ties; ভালোবাসা, শ্রদ্ধা, অহংকার রূপান্তরিত হয় ঘৃণা, বিতৃষ্ণা ও লজ্জায়। সম্পর্কের একই পরিণতি ঘটে পূর্বপুরুষদের উপাস্য দেবদেবীদের ক্ষেত্রেও। এইভাবে পূর্বপুরুষদের সংস্কৃতি ও ইতিহাসের উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে জন্ম হয় অতীতের প্রতি বৈরীভাবাপন্ন এক নবজাতির। [9]

এই উপলব্ধি থেকে স্বামী বিবেকানন্দ প্রবুদ্ধ ভারতকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, কোন হিন্দু ধর্মান্তরিত হলে হিন্দু সমাজের সংখ্যাই শুধু কমে না, একজন শত্রুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়:

And then every man going out of the Hindu pale is not only a man less, but an enemy the more.”[10]

ইসলামে ধর্মান্তরিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই মনস্তাত্বিক প্রভাব নিয়ে আরো বিশদে আলোচনা করেছিলেন বিদ্যাধর নাইপল। Among the Believers: An Islamic Journey প্রকাশিত হবার ষোল বছর পর ধর্মান্তরিত মুসলমান মানসের উপর ইসলামের প্রভাব আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে নাইপল পুনর্বার আরব জগতের বহির্ভুত ইসলামী ইরান, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও মালেশিয়া ভ্রমণ করেন, লেখেন তাঁর অভিজ্ঞতাপ্রসূত Beyond Belief: Islamic Excursions Among the Converted Peoples। এই প্রসঙ্গে গার্ডিয়ান পত্রিকায় এক সাক্ষাৎকারে নাইপল বিজিত জাতিগুলির উপর ইসলামী সাম্রাজ্যবাদের পরিণামকে সর্বনাশা (“calamitous”) আখ্যা দিয়ে বলেছিলেন:

[Islam] has had a calamitous effect on converted peoples. To be converted you have to destroy your past, destroy your history. You have to stamp on it, you have to say ‘my ancestral culture does not exist, it doesn’t matter’.”

(“ধর্মান্তরিতদের উপর ইসলামের প্রভাব সর্বনাশা। [ইসলামে] ধর্মান্তরিত হবার অর্থ, নিজের অতীতকে, নিজের ইতিহাসকে ধ্বংস করা। [নিজের পূর্বপুরুষদের] সেই অতীতকে পা দিয়ে দাবিয়ে ঘোষণা করতে হয়, ‘আমার পিতৃপুরুষের সংস্কৃতির কোন অস্তিত্ব নেই, [আর থাকলেও] তাতে কিছু যায় আসে না।“)[11]

বাংলাভাষী মুসলমানরাও হয়েছিল একই বিজাতীয়করণের সম্মুখীন। কিন্তু তুর্কি, ইরানি, আফগান বা ইসলামী/আরব সাম্রাজ্যবাদের কাছে বিজিত অন্যান্য অনেক জাতির মতো সমগ্র বাঙ্গালী জাতি ধর্মান্তরিত হয়নি, উপরন্তু ইসলাম শাসিত মধ্যযুগেও বঙ্গীয় সংস্কৃতির ধারক ও বাহক ছিল বাঙ্গালী হিন্দুরাই। তাই বঙ্গীয় হিন্দুদের বাঙ্গালী ও নিজেদের মুসলমান পরিচয় দিয়েই তারা সন্তুষ্ট ছিল। এইভাবে কয়েক শতক চললেও বিংশ শতকের দ্বারপ্রান্তে এসে, বঙ্গের নবজাগরণ তথা ছাপাখানার সহায়তায় বাঙ্গালী হিন্দু প্রণীত সাহিত্যের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও ইংরেজ প্রবর্তিত প্রাতিষ্ঠানিক উচ্চশিক্ষার প্রসারের ফলে তারা মুসলমাননা বাঙ্গালী‘, না বাঙ্গালী মুসলমান‘, এমনি নানাবিধ আত্মপরিচয়ের সংকটে হল আবর্তিত। এইভাবে শুরু হয় বাংলার মুসলমানের জাতিসত্তার অনুসন্ধান, কিন্তু তা নিজেদের হিন্দু শিকড়কে অস্বীকার করে।

সমস্যা হল, অতীতকে অস্বীকার করলেই হয় না, সেই শূন্যস্থানে তৈরী করতে হয় নব্য ধর্মমতের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি ও অঞ্চলকে জুড়ে এক নতুন ইতিহাস, সৃষ্টি করতে হয় নতুন সাংস্কৃতিক চেতনা, সেই হেতু কখনো প্রয়োজন হয় বিকল্প ভাষার অথবা প্রচলিত ভাষার নবতর সংস্করণের।

অর্থাৎ, বাঙ্গালী জাতিসত্তা বা বাঙ্গালিত্ব যখন —

f(হিন্দু ধর্ম, সনাতনী বাংলা, বঙ্গভূমি)

তখন বাংলাভাষী মুসলমানের জাতিসত্তা হয়ে দাঁড়ায় —

f(ইসলাম, মুসলমানি বাংলা,   + সুবে বাংলা)

কিন্তু ইতিহাসকে বিকৃত করেই এক নতুন ইতিহাস রচনা করা সম্ভব, যা বাংলাভাষী মুসলমানরা উনিশ শতক থেকে করে আসছে, বাংলাদেশেও সেই প্রচেষ্টা পর্যাপ্ত ভাবে বিদ্যমান।

ইতিহাস বিকৃতির প্রথম ধাপ, বঙ্গের প্রথম ইসলামী আগ্রাসন ও তার পরবর্তী নায়কদের উদার, অসাম্প্রদায়িক মুক্তির দিশারী হিসেবে উপস্থাপন করা। যেমন, অধুনা প্রয়াত বাংলাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদা উপাচার্য, ‘একুশে পদকপ্রাপ্ত, বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপকসৈয়দ আলী আহসান একটি বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন:

১২০৫ খ্রিস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন খিলজীর আগমনে এদেশের সাধারন মানুষ নতুন করে চেতনা পেল। […] মানুষে মানুষে বিভাজন মুসলমান আমলে আর রইল না, পাল আমলেও এটা ছিল না। মুসলমানরা একটা নতুন বিশ্বাসকে আনলেন, এদেশের সংস্কৃতিতে নতুন প্রাণ সঞ্চার করলেন এবং একটি বিস্ময়কর মানবিক চৈতন্যের উদ্বোধন ঘটালেন।[12]

সৈয়দ আলী আহসান যে “বিস্ময়কর মানবিক চৈতন্য”র কথা উল্লেখ করেছেন, ইখতিয়ার উদ্দিন খিলজী ইতিপূর্বেই সেই চেতনার আলোকচ্ছটায় চৈতন্যপ্রাপ্ত হয়ে বঙ্গ ও মগধ “আগমন” হেতু এই দুই রাজ্যের সকল প্রসিদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ধ্বংস করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল রাজা গোপাল প্রতিষ্ঠিত ওদন্তপুরী, ধর্মপাল প্রতিষ্ঠিত বিক্রমশীলা এবং অবশ্যই সুপ্রসিদ্ধ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়, যার লক্ষ লক্ষ বই ও পাণ্ডুলিপি মাসের পর মাস ইসলামী সেনার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়।

তা সত্ত্বেও বখতিয়ারকে নিয়ে বাংলাভাষী মুসলমানের রোমান্টিসিজমের শেষ নেই। ব্যতিক্রম ছিলেন না বাংলাদেশের আধুনিক বাংলা সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি আল মাহমুদ। একাধিক পাঠাগার ধ্বংসের খলনায়ক বখতিয়ারের প্রশস্তি করে তিনি লিখেছিলেন ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, যার কয়েকটা পংক্তি ছিল:

আল্লার সেপাই তিনি, দুঃখীদের রাজা।

যেখানে আজান দিতে ভয় পান মোমেনেরা,

আর মানুষ করে মানুষের পূজা,

সেখানেই আসেন তিনি। খিলজীদের শাদা ঘোড়ার সোয়ারি।

দ্যাখো দ্যাখো জালিম পালায় খিড়কি দিয়ে

দ্যাখো, দ্যাখো।

মায়ের কেচ্ছায় ঘুমিয়ে পড়ে বালক

তুলোর ভেতর অশ্বখুরের শব্দে স্বপ্ন তার

নিশেন ওড়ায়।

অথচ এক সাক্ষাৎকারে এই মানুষটিই বলেছিলেন, “বইহীন পৃথিবী আমি কল্পনা করতে পারি না।“[13]  এই দ্বিচারিতা, বা বলা ভাল, চিন্তার ব্লাইন্ড স্পটের মূলে যে সেই “বিস্ময়কর মানবিক চৈতন্য” কাজ করেছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

বখতিয়ারের ধ্বংসলীলা সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলেই বঙ্গে মুসলমানদের নিপীড়িত[14] হবার এমন আজব কল্পনা আল মাহমুদ করেছিলেন কিনা জানা নেই, কিন্তু মাত্র আঠারো সৈন্য নিয়ে বখতিয়ারের তথাকথিত বাংলা জয়ের যে মিথ বামৈস্লামিক ইতিহাসবিদদের বদান্যতায় এই পশ্চিমবঙ্গেও বহুল প্রচারিত, তার সূত্রপাত মিনহাজসিরাজের তবকাৎনাসিরী গ্রন্থ। কাহিনীটি যে অতিরঞ্জিত সে বিষয়ে সন্দেহ নেই (মূল বাহিনী ছিল পশ্চাতে, শহরের অনতিদূরে, এই কয়েকজন অশ্বারোহী এগিয়ে ছিলেন মাত্র), কিন্তু অধিকাংশ বাঙ্গালী যা জানেন না তা হল, নবদ্বীপ নয়, সেন রাজাদের রাজধানী ছিল বিক্রমপুর।[15] লক্ষ্মণসেন ছিলেন একজন ‘পরম বৈষ্ণব’ (তিনি স্বয়ং ওই উপাধি ধারণ করেছিলেন, জয়দেব ছিলেন তাঁর অন্যতম সভাকবি), আক্রমণের সময় তিনি নবদ্বীপে তীর্থভ্রমণরত ছিলেন। নবদ্বীপ ত্যাগ করে রাজধানী বিক্রমপুর থেকে যথারীতি তিনি তাঁর শাসনকার্য চালিয়ে যান। লক্ষ্মণসেনের দেহাবসানের পর তাঁর দুই পুত্র, বিশ্বরূপ সেন ও কেশব সেন, প্রায় অর্ধশতাব্দী রাজত্ব করেন, তবকাৎনাসিরীতে সেকথারও উল্লেখ আছে। বিশেষ উল্লেখযোগ্য হল, মিনহাজের বই এবং লক্ষ্মণসেন ও কেশব সেনের প্রশস্তি থেকে আমরা জানতে পারি যে, পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করতে গিয়ে পিতা এবং পুত্র, দুজনের কাছেই মুসলমানরা পরাজয় বরণ করেছিল।[16]

সেন বংশের অবসানের কিছুকাল পরেই দেব বংশের উত্থান ঘটে, যাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছেন ‘অরিরাজদনুজমাধব’ দশরথদেব। দশরথদেবের বিক্রমপুর প্রশস্তি থেকে জানা যায় তিনি গৌড় পুনরুদ্ধার করেছিলেন। এছাড়া ইয়াহিয়া বিন আহমেদের তারিখমুবারক শাহি গ্রন্থে উল্লেখ আছে, তিনি ১২৮১ সালে গিয়াসুদ্দিন বলবনের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন করেছিলেন।[17] মোদ্দা কথা, বখতিয়ারের নবদ্বীপ আক্রমণের পর প্রায় শতাধিক বছর গৌড় ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চল নিয়েই মুসলমানদের সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছিল; বঙ্গের অধিকাংশ অঞ্চলের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল হিন্দুদের হাতে।

এদিকে ধর্মস্থানের উপর আক্রমণের কোন পরিসমাপ্তি অবশ্য ঘটেনি। বখতিয়ারের উত্তরসূরিরা, ত্রয়োদশ শতকের জাফর খাঁ গাজি থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতকের মুর্শিদকুলী খাঁ পর্যন্ত সকলেই আর কোন বৌদ্ধ বিহার অবশিষ্ট না পেলেও বহু মন্দির ভেঙেছিলেন। ইতিহাস বলে, বাংলার প্রথম মসজিদ তৈরী হয় বাঙ্গালীর মন্দির ও রক্তের বিনিময়ে। বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ লেখক গোলাম মুরশিদের কথায়:

বঙ্গদেশের মুসলিম শাসনের প্রথম শতাব্দীর ইতিহাস তরবারি দিয়ে দেশশাসনের ইতিহাস। সুলতান, তাঁর সামরিক কর্মকর্তা এবং আমীরওমরাহরা স্থানীয় জনগণকে বশে আনার জন্য রক্তপাত করতে অথবা তাঁদের ধর্মীয় স্থান অপবিত্র করতে দ্বিধা করেন নি। এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য প্রতীকী দৃষ্টান্ত হলো শতাব্দীর একেবারে শেষে জাফর খানের। […] ত্রিবেণীতে তিনি একটি বিরাট মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। তরবারি দিয়ে ধর্ম প্রচারের বিশেষ উল্লেখযোগ্য নজির হলো এই মসজিদ। ১২৯৮ সালে নির্মিত তাঁর এই মসজিদে যেপাথর ব্যবহৃত হয়েছে, সেসব পাথরের অনেকটারই উল্টো দিকে আছে হিন্দু দেবদেবীর মূর্তি। তা ছাড়া, এই মসজিদের ওপর উৎকীর্ণ শিলালিপিতে গর্ব করে তিনি বলেছেন, কীভাবে তরবারি দিয়ে কাফেরদের তিনি বিনাশ করেছেন।[18]

এইরূপে বহু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ নিয়ে অথবা তাদের উপরেই গড়ে উঠেছিল মসজিদ, যার প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ মালদার চিকা ও আদিনা মসজিদ, এবং হুগলির ছোট পাণ্ডুয়ার বাইশ দরওয়াজাবা বড়ি মসজিদ।[19]

কিন্তু এই আঘাত শুধু বাঙ্গালীর মন্দিরের ক্ষতি করেছিল ভাবলে ভুল হবে। আগেই বলেছি, কোন জাতির জাতিসত্তার মূর্ত প্রকাশ তার শিল্পে, স্থাপত্যে। বখতিয়ার ও তাঁর উত্তরসূরি ইসলামী শাসকদের এই আঘাত প্রকৃতপক্ষে ছিল বাঙ্গালীর জাতিসত্তার উপর। প্রণব রায় লিখেছেন:

মুসলমান বিজয়ের ফলে বাংলায় এলো এক নতুন যুগ। গুপ্তযুগ থেকে সেনযুগের অবসান পর্যন্ত স্থাপত্যশিল্পে সর্বভারতীয় ঐতিহ্যের যে এক ধ্রুপদী রূপ সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্যেও যা ছিল সমুজ্জল, তার বিকাশ ও গতি রুদ্ধ হয়ে পড়ল। সুউচ্চ শিখরও অন্যান্য দেউলগুলি যা ছিল প্রাচীন বাংলার সম্পদ ও গৌরব, সুলতানী শাসনের প্রথম প্রায় দুশ বছরে সেগুলি সম্পূর্ণ ধ্বংস করে সে ধ্বংসাবশেষ দিয়ে মসজিদ, মাজার তৈরী করাই ছিল মূল লক্ষ্য। সুন্দর সুন্দর মূর্তিগুলি ভেঙ্গে তার অবশিষ্ট অংশে ফারসী আরবী লিপিতে মসজিদ প্রতিষ্ঠার ইতিহাস লিপিবদ্ধ হোল।[20]

দেশজ ধর্মস্থানের উপর যখন এইভাবে নিরন্তর আঘাত আসছিল তখন বাঙ্গালীর ধর্মাচরণের স্বাধীনতা কতটুকু ছিল, তার সাক্ষ্য দেয় মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য। বাংলাদেশ এবং এ রাজ্যের বামৈস্লামিক ইতিহাসবিদদের মনগড়া হিন্দুমুসলমানের সম্প্রীতির চিত্রের আসল রূপ বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, বৈষ্ণব গ্রন্থ প্রেমবিলাস, চৈতন্যভাগবত, চৈতন্যচরিতামৃতে ইতস্তত ছড়িয়ে আছে, যার কয়েকটি রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সংকলন করেছেন তাঁর প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে হিন্দুমুসলমান গ্রন্থে।[21] উদার(!) সুলতান হোসেন শাহর রাজত্বে নদীয়ার হিন্দুরা ঠিক কতটা নির্ভয়ে স্বধর্ম পালন করতে পারত তার একটা নিদর্শন শ্রীচৈতন্য ভাগবতথেকে:  

চারি ভাই শ্রীবাস মিলিয়ে নিজঘরে।

নিশা হইলে হরিনাম গায় উচ্চস্বরে।।

শুনিয়া পাষণ্ডী বোলে — হইল প্রমাদ।

এ ব্রাহ্মণ করিবেক গ্রামের উৎসাদ।।

মহাতীব্র নরপতি যবন ইহার।

এ আখ্যান শুনিলে প্রমাদ নদিয়ার।।

 কেহ বোলে – এ বামনে এই গ্রাম হৈতে।

ঘর ভাঙি ঘুচাই ফেলাই নিঞা স্রোতে।।

এ বামনে ঘুচাইলে গ্রামের মঙ্গল। 

অন্যথা যবনে গ্রাম করিবে কবল।।

(আদি খন্ড, দ্বিতীয় অধ্যায়)

সুতরাং শ্রীচৈতন্য তাঁর ভাবান্দোলন শুরু করার অল্প সময়ের মধ্যেই যে যবন অধিকৃত বঙ্গ ত্যাগ করে হিন্দু রাজা শাসিত উৎকলে জীবনের শেষ আঠেরো বছর অতিবাহিত করেছিলেন, এবং বাংলার মাটিতে আর একবারের জন্যও পদার্পন করেননি এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। এ বিষয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তব্য এই অধ্যায়ে পরে উদ্ধৃত করেছি।

আর সত্যিই কি ইসলামী আক্রমণকে নিম্নবর্ণের হিন্দুরা দুই হাত তুলে স্বাগত জানিয়ে দলে দলে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন? মধ্যযুগের মুসলমান গ্রন্থকাররা এমন কোনও দাবি করেননি, তথ্যপ্রমান পেশ করা তো দূরের কথা। তাঁদের আক্রমণের নিশানা বরাবর ছিল হিন্দু ধর্মের বহু দেববাদ তত্ত্ব। প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ ও বামপন্থীদের দ্বারা বিশেষ সমাদৃত রিচার্ড ঈটন লিখেছেন:

The problem, however, is that no evidence can be found in support of [the Religion of Social Liberation] theory. […] In fact, however, in thinking about Islam in relation to Indian religions, premodern Muslim intellectuals did not stress their religion’s ideal of social equality as opposed to Hindu inequality, but rather Islamic monotheism as opposed to Hindu polytheism. That is, their frame of reference for comparing these two civilizations was theological, not social. In fact, the idea that Islam fosters social equality (as opposed to religious equality) seems to be a recent notion, dating only from the period of the Enlightenment, and more particularly from the legacy of the French Revolution among nineteenth-century Muslim reformers. [emphasis added]

(সমস্যা হল, এই [সামাজিক মুক্তির ধর্মের] তত্ত্বের সমর্থনে কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। […] বাস্তব ঘটনা হল, ভারতীয় ধর্মগুলির সাথে ইসলামের তুলনা করতে গিয়ে আধুনিকপূর্ব যুগের মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা হিন্দু ধর্মের জাতিভেদের বিপ্রতীপে তাঁদের ধর্মের সামাজিক সাম্যের আদর্শের উপর জোর দেননি, বরং হিন্দু বহুদেবত্ববাদের বিরুদ্ধে ইসলামী একেশ্বরবাদের উপর জোর দিয়েছেন। অর্থাৎ, তাঁদের কাছে এই দুটি সভ্যতা তুলনা করার মানদন্ড ছিল ধর্মতাত্ত্বিক, সামাজিক নয়। [127], ইসলাম যে সামাজিক সাম্যকে (ধর্মীয় সাম্যের বিপরীতে) প্রোৎসাহিত করে, এমন ধারণা সাম্প্রতিক কালের বলে মনে হয়, যার সূচনা হয়েছিল ইউরোপের আলোকায়নের যুগ থেকে, বিশেষ করে উনিশ শতকের মুসলিম সংস্কারকদের মধ্যে ফরাসী বিপ্লবের প্রভাবে।)[22]

সুতরাং, ইসলামী শাসক ও মৌলবীদের কাছে সকল হিন্দুই যখন ‘পৌত্তলিক’ কাফের, তখন আলাদা করে কেন নিম্নবর্ণের হিন্দুদের তাঁরা বিশেষ অনুগ্রহ দেখাতে যাবেন? সাম্প্রতিক কালেও আমরা দেখি, ‘৪৬র নোয়াখালী, ‘৫০র ঢাকাবরিশাল, ‘৭১র মুক্তিযুদ্ধ বা তার পরে, পূর্ববঙ্গে যে সকল হিন্দু বিরোধী গণহত্যা ও দাঙ্গা হয়, নমঃশূদ্র সহ তথাকথিত নিম্নশ্রেণীর হিন্দুরাই নিপীড়িত হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। অতীতের কাহিনীও  কিছু ভিন্ন নয়। আবার মধ্যযুগের বৈষ্ণব সাহিত্য থেকে আমরা জানতে পারি, মহাপ্রভুর প্রেমধর্মে আকৃষ্ট হয়ে হিন্দু সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণী বিশাল সংখ্যায় তাতে যোগদান করেছিলেন। অথচ শ্রীচৈতন্যের বৈষ্ণব আন্দোলনের আগে প্রায় দুশ বছর ধরে গৌড়বঙ্গে ইসলামী শাসন ছিল সুপ্রতিষ্ঠিত। ইসলাম গ্রহণ করার জন্য দুশো বছর, অর্থাৎ আট থেকে দশ প্রজন্ম কি তাঁদের জন্য যথেষ্ট ছিল না? অপরদিকে শ্রী চৈতন্যদেবের আন্দোলনে সাড়া দিয়ে অসংখ্য মুসলমান কবিও এ সময় লীলাবিষয়ক রাধাকৃষ্ণের উপর পদ রচনা করেন। যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য তাঁর বাংলার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি গ্রন্থে ১০২ জন বৈষ্ণব ভাবাপন্ন মুসলমান কবিদের প্রায় ৪৫০টি পদ রচনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন:

চৈতন্যযুগে যখন প্রেমের প্রবল বন্যায় বঙ্গদেশ প্লাবিত, তখন তাহা মুসলমানদের আঙ্গিনার মধ্যেও প্রবেশ করিল। […] তাহার ফলে হিন্দুরা মন্দাকিনীর পূত বারি পানে যেরূপ চরিতার্থ হইয়াছেন, মুসলমানরা সেই রূপ না হইলেও প্রেমতৃষ্ণা নিবারণের জন্য এই ধারা হইতে যে সময় সময় বারি আহরণ করেছেন, তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।[23]

এই প্রেমতৃষ্ণা নিবারণের উপায় যে তাঁরা ইসলামের মধ্যে সন্ধান করে পাননি সে বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। এর বিপ্রতীপে, মুসলমান শাসনকালের কোন ঐতিহাসিকের গ্রন্থে এর বিপরীত চিত্রটি, অর্থাৎ, দলে দলে হিন্দুরা স্বেচ্ছায় ইসলামকে গ্রহণ করছে, এমন ছবি কিন্তু আমরা পাই না। পীরদরবেশদের ঝাড়ফুঁক ইত্যাদি দ্বারা মোহিত হয়ে অথবা ভয়ে কিছু মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিল, অনেকে সমাজচ্যুত হয়েছিল যবন দোষে‘, কিন্তু বর্ণ বৈষম্যের কারণে বিশাল সংখ্যক মানুষের ইসলাম গ্রহণের কোন সাক্ষ্য মধ্যযুগের মুসলমান গ্রন্থগুলি থেকে পাওয়া যায় না। পরিবর্তে সেখানে আছে শুধু জেহাদের জয়োল্লাস।

বৌদ্ধদের মধ্যেও কি আদৌ স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরকরণ ঘটেছিল, না তা সম্ভব? তাঁদের গর্বের বিহার ধ্বংসকারীদের, ভিক্ষুভিক্ষুনী হত্যাকারীদের তাঁরা অবিবেচকের মতো আলিঙ্গন করতে যাবেনই বা কেন? বিক্ষিপ্তভাবে ধর্মান্তরণ যদি কোথাও আদৌ হয়ে থাকে তাহলে তার প্রধান কারণ হয় উপায়ান্তর না থাকা অথবা নেতৃত্বহীনতা। বৌদ্ধ সমাজে ভিক্ষুরাই ছিলেন ধর্মের মার্গদর্শক। তাঁদের মঠগুলি ছিল আবার রাজানুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। রাজন্যবর্গের পৃষ্টপোষকতার অবসান ও ইসলামী শাসন, এবং নির্বিচার বিহার ধ্বংসের ফলে বৌদ্ধ সমাজ হয়ে পড়লো অভিভাবকহীন। এই অবস্থায় ইসলামী শাসনযন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পন করা ছাড়া বৌদ্ধদের একাংশের আর কোন পথ ছিল না।

কিন্তু বৌদ্ধদের মধ্যে আদৌ কতজন ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন? আমাদের বর্তমান ধর্ম, ইতিহাস ও সমাজ চেতনা বিগত উনিশ ও বিশ শতকের প্রাচ্যতত্ত্বের পরিণাম। আমাদের কল্পিত হিন্দুবৌদ্ধ বিভাজন পাশ্চাত্যের তথাকথিত প্রাচ্যতত্ত্ববিদ (Orientalist) গোষ্ঠীর অবদান যা ভ্রান্ত ও অজ্ঞতাপ্রসূত। এই হিন্দুবৌদ্ধবিভাজন  তৎকালীন যুগে ছিল না। আজ বৌদ্ধ ধর্ম এক স্বতন্ত্র ধর্মের পরিচয় পেয়েছে কারণ ইউরোপীয়রা মধ্যযুগে বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্মের সাথে পরিচয় লাভ করেছে ভারতের বাইরে — চীন, জাপান ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায়, এবং পরবর্তীকালে প্রাচ্যতত্ত্ববিদরা বৌদ্ধধর্মকে রাঙিয়েছে নিজেদের মতো করে।[24] উনিশ শতকে ভারতে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে শুরু হয় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, পাওয়া যায় তথাগত বুদ্ধের ঐতিহাসিকতা ও ভারতে বৌদ্ধ অস্তিত্বের প্রমাণ।[25] অন্যথা হলে আজ বৌদ্ধ ধর্মকে হিন্দু ধর্মেরই এক শাখা হিসেবে গণ্য করা হতো। বস্তুতঃ ভারতে উদ্ভুত সকল আধ্যাত্মিক মত ও পথের সমষ্টিগত রূপ হিন্দু বা সনাতন ধর্ম।। বৌদ্ধ ধর্মের স্বাতন্ত্র্য হিন্দু ধর্ম হতে নয়, সেই স্বাতন্ত্র্য শৈব, শাক্ত, বৈষ্ণব ধর্ম সহ প্রচলিত বিবিধ দেশজ ধর্ম ও উপধর্ম হতে। বিবাদ যা ছিল তা বিভিন্ন দার্শনিক মতের সাথে, কিন্তু সেরূপ বিবাদ নৈয়ায়িক, বৈশেষিক, পূর্ব ও উত্তর মীমাংসকদের মধ্যেও আমরা ইতিহাসে প্রত্যক্ষ করে থাকি। আবার বৌদ্ধধর্মের অন্তর্গত শাখাপ্রশাখা, যেমন থেরবাদ, মহাযান, বজ্রযান প্রভৃতির পার্থক্যকেও ভুলে গেলে চলবে না।

সামাজিক ক্ষেত্রে কিন্তু গৃহস্থ বৌদ্ধদের অন্যান্যদের থেকে পৃথক করা আরো কঠিন। ঈটন স্বীকার করেছেন ইসলামী আক্রমণের সময় সামাজিক ক্ষেত্রে গৃহস্থ বৌদ্ধদের জীবনের বিবিধ সংস্কার ব্রাহ্মণদের দ্বারাই পরিচালিত হতো।[26] এটাও লক্ষণীয়, বৌদ্ধ ভিক্ষু ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ব্রাহ্মণ এবং বৌদ্ধ সাহিত্যে তাঁদের ব্রাহ্মণ বলেই অভিহিত করা করেছে।[27] এছাড়া গোতম গোত্রীয় তথাগত বুদ্ধ তাঁর উপলব্ধ চার সত্য ও আটটি পথকে চার আর্য সত্যঅষ্টাঙ্গিক আর্য মার্গআখ্যা দিয়ে নিজের মতকে আর্য তথা বৈদিক ধর্মের অঙ্গীভূত করেছিলেন। এর থেকে স্পষ্ট হয়, বৌদ্ধ সম্প্রদায় ছিল বৃহত্তর হিন্দু সমাজের এক অংশ। সামাজিক ব্যবধানের অভাবের আর এক প্রমান, পাল রাজাদের প্রধানমন্ত্রী সহ বিশিষ্ট মন্ত্রীরা অধিকাংশই ছিলেন বেদান্ত, মীমাংসা ও তন্ত্রে সুপন্ডিত ব্রাহ্মণ, যা মুসলমান রাজত্বে ছিল অকল্পনীয়।  এছাড়া, সেন রাজাদের যেমন দেখি প্রজন্মান্তরে শৈবশাক্তসৌর সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত হতে, প্রথম মহীপাল সহ পাল বংশের একাধিক রাজারাও বৌদ্ধ থেকে শৈব সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েছিলেন।[28] অর্জুনদেব সেনশর্মা তাঁর গবেষণা সন্দর্ভে বিজয়গুপ্তের মনসামঙ্গল ও বৃন্দাবন দাসের শ্রীচৈতন্যভাগবতর দুটি উদ্ধৃতিতে হিন্দুশব্দের উল্লেখের তাৎপর্য প্রসঙ্গে লিখেছেন:

লক্ষ করবার মত যে দুটি উদ্ধৃতিই হিন্দু কবির কাব্যে উদ্ধৃত মুসলিমের উক্তি। অর্থাৎ হিন্দু এই গোত্রপরিচয় মুসলিম ও অমুসলিম এই উভয়দিকেরই ব্যবহারিক প্রযয়োজনীয়তা থেকে তৈরি হয়ে উঠছিল। তখনও বঙ্গীয় সমাজে বৌদ্ধরা সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে যাননি। কবিকর্ণপুর চৈতন্যচন্দ্রোদয়নাটকে বৌদ্ধদের উল্লেখ করেছেন। এই সময়ের কিছু পরে বীরভদ্র সহজিয়া বৌদ্ধদের বৈষ্ণবধর্মে অন্তর্ভুক্ত করবেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মে যে সৎশূদ্র, জলআচরণীয় শূদ্র, অনাচারণীয় শূদ্র, অন্ত্যজ, বৌদ্ধ সহজিয়া এমনকী পার্বত্য উপজাতি (যেমন মণিপুরী ভোটচীনীয় জনগোষ্ঠী)-ও অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়বে, এবং সেই অন্তর্ভুক্ত করবার শক্তি যে মহাপ্রভু আরব্ধ ধর্মান্দোলনের মধ্যে ছিল, তার অব্যর্থ প্রমান—বৃন্দাবন দাসের ব্যবহৃত এই নাতিক্ষুদ্র হিন্দুশব্দটি।[29]

সুতরাং মুসলমান আক্রমণের পর বৌদ্ধদের অধিকাংশ যে বৃহত্তর হিন্দু সমাজে লীন হয়েছিলেন সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

সামাজিক মুক্তি‘-র এই মিথের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পৃক্ত আর এক মিথ ― আর্য আক্রমণ তত্ত্ব। আর্য আক্রমণের ফলে আর্যব্রাহ্মণ্যবাদের দ্বারা অনার্য বাঙ্গালী নিপীড়িত হয়ে প্রথমে বৌদ্ধধর্মে ও পরে ইসলামের কাছে সঁপে দিয়ে নিজের মুক্তি চেয়েছিলএমন এক ন্যারেটিভ প্রচার করার লোভ সংবরণ করা কঠিন।

কিন্তু সমস্যা হল, বিগত সাত দশকের প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান ও গবেষণার ফলে এই তত্ত্বটি আজ এতটাই পরিত্যাজ্য যে, রমিলা থাপারের মতো হিন্দু বিদ্বেষী বাম ইতিহাসবিদকেও সংবাদপত্রের পত্রবিভাগে চিঠি দিয়ে নিজেকে এই তত্ত্ব থেকে বিযুক্ত থাকার দাবি জানাতে হয়। ২০০৪ সালে দ্য হিন্দু পত্রিকায় সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর এক নিবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে লেখা এক চিঠিতে রোমিলা থাপার দাবি করেছিলেন ষাটের দশক থেকেই তিনি ও তাঁর সতীর্থরা আর্যদ্রাবিড় নামক জাতিতত্ত্ব ও আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে অস্বীকার করে আসছেন:

[For] the last 30 years I, together with other historians, have been refuting the concept of an Aryan race or a Dravidian race. I have stated categorically in “A History of India,” Vol. I, published in 1966, that Aryan is a linguistic term. I discussed this in greater detail in my presidential address to the Ancient Indian History Section of the Indian History Congress in Varanasi in 1968, where I argued that Aryan is a linguistic label and not a racial category. And just for the record, since I am frequently misquoted on this by some people, I argued further that although I did not accept the notion of an Aryan invasion, I did support the idea of a graduated migration of Aryan-speaking peoples from the Indo-Iranian borderlands into north-western India. This resulted in an interface of various cultures and this interface needs to be explored — and many of us have done so, as would be apparent from our other publications on the subject.

(বিগত ৩০ বছর ধরে অন্যান্য ঐতিহাসিদের সাথে আমিও আর্য জাতি ও দ্রাবিড় জাতির ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে আসছি। আমি, ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত A History of India গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে স্পষ্টভাবে বলেছি যে, আর্য একটি ভাষাগোষ্ঠী বাচক শব্দ। ১৯৬৮ সালে বারাণসীতে ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস বিভাগের সভাপতির ভাষণে আমি এটি নিয়ে আরও বিস্তারিত আলোচনা করেছি, যেখানে আমি ব্যাখ্যা করেছিলাম যে আর্য একটি ভাসাগত পরিচয়, কোন রেস নয়। যেহেতু এই সম্পর্কে প্রায়শই কিছু লোকের দ্বারা আমার মন্তব্যকে বিকৃত করা হয়, [তাই সবার] অবগতির জন্য বলি, আমি আরও বলেছিলাম যে, যদিও আমি আর্য আক্রমণের ধারণাটি স্বীকার করি না, আমি ইরান হতে উত্তরপশ্চিম ভারত হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে চলা (graduated) আর্যভাষী সম্প্রদায়ের অভিবাসনের ধারণাকে সমর্থন করি। এর ফলে বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে যে আদানপ্রদানের প্রক্রিয়া ঘটেছিল তার অন্বেষণ করা দরকার এবং আমাদের মধ্যে অনেকেই তা করেছেন, এই বিষয়ের উপর আমাদের বিভিন্ন প্রকাশনা থেকে তা স্পষ্ট হবে।)[30]

অর্থাৎ, বামপন্থী ইতিহাসবিদদের কাছে ‘আর্য আক্রমণ’ আজ রূপান্তরিত হয়েছে আর্য অভিবাসনে! কিন্তু তথাকথিত আর্যরা কি আদৌ ভারতের বহিরাগত গোষ্ঠী ছিলেন? স্বল্প পরিসরে এর আলোচনা সম্ভব নয়। শুধু এটুকু বলব, উপগ্রহের মাধ্যমে প্রাপ্ত শুকিয়ে যাওয়া সরস্বতী নদীর ভূতাত্ত্বিক তথ্য, ভূগর্ভস্থ জলের গবেষণা, গত কয়েক দশকে সরস্বতীর তীরে বহু সংখ্যক বাসভূমির প্রত্নতাত্ত্বিক খনন, ঋগ্বেদের ভৌগোলিক ও  ভাষাতাত্ত্বিক গবেষণা এই আর্য অভিবাসন তত্ত্বকেও আজ প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। জেনেটিক্সও বিশেষ সহায়তা করছে না। উৎসাহী পাঠক পড়তে পারেন দুই মৌলিক গবেষক, মিশেল দানিনোর (Michel Danino) The Lost River: On the Trail of the Sarasvatī এবং শ্রীকান্ত তালাগেরির (Shrikant Talageri) বিভিন্ন গ্রন্থ, বিশেষ করে Genetics and the Aryan debate: “Early Indians” Tony Joseph’s Latest Assault। ইদানিং বাংলাতেও প্রকাশিত হয়েছে গবেষক রজত পালের বেশ কয়েকটি বই — আর্য দিগন্তে সিন্ধু সভ্যতা, সিন্ধু সভ্যতার কথা ও কাহিনী এবং সিন্ধু সভ্যতায় বৈদিক উপাদান ও সিন্ধু লিপির পাঠ

সামাজিক মুক্তি‘-র তত্ত্ব ছাড়াও ‘আর্য আক্রমণ’ তত্ত্ব রসদ যুগিয়েছে মূলনিবাসীতত্ত্বের — বাঙ্গালীর হিন্দু ধর্ম, সংস্কৃতি ও জনগোষ্ঠীর একাংশকে বহিরাগত তথা অবাঙ্গালী প্রতিপন্ন করতে, এবং বঙ্গে ইসলামী আক্রমণকে পরোক্ষে বৈধতা দিতে এই তত্ত্ব বাংলার মুসলিম ইতিহাসবিদদের প্রধান অস্ত্র। এর প্রতিপাদ্য, সহস্রাধিক বছর ধরে পুরুষানুক্রমিক ভাবে বঙ্গে বসবাস করা কয়েক কোটি হিন্দু আর্যহবার দরুন বাঙ্গালী নন, তাঁরা বহিরাগত। অপরদিকে মাত্র পাঁচশ বছর পূর্বে ইরাক হতে আসা এক দরবেশের বংশধর, ‘শেখউপাধিধারী একজন হলেন হাজার বছরের শেষ্ঠ বাঙ্গালী। সৌভাগ্যবশতঃ এই দ্বান্দ্বিকতার সমন্বয় সাধন করতে সমর্থ হয়েছে সামাজিক গণমাধ্যমে প্রচারিত একটি মীম:

সুমন চট্টোপাধ্যায় বহিরাগত আর্য কিন্তু কবীর সুমন মূলনিবাসী!”

প্রসঙ্গত বলে রাখি, রোমিলা থাপারদের উপলব্ধির প্রায় দুদশক আগেই বাবাসাহেব আম্বেদকর আর্যদের বহিরাগত হবার দাবিকে অস্বীকার করেছিলেন।[31] কিন্তু ইতিহাস চর্চা যখন সত্যান্বেষণের পরিবর্তে এজেন্ডা দ্বারা পরিচালিত হয় তখন এইরূপ সত্যের অপলাপ অবশ্যম্ভাবী।

ইতিহাস বিকৃতির দ্বিতীয় ধাপ, মুসলিম শাসকদের পৃষ্টপোষকতাতেই বাংলা ভাষা ও বাংলা সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে, এটা প্রতিপাদন করা। সেই ১৯১৮ সালে যশোহরখুলনাসিদ্দিকিয়া সাহিত্যসমিতির এক অধিবেশনের বক্তৃতায় আহসান উল্লা (বা আহ্ছানউল্লা) দাবি করেছিলেন, “হিন্দু রাজত্ব অক্ষুন্ন থাকলে বঙ্গভাষা এরকম উঁচু স্থান পেত কিনা সন্দেহ।“[32] তারপর সেই দাবিরই পুনরাবৃত্তি দেখি কাজী মোতাহের হোসেন ও ডঃ শহীদুল্লাহর লেখায় যার কিছু দৃষ্টান্ত ইতিপূর্বে আমরা দিয়েছি। নিরন্তর এই মিথ প্রচারের ফলে বাংলাভাষী মুসলিম মানসে বহুদিন যাবৎ এই ধারণা গেঁথে গেছে। এ প্রসঙ্গে রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তব্য:

অনেকে মনে করেন মুসলমান সুলতান ও ওমরাহের উৎসাহেই বাংলা সাহিত্য প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছে। দুইটি বাস্তব ঘটনার উল্লেখ করিলেই এই ধারণার অসারতার প্রতিপন্ন হইবে।

প্রথমতঃ, বাংলাদেশে প্রায় ছয় শত বৎসর ব্যাপী মুসলমান রাজত্বে মুসলমান সুলতান ও তাঁহাদের অনুচরের মধ্যে বাংলা ভাষার পৃষ্টপোষক যাঁহাদের নাম জানা গিয়াছে, তাঁহাদের সংখ্যা ছয় জনের বেশি নহে।

দ্বিতীয়তঃ, মধ্যযুগে কেবল বাংলায় নহে ভারতের সকল প্রদেশেই এমন কি যেখানে মুসলমানদের আধিপত্য ছিল না এবং মুসলমান সুলতানের পৃষ্টপোষকতার কোন উল্লেখ পাওয়া যায় না, সেইসব দেশেও স্থানীয় কথ্যভাষা সাহিত্যের ভাষায় উন্নীত হয়েছিল।

সুতরাং বাংলার মুসলমান সুলতানদের অনুগ্রহ না হইলে যে বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠা হয়তো না এরূপ মনে করিবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নাই।[33]

এক্ষেত্রে হোসেন শাহকে নিয়ে বামৈস্লামিক ইতিহাসবিদদের আহ্লাদের শেষ নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ইংরেজি ইতিহাস বইতে, সুলতান হোসেন শাহের বংশের উদার শাসননীতির ফলে “রুদ্ধগতি প্রাপ্ত বাঙ্গালীর সাহিত্য প্রতিভা বেগবতী নদীর মত প্রবাহিত হয়েছিল” (“the vernacular found its due recognition as the literary medium through which the repressed intellect of Bengal was to find its release” — The History of Bengal, University of Dacca, Vol II), লেখক অধ্যাপক হাবীবুল্লাহর এমনতর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন:

হোসেন শাহের রাজত্বকাল ১৪৩৯ হইতে ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দ। ইহার পূর্বেই চন্ডিদাসের পদাবলী, কৃত্তিবাসের বাংলা রামায়ণ, বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল এবং মালাধর বসুর শ্রীকৃষ্ণবিজয় বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করিয়াছে। বিপ্রদাস পিপিলাই হোসেন শাহের রাজত্ব লাভের দুই বৎসরের মধ্যে তাঁহার মনসামঙ্গল রচনা করেন। সুতরাং মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের যে তিনটি প্রধান বিভাগ অনুবাদসাহিত্য, মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব পদাবলী তাহার প্রতিটি বিভাগেই উৎকৃষ্ট কাব্য হোসেন শাহী আমলের পূর্বেই রচিত হইয়াছে। সুতরাং বাঙালী কবির সৃজনীশক্তি যে হোসেন শাহের পূর্বেই রুদ্ধ হইয়াছিল, এরূপ মনে করিবার কোন কারণ নাই। […] মঙ্গলকাব্যের মধ্যে যে দুইখানি বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গল অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া গ্রহণ করা যাইতে পারে তাহার মধ্যে একখানি মুকুন্দরামের চন্ডীমঙ্গল কাব্য হোসেন শাহী বংশের অবসানের ৬০।৭০ বৎসর পর, এবং আর একখানি ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল তাহারও দেড়শত বৎসর পরে রচিত হইয়াছিল। সুতরাং হোসেন শাহী শাসনের আশ্রয়েই যে বাংলা সাহিত্যের চরম উন্নতি হইয়াছিল এই উক্তির সপক্ষে কোন যুক্তিই নাই।[34]

এখানেই না থেমে অধ্যাপক হাবীবুল্লাহর দাবি ছিল হোসেন শাহের উদার ও পরধর্মসহিষ্ণুতা বিনা ওই যুগে বাংলার সাংস্কৃতিক নবজাগরণ সম্ভবপর ছিল না —  “It is almost impossible to conceive of the rise and progress of Vaishnavism or the development of Benglai literature at this period without recalling to mind the tolerant and enlightened rule of the Muslim Lord of Gaur”। এর প্রত্যুত্তরে রমেশচন্দ্র মজুমদারের বক্তব্য:

হোসেন শাহের রাজত্বে নবদ্বীপের কাজী বৈষ্ণব ভক্তগণের প্রতি কিরূপ অত্যাচার করিয়াছিলেন এবং চৈতন্যদেব যে কাজীর বিরুদ্ধে লড়াই করিয়াই বৈষ্ণবধর্মের একটি প্রধান অঙ্গ হরিনাম সংকীর্তন প্রচলিত করিতে পারিয়াছিলেন, তাহা পূর্বেই বলা হইয়াছে। হোসেন শাহের মন্ত্রী ও পারিষদেরা যে তাঁহার ভয়ে চৈতন্যদেবকে রাজধানী গৌড়ের সান্নিধ্য ত্যাগ করিয়া যাইতে বাধ্য করিয়াছিলেন, তাহারও উল্লেখ করা হইয়াছে। আর ইহাও বিশেষভাবে স্মরণ রাখিতে হইবে যে শ্রীচৈতন্যদেব দীক্ষার পরে চব্বিশ বৎসর (১৫১০৩৩ খ্ৰী) জীবিত ছিলেন —  ইহার মধ্যে সর্বসাকুল্যে পুরা একটি বছরও তিনি হোসেন শাহী রাজ্যে অর্থাৎ বাংলাদেশে কাটান নাই। তাঁহার পরম ভক্ত ও হোসেন শাহের পরম শত্রু উড়িষ্যার পরাক্রান্ত স্বাধীন রাজা প্রতাপরুদ্রের আশ্রয়েই তিনি অবশিষ্ট জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটাইয়াছেন।

এই সমুদয় মনে রাখিলে সহজেই বুঝিতে পারা যাইবে যে অধ্যাপক হাবিবুল্লাহর উক্তি এত অসার ও ভিত্তিহীন যে আলোচনার যোগ্য নয়।[35]

বিকৃত ইতিহাস রচনার তৃতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হল, বঙ্গের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে হিন্দু অবদানকে যথাসম্ভব অস্বীকার অথবা হীন প্রতিপন্ন করা, এবং মুসলিম অবদানের প্রাধান্যকে প্রতিষ্ঠা করে বাঙ্গালী মাত্রই বাংলাভাষী মুসলমান এই ধারণাটি বঙ্গে তথা বিশ্বে প্রতিপাদন করা। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালী হিন্দুরা সর্বস্ব খোয়ালেও, নিজের বাঙ্গালী আইডেন্টিটি হারানোর ভয় ছিল না। কিন্তু বাংলাদেশ সৃষ্টির পর সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান সম্প্রদায় আজ বাঙ্গালী হিন্দুর বাঙ্গালীসত্তাকে হরণ করতে উদ্যত, ঠিক যেভাবে কাশ্মীরের সুন্নি মুসলিমরা কাশ্মীরিপরিচয়টি কাশ্মীরি হিন্দুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়েছে।

এর অন্যতম উদাহরণ, মুজিবুর রহমানকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’র আখ্যা দান। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নন, রামমোহন নন রবীন্দ্রনাথ নন, নেতাজি সুভাষ নন  বিগত হাজার বছরের সকল হিন্দু জ্যোতিষ্ককে কলমের এক খোঁচায় ম্লান করে দিয়ে শ্রেষ্ঠত্বে ভূষিত হয়েছেন শেখ মুজিব,[36] মাত্র পাঁচশো বছর পূর্বে যাঁর এক পূর্বপুরুষের বঙ্গে আগমনের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ইসলাম প্রচার!

একটি প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক — সময়সীমাকে “হাজার বছরে” বেঁধে দেবার কারণ কি? সাধারণত মুসলমানদের মধ্যে প্রাকইসলামী যুগের ইতিহাস অস্বীকার করার প্রবণতা অথবা সেই ইতিহাসকে জানার প্রবল অনীহা দেখা যায়, যার আলোচনা আগেই করেছি। বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ও বখতিয়ারের ইতিহাস থেকেই নিজেদের ইতিহাসের সূচনা করে থাকে। সেক্ষেত্রে আটশো বছর (এর অন্তর্গত অবশ্য আড়াইশো বছরের ইংরেজ রাজত্ব) নয় কেন?

অপরদিকে বঙ্গদেশ ও বঙ্গজাতির ইতিহাস অতি প্রাচীন। ঐতরেয় ব্রাহ্মণে পুন্ড্রএবং ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গনামে জনগোষ্ঠীর উল্লেখ আছে। মহাভারতের সভাপর্বে ভীমের দিগ্বিজয় উপলক্ষ্যে পুন্ড্র, বঙ্গ, তাম্রলিপ্ত, কর্বট প্রভৃতি জাতি ও জনপদের নাম পাওয়া যায়। গঙ্গাবিধৌত এই প্রদেশের জাতির পরাক্রমের কথা আলেকজান্ডারের সমসাময়িক ও পরবর্তীকালে গ্রীকরোমান ঐতিহাসিকেরা বলেছেন, যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডিওডোরাস, প্লিনি ও টলেমি। তারপর রয়েছে পুণ্ড্রবর্ধনের ইতিহাস ও তাম্রলিপ্ত বন্দরের বহু শতকের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। আছে বিজয় সিংহের সিংহল অভিযান ও সাম্রাজ্যস্থাপন, গৌড়াধিপ শশাঙ্কের কর্ণসুবর্ণ প্রতিষ্ঠা ও গৌড়বঙ্গের রাজনৈতিক ঐক্যসাধন। তাহলে হাজারে না থেমে বাংলাভাষী মুসলমানরা আরো পিছিয়ে গেল না কেন?

কেউ হয়তো বলবেন, চর্যাপদের আদি কাল দশম শতককে বাঙ্গালী জাতির আদি বিন্দু ধরে এখানে হাজার বছর গণ্য করা হয়েছে। একথা ঠিক, এযাবৎ প্রাচীনতম বাংলা পুঁথির রচনাকাল আনুমানিক দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়। অর্থাৎ, খিলজির আক্রমণ তথা বঙ্গে মুসলমান অস্তিত্বের কিছু পূর্বে। কিন্তু তার অনেক আগেই যে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়নি, বা কোন পুঁথি তৈরির কাজ শুরু হয়নি এমন কথা হলফ করে বলা যায় না। কারণ, বখতিয়ার ও তাঁর উত্তরসূরি হানাদারদের অবিরাম ধ্বংসলীলার কারণে ওই যুগের সাহিত্যকীর্তির কিছুই বঙ্গে আর অবশিষ্ট নেই। আবিষ্কৃত সেই প্রাচীনতম বাংলা পুঁথি বৌদ্ধ চর্যাপদ হরপ্রসাদ শাস্ত্রী নেপাল ভ্রমণকালে পুনরুদ্ধার করেন ১৯০৭ সালে, অর্থাৎ ইংরেজ আমলে। সুতরাং সুনিশ্চিত করে দশম শতককে বাংলা ভাষার আবির্ভাব কাল হিসেবে মান্য করা যায় না।

দ্বিতীয়ত, আমরা ইতিপূর্বেই আলোচনা করেছি যে, জাতিসত্তা গঠনে মুখ্য ভূমিকা ধর্মের, ভাষার নয়, এবং জাতিসত্তার প্রাণভোমরা হল জাতির ইতিহাস চেতনা, যার মধ্যে মিশে আছে ধর্মীয় চেতনা ও পূর্বজদের প্রতি শ্রদ্ধা।  সে কারণবশতঃ বাংলা ভাষার উৎপত্তির বহু পূর্বে জন্ম নেওয়া বিজয় সিংহকে নিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গর্ব করতে পারেন (“একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়“), কিন্তু বঙ্গের মুসলমানরা পারেন না। পরিবর্তে বাংলা না জানা তুর্কি দস্যু বখতিয়ার বা আরবি সন্তান হোসেন শাহ হয়ে ওঠেন বাংলাভাষী মুসলমানদের কাছে অতি আপনজন।

অতএব ভাষা নয়, বাংলাভাষী মুসলমানের এই ‘হাজার বছর” নির্ধারণের কারণ তাঁদের ইতিহাস রচনার প্রধান এজেন্ডা — ইতিহাস থেকে হিন্দুদের যথাসম্ভব মুছে দেবার পাশাপাশি বাংলার মুসলমানদের বৌদ্ধদের উত্তরসূরি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা। আপাত প্রাচীনতম বঙ্গীয় সাহিত্যকীর্তি বৌদ্ধ হলেও ইসলামী সেনাদের হাতে ধ্বংসপ্রাপ্ত কিছু বৌদ্ধবিহার, আর সংখ্যাগরিষ্ঠের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে কোনঠাসা পার্বত্য চট্টগ্রামের অল্প সংখ্যক বৌদ্ধ চাকমা[37] ছাড়া বঙ্গের বৌদ্ধ ঐতিহ্য প্রায় লুপ্ত। তাই বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়কে বৌদ্ধদের সাথে বাঙ্গালী পরিচয়কে ভাগ করে নেবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আছে কয়েক কোটি হিন্দু। আর প্রাচীনতম বাংলা সাহিত্যের নিদর্শন বৌদ্ধ হলেও, বৌদ্ধ পাল রাজত্ব ও ইসলামী শাসনের মধ্যবর্তী কয়েকশবছরের হিন্দু সেন রাজাদের ইতিহাস রয়ে গেছে। এমতাবস্থায় বাঙ্গালীসত্তার দখল নিতে এ হচ্ছে ইতিহাসের পাতা থেকে হিন্দুদের উপস্থিতি বা কৃতিত্বকে পাৰ্জ বা বহিষ্কার করার অপচেষ্টা।

এই অপচেষ্টার অন্তর্গত যেমন শেখ মুজিবকে ‘হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী’ আখ্যায় ভূষিত করা, তেমনি বাংলাদেশের জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড দ্বারা নবম ও দশম শ্রেণীর জন্য প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকে বারোভূঁইয়াদের ইতিহাসে[38] মহারাজা প্রতাপাদিত্যের উপস্থিতি মুছে দেওয়া। মধ্যযুগীয় বঙ্গে মুসলিম শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবার পরেও যে হিন্দু সরলা দেবীর ভাষায়, “politically great ছিলেন, বাঙলার শিবাজী ছিলেন, মোগলবাদশার বিরুদ্ধে একলা খাড়া হয়ে বাঙলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, নিজের নামের সিক্কা চালিয়েছিলেন“,[39] সেই প্রতাপাদিত্যের গৌরবময় ইতিহাস বাংলাদেশের সরকারি ইতিহাসের ভাষ্যকারদের কাছে এক বিড়ম্বনা।

আর একটি উদাহরণ, পর্যাপ্ত প্রমাণের অভাব সত্ত্বেও বঙ্গাব্দ প্রবর্তন করার কৃতিত্ব গৌড়াধিপ শশাঙ্কের পরিবর্তে আকবরকে দেওয়া, এবং পয়লা বৈশাখকে হিন্দুত্ব বর্জিত করে, চিরাচরিত হিন্দুবর্ষ গণনা পদ্ধতিকে অগ্রাহ্য করে একটি নতুন কৃত্রিম পহেলা বৈশাখ‘-এর প্রচলন। অর্থাৎ, বঙ্গাব্দ প্রচলিত থাকবে, কিন্তু প্রচলিত থাকবে না তার হিন্দু পঞ্জিকার গণনা পদ্ধতি, রীতি ও অনুষ্ঠান। ‘বঙ্গাব্দ’ নামটি থাকবে, কিন্তু তার প্রবর্তক হিসাবে শোভা পাবে কোন মোগলপাঠানের নাম!

এত কিছুর পরেও বাকি থাকে একটি কাঁটা — ভাষা।

এমারসন ভাষাকে ইতিহাসের সংরক্ষণাগার হিসেবে অভিহিত করেছিলেন:

Language is the archive of history.

রিতা মে ব্রাউন (Rita Mae Brown) আর একটু বিস্তারিত করে বলেছেন:

Language is the road map of a culture. It tells you where its people come from and where they are going.

অর্থাৎ, ভাষা একটি জাতির সাংস্কৃতিক রোডম্যাপ। সে কোথা থেকে এসেছে, এবং কোথায় সে ধাবমান তার ইঙ্গিত বহন করে ভাষা।

খুব স্বাভাবিকভাবেই উনিশ শতকে মৌলবীরা বাংলাকে হিন্দুর ভাষা অথবা কুফুরি জবানঅর্থাৎ কাফেরের ভাষা বলে ফতোয়া দিয়েছিলেন।“[40] বাংলায় নবচেতনার উত্থানের সময় নিজেদের হিন্দু পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে অস্বীকার করতে চাওয়া বঙ্গের শিক্ষিত মুসলমান সমাজ উর্দু ও আরবী ভাষার প্রতিই অধিক অনুরাগ পোষণ করতেন। বেগম রোকেয়া, ফজলুল হকের পরিবার সহ অনেক অভিজাত মুসলিম পরিবারে উর্দু ছিল মাতৃভাষা। বিশ শতকের গোড়াতেও বাংলার অধিকাংশ মুসলমান বাংলাকে নিজেদের মাতৃভাষা বলে স্বীকার করতেন না। এই সকল কারণে বাঙ্গালী যে হিন্দুই, এই নিয়ে কোন দ্বিমত ছিল না, যার প্রতিফলন ১৯১৭ সালে প্রকাশিত শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের বাঙ্গালী ও মুসলমান ছাত্রদের ‘ফুটবল ম্যাচ্‌’

অতএব ১৯২২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাভাষী মুসলমানরা তার বিরোধিতা করলে, অনেকের মতো ফজলুল হকও প্রতিবাদ করতে এগিয়ে আসেন:

তাঁরই উৎসাহে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম করার বিরুদ্ধে একটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় কলকাতার মুসলিম ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত ছাত্রদের একটি সভায়।[41]

এর পাশাপাশি এক অংশ উর্দুর সপক্ষে দাবি জানাতে থাকে। এই প্রবণতার বৃদ্ধি দেখে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেন:

সম্প্রতি হিন্দুর প্রতি আড়ি করিয়া বাংলাদেশের কয়েকজন মুসলমান বাঙালিমুসলমানের মাতৃভাষা কাড়িয়া লইতে উদ্যত হইয়াছেন। এ যেন ভায়ের প্রতি রাগ করিয়া মাতাকে তাড়াইয়া দিবার প্রস্তাব। বাংলাদেশের শতকরা নিরানব্বইয়ের অধিকসংখ্যক মুসলমানের ভাষা বাংলা। সেই ভাষাটাকে কোণঠেসা করিয়া তাহাদের উপর যদি উর্দু চাপানো হয়, তাহা হইলে তাহাদের জিহ্বার আধখানা কাটিয়া দেওয়ার মতো হইবে না কি।[42]

কিন্তু আর এক সমান্তরাল ধারাও বইছিল সেই উনিশ শতকের শেষের থেকেই। ক্রমবর্ধমান নগরায়ন ও আধুনিকতার প্রভাবে মুসলমান তরুণ সমাজের একটি শিক্ষিত অংশ বাংলাকে মাতৃভাষা রূপে গ্রহণ করতে শুরু করে। বিশের দশকে সেই আন্দোলন বিশেষ দানা বাঁধে ঢাকা অবস্থিত শিখাগোষ্ঠীর হাত ধরে। বাংলাকে শুধু মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করেই নয়, আরো এক ধাপ এগিয়ে, বাংলা ভাষাকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে আইডেন্টিটির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায় তার সম্ভাবনাও দেখলেন প্রথম মুসলিম নারী ঔপন্যাসিক নুরুন্নেচ্ছা খাতুন বিদ্যাবিনোদিনী। বাংলার মুসলমান সমাজকে বোঝাতে প্রয়াসী হলেন যে, বাংলাকে আপন করলে বাংলাভাষী মুসলমানরাই হয়ে উঠবে বাঙ্গালী আইডেন্টিটির প্রধান ধারক ও বাহক:

সর্ব্বক্ষন এই ভাবটা আমাদের অন্তরে পোষণ করতে হবে যে বাঙালি শব্দের উপর আমাদের প্রতিবেশী হিন্দুর যে পরিমাণ অধিকার, তার চেয়ে আমাদের দাবি অনেকাংশে বেশী। অর্থাৎ কিনা প্রকৃত বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে হলে, হিন্দুর চেয়ে আমরাই বরং দু পা এগিয়ে যাব।“[43]

এই উদ্দেশ্যে বঙ্গের মুসলমান সমাজও ক্রমশ হাঁটতে শুরু করে, কিন্তু পন্থা হয় ক্রমাগত আরবীফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে, বাংলা ভাষাকে হিন্দুত্ববর্জিত করে তার ইসলামীকরণ। বাংলা ভাষার এই আরবীফারসি দূষণ নিয়ে প্রবাসী পত্রিকার ১৩৩৯ সালের বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয় রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের মক্তবমাদ্রাসার বাংলা ভাষা। এই প্রবন্ধটি পাঠ করে চিন্তিত রবীন্দ্রনাথ ওই পত্রিকার ভাদ্র সংখ্যায় লেখেন:

ভাষা মাত্রের মধ্যে একটা প্রাণধর্ম আছে। তার সেই প্রাণের নিয়ম রক্ষা করে তবেই লেখকেরা তাকে নূতন পথে চালিত করতে পারে। […]

এমন কোনো সভ্য ভাষা নেই যে নানা জাতির সঙ্গে নানা ব্যবহারের ফলে বিদেশী শব্দ কিছুনাকিছু আত্মসাৎ করে নি। বহুকাল মুসলমানের সংস্রবে থাকাতে বাংলা ভাষাও অনেক পারসী শব্দ এবং কিছু কিছু আরবীও স্বভাবতই গ্রহণ করেছে। বস্তুত বাংলা ভাষা যে বাঙালি হিন্দুমুসলমান উভয়েরই আপন তার স্বাভাবিক প্রমাণ ভাষার মধ্যে প্রচুর রয়েছে। […] এই শব্দগুলো যে এত জোর পেয়েছে তার কারণ বাংলা ভাষার প্রাণের সঙ্গে এদের সহজে যোগ হয়েছে।

শিশুপাঠ্য বাংলা কেতাবে গায়ের জোরে আরবীআনা পারসীআনা করাটাকেই আচারনিষ্ঠ মুসলমান যদি সাধুতা বলে জ্ঞান করেন তবে ইংরেজি স্কুলপাঠ্যের ভাষাকেও মাঝে মাঝে পারসী বা আরবী ছিটিয়ে শোধন না করেন কেন? […] ইংরেজের অসন্তুষ্টিই তার একমাত্র কারণ নয়। শিক্ষক জানেন পাঠ্যপুস্তকে ইংরেজিকে বিকৃতি করার অভ্যাসকে প্রশ্রয় দিলে ছাত্রদের ইংরেজি শিক্ষায় গলদ ঘটবে, তারা ঐ ভাষা সম্যকরূপে ব্যবহার করতে পারবে না। […] সেই একই কারণে ছাত্রদের নিজের খাতিরেই বাংলাটাকে খাঁটি বাংলারূপে বজায় রেখেই তাদের শেখানো দরকার। মৌলবী ছাহাব বলতে পারেন আমরা ঘরে যে বাংলা বলি সেটা ফারসী আরবী জড়ানো, সেইটাকেই মুসলমান ছেলেদের বাংলা বলে আমরা চালাব। আধুনিক ইংরেজি ভাষায় যাঁদের অ্যাংলোইণ্ডিয়ান বলে, তাঁরা ঘরে যে ইংরেজি বলেন, সকলেই জানেন সেটা আন্‌ডিফাইল্‌ড আদর্শ ইংরেজি নয়স্বসম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতবশত তাঁরা যদি বলেন যে, তাঁদের ছেলেদের জন্যে সেই অ্যাংলোইণ্ডিয়ানী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা না করলে তাঁদের অসম্মান হবে, তবে সে কথাটা বিনা হাস্যে গম্ভীরভাবে নেওয়া চলবে না। বরঞ্চ এই ইংরেজি তাঁদের ছেলেদের জন্যে প্রবর্তন করলে সেইটেতেই তাঁদের অসম্মান এই কথাটাই তাঁদের অবশ্য বোঝানো দরকার হবে।[44]

রবীন্দ্রনাথের এহেন সমালোচনার জবাবে এক বাংলাভাষী মুসলমান পাঠক বাংলার মুসলমানদের অবস্থানকে সমর্থন করে পত্রিকার সম্পাদককে এক পত্রে লেখেন:

বাংলার মুসলমান যেদিন হতে বুঝতে পেরেছে বাংলা তার নিজের ভাষা সেদিন হ’তে সে তার ভাষায় নিজেদের হামেশা বোলচালের একএকটা শব্দ ক্রমশঃ এ্যাবজরব করে নিচ্ছে।“[45]

রবীন্দ্রনাথের প্রত্যুত্তরে ফুটে উঠেছিল বিরক্তি:

আজকের বাংলা ভাষা যদি বাঙালী মুসলমানদের ভাব সুস্পষ্টরূপে ও সহজভাবে প্রকাশ করতে অক্ষম হয়, তবে তাঁরা বাংলা পরিত্যাগ করে উর্দ্দু গ্রহণ করতে পারেন। সেটা বাঙালী জাতির পক্ষে যতই দুঃখকর হোক না, বাংলা ভাষার মূল স্বরূপকে দুর্ব্যবহারের দ্বারা নিপীড়িত করলে সেটা আরো বেশি শোচনীয় হবে। […]

বাংলা ভাষায় সহজেই হাজার হাজার পার্সি আরবি শব্দ চলে গেছে। তার মধ্যে আড়াআড়ি বা কৃত্রিম জেদের কোন লক্ষণ নেই। কিন্তু যেসব পার্সি আরবি শব্দ সাধারণ্যে অপ্রচলিত, অথবা হয়ত কোনো এক শ্রেণীর মধ্যে বদ্ধ, তাকে বাংলা ভাষার মধ্যে প্রক্ষেপ করাকে জবরদস্তি বলতেই হবে। হত্যা অর্থে খুন ব্যবহার করলে বেখাপ হয় না; বাংলার সৰ্ব্বজনের ভাষায় সেটা বেমালুম চলে গেছে। কিন্তু রক্ত অর্থে খুন চলে নি, তা নিয়ে তর্ক করা নিষ্ফল।[46]

বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে বাংলা ভাষারএই ইসলামীকরণের প্রেরণার অন্যতম উৎস ছিল মধ্যযুগের আরবী, ফারসি, ও তুর্কি ভাষার বিপুল মিশ্রণে সৃষ্ট মুসলিম পুঁথি সাহিত্য। মধ্যযুগে বঙ্গে রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ইসলামীয় শাসকদের হাতে থাকলেও, তাঁদের বাংলা ভাষা অথবা বঙ্গীয় সংস্কৃতির সাথে কোন বিশেষ সম্পর্ক ছিল না; সাংস্কৃতিক জগতে ছিল হিন্দু আধিপত্য। এরই প্রতিক্রিয়ায় বাংলাভাষী মুসলমান পাঠককে উদ্দেশ্য করে এই মুসলমানি পুঁথি সাহিত্যের আবির্ভাব। কিন্তু নবাব রাজত্বের অবসান ও ইংরেজ আধিপত্যের সূচনার ফলে উনিশ শতকে এই  মিশ্রভাষী সাহিত্যের ধারা স্তব্ধ হয়ে যায়।

এই বিজাতীয় ভাষার মিশ্রনের কারণ ব্যাখ্যা করেছেন বাংলাদেশের, বা বলা ভাল, বাংলাভাষী মুসলমানের জাতিসত্তার নির্মাণ ও পরিচয় নিয়ে যিনি ছিলেন সর্বদাই ভাবিত, সেই প্রখ্যাত সাহিত্যিক ও চিন্তাবিদ আহমদ ছফা, তাঁর বিখ্যাত ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ প্রবন্ধে:

এই পুঁথিসমূহের দোভাষী অর্থাৎ বাংলা এবং আরবীফার্সী মিশ্রিত হওয়ার পেছনে একটি অত্যন্ত দূরবর্তী ঐতিহাসিক কারণ বর্তমান। হাদীসে তিনটি কারণে অন্যান্য ভাষার চাইতে আরবীকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। প্রথম হলো কোরআনের ভাষা আরবী, দ্বিতীয় কারণ বেহেশতের অধিবাসীদের ভাষা আরবী এবং তৃতীয়ত হজরত মুহম্মদ নিজে একজন আরবীভাষী ছিলেন। এই তিনটি মুখ্য কারণে যে সমস্ত দেশে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে, সেখানে অপ্রতিরোধ্যভাবে এই ভাষাটিরও অনুপ্রবেশ ঘটেছে। আরব অধিকারের পূর্বে মিশর এবং আফ্রিকার দেশসমূহের নিজস্ব ভাষা এবং বর্ণমালা দুইই ছিল। কিন্তু আরব অধিকারে আসার পর আরবী ভাষা এবং বর্ণমালা দুইটিকেই অধিবাসীদের গ্রহণ করতে হয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবী ভাষা এবং ইসলাম অনেকটা অভিন্নার্থক ছিল। আরবী ভাষাকে গ্রহণ না করে ইসলাম গ্রহণ করলে প্রকৃত মুসলমান হওয়া যাবে না, সে সময় এরকম একটা প্রবল মত অতিমাত্রায় সক্রিয় ছিল। অন্য যেকোনো সেমিটিক ধর্মের মতো ইসলামেও পরলৌকিক জীবনের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সারাজীবন মুসলমান হিসেবে জীবন কাটিয়ে পরকালে বেহেশতে যেয়েও ভাষাজ্ঞানের অভাবে একঘরে জীবন কাটাতে হবে এটা ধর্মপ্রাণ মুসলমান মত্রেরই সহ্যের অতীত একটা ব্যাপার। তাই মিশর থেকে শুরু করে মরক্কো পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের অধিবাসীরা আরবী ভাষা এবং বর্ণমালা দুটিই গ্রহণ করেছিল। […]

বাঙালী মুসলমানের চোখে ফার্সী এবং উর্দু দুটো আরবীর মতোই পবিত্র ছিল। আর এ দুটো রাজভাষা এবং শাসক নেতৃশ্রেণীর ভাষা হওয়ায়, তাদের শ্রদ্ধা নিশ্চয়ই অনেকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। কিন্তু এ দুটির একটিকেও পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করার জন্য একটি সমাজের পেছনে যে শক্ত আর্থিক ভিত্তি এবং সাংস্কৃতিক বুনিয়াদ থাকা প্রয়োজন ছিল দুটির কোনোটিই তাঁদের ছিল না। […] কিন্তু বাঙালী মুসলমানেরা নিজেদের সামর্থ্য অনুসারে আরবী, ফার্সী এবং উর্দু এই তিনটা ভাষার তালিম গ্রহণ করার প্রাণান্তকর প্রয়াস চালিয়ে গেছেন। আরবী, ফার্সী এবং উর্দু ভাষাটাও যখন তাঁদের পক্ষে পরিপূর্ণভাবে রপ্ত করা অসম্ভব মনে হয়েছে তখন ঐ বর্ণমালাতে বাংলা লেখার চেষ্টা করেছেন। এখানে একটা কথা পরিষ্কার করে নেয়ার আছে, কোনো ব্যক্তি বিশেষ একটা ভাষা রপ্ত করতে পারেন, কিন্তু সেটা সামাজিকভাবে রপ্ত করা বলা চলে না। ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকেও আরবী হরফে বাংলা পুঁথিপত্র যে লেখা হয়েছে সেটাকে ক’জন অবসরভোগী পুঁথিলেখকের নিছক খেয়াল মনে করলে ভুল করা হবে। আসলে তা ছিল বেহেশতের ভাষার প্রতি কৃতজ্ঞতা নিবেদনের অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণ মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ। যখন দেখা গেল আরবী হরফে বাংলা লিখেও সমাজে চালু করা যায় না তখন পুঁথিলেখকেরা সবান্ধবে পরবর্তী পন্থাটা অনুসরণ করতে থাকলেন। বাংলা ভাষার সঙ্গে এন্তার আরবীফার্সী শব্দ মিশেল দিয়ে কাব্য রচনা করতে আরম্ভ করলেন। জনগণ তাঁদের এই ভাষাটিকে গ্রহণও করেছিলেন। কিন্তু কোন্‌ জনগণ? এঁরা ছিলেন সেই জনগণ, সংস্কৃত ভাষা যাঁদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল, আরবী অজানা, ফার্সীর নাম শুনেছেন এবং উর্দু ভাষা কানে শুনেছেন মাত্র।

উনিশ শতকে পুঁথি সাহিত্যের অবসান ঘটলেও, বিশ শতকের গোড়ায় মুসলমানি সাহিত্যের পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজ শুরু হয়। বাংলা সাহিত্যে বাঙ্গালী হিন্দুর আধিপত্যে শঙ্কিত ইসলাম মিশন সমিতি‘-র জনক মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী মিশনের কর্মধারাকে আরো বৃহত্তর রূপ দিতে ১৯১১ সালে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোজাম্মেল হক ও অন্যান্যদের নিয়ে স্থাপন করেন ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’। ইসলামী গ্রন্থ, আরবীফারসিউর্দু সাহিত্যের বাংলা অনুবাদের পাশাপাশি এই সমিতির অন্যতম লক্ষ্য ছিল মুসলমান সাহিত্য ও সাহিত্যিকদের পৃষ্টপোষকতা করা। পরবর্তীকালে মোহাম্মদ আকরম খাঁ সমিতিতে যোগ দিলে দোভাষী বা মুসলমানি বাংলার দাবি নতুন করে গতি লাভ করে।[47]

১৯৪০ সালে ‘লাহোর প্রস্তাবগ্রহণের পর বাংলা ভাষার আরবীকরণের এই আন্দোলনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, কবি গোলাম মোস্তফা, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী ও অন্যান্যরা বাংলা ভাষার ভেতরে আরবীফারসিউর্দু শব্দের ব্যাপক প্রয়োগের মাধ্যমে ইসলামিকরণের প্রয়াস শুরু করেন। দৈনিক আজাদসম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন দ্বারা ‘পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটিগঠনের মাধ্যমে এই আন্দোলন সংগঠিত রূপ লাভ করে। সোসাইটির এই ভাবধারা প্রচারে এগিয়ে আসে মোহাম্মদ আকরম খাঁর দৈনিক আজাদ‘, ‘মাসিক মোহাম্মদীসহ অনেক মুসলিম পত্রিকা। ১৯৪৪র ৫ই মে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটির প্রথম সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে আবুল মনসুর আহমদ বিংশ শতকের আধুনিক বাংলা সাহিত্য হতে পৃথক, বাংলাভাষী মুসলিম জাতিসত্তার উপযোগী এক স্বতন্ত্র পূর্বপাকিস্তানী সাহিত্যের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন:

রাজনীতিকের বিচারে ‘পাকিস্তানের’ অর্থ যাই হোক না কেন, সাহিত্যিকের কাছে তাঁর অর্থ তমদ্দুনী আজাদী, সাংস্কৃতিক স্বরাজ, কালচার‍্যাল অটনমী। রাজনৈতিক আযাদী ছাড়া কোনো জাতি বাঁচতে পারে কিনা, সে প্রশ্নের জাবার পাবেন আপনারা রাষ্ট্র নেতাদের কাছে। আমরা সাহিত্যিকরা শুধু এই কথাটাই বলতে পারি যে, তমদ্দুনী আযাদী ছাড়া কোনো সাহিত্য— বাঁচাতো পরের কথা— জন্মাতেই পারে না। […]

এ কথা মানি যে, হিন্দুর সংস্কৃতিতে ও মুসলমানের তমুদ্দুনে এক শএকটা মিল রয়েছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে যে, তাদের মধ্যে গরমিলও রয়েছে প্রচুর। […] জীবেজীবে, জাতিতেজাতিতে, এমনকি ব্যক্তিতেব্যক্তিতেও মিলটা সত্য নয়, গরমিলটাই সত্য। কারণ ঐটাই সত্তা। ঐটুকু দিয়েই এককে অন্য থেকে আলাদা করে চেনা যায়। […] মানুষে পশুতেও গরমিলের চেয়ে মিলের সংখ্যাই কি বেশি নয়? তবু ওই গরমিল টুকুকেই আমরা মানুষের বৈশিষ্ট্য বলে গর্ব করে থাকি। […]

[রেনেসাঁর মতো] পাকিস্তানও একটা বিপ্লব। এ বিপ্লব আনতে হলে সাহিত্যের ভেতর দিয়েই তা করতে হবে। কিন্তু কোথায় পাকিস্তানের সাহিত্য? […] পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলা ও আসামের সাহিত্য বলতে আমরা যা বুঝি, তা বিদ্যাসাগরবঙ্কিমচন্দ্র থেকে রবীন্দ্রশরৎচন্দ্র যুগের সাহিত্যিকদের সাহিত্য। এটা খুবই উন্নত সাহিত্য। বিশেষতঃ রবীন্দ্রনাথ এসাহিত্যকে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে স্থান দিয়ে গিয়েছিলেন।

তবুও এসাহিত্যে পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য নয়। […] এ সাহিত্যে মুলমানদের উল্লেখযোগ্য কোন দান নেই শুধু তা নয়, মুসলমানদের প্রতিও এ সাহিত্যের কোনো দান নেই। অর্থাৎ এ সাহিত্য থেকে মুসলিম সমাজ প্রাণপ্রেরণা পায় নি এবং পাচ্ছে না। এর কারণ আছে। সে কারণ এই যে, সাহিত্যের স্রষ্টাও মুসলমান নয়; এর বিষয়বস্তুও মুসলমান নয়। এর স্পিরিট ও মুসলমানী নয়; এর ভাষাও মুসলমানের ভাষা নয়।

প্রথমত এসাহিত্যের স্পিরিটের কথাই ধরা যাক। এ সাহিত্য হিন্দুমনীষীর সৃষ্টি। সুতরাং স্বভাবতই হিন্দু সংস্কৃতিকে বুনিয়াদ করেই তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। ঠিকই করেছেন তাঁরা। নইলে ওটা জীবন্ত সাহিত্য হতো না। […]

কিন্তু সত্য কথা এই যে, ঐ সাহিত্যকে মুসলমানেরা তাদের সাহিত্য মনে করে না। কারণ, ত্যাগ বৈরাগ্য ভক্তিপ্রেম যতই উঁচুদরের আদর্শ হোক, মুসলমানের জীবনাদর্শ তা নয়। হিন্দুর ধর্ম যেমন ত্যাগ, বৈরাগ্য ও মুনিঋষির ধর্ম, মুসলমানের ধর্ম তেমনি হকইনসাফ ও জেহাদশহীদের ধর্ম। […]

সাহিত্যের স্পিরিট সম্মন্ধে যা বলেছি, বিষয়বস্তু সম্মন্ধেও তাই বলতে হয়। সাহিত্যের নায়কনায়িকা যদি আমরা না হলাম, সাহিত্যের পটভূমি যদি আমার কর্মভূমি না হলো, সাহিত্যের বাণী যদি আমার মর্মবানী না হলো, তবে সে সাহিত্য আমার সাহিত্য হয় কি রূপে? আমার ঐতিহ্য, আমার ইতিহাস, আমার কিম্বদন্তী এবং আমার উপকথা যে সাহিত্যের উৎস নয়, সেসাহিত্য আমার জীবনউৎস হবে কেমন করে? […]

বস্তুত, বাংলার মুসলমানের যেমন একটা নিজস্ব সংস্কৃতি আছে, তেমনি তাদের একটা নিজস্ব সাহিত্যও আছে। সে সাহিত্যের নাম মুসলমানী বাংলা সাহিত্য বা পুঁথি সাহিত্য। […] পূর্বপাকিস্তানের সাহিত্যিক রেনেসাঁ আসবে এই পুঁথি সাহিত্যের বুনিয়াদে। […]

আজকার তথাকথিত জাতীয় সাহিত্যে বাংলার মেজরিটি মুসলমানের জীবনই যে শুধু বাদ পড়েছে তা নয়, তার মুখের ভাষাও সে সাহিত্যে অপাংক্তেয় রয়েছে। মুসলমানদের আল্লাখোদা, রোযানামায, হজ্জযাকাত, ইবাদাৎবন্দেগি, অযুগোসল, খানাপিনা সমস্তই বাঙলা সাহিত্যের দিকপাল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তাদের কাছে বিদেশী ভাষা। এ যুলুমবাজির মধ্যে কোনো জাতির সাহিত্য গড়ে উঠতে পারে না। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য রচিত হবে পূর্ব পাকিস্তানীদের মুখের ভাষায়। সে ভাষা সংস্কৃত ব্যাকরণের বা তথাকথিত বাংলা ব্যাকরণের কোনো তোয়াক্কা রাখবে না।[48]

মনসুর আহমদের ভাষণটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিল ও সম্মিলনীতেই কয়েক হাজার কপি বিক্রি হয়। প্রথম সম্মেলনের প্রতিষ্ঠাতাসভাপতি আবুল কালাম শামসুদ্দীন ও আহমদের ভাষণ দু’টি পরে ফলাও করে প্রকাশ করে ‘মাসিক মোহাম্মদী’ তাদের শ্রাবণভাদ্র সংখ্যায়।

বাহান্নর তথাকথিত ভাষা আন্দোলনের পরেও এই মুসলমানি বাংলারগ্রহণযোগ্যতা কিছুমাত্র হ্রাস পায়নি। ১৯৫৮র ৩রা মে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত পূর্বপাক সাহিত্য সম্মিলনীর কালচার ও ভাষ্য শাখার সভাপতিরূপে আমন্ত্রিত হয়ে মনসুর আহমদ আমাদের ভাষাশীর্ষক ভাষণে বলেন:

অবিভক্ত বাংলায় বাংলা সাহিত্যের সকল ক্ষেত্রে প্রাধান্য ছিল হিন্দুদের। তার মানে বাংলা সাহিত্য ছিল মূলত এবং প্রধানত হিন্দু কালচারের বাহক। সে সাহিত্য বাংলার মুসলিম কালচারের বাহক তো ছিলই না বরঞ্চ তার প্রতি বিরূপ ছিল। সুতরাং সে সাহিত্যে গোটাকতক মুসলমানী শব্দ ঢুকাইয়া দিলেই তা মুসলিম কালচারের বাহক সাহিত্য হইয়া যাইত না। রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রের ভাল ভাল বইয়ের হিন্দু চরিত্রগুলির জায়গায় মুসলমান নাম বসাইয়া দিলেই ওগুলি মুসলিম চরিত্র হইয়া যাইবে না। তাতে মুসলিম সাহিত্যও হইবে না। বরং রবীন্দ্রশরৎচন্দ্রের সৃষ্টিপ্রতিভার তাতে অপমানই করা হইবে।

পক্ষান্তরে ‘বাংগাল’ বা ‘মুসলমান’ বলিয়া নিজেদের বাপদাদার আমলের মুখের নফ্্যগুলি বাদ দিলেই আমরা ‘আধুনিক’ ও ‘প্রগতিশীল’ হইয়া যাইব না। গোশতের বদলে ‘মাংস’, আণ্ডার বদলে ‘ডিম’, জনাবের বদলে ‘সুধী’, আরযের বদলে ‘নিবেদন’, তসলিমবাদ এর বদলে ‘সবিনয়’, দাওয়াতনামার বদলে ‘নিমন্ত্রণ পত্র’, ‘শাদি মোবারকের’ বদলে ‘শুভ বিবাহ’ ব্যবহার করিলেই আমরা ‘সভ্য’ ‘কৃষ্টিবান’ ও ‘সুধী বিদগ্ধ’ হইলাম, নইলে হইলাম না, এমন ধারণা হীনমন্যতার পরিচায়ক। কৃষ্টিক চেতনা ও রেনেসাঁর জন্য এটা অশুভ ইংগিত। […]

গোশত, আণ্ডা ও পানির মধ্যে ‘ইসলামত্ব’ নাই বটে। কিন্তু ‘মুসলমানত্ব’ আছে। […] আমরা যদি ‘পানি’ ছাড়িয়া ‘জল’ ধরি তবে আমরা ধর্মচ্যুত হইব না সত্য কিন্তু ঐতিহ্যচ্যুত হইব নিশ্চয়ই। এর পরিণাম ও প্রতিক্রিয়া সুদূরপ্রসারী হইবে। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্ররা তা সহজেই বুঝিতে পারিবেন।[49]

সুতরাং, “মুসলমানত্ব” বজায় রাখতে, তার শিকড় আরো গভীরে প্রোথিত করতে ‘মুসলমানি বাংলা’র এই অভিযান স্বাধীন বাংলাদেশে আজও থেমে নেই — বাংলা ভাষায় আরবীফারসি শব্দের অনুপ্রবেশ ঘটছে নিরন্তর। আসলে বাংলাভাষী মুসলমানরা যাই দাবি করুক, তারা জানে এবং বিশ্বাসও করে, বাংলা ভাষা হিন্দুর ভাষা, এই ভাষা ‘পৌত্তলিক’ হিন্দুদের সংস্কৃতি, দর্শন এবং জীবন বোধের ধারক ও বাহক। যে ‘সাংস্কৃতিক স্বরাজ, কালচার‍্যাল অটনমী’র দাবি আবুল মনসুর আহমদ তুলেছিলেন, দেশজ সাংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত হয়ে আরব সাংস্কৃতিক সাম্রাজ্যবাদের কাছে আত্মসমর্পনের মুহূর্তেই সেই ‘অটনমী’ বাংলাভাষী মুসলমান হারিয়ে বসেছে। এ প্রসঙ্গে হুমায়ুন আজাদের অভিমত প্রণিধানযোগ্য:

মুসলমানের মুক্তি ঘটেনি। কারণ তারা অতীত ও তাদের মহাপুরুষদের সম্পর্কে কোনও সত্যনিষ্ঠ আলোচনা করতে দেয় না।[50]

আসলে আরবের ধর্মীয় সত্তাই যাদের কাছে সবার উপরে, নিজেদের নামে, ধামে আর প্রতিদিনকার আচারব্যবহারে সেই সত্তাকে বহন করে চলতে চায় যারা, দেশজ ‘পৌত্তলিকতা’ যাদের কাছে ‘শির্ক’ (মহাপাপ), বঙ্গের সেই মুসলিম উম্মাহর কাছে তাই পৌত্তলিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক বাংলা ভাষার ব্যাপক ইসলামিকরণ ছাড়া নিজেদের ‘মুসলমানত্ব’ রক্ষার আর কোন উপায় নেই।

এই উদ্দেশ্যে ক্রমাগত তৎসম তদ্ভব প্রভৃতি শব্দকে সরিয়ে আরবীফারসি শব্দ বাংলা অক্ষরে লিখে বাংলা ভাষার মাধুর্য সম্পূর্ণরূপে বিনাশ করতে আজ তারা উদ্যত। পঞ্চাশের দশকে ডঃ শহীদুল্লাহ তাঁর বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত গ্রন্থে আরবী, ফারসি ও তুর্কি শব্দের সংখ্যা দুই হাজারের বেশি বলে নির্ধারণ করেছিলেন, আর পাকিস্তান গঠনের প্রায় দুই দশক পর, ষাটের দশকে ডঃ হিলালী তাঁর Perso-Arabic Elements in Bengali গ্রন্থে আরবী ও ফারসিজাত সংখ্যা নির্ণয় করেছিলেন ৫১৮৬টি।[51] কিন্তু বাংলাদেশ স্থাপনের প্রায় অর্ধশতক পরে বাংলাদেশের বাংলা ভাষায় প্রবিষ্ট আরবীফারসি শব্দের বাহুল্য হেতু ২০১৫ সালে ঢাকার বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে মোহাম্মদ হারুন রশিদ দ্বারা সংকলিত ও সম্পাদিত বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান। বিপুল চাহিদার ফলে মাত্র তিন বছরে বইটির হয়েছে দুবার পুনর্মুদ্রণ। এখানে আছে প্রায় নয় হাজার শব্দ, যদিও সংকলক গ্রন্থের ভূমিকায় স্বীকার করেছেন, প্রকৃত সংখ্যা এর থেকে আরো বেশি। অর্থাৎ, ভাষা ও সংস্কৃতির আরবীকরণের মাধ্যমে আবুল মনসুর আহমদের অভীপ্সিত বাংলাভাষী মুসলমানের “তমদ্দুনী আজাদী”র অভিযান আজ বাংলাদেশে তীব্রগতিতে ছুটে চলেছে!

ভাষার এই বিকৃতির পাশাপাশি ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা (সমগ্র বঙ্গের মুসলমান জনসংখ্যা প্রায় সত্তর শতাংশ) ও স্বতন্ত্র বাংলাভাষী মুসলিম রাষ্ট্রের পরিচয়কে কাজে লাগিয়ে বহির্বিশ্বে এক নব্য বাঙ্গালী আইডেন্টিটি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস চলছে, যেখানে বাঙ্গালী বলতেই মানুষ বুঝবে বাংলাভাষী মুসলমান ও তার সংস্কৃতি, যে ধারণা বাংলাদেশে ইতোমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত।

হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি গ্রন্থের লেখক, বিশিষ্ট প্রবাসী বাংলাদেশী বুদ্ধিজীবী গোলাম মুরশিদ বাংলাদেশে বাঙ্গালী আইডেন্টিটির এই বিবর্তনের ধারাটি আলোচনা করেছেন একটি নিবন্ধে:

একটা সময় ছিল যখন, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে, ‘বাঙালি’ বললে বোঝাত শুধু বাংলাভাষী হিন্দুদের। ‘বাঙালি’ ও ‘মুসলমান’ শব্দ দুটির অর্থ ছিল হিন্দু আর মুসলমান। এই পরিচিতি সম্পর্কে মুসলমানদেরও বিশেষ কোনো আপত্তি ছিল না। কারণ, শিক্ষিত মুসলমানরা তখন অনেকেই মনে করত যে তাদের স্বদেশভূমি সুদূর মধ্যপ্রাচ্য অথবা উত্তর ভারত এবং তাদের মাতৃভাষা ফারসি অথবা নিদেনপক্ষে উর্দু। বাংলাকে যারা মাতৃভাষা বলে বিবেচনা করত, তারা বলত এবং মক্তবে শিখত ‘মুসলমানি বাংলা’। কিন্তু বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করতে গিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মুসলমানরা ধীরে ধীরে নিজেদের শনাক্ত করে বাঙালি বলে। […]

কিন্তু [বাংলাদেশ] স্বাধীনতা লাভের আগেকার এবং তার পরবর্তী কালের ‘বাঙালি’ শব্দের অভিধা এক নয়। স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় যে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনা দানা বাঁধছিল, স্বাধীনতা লাভের পর সেই অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনায় ফাটল ধরে। যে দেশের জনসংখ্যার শতকরা আশি ভাগের বেশি মুসলমান এবং যে মুসলমানরা ১৯৪৭ সালে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে যোগ দিয়েছিল পাকিস্তানে, তারা মনেপ্রাণে অসাম্প্রদায়িক হয়নি কখনোই। […] স্বাধীনতা লাভের পরে তাদের সেই স্বল্পকালের জন্য ধার করা পালকটি খসে পড়তে খুব দেরি হলো না। […] বরং অসাম্প্রদায়িক বাঙালি পরিচয়ের জায়গায় জোরেশোরে ফিরে এল জাতি হিসেবে তাদের ধর্মীয় পরিচয়। […]

কিন্তু যা কৌতূহলোদ্দীপক, তা হলো: বাংলাদেশে নতুন করে যে মুসলিম পরিচয় দেখা দিল, তা খাঁটি হলেও, মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত তারা যে ভাষাভিত্তিক ‘বাঙালি’ পরিচয় অর্জন করেছিল, সেই পরিচয়কেও তারা বিসর্জন দিতে পারল না। বরং বাঙালিত্বের নতুন সংজ্ঞা দিয়ে তাকে আঁকড়ে রাখল। কেবল তাই নয়, নিজেদের সেই নব্যবাঙালিত্বের বলয় থেকে অমুসলমানদের বহিষ্কার করার একটা প্রবণতাও তাদের মধ্যে লক্ষ করা গেল। এবং এই নতুন সংজ্ঞায়িত ‘বাঙালিত্ব’ অচিরেই তাদের কাছে ‘বাংলাভাষী মুসলমানত্বে’ পরিণত হলো। এভাবে কয়েক বছরের মধ্যে বাঙালিত্বের অভিধা এক প্রান্ত থেকে একেবারে উল্টো প্রান্তে পৌঁছে গেল। কয়েক দশক আগেও যা ছিল ‘হিন্দু বাঙালিত্ব’, তাই ‘মুসলমান বাঙালিত্বে’ পরিণত হলো।[52]

সেই নব্যবাঙালিত্বের বলয় থেকে অমুসলমানদের বহিষ্কার করারপ্রবণতার একটা উদাহরণ ভাসানীর সাপ্তাহিক হককথা থেকে:

[সাম্প্রদায়িক] সংঘাতটা একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতে। তা হল, মুসলমানরা সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বাঙ্গালী হতে পেরেছেন। কিন্তু হিন্দুরা হিন্দুবাঙ্গালীরয়েছেন।[53]

এই ‘মুসলমান বাঙালিত্ব’র মাপকাঠিতে রবীন্দ্রনাথও যথার্থ বাঙ্গালী নন কেননা বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথের বিশ্ব ভারতীয় আকাশে কতবার শরতের চন্দ্রোদয় হয়েছে, তাতে শারদীয়া পূজায় আনন্দময়ী মাকতবার এসেছে গিয়েছে, কিন্তু একদিনের তরেও সে বিশ্বের আকাশে ঈদমোহরমের চাঁদ ওঠেনি।“[54]

সুতরাং বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই আজ বাংলাদেশের আত্মার (ethos) সঙ্গে হিন্দুয়ানির পরিচয় বহন করা কবিগুরুর আমার সোনার বাংলার সামঞ্জস্য খুঁজে পান না। বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের দাবিও তাই ক্রমশ জোরালো হচ্ছে।[55]

(ক্রমশঃ) 

পাদটীকা

[1] রফিউদ্দিন আহমেদের (Rafiuddin Ahmed) The Bengal Muslims, 1871-1906: A Quest for Identity দেখুন

[2] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘নেশন কী‘, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৫০, পৃ. ৫১৭

[3] ফরাসি, রুশী, সার্ব, হুঙ্গারীয় প্রভৃতি ইয়রোপীয় জাতিদের জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রসত্তা সমার্থক। বাংলাভাষী মুসলমানদেরও জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রসত্তা এক, তাই পূর্ব পাকিস্তান গঠন হবার পর বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ছিল অনিবার্য। বাঙ্গালী, অর্থাৎ বাঙ্গালী হিন্দুর জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রসত্তা কিন্তু ভিন্ন। বাংলাভাষী মুসলমানের এই দুই সত্তার অভিন্নতা এবং আমাদের দুই সত্তার পার্থক্যের কারণ বিশ্লেষণ দীর্ঘ আলোচনা সাপেক্ষ।

[4] Yuval Noah Harari, Sapiens: A Brief History of Humankind, Penguin Random House, 2015, pp. 27

প্রসঙ্গত বলে রাখা প্রয়োজন, জৈবিক বিবর্তনের ফলে শুধু কল্পনাশক্তির বিকাশ নয়, অতীন্দ্রিয় জগতের দ্বারও মানুষের কাছে উন্মোচিত হয়েছে। গড়ে উঠেছে গুহ্যবিদ্যা, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তান্ত্রিক ও যৌগিক পরম্পরা। তাই ধর্মের সবকিছুকে কল্পনাবিলাসিতা অথবা সকল আধ্যাত্মিক অনুভূতিকে অলীক (hallucination) ভাবলে ভুল হবে।

[5] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘নেশন কী‘, রবীন্দ্ররচনাবলী, ৩য় খণ্ড, বিশ্বভারতী, ১৯৫০, পৃ. ৫১৮:

জনসম্প্রদায় বলিতে যে পবিত্র পদার্থকে বুঝি, মনুষ্যই তাহার শ্রেষ্ঠ উপকরণ। সুগভীর ঐতিহাসিক মন্থনজাত নেশন একটি মানসিক পদার্থ, তাহা একটি মানসিক পরিবার, তাহা ভূখণ্ডের আকৃতির দ্বারা আবদ্ধ নহে।

[6] বেনেডিক্ট এন্ডারসনের (Bendedict Anderson) Imagined Communities দেখুন।

[7] Yuval Noah Harari, পূর্বোক্ত, pp. 27-28

[8] এই দুই ধর্মের মতানুযায়ী নিজেদের মত ছাড়া অপর সব ধর্মমত মিথ্যা, এবং সেই সকল ভ্রান্তমতের অনুগামীদের জন্য শাস্তি হিসেবে থাকবে অনন্ত নরকবাস।

[9] এ প্রসঙ্গে আমরা স্মরণ করতে পারি রোমানীয় দার্শনিক এমিল চিয়োরানের (Emil Cioran) প্রগাঢ় উপলব্ধি:

A civilization is destroyed only when its gods are destroyed.

[10] ‘On the Bounds of Hinduism’, Prabuddha Bharata, April 1899, Complete Works of Swami Vivekananda, Vol 5

[11] ‘VS Naipaul launches attack on Islam’, The Guardian, e-edition: Oct 4, 2011, https://www.theguardian.com/world/2001/oct/04/afghanistan.terrorism9

[12] আহসান মোহাম্মাদ আবদুল মান্নান, আমাদের জাতি সত্তার বিকাশধারা, কামিয়াব প্রকাশন লিমিটেড, ২০০৬

[13] ‘বইহীন পৃথিবী আমি কল্পনা করতে পারি না: আল মাহমুদ’, প্রথম আলো, সংস্করণ ২২ জুলাই ২০১৬, https://www.prothomalo.com/onnoalo/article/921709

[14] আল মাহমুদ তবু নিপীড়িত মুসলমানের কল্পনা করেছিলেন। কেউ কেউ আবার বখতিয়ারের অপকীর্তি আর্যব্রাহ্মণসেন রাজাদের ঘাড়ে চাপিয়ে সেই “বিস্ময়কর মানবিক চৈতন্য” প্রাপ্তির ঋণ শোধ করেছেন। একটি উদাহরণ, অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমানের লেখা থেকে:

একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শেষ দিকে দাক্ষিণাত্যের কর্ণাটক থেকে আগত সেন বংশীয় আর্যব্রাহ্মণগণ বাংলায় রাজত্ব বিস্তার করে। তারা বৌদ্ধ ধর্ম, বৌদ্ধদের শিল্পসাহিত্যস্থাপত্য সবকিছু ধ্বংস করে। বৌদ্ধদেরকেও পাইকারীহারে হত্যা করে। অনেকে প্রাণভয়ে পার্বত্য অরণ্যানী অঞ্চল ও দেশের বাইরে বর্মা, থাইল্যান্ড, শ্রীলংকা, চীন প্রভৃতি দেশে পলায়ন করে আত্মরক্ষা করে। অনেকে নিরুপায় হয়ে নিজ ধর্ম ত্যাগ করে নীচ জাতীয় হিন্দু হিসেবে জীবন রক্ষা করে। ফলে পাল আমলের সাহিত্যসংস্কৃতি, শিল্পভাস্কর্যস্থাপত্য ইত্যাদি অনেক কিছু থেকেই আমরা বঞ্চিত হই।

(মুহম্মদ মতিউর রহমান, বাংলা সাহিত্যে মুসলিম ঐতিহ্য, বাংলাদেশ কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি লিঃ, ২০১৩, পৃ. ১০)

[15] বল্লালচরিতে বল্লালসেনের তিনটি রাজধানীর উল্লেখ আছে বিক্রমপুর, গৌড় ও স্বর্ণগ্রাম। কিন্তু বিজয়সেন, বল্লাল সেনের সকল তাম্রশাসন ও লক্ষ্মণসেনের অধিকাংশ যখন বিক্রমপুর থেকে প্রদত্ত তখন বিক্রমপুরই যে সেন সাম্রাজ্যের প্রধান কেন্দ্র ছিল সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।

(রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস, ১ম খন্ড, জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১৩৭৩ বঃ, পৃ. ১০৪)

[16] নীতিশ সেনগুপ্ত লিখেছেন:

[…] Bakhtiar had only occupied a holy place on the river Bhagirathi where religious minded people often stayed in order to have regular dips in the holy river. Nabadwip was not the capita of Bengal, nor close to the capital Gaur, also called Lakhnaoti; but Bakhtiar must have followed up the conquest of Nadia by occupying the central part of Bengal around Lakhnouti.

Lakshmansen continued to rule in East Bengal for several years after AD 1201. Several land grants issued by him from East Bengal (e.g. Bhawal Pargana grant, AD 1205) clearly attest to this. There is also a laudatory reference to Lakshmansen’s victory against the mlechchha king and also to the victory of his sons over Yavanas. Even the author of Tabaqat uses a very complimentary term in relation to him and describes him as the great Rai of Bengal comparable to Sultan Qutb-ud-din of Delhi. Lakshmansen died around AD 1206. His two sons, Biswarup Sen and Keshav Sen, ruled in succession in East Bengal with the usual imperial titles. […] According to Minhaj, Ghiyas-ud-din Iwaz, the sultan of Lakhnaoti, made an abortive attempt in 1226 to conquer Banga. Perhaps this invasion was foiled by Biswarup Sen. Keshav Sen claimed victory in his inscription, over invaders from the west, possibly Malik Saifuddin (AD 1231-33) of Gaur, who sent an expedition to Banga which brought some elephants, according to Minhaj. Minhaj also informs us that the Sens occupied the throne of Banga upto AD 1245.

(Nitish Sengupta, Land of Two Rivers, Penguin Books, 2011, p. 59)

এ প্রসঙ্গে রমেশ চন্দ্র মজুমদার আরো বিস্তৃত আলোচনা করেছেন:

আঃ ১২০২ অব্দে বখতিয়ার নদীয়া আক্রমণ করেন। ইহার পরও লক্ষ্মণসেন অন্তত তিন চারি বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। তাঁহার এই সময়কার দুইখানি তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। ইহাতে রাজকবি যে ভাবে তাঁহার শৌর্যবীর্যের ও প্রাচীন রীতি অনুযায়ী রাজপদবির প্রভৃতির উল্লেখ করিয়াছেন, তাহাতে বাংলাদেশের গুরুতর রাষ্ট্রীয় পরিবর্তনের কোন আভাসই পাওয়া যায় না। অপর দিকে উত্তরবঙ্গ অথবা তাহার এক অংশ ব্যতীত বখতিয়ার বাংলার আর কোন প্রদেশে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করিতে পারিয়াছিলেন, ইহারও কোন প্রমান নাই। বঙ্গজয় সম্পূর্ণ না করিয়াই বখতিয়ার সুদূর তিব্বতের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং এই অভিযানে সর্বস্বান্ত হইয়া ভগ্নহৃদয়ে প্রাণত্যাগ করেন। বখতিয়ারের এই বিফলতার সহিত সেনরাজগণের যুদ্ধোদ্যমের কোন সম্বন্ধে আছে কিনা, তুর্কি ঐতিহাসিকগণ সে সম্বন্ধে একেবারে নীরব।

লক্ষ্মণসেন ও বখতিয়ার উভয়েই সম্ভবত ১২০৫ অব্দে বা তাহার দুই এক বৎসরের মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হন। লক্ষ্মণসেনের পর তাঁহার দুই পুত্র বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন সিংহাসনে আরোহন করেন। […] এই দুই রাজারই তাম্রশাসন পাওয়া গিয়েছে। ইহাতে বিশ্বরূপসেন অরিরাজ বৃষভাঙ্কশঙ্কর গৌড়েশ্বরও কেশবসেন অরিরাজ অসহ্যশঙ্কর গৌড়েশ্বরউপাধিতে ভূষিত হইয়াছেন। উভয়েই সৌরঅর্থাৎ সূর্যের উপাসক ছিলেন। এইরূপে দেখা যায় যে, সেন রাজগণ যথাক্রমে শৈব, বৈষ্ণব ও সৌর সম্প্রদায়ভুক্ত হইয়াছিলেন।

এই দুই রাজার রাজ্যকালের কোন বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু দক্ষিণ ও পূর্ববাংলা যে তাঁহাদের রাজ্যভুক্ত ছিল, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কারণ ইঁহাদের তাম্রশাসনে বিক্রমপুর ও দক্ষিণবঙ্গের সমুদ্রতীরে ভূমিদানের উল্লেখ আছে। বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন উভয়েই যবনান্বয়প্রলয়কালরুদ্রবলিয়া তাম্রশাসনে অভিহিত হইয়াছেন। ইহা হইতে অনুমিত হয় যে, উভয়েই উত্তরবঙ্গের মুসলমান তুর্কীরাজের সহিত যুদ্ধে সফলতা লাভ করিয়াছিলেন। ইহা কেবলমাত্র প্রশস্তিকারের স্তুতিবাক্য নহে। কারণ মিন্হাজুদ্দিনের ইতিহাস হইতেও প্রমাণিত হয় যে, তুর্কীগণ উত্তরবঙ্গের সমগ্র অথবা অধিকাংশ অধিকার করিলেও বহুদিন পর্যন্ত পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ অধিকার করিতে পারেন নাই। তিনি লিখিয়াছেন যে, গঙ্গার দুই তীরে, রাঢ় ও বরেন্দ্রেই তুর্কীরাজ্য সীমাবদ্ধ ছিল, এবং তখনও লক্ষ্মণসেনের বংশধরগণ বঙ্গে রাজত্ব করিতেন। তুর্কীরাজগণ যে মধ্যে মধ্যে বঙ্গে অভিযান করিতেন, তাহাও এই গ্রন্থে উল্লিখিত হইয়াছে। সুতরাং বিশ্বরূপসেন ও কেশবসেন যে যবনরাজাকে যুদ্ধে পরাজিত করিয়া পূর্ব ও দক্ষিণবঙ্গ স্বীয় অধিকারে রাখিতে সমর্থ হইয়াছিলেন, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই।

(রমেশচন্দ্র মজুমদার, পূর্বোক্ত, ১ম খন্ড, পৃ. ১০০০১)

[17] Nitish Sengupta, পূর্বোক্ত, p. 60:

Danuja Madhav Dasaratha Deva […] claimed to have wrested Gaur through the grace of god Narayana and […] issued an inscription from Bikrampur. Danuja Madhav entered into a treaty with Balban, the sultan of Delhi, in AD 1293, on equal terms. The meeting between Balban and Danuj Rai at Sonargaon is vividly described in Tarikh-i-Mubarak Shahi.

এখানে নীতিশ সেনগুপ্ত ভুল সালের উল্লেখ করেছেন; ওটা হবে ১২৮০র আশেপাশে, সম্ভবত ১২৮১। বলবন মারা যান ১২৮৭এ।

[18] গোলাম মুরশিদ, হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি, অবসর, ২০১৪, পৃ: ৩১

[19] চিকা মসজিদের গম্বুজ ব্যতিরেকে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বঙ্গীয় মন্দির স্থাপত্যের নিদর্শন। মন্দিরের দেউল বা চূড়া ভেঙে গম্বুজ বানিয়ে মন্দিরকে মসজিদে পরিণত দৃষ্টান্ত বঙ্গের বাইরে ভারতের অন্যত্রও আছে। একটি দৃষ্টান্ত তেলেঙ্গানার নিজামাবাদের কাছে দেবল মসজিদ‘, যেখানে মুহম্মদবিনতুঘলকের আক্রমণের সময় এক জৈন মন্দিরের চূড়াগুলি ভেঙে ছোট ছোট গম্বুজ বানিয়ে তাকে মসজিদ‘-এ রূপান্তরিত করা হয়।

আদিনা মসজিদের অন্দরমহলের স্থাপত্য আমাদের প্রাচীন মন্দিরের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রণব রায় লিখেছেন:

গৌড়ের লক্ষ্মণাবতীতে সুবিশাল প্রাসাদ ও মন্দিরাদি ভেঙে ফেলে সেগুলি দিয়ে গৌড় ও পাণ্ডুয়ার রাজধানী ও বিশালাকার আদিনা মসজিদ নির্মাণ করা হয়। এই ভাবে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদহিন্দুমন্দিরের ধ্বংসাবশেষ ও লক্ষ্মণাবতীতে সেনরাজাদের প্রাসাদের ভগ্ন অংশ থেকে নির্মিত হয়েছিল। এই মসজিদে যে তিনশটি কারুকার্যযুক্ত স্তম্ভ বর্তমান, সেগুলি সবই পাওয়া যায় হিন্দু সৌধ থেকে।

(প্রণব রায়, বাংলার মন্দির: স্থাপত্য ও ভাস্কর্য, পুস্তক বিপণি, ২০০৪, পৃ. ১৭১৮)

প্রণব রায় এ প্রসঙ্গে পার্সি ব্রাউনকে (Percy Brown) উদ্ধৃত করেছেন:

Many temples and places appear to have been dismantled to provide the amount of stone required and it is not improbable that the finest monuments of the Hindu capital of Lakhnauti were demolished in order to produce this one Mohammedan mosque.”

(, পৃ. ১৮)

এই দুই মসজিদ সম্পর্কে সরকারি ওয়েব সাইটে (http://malda.gov.in/place_about.htm) বলা আছে:

Chika Mosque: “The beautifully ornate carvings on the walls and the images of Hindu idols on the stonework of doors and lintels are still partly visible. The mosque also bears traces of Hindu temple architecture.”

Adina Mosque: “Carved basalt masonry from earlier Hindu temples is used to support the 88 brick arches and 378 identical small domes.”

বাংলায় ভ্রমণ গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে রয়েছে বাইশ দরওয়াজাবা বড়ি মসজিদের বর্ণনা

শমস্উদদীন ইউসুফ শাহ (১৪৭৬১৪৮৩ খৃষ্টাব্দ) পাণ্ডুয়ার হিন্দুরাজ্য জয় করেন। তখন পাণ্ডুয়ায় বহু মন্দির ছিল। এই নগর অধিকার করিয়া মুসলমানগণ এখানকার অতি প্রাচীন সূৰ্য্যমন্দিরকে মসজিদে পরিণত করেন। এই মসজিদের ধবংসাবশেষ এখন “বাইশ দরওয়াজা” নামে পরিচিত। ইহার মধ্যে হিন্দু মন্দিরের বহু শিলা স্তম্ভ প্রভৃতি দৃষ্ট হয়। মসজিদের বেদী বা মেম্বর একটি হিন্দু মন্দিরের গর্ভগৃহ। ব্ৰহ্ম শিলা নিৰ্ম্মিত একটি প্রকাণ্ড সূৰ্য্যমূৰ্ত্তির পশ্চাতে উৎকীর্ণ আরবী শিলালিপি হইতে জানা যায় যে ইউসুফ শাহের রাজ্যকালে ১৪৭৭ খৃষ্টাব্দে মসৃজিদটি নিৰ্ম্মিত হইয়াছিল।

(অমিয় বসু সম্পাদিত বাংলায় ভ্রমণ, দ্বিতীয় খণ্ড, পূর্ববঙ্গ রেলপথ প্রচার বিভাগ, ১৯৪০, পৃ. ৮০

এই তিনটি মসজিদ ছাড়াও সীতারাম গোয়েলের Hindu Temples: What Happened to Themএর প্রথম খন্ডে উল্লেখিত বঙ্গের বহু মন্দির ভেঙে গড়া মসজিদ বা দরগার একটা তালিকা পাবেন dharmapedia-র সাইটে:

https://en.dharmapedia.net/wiki/List_of_Hindu_Temples_converted_to_mosques_in_Bengal

[20] প্রণব রায়, পূর্বোক্ত, পৃ. ১৪

[21] ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত এই বইটির নবসংস্করণ প্রকাশ করেছে খড়ি প্রকাশনী

[22] Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760, University of California Press, 1996, p. 117

ঈটন এই শোষণ মুক্তির তত্ত্বের বিরুদ্ধে উদাহরণ সহ আরো দুটি যুক্তি উত্থাপন করেছেন:

. ধর্মান্তরিতদের সামাজিক পদোন্নতি হতে দেখা যায়নি।

. যেখানে বৈদিক সমাজ ব্যবস্থা অধিক দৃঢ় সেখানে ধর্মান্তরণের কোন উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত নেই, বরং উল্টোটা সত্যি।

Second, even if Indians did believe in the fundamental equality of mankind, and even if Islam had been presented to them as an ideology of social equality—though both propositions appear to be false—there is abundant evidence that Indian communities failed, upon Islamization, to improve their status in the social hierarchy. On the contrary, most simply carried into Muslim society the same birth-ascribed rank that they had formerly known in Hindu society. This is especially true of Bengal. As James Wise observed in 1883: “In other parts of India menial work is performed by outcast Hindus; but in Bengal any repulsive or offensive occupation devolves on the Muhammadan. The Beldar [scavenger, and remover of carcasses] is to the Muhammadan village what the Bhuinmali is to the Hindu, and it is not improbable that his ancestors belonged to this vile caste.”

Finally, […] the Religion of Social Liberation theory is refuted by the facts of geography. In 1872, when the earliest reliable census was taken, the highest concentrations of Muslims were found in eastern Bengal, western Punjab, the Northwest Frontier region, and Baluchistan. What is striking about those areas is not only that they lay far from the center of Muslim political power but that their indigenous populations had not yet, at the time of their contact with Islam, been fully integrated into either the Hindu or the Buddhist social system. In Bengal, Muslim converts were drawn mainly from Rajbansi, Pod, Chandal, Kuch, and other indigenous groups that had been only lightly exposed to Brahmanic culture, and in Punjab the same was true of the various Jat clans that eventually formed the bulk of the Muslim community.

(, pp. 117-118)

সংক্ষেপে, ধর্মান্তরণের হার সেখানেই অধিক যেখানে বৈদিক সমাজ ব্যবস্থা সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল না, পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের প্রভাবও ছিল যেখানে ক্ষীণ।

এ প্রসঙ্গে মনে আসে গভীর নির্জন পথে গ্রন্থে সুধীর চক্রবর্তীর একটি পর্যবেক্ষণের কথা। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে ধর্মান্তরণের উদ্দেশ্যে কেরি, মার্সম্যান, আলেকজান্ডার ডাফ ও অন্যান্য মিশনারিরা কর্তাভজা সম্প্রদায় অধ্যুষিত নদীয়া জেলার ঘোষপাড়ার উপর বিশেষ নজর রাখতেন। এত জায়গা থাকতে ঘোষপাড়া কেন? বইটির এক পাদটীকায় সুধীরবাবু ব্যাখ্যা করেছেন:

নজর রাখতেন, কারণ তাঁরা জানতেন যারা হিন্দুধর্মের ক্রিয়াকাণ্ড ত্যাগ করে জাতিবর্ণহীন কর্তাভজা হয়েছে তাদেরই পরে খ্রিষ্টান বানানো সহজ হবে। ১৮৯৯ সালে লন্ডন থেকে ছাপা Eugena Stock তাঁর The History of the Church Missionery Society, its Environment, its men and its work বইয়ের প্রথম খন্ডে দিয়েছেন কর্তাভজাদের গ্রামকে গ্রাম খ্রিষ্টধর্মগ্রহণের বৃত্তান্ত। সময় ১৮৩৯ সালের আশেপাশে।

(সুধীর চক্রবর্তী, গভীর নির্জন পথে, আনন্দ, ২০১২, পৃ. ৫৮)

আমরা জানি যে হিন্দু ধর্মের বিকাশ ও বিবর্তন আব্রাহামীয় ধর্মের অনুরূপ নয়। সমগ্র মানবজাতিকে পরাভূত করে সনাতন ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করার কোন এজেন্ডা আমাদের ছিল না, তাই সমাজকে রেজিমেন্টেড করার কোন অভিপ্রায় কখনো হয়নি। এর ফলে হিন্দুদের মধ্যে কোন নিখিল হিন্দু চেতনা (pan-Hindu consciousness) গড়ে ওঠেনি। এই চেতনার অভাব থাকলেও, শেষ পর্যন্ত জাতিগত চেতনাই (caste consciousness) কি হিন্দুদের ইসলামী ও খ্রিষ্টান আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রেজিমেন্টেশনে সাহায্য করেছিল? বর্ণব্যবস্থা বিহীন মঠকেন্দ্রিক বৌদ্ধ সমাজের ধর্মান্তরিত অংশ কি সেই রেজিমেন্টেশনের অভাবেই ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল? আশাকরি আগামীদিনে ইতিহাসবিদ ও সমাজতত্ত্ববিদরা এদিকে দৃষ্টি দেবেন।

[23] যতীন্দ্রমোহন ভট্টাচার্য, বাংলার বৈষ্ণবভাবাপন্ন মুসলমান কবি, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬২, ভূমিকা অংশ পৃ.

[24] ফিলিপ এলমন্ডের (Philip C. Almond) The British Discovery of Buddhism দেখুন

[24] চার্লস এলেনের (Charles Allen) The Buddha and the Sahibs দেখুন

[26] Richard M. Eaton, The Rise of Islam and the Bengal Frontier, 1204-1760, University of California Press, 1996, p. 13:

Even while Indo-Buddhist civilization expanded and flourished overseas, however, Buddhist institutions were steadily declining in eastern India. Since Buddhists there had left life-cycle rites in the hands of Brahman priests, Buddhist monastic establishments, so central for the religion’s institutional survival, became disconnected from the laity and fatally dependent on court patronage for their support.

[27] Johannes Bronkhorst, ‘Were Buddhist Brahmins Buddhists or Brahmins?’ in M.F. Albedil and N. Yanchevskaya (ed.), Mitrasampradānam: A collection of papers in honour of Yaroslav Vassilkov, Mae Ras, Saint Petersburg, 2018, pp. 313-314:

Interestingly and importantly, these Buddhists [viz. Udbhaṭasiddhasvāmin, Śaṅkarasvāmin, Aśvaghoṣa,  Mātṛceṭa, etc.] remained Brahmins. […] The Kashmirian author Śaṅkaranandana leaves no doubt about his Buddhist convictions in his works, yet is consistently referred to as a Brahmin in the Buddhist tradition. Many of the leading scholars at Nālandā, the great monastery/university of the eastern Ganges valley, came from Brahmin families.  B. N. Misra ([Nālandā: Sources and Background, Vol. 1. Delhi: B. R. Publishing Corporation]1998: 282-302) enumerates a number of these, among them Dignāga, Dharmakīrti, Śīlabhadra and Saraha Rāhulabhadra. Hartmut Scharfe (2002: 139) enumerates, beside Aśvaghoṣa, the following Buddhist authors who were or may have been  Brahmins: the philosophers Nāgārjuna and Vasubandhu, and the  grammarian Candragomin. He further points out that Faxian, a Chinese Buddhist pilgrim, saw in the monastery at Pāṭaliputra two  famous professors of Mahāyāna, Rādhāsvāmin and Mañjuśrī, whom he calls Brahmins; presumably they were both Brahmins and Buddhists. Scharfe also refers to a story told by the Tibetan historian Tāranātha, which tells that the Brahmin Haribhadra was defeated in a  debate by a Buddhist and, as a result, converted to Buddhism; however, he and his son, who worked as a Buddhist missionary, continued to be called Brahmins.

[28] ভাগলপুর তাম্রফলক থেকে জানা যায় নারায়ণ পাল শৈব মঠের উদ্দেশ্যে একটি গ্রাম দান করেছিলেন। এই ফলকে তাঁকে পরমসৌগতবলে উল্লেখ করা হয়নি, অর্থাৎ তাঁকে বৌদ্ধ বলে চিহ্ণিত করা হয়নি। ১০২৬ সালের এক শিলালেখ থেকে আমরা জানতে পারি মহীপাল ছিলেন এক পশুপত সম্প্রদায়ের ভক্ত। বাণগড় শিলালেখ থেকে জানা যায় নয়পাল শৈবাচার্য সর্বশিবের শিষ্য ছিলেন।

Though staunch Buddhist in character, some of the Pāla rulers abandoned the paternal religion and accepted new religions. These kings were Nārāyanpāla, his son Mahīpāla I and Mahīpāla I’s son Nayapāla. The Bhagalpur Copper Plate of Nārāyanapāla does not address the king as Parama-saugata. The king donated the village Makutikā situated in Kakṣa viṣaya, within Tira-bhukti, to the god Śiva-bhattāraka, after constructing a great and vast spacious temple in the village Kalasapata and consecrating the image of Śiva there. Over and above, it is noted there that the village was donated to the board of Āchāryas of Pāśupat followers, entrusted with the task of looking after the temple and worshipping the idol. […] From this proclamation it is apparent that Nārāyanpāla himself loved the Śaiva cult and was very much concerned with the worship of god Śiva and the well-being of followers of Śaiva cult. And it might not be unreasonable to say that king Nārāyanpāla, perhaps, gave up the paternal religion of Buddhism and adopted Śaivism as his religion.

The recently discovered epigraph from Bangadh of the time of Nayapāla, designated as MurtiŚiva Prasasti, throws much light upon the religious doctrine of Mahīpāla I and his son Nayapāla. From this epigraph, we are told that around the tenth and eleventh century A.D., Bengal was very much influenced by the powers of the moderate Śaiva ascetics. There was a Śaiva monastery or school near Bangadh situated in Dinajpur of East Bengal, named Golaki or Golagimaṭha. The Pāla kings patronized the Śaiva ascetics associated with this monastery and got initiation from them. […] According to a later inscription of his time of 1026 A.D., Mahīpāla I was a devotee of Vāmarāśi, the hard-souled or Kathorpanthi Pasupat preceptor of Venaras.

According to the Praśasti, Indraśiva’s disciple Sarvaśiva was the spiritual guide of Nayapāladeva, son of Mahīpāla I, a great man. […] According to Siyan Pillar Inscription, Nayapāla erected temples, consecrated idols and placed golden jars over the top of temples at many places of Bengal and Bihar.

The above facts indicate that in medieval India, religious liberality was prevalent; […] King Pravākaravardhana of Puṣyabhuti dynasty was the devotee of Paramāditya or Sun-god, but his eldest son Rājyavardhana was Parama-Saugata (devotee of Buddha) and Harṣavardhana, his younger son, was Parama-māheśwara (devotee of Māheśwara or Śiva). In the Sena dynasty, Vijaysena and Vallālasena were Parama-māheśwara or devotee of Śiva, but Lakshmanasena was Parama-vaiṣṇava or respectful to Viṣṇu, and Viśvarupasena was Paramasaura or devotee of Sun-god.

(Jhunu Bagchi, The History and Culture of the Pālas of Bengal and Bihar (Cir. 750 AD – Cir. 1200 AD), Abhinav Publications, 1993, pp. 97-99)

[29] অর্জুনদেব সেনশর্মা, প্রাগাধুনিক বাংলা সাহিত্যে রাঢ়বঙ্গের হিন্দু বাঙালির জাতিরাজনীতি, পিএইচডি গবেষণা সন্দর্ভ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়), ২০১৩, পৃ. ১০

[30] Letters, The Hindu, March 22, 2004, https://www.thehindu.com/todays-paper/tp-national/tp-tamilnadu/redefining-secularism/article27579776.ece

এছাড়াও দেখুন রোমিলা থাপারের প্রবন্ধ, The Theory of Aryan Race and India: History and Politics, (Social Scientist, Vol. 24, No. 1/3 (Jan. – Mar., 1996), pp. 3-29, https://www.jstor.org/stable/3520116)

[31] তাঁর Who Were The Shudras দেখুন

[32] আহসান উল্লা, ‘বঙ্গভাষা ও মুসলমান সাহিত্য‘, উদ্ধৃত তপস্যা ঘোষের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসরচনা: সিদ্ধি ও সীমাবদ্ধতা, পিএইচডি গবেষণা সন্দর্ভ (কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়), ২০০১, পৃ. ১০৮

[33] রমেশচন্দ্র মজুমদার, বাংলা দেশের ইতিহাস, ২য় খন্ড, জেনারেল প্রিন্টার্স এন্ড পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, ১৯৮৭, পৃ. ৩৩৩

[34] , পৃ. ৩৩৪

[35] , পৃ. ৩৩৪৩৫

[36] মুজিবঅনুরাগীদের দ্বারা যে কথা অনুচ্চারিত রয়েছে, ভাসানীর অনুরাগী তা সগর্বে ঘোষণা করেছে:

We Bengalis have been fortunate in having leaders of the stature of Chittaranjan Das, Subhash Chandra Bose, A.K. Fazlul Haque and Sheikh Mujibur Rahman, all of whom were great and unique in their own ways; but it would be neither unfair nor an exaggeration to say that Bhasani was the greatest among the great.

(Serajul Islam Choudhury in his Foreward to Anisuzzaman Chowdhury edited Moulana Bhashani: Leader of the Toiling Masses, Moulana Abdul Hamid Khan Bhashani Foundation, 2012)

[37] স্মরণে আসে চাকমা নেতা মানবেন্দ্র লারমার উদ্দেশ্যে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবের সেই বিখ্যাত উক্তি — তোরা বাঙ্গালী হয়ে যা।কিন্তু চাকমারা নত স্বীকার করে নিজেদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য হারাতে রাজি হয়নি, আর তার মূল্য — গণহত্যা, অপহরণ, গণধর্ষণ — তাদেরকে দিতে হয়েছে। এই সংখ্যালঘু বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের উপর মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক ঘটনার মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলেছিল ১৯৯৬র ১২ই জুন পার্বত্য চট্টগ্রামের নেত্রী মাত্র তেইশ বছরের কল্পনা চাকমার অপহরণ। এই অপহরণের মূল অভিযুক্তদের নাম লেফটেন্যান্ট ফিরদৌস, গ্রাম রক্ষী বাহিনীর (Village Defense Party) নুরুল হক ও পুলিশ কনস্টেবল সালেহ আহমেদ। দুই দশক পেরিয়ে গেলেও এই কেসের আজ পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি।

[38] ডঃ সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও তাসলিমা বেগম সম্পাদিত বাংলাদেশের ইতিহাস ও বিশ্বসভ্যতা (নবমদশম শ্রেণী), জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (বাংলাদেশ), ২০১৭, পৃ. ৭৪৭৬, http://nctb.gov.bd/site/page/079828a6-18e6-44c1-9a2d-59f8d223199c

[39] সরলা দেবী চৌধুরানী, জীবনের ঝরাপাতা, রূপা এন্ড কোম্পানী, ১৯৫০, পৃ. ১২৯

[40] গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৮০৮১

[41] , পৃ: ১৭৬

[42] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘সাহিত্যসম্মিলন’, রবীন্দ্ররচনাবলী, ২৩শ খণ্ড), বিশ্বভারতী, ১৯৫০, পৃ. ৪৮৩

[43] গোলাম মুরশিদ, পূর্বোক্ত, পৃ: ১৮২৮৩

[44] রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘মক্তবমাদ্রাসার বাংলা ভাষা’, প্রবাসী, ভাদ্র, ১৩৩৯

[45] ‘মক্তবমাদ্রাসার বাংলা’, প্রবাসী, বৈশাখ ১৩৪১, পৃ. ১০৩

[46] , পৃ. ১০৩

বিশ্বভারতীর দ্বারা বাংলা শব্দতত্ত্ব গ্রন্থে ভাষাশিক্ষায় সাম্প্রদায়িকতাশিরোনামে রবীন্দ্রনাথের এই পত্র সন্নিবেশিত করার সময় আজকের বাংলা ভাষা […] আরো বেশি শোচনীয় হবে।অংশটি অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, যার ফলে রচনাবলীতে পত্রের এই অনুচ্ছেদটি উপলব্ধ নয়।

[47] Bidyut Chakrabarty, পূর্বোক্ত, pp. 44-46

[48] আবুল মনসুর আহমদ, বাংলাদেশের কালচার, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ২০১১, পৃ. ৯৪১০৪

[49] , পৃ. ১২৯৩০

[50] হুমায়ুন আজাদ, প্রবচনগুচ্ছ, প্রবচন নং ১৯৪

[51] মোহাম্মদ হারুন রশিদ সম্পাদিত বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি উর্দু শব্দের অভিধান, বাংলা একাডেমি ঢাকা, ২০১৮, ভূমিকা অংশ পৃ. ১১১২

[52] গোলাম মুরশিদ, ‘বাঙালিত্বের বিবর্তন ও ভবিষ্যৎ’, প্রথম আলো, সংস্করণ: ২৬ মার্চ ২০১৮, https://www.prothomalo.com/bangladesh/article/1457451/বাঙালিত্বেরবিবর্তনভবিষ্যৎ

[53] ‘সাম্প্রদায়িক অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছি কি?’, আবু সালেক সম্পাদিত সাপ্তাহিক হককথা সমগ্র, ঘাস ফুল নদী, ২০০৬, পৃ. ২৭

[54] আবুল মনসুর আহমদ, পূর্বোক্ত, পৃ. ১০৩

[55] দেখুন ‘‘জাতীয় সংগীত’ নিয়ে মন্তব্য করে নতুন বিতর্কে নোবেল’, যুগান্তর, সংস্করণ: ১ আগস্ট ২০১৯, https://www.jugantor.com/entertainment/205785/জাতীয়সংগীতনিয়েমন্তব্যকরেনতুনবিতর্কেনোবেল

অথবা,

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় হোক নতুন জাতীয় সংগীত, প্রতিবাদী ব্যানার ঘিরে ফের বিতর্ক বাংলাদেশে’, সংবাদ প্রতিদিন, সংস্করণ: ১৮ আগস্ট ২০১৯, https://www.sangbadpratidin.in/bangladesh/controversy-over-a-banner-in-bangladesh-demanding-few-changes/