বাঙালির বিস্মৃত ‘জলপরী’ আরতিকে জন্মদিনে ডুডলে মনে করাল গুগল

0
1181

বঙ্গদেশ ডেস্ক: জার্নির শুরুটা ৪ বছর বয়স থেকেই। জলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল শিশু বয়স থেকেই। ওই বয়সে যখন আর পাঁচজন শিশু যখন ছুটে দৌড়ে বেড়ায় ওই বয়সেই কাকার সঙ্গে চাঁপাতলার ঘাটে প্রতিদিন স্নান করতে যেতেন তিনি। জলের নেশা তখন থেকেই তাঁকে পেয়ে বসে।

মেয়ের উৎসাহ দেখে বাবা তাঁকে খেলার ছলে একদিন হাটখোলা সুইমিং ক্লাবে ভরতি করে দিলেন। মাত্র এক বছর পর শৈলেন্দ্র স্মৃতি সাঁতার প্রতিযোগিতায় ১১০ গজ ফ্রি-স্টাইলে প্রথম হয় বাচ্চা আরতি। ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি কোচের কোলে চড়ে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে উঠেছিল। উপস্থিত সবাই দেখে বেশ অবাক হয়েছিল। কোচের কোলে করে নিয়ে গিয়েছিলেন প্রথম পুরস্কার আনতে।

সেই থেকেই শুরু হয়ে গেল সাঁতার প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ। স্বাধীনতার আগের বছর থেকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত যতগুলি প্রতিযোগিতায় সে পারফর্ম করেছিল সবকটিতেই প্রথম, কখনও দ্বিতীয় হয়নি। বাংলার সীমানা ছাড়িয়ে প্রথমে দেশ, তারপর দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশ‌। ধীরে ধীরে অনেকেই তাঁর নাম জেনে গেল।

মাত্র আড়াই বছর বয়সে মাতৃহারা হারিয়েছিলেন এই সাঁতারু। বাবা পাঁচুগোপাল সাহা সেনা বিভাগে কর্মরত ছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর বোন ও দাদা মামারবাড়িতে চলে গেলে ছোট্ট আরতি থেকে যায় ঠাকুমার কাছে।

১৯৫২ সালে হেলসিঙ্কি অলিম্পিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাঁতারু ডলি নজিরের সঙ্গে ‘জলপরী’ ছিলেন ভারতের সর্বকনিষ্ঠ প্রতিনিধি। বাংলাদেশের সাঁতারু ব্রজেন দাস ছিলেন তাঁর অনুপ্রেরণা। সেই অনুপ্রেরণা আর নিজের জেদকে সঙ্গী করেই ইংলিশ চ্যানেল পার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি ৷ তখন বয়স মাত্র ১৮৷

অবশ্য সে দুঃসাহসিক চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল৷ কিন্তু হতাশা তাঁকে ছুঁতে পারেনি। পরের বছর আবার ইংলিশ চ্যানেল জয় করার একবুক স্বপ্ন নিয়ে জলে নামেন৷ ১৯৫৮-৬১ সালের মধ্যে মোট ছ’বার ইংলিশ চ্যানেল পার করেছিলেন এশিয়া তথা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাঁতারু ব্রজেন দাস।

ভারতীয় মহিলা হিসেবে ইংলিশ চ্যানেল অভিযানেকে সক্ষম হবে জানতে চাওয়ায়, তিনি আরতি সাহার নাম সুপারিশ করেন। তত দিনে আরতি সাহা নামটি বিশ্বের সাঁতারের দরবারে বেশ পরিচিত মুখ। কিন্তু নামযশ পেলেও অর্থের অভাব ছিল। দরকার ছিল হাজার কুড়ি টাকা।

দিনে পাঁচ-ছ’ঘণ্টা সাঁতার অনুশীলন, চাকরি, তার পর টাকার জন্য ঘুরে ঘুরে খালি হাতে ঘরে ফেরা এই ছিল নিত্যদিনের সঙ্গী। অল ইন্ডিয়া স্পোর্টস কাউন্সিল-এর সদস্য পঙ্কজ গুপ্ত আরতিকে নিয়ে গেলেন তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে আর্থিক সাহায্যের জন্য। চ্যানেল পার হওয়ার কথা শুনে বিধানচন্দ্র রায় অবাক হয়ে বলেছিলেন, “ইংলিশ চ্যানেল চোখে দেখেছ! পার যে হবে বলছ?’

পরে অবশ্য আরতির মাথায় হাত রেখে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, টাকা কাল সকালে তোমার বাড়িতে ঠিক পৌঁছে যাবে। চিন্তা করো না হাসি মুখে বাড়ি ফিরে যাও। আরোও ভালো করে অনুশীলন কর।” পরে আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন জওহরলাল নেহরু, মিহির সেন, প্রফুল্লচন্দ্র সেন, অতুল্য ঘোষ।

তারপর এল সেই দিনটি, ২৭ অগস্ট, ১৯৫৯। প্রায় চল্লিশ মিনিট দেরিতে এল ন্যাভিগেশন বোট। কিন্তু তা সত্ত্বেও দমে যাননি আরতি সাহা। ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করা প্রথম এশীয় মহিলা আরতি বলেছিলেন, ‘সাঁতার কাটতে কাটতে চোখে পড়ল একটা কচ্ছপ ভেসে যাচ্ছে। তখন মনে হচ্ছিল ওটার পিঠে চেপে চলে যাই। ঠান্ডায় হাত পা জমে যাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল দশটা জ্বলন্ত উনুন পেটের কাছে থাকলে ভাল হয়।

১৪ ঘণ্টা ১০ মিনিট একটানা সাঁতার কাটার পর লক্ষ্য স্পর্শ করতে তখন বাকি মাত্র ৩ মাইল। বোটম্যান ঘুরপথে চালিত করলে আরতি স্রোতের বিপরীতে পড়ে যান। তাঁর পাশে তখন সাঁতার কাটছেন ১৯৪৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকের সোনাজয়ী সাঁতারু গ্রেটা অ্যান্ডারসন। স্রোতের মুখে আরতি আর এগোতে পারছেন না দেখে বোটম্যান তাঁকে ছুঁয়ে দেন— নিয়মানুয়াযী কেউ সাঁতারুকে স্পর্শ করলে তিনি প্রতিযোগিতা থেকে বাতিল হয়ে যান।

২৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৫৯ সাঁতরে ইংলিশ চ্যানেল পার করে ফেললেন আরতি সাহা। সময় নিয়েছিলেন ১৬ ঘণ্টা ২০ মিনিট। ফ্রান্সের কেপ গ্রিস নের থেকে ইংল্যান্ডের স্যান্ডগেট।ভোর ৫ টা ৫৫ মিনিটে জলে নেমে আঁকাবাঁকা পথে ৪২ মাইল পথ অতিক্রম করেন তিনি।

ক্যাপ্টেন হার্টিনসন গাইড হিসেবে তাঁর জীবনে এই প্রথম কোনও মহিলাকে পথ দেখাচ্ছিলেন। নিয়ম ছিল চ্যানেলের একটি বন্দর ফকস্টোন থেকে ৫ মাইল দূরে স্যান্ডগেটে বোট থেমে যাবে কিন্তু তারপরেও প্রতিযোগীদের আরও ১০ গজ হেঁটে যেতে হবে।

অবশেষে সাফল্য লাভ করেন আরতি সাহা। সেই সাফল্যের হাত ধরে তিনি আরও একটা অন্যন্য নজির গড়েন৷ আর তা হল ১৯৬০ সালে তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মান দেওয়া হয়৷ তিনিই প্রথম কোনও মহিলা ক্রীড়াবিদ, যিনি এই সম্মান পেয়েছিলেন৷

১৯৯৪ সালের ২৩ অগাস্ট ইহলোক ত্যাগ করেন আরতি সাহা। তবে ক্রীড়াক্ষেত্রে তাঁর অসামান্য অবদান এখনও স্মরণ করেন বহু জ্ঞানীগুণী মানুষ।