বিধাতার হাতে লেখা গান – ৩৩

অভীক মুখোপাধ্যায়

(দ্বাত্রিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৩৩

বিশ্ব দুটি মহাশক্তির মধ্যে বিভক্ত হয়ে চলেছিল, আর আমেরিকা দ্বিধাবিভক্ত ছিল দুটি বর্ণের ভিত্তিতে — কালো এবং সাদা। কৃষ্ণাঙ্গ আর শ্বেতাঙ্গদের মধ্যেকার সেতু হিসেবে উঠে নিজেকে স্থাপন করতে চাইছিলেন কেনেডি। নিজের উদ্বোধনী বক্তৃতায় তিনি বললেন —

‘আমি যা করতে চাইছি, তা আগামী একশো দিনেই হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। হয়তো আগামী হাজার দিনেও তা সম্পূর্ণ হবে না। একশো বছরে হওয়া সম্ভব নয় কিংবা হয়তো কখনওই হবে না, কিন্তু তবুও একথা ভেবে আমি শান্তিতে মরতে অন্তত পারব যে আমিই কাজটা শুরু করেছিলাম।’

কবে চলে গেছেন আব্রাহাম লিংকন। তাঁর মৃত্যুর একশো বছর পরেও আমেরিকায় বর্ণভেদ অব্যাহত রয়েছে। কৃষ্ণাঙ্গদের পাড়া আলাদা, খাওয়ার টেবল পৃথক, রেলওয়ে স্টেশনে আলাদা ওয়েটিং রুম, সিনেমাহল সেপারেটেড, এমনকি হাত ধোওয়ার বেসিন অবধি আলাদা। এগুলো সব বিগত শতাব্দীর ছয়ের দশকের কথা। যে সময়ে বিশ্বের মানচিত্রে পরাধীন দেশের সংখ্যা প্রায় শূন্যে পরিণত হয়েছে, সেই সময়ে আমেরিকার স্বাধীন সরকারের অধীনে কৃষ্ণাঙ্গরা এভাবেই বাস করতেন।

যেদিন কেনেডি রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিলেন, সেদিন ওঁর সামনে দিয়ে গার্ড অব ওনার দিল মার্কিন নেভি। নৌসেনা মার্চ করল। কেনেডি দেখলেন নেভির মার্চিং টিমে একজনও কৃষ্ণাঙ্গ সদস্য নেই। রাষ্ট্রপতির মাথায় এল যে সেনেটেও তো কোনও নিগ্রো নেই। নিজের অফিসে ফিরেই তিনি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তিকে মার্কিন রাজদূত রূপে নরওয়েতে পাঠালেন। কোনও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষকে রাজপুরুষ রূপে নিযুক্তির প্রথম ঘটনার সাক্ষী হল মার্কিন মুলুক।

ববি কেনেডির মধ্যে নাৎসিবাদের প্রাবল্য ছিল, কিন্তু সেই ববিই যখন অ্যাটর্নি জেনারেলের পদ অলংকৃত করলেন, তাঁর মধ্যে অদ্ভুত একটা পরিবর্তন দেখা দিল। দেশের আইন তখন তাঁর হাতে। অত্যন্ত সচেতন ভাবে প্রতিটা পা ফেলছিলেন ববি। নাৎসিবাদ নিয়ে ওঁর চিন্তাধারা পালটে গেল। ববি স্ব – মূল্যায়ন করে দেখলেন, আরে যা ভাবতাম তা তো ভুল, তা সংবিধান – বিরোধী, দেশের মানুষকে সাদা – কালোতে ভাগ করে দিচ্ছে। সুধী পাঠক, এখানে একটা কথা মনে রাখোতে হবে — এই দুই ভাই ধনী পরিবারের সন্তান। এর আগে জীবনে কখনও কোনও নিগ্রোর পাশে বসে কফির কাপে চুমুক দেওয়ার মতো ঔদার্যটুকুও প্রদর্শন করেননি। ছোট্টবেলা থেকে কালোকুলো মানুষগুলোকে ওঁরা চাকরের চোখেই দেখেছেন। শ্বেতাঙ্গ চাহনির রাডারে কৃষ্ণাঙ্গদের আর কোনও ভূমিকা ছিলই না। স্কুলে – কলেজে কখনও কোনও কালো ছেলে বা মেয়ে ওঁদের বন্ধু হয়নি, খেলার সঙ্গী হয়নি, সেনায় থাকাকালীন কমরেড হয়নি, এমনকি রাজনীতিতে পা – রাখার সময়েও সাথী হয়নি। ওঁদের যা কিছু বোধোদয়, তা হয়েছিল ক্ষমতায় আসার পরে। ক্ষমতা মানুষকে দায়িত্ববান করে তুললে তা শুভ লক্ষণ। যে নিগ্রোরা আদৌ মানুষ কিনা সেই সম্পর্কেই ওঁদের কোনও ধারণা ছিল না, আচমকাই সেই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের নিয়ে এই চিন্তাশীলতা ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছিল।

নিগ্রোরা কেমন হন?

গায়ের রঙ কালো। ঘুঙুরের মতো মোটা মোটা চুল। থ্যাবড়া নাক। মোটা ঠোঁট। চোয়াল চওড়া। আফ্রিকার বুক থেকে তাঁদের শেকড় ছিঁড়ে তুলে এনে ফেলা দেওয়া হয়েছিল আমেরিকা মহাদেশের মাটিতে। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যিখানে। চারশো বছরের দাসত্ব জীবন কাটিয়েছিলেন তাঁরা। সেই শৃঙ্খল কাটিয়ে ওঠার পরেও শ্বেতাঙ্গদের পায়ের জুতো হয়েই জীবন কাটাচ্ছিলেন। শুধুমাত্র আমেরিকার দক্ষিণের গোঁড়া শ্বেতাঙ্গরাই নয়, উত্তরের ব্যুরোক্র্যাটরাও তাঁদের পদদলিত করে রাখত। এফ বি আই –এর ডিরেক্টর এডগার হুবর খোলাখুলি বর্ণবিদ্বেষকে সমর্থন করতেও পিছপা হতেন না। ইচ্ছেমতো তাঁদের জেলে ভরতেন, শাস্তি দিতেন। খুন, গুমখুন করে দেওয়া হতো। এখন তো এই সব তথ্যই সরকারি নথিতে স্থান পেয়েছে।

ওইসময়ে নিগ্রোদের অধিকার রক্ষার জন্যে দুজনের নাম সকলের মুখে – মুখে ঘুরছিল। একজন ছিলেন মার্টিন লুথার কিং, এবং অপরজন ছিলেন ম্যালকম এক্স। দুজনেই প্রায় সমবয়সী। স্যুট বুট পরে কেতাদুরস্ত। প্রখর বক্তা। কিন্তু দুজনের মধ্যে ফারাকও ছিল অনেক। কিং ধর্মনিষ্ঠ খ্রিষ্টান, ধর্মশিক্ষা নিয়ে বড় হয়েছেন। আর এক্স কট্টর তানাশাহী ইসলামিক সংগঠনের উগ্র মুখ, জীবনের প্রথম পর্যায় থেকেই অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। মার্টিন লুথার কিং নিজের অহিংস আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন এক ভারতীয় নায়ককে, ভদ্রলোকের নাম মোহনদাস করমচন্দ গান্ধী। আর ম্যালকম এক্স ছিলেন উগ্রবাদী বিপ্লবে বিশ্বাসী, এক্সের বিরোধীরা তাঁকে ‘কালো হিটলার’ বলতেন। দুজনকেই মরতে হয়েছিল গুলি খেয়ে। কিং-কে হত্যা করেছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ খ্রিষ্টান, এক্স-কে মেরেছিল একজন কৃষ্ণাঙ্গ মুসলিম। যেভাবে ভারতীয় উপমহাদেশে গান্ধীজিকে মেরেছিল একজন হিন্দু, পাকিস্তানের প্রথম ওয়াজির – এ – আজমকে মেরেছিল একজন মুসলিম। পরে এভাবেই কেনেডিকেও মরতে হবে। রাজনীতি আসলে ইতিহাসের অপর নাম, ফিরে ফিরে আসে, নিজেকে রিপিট করে। প্রত্যেকটি মৃত্যুর পর বলা হয়েছে কোনও না কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংগঠন এসবের সঙ্গে জড়িত ছিল। হতে পারে, আবার না-ও হতে পারে। আমাদের কাজ খেলা দেখা। আমরা খেলার অঙ্গ নই।

কেনেডি রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে অবধি আমেরিকার ইলেকশনে দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে নিজের ভোট দিতে গেলে একটি সাক্ষরতা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতো। এবং এটা শুধু এবং শুধুমাত্র নিগ্রোদের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য ছিল। যদি কোনও কৃষ্ণাঙ্গ লেখাপড়া না – জানতেন, তবে তাঁকে ভোট দিতে দেওয়া হতো না। এখানেও আবার গ্যাঁড়াকল ছিল, বন্ধু। যদি কোনও কালো চামড়ার মানুষ সাক্ষরতা পরীক্ষায় পাশে করে যাবেন বা যাচ্ছেন, তখন তাঁকে প্রশ্ন করা হতো সংবিধানের অনুচ্ছেদ থেকে…এখানে কী আছে, এটা কোথায় আছে ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে, কোনও ভাবেই তোকে ভোট দিতে দেব না। লক্ষ লক্ষ কৃষ্ণাঙ্গ মানুষ আমেরিকায় বছরের পর বছর ভোটাধিকার প্রয়োগ করতেই পারেননি। এটা মনে রাখার মতো বিষয় যে, কেনেডি যে সময়ে প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন তার প্রায় এক দশক আগে স্বাধীন ভারতের প্রথম জেনারেল ইলেকশন হয়েছিল। সেখানে কিন্তু কোনও প্রকার নিম্নরুচিকর বিধিনিষেধের বেড়াজালে মতদাতাদের বেঁধে রাখা হয়নি। যদিও ভারত তথাকথিত তৃতীয় বিশ্বের দেশ ছিল, এবং আমেরিকা ছিল সবার পিতৃতুল্য, মডার্ন, সফিস্টিকিটেড।

ববি কেনেডি ১৯৬১ সালের এপ্রিল মাসে কিং-কে নিজের বাড়িতে ডেকেছিলেন। এই সাক্ষাৎকার গোপন ছিল। উনি বলেছিলেন — ‘এই নিন, এটা আমার ফোন নাম্বার। যদি কোথাও, কেউ কোনও কৃষ্ণাঙ্গকে তাঁর ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে, তাহলে সোজা আমায় ফোন করবেন। সংবিধান বদলে দেওয়ার ক্ষমতা তো আমার নেই, কিন্তু যেটুকু সংবিধানে লেখা রয়েছে তা যথাপূর্বক পালন করার দায়িত্ব আমার কাঁধে দেওয়া হয়েছে।’

(ক্রমশঃ)