গ্রেটা থানবার্গের কৃষক আন্দোলনের উপর মুছে ফেলা টুলকিট ও ডিজিটাল প্রচারের অদৃশ্য হাতগুলির রহস্য অনাবৃত

0
1028

গ্রেটা থানবার্গ যে ট্যুইটটি মুছে ফেলেছিলেন, তাতে “বিশ্বজনীন কৃষক আন্দোলন-প্রথম ধাপ” শীর্ষক অনুচ্ছেদ আছে, যেখানে পাঠককে অনুরোধ করা হয়েছে যাতে তাঁরা ভারতের “অধোগামী গণতন্ত্র”-এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান এবং বলা হয়েছিল যে ভারতের উপর “আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি করা হল সর্বপ্রধান কাজ”।

প্রকৃতি-আন্দোলনকারী গ্রেটা থানবার্গ কৃষকা আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আচমকা একটি ট্যুইট করেছিলেন যা অতি শীঘ্র মুছেও ফেলা হয়েছে – এই ঘটনা ট্যুইটারে ঝড় তুলে দিয়েছে।

ট্যুইটে “বিশ্বজনীন কৃষক আন্দোলন-প্রথম ধাপ” শীর্ষক একটি নিবন্ধের লিঙ্ক ছিল। এটি পরবর্তীতে পাঠককে ভারতের “অধোগামী গণতন্ত্র”-এর বিরুদ্ধে অবস্থান করার জন্য অনুরোধ করে (ফ্যাসিবাদী শাসক আরএসএস-বিজেপি’র নির্দেশে)

প্রথম পাতায় লেখা ছিল, “আপনি কি মানবজাতির ইতিহাসে ঘটা সবচেয়ে বড় আন্দোলনের অংশ হবেন”?

নথিটিতে দেখা যায় যে এতে ভারত সরকার দ্বারা পাশ করা কৃষি বিলের বিরুদ্ধে ডিজিটাল প্রচার করার সুন্দর পরিকল্পনা করা আছে।

নথিটিতে “আপৎকালীন পদক্ষেপ” ও প্রারম্ভিক গুরুওপূর্ণ গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ”- এর একটি সূচি আছে। এটিতে একটি সময়সূচি ছিল : ৪ঠা ও ৫ই ফেব্রুয়ারি ট্যুইটারে ঝড় ওঠে; ৫ই ও ৬ই ফেব্রুয়ারি সংহতিমূলক ছবি বা ভিডিও বার্তা যায়; সরকারের প্রতিনিধিদের উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করেছিলেন; অনলাইন দরখাস্ত জমা করা; আদানি, অম্বানি এন্টারপ্রাইজ পরিত্যাগ করা।

“প্রারম্ভিক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ” এর মধ্যে আছে “ডিজিটাল আন্দোলন” এবং “ভারতকে জিজ্ঞাসা কর কেন” হ্যাশট্যাগ এবং পাঠকদের অনুরোধ করা হয় @PMOIndia, @nStomar (কৃষি ও কৃষক কল্যাণ মন্ত্রক) প্রমুখকে ট্যাগ করতে, অন্যান্য জাতির প্রধান, নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন- আইএমএফ, ডাব্লুটিও, এফএও, বিশ্বব্যাঙ্ক।

এই নথিতে “বিলুপ্তপ্রায় রাষ্ট্রদ্রোহের ইন্সটাগ্রাম লাইভ” আছে ২৬শে জানুয়ারি (ভারতের প্রজাতান্ত্রিক দিবস) দিল্লির সীমান্তে কৃষকদের সঙ্গে এবং বিশ্বব্যাপী প্রকৃতিকর্মী ও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে। এই একইদিনে পরিকল্পিত আরো নানা কার্যকলাপ এখান থেকে জানা যায়।

উল্লেখযোগ্যভাবে “বিলুপ্তপ্রায় রাষ্ট্রদ্রোহ” এর (নথিতে এক্সআর নামেও পরিচিত) একই দিনে জাতীয় রাজধানীতে কৃষকদের ট্র্যাক্টর মিছিল হিংসাত্মক রূপ ধারণ করেছিল।

নথিতে দেখানো হয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্রের মধ্যে কেন তীব্র অবজ্ঞা নিয়ে প্রজাতন্ত্র দিবসকেই উদ্দেশ্য করা হয়েছে। এখানে বলা হয়, “ভারতের দুর্বল নাগরিকদের মানবাধিকার উল্লঙ্ঘন, হিংসা ও ক্রূরতাপূর্ণ অবজ্ঞা করার একটি দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে”।

২৬শে জানুয়ারি সরকার ফৌজের প্যারেডের মাধ্যমে এই সংবিধানের বিধিবদ্ধ গ্রহণ করাকে উদযাপন করবেন এবং এরই মধ্যে তাঁদের নিজস্ব সংবিধানকে উল্লঙ্ঘন করে এমন ক্ষতিকর নীতিও তাঁরা চিরকাল জিইয়ে রেখেছিলেন।

ভারতের কৃষক এবং অন্যান্য নাগরিকদের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি দেওয়া উচিত- পৃথিবীর জানা উচিত যে ভারতবর্ষ গণতন্ত্র থেকে পিছু হটছে, ফ্যাসিবাদের কাছে মাথা নিচু করে কঠোর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। যেহেতু এই সকল আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপ রয়েছে তাই রাজ্য দ্বারা সম্পাদিত কোনো হিংসা এবং আরো গণহত্যা হয়নি”।

এটি পরবর্তীতে পাঠককে অনুরোধ করে “ভারতীয় দূতাবাস, সরকারি দপ্তর, গণমাধ্যম দপ্তর (এমনকি আদানি-আম্বানির দপ্তর) এ বিশ্বজনীনভাবে” “শারীরিক প্রতিরোধ” গড়ে তুলতে।

নথির মধ্যে আছে একটি “টুলকিট”, অনেক ছবি, “নমুনা” ও “দলিল” আছে বিভিন্ন ভাষায়, যেখানে নানা ভাষায় পরিকল্পিত কার্যকলাপ লেখা আছে, যার মধ্য থেকে পাঠক নির্বাচন করতে পারেন। নথিতে বলা হচ্ছে, “ভারত সরকারের উপর চাপ বৃদ্ধি করা মুখ্য কাজ” এবং তাঁরা পাঠকদের এইগুলি ব্যবহার করতে অনুরোধ করে।

নথিতে আরো লেখা আছে যে “এই বিষয়ে ইংল্যান্ডের সাংসদদের অত্যন্ত আগ্রহ আছে” এবং পাঠকদের অনুরোধ করে যাতে তাঁরা ইংল্যান্ডের সাংসদদের কাছে দরখাস্ত করে।

বলা হয় যে এখন দুইভাবে ইংল্যান্ডের সাংসদদের ভারতীয় কৃষকদের সমর্থন করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। প্রথমে কৃষির উপর চিন্তামূলক ভাবনা ও ইংল্যান্ড-ভারত পরিকাঠামো টেকনিক্যাল সমবায় সুবিধা (আইটিসিএফ) এর অধীনে ভারতকে নিয়ামক হিসাবে ব্যবহার করা হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ও অন্যান্য দেশে জীবাণুনাশক রপ্তানি করা বন্ধ করে।

নথিটিতে পাঠককুলকে অনুরোধ করা হয়, তাঁরা যেন আদানি ও আম্বানিদের মত সংস্থাগুলি পরিত্যাগ করেন, বলা হয়, ” কোটিপতি মুকেশ অম্বানি এবং গৌতম আদানির ধন সম্পত্তি বৃদ্ধি পায় মোদী শাসনে হাতে হাত রেখে বিশ্বের মানুষদের শোষণ করে, ভূমি ও সংস্কৃতির ক্ষতি করে”।

এটি পাঠককুলকে “মোক্ষম জায়গায়” আঘাত করতে বলে।

এই নথিটির অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর “পরামর্শ দেওয়া পোস্টগুলি”র অংশ যেখানে ট্যুইটের একটি সিরিজ দেওয়া আছে যা এই আন্দোলনের একটি অংশ হিসাবে পোস্ট করা যেতে পারে। আশ্চর্যভাবে, এই পরামর্শ দেওয়া ট্যুইটগুলির মধ্যে একটি রেহানার উদ্দেশ্যে রয়েছে, যিনি গত পরশু শব্দের পর শব্দ হুবহু নকল করে লিখে দিয়েছিলেন।

Explained: Mystery Of Greta Thunberg’s Deleted Toolkit On Farmers’ Protests And Invisible Hands Of Digital Propaganda 

এই নথির মাধ্যমে এই সন্দেহ আর জোরালো হয় যে ভারতে কৃষকদের আন্দোলনকে কিছু গোষ্ঠী তাঁদের নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছে; এই আন্দোলনগুলির পিছনে অদৃশ্য হাত ও পকেট রয়েছে; বিখ্যাত ব্যক্তিত্বরা যে সোশ্যাল মিডিয়ার পোস্টগুলি করেন, তা কোনো সংগঠিত বিক্ষোভ নয়।

 

যাই হোক, বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের কোনো দেশের সুরক্ষা ও সার্বভৌমিকতার ক্ষতিসাধন করার জন্য বিদেশ থেকে সাহাযযপ্রাপ্ত নানা আন্দোলনের একটি দীর্ঘ ইতিহাস আছে।

ভারতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মন্ত্রক (এমইএ) গতকাল একটি বিবৃতি জারি করেছিলেন এবং তাতে বলেছিলেন, “তথাপি, অন্য কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী তাঁদের স্বার্থ এই সব আন্দোলনে চাপিয়ে দিচ্ছে ও তাঁদের বিপথে চালনা করছে, এটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক। ২৬শে জানুয়ারি, ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের দিন এটি আরো অসাধারণভাবে প্রত্যক্ষ করা গিয়েছিল। ভারতীয় সংবিধানের বিধিবদ্ধ গ্রহণের মত পবিত্র জাতীয় দিনটি ভারতীয় রাজধানীতে হিংসা ও বর্বরতার দ্বারা কলঙ্কিত হয়ে গিয়েছিল”।

এমইএ বলেন, “এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ভারতের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক মদত জোরালো করার জন্যও উঠে পড়ে লেগেছে, এই সকল দুর্বৃত্তদের উস্কানিতে বিশ্বের বহু জায়গায় মহাত্মা গান্ধীর মূর্তির অবমাননা করা হয়েছে। এটি ভারত ও সর্বত্র কোনো সভ্য জাতির জন্যই অত্যন্ত বিরক্তিকর”।

এমইএ এই বিবৃতিতে বলেন, “এই জাতীয় কোনো ব্যাপারে মন্তব্য করার জন্য ছোটার পূর্বে আমাদের দাবি করতে হবে যাতে তথ্যগুলি সঠিকভাবে যাচাই করা হয় এবং সমস্যাগুলির যথাযথ বোঝাপড়া হয়। যখন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং অন্যান্যরা সোশ্যাল মিডিয়ায় এই জাতীয় প্রভাব বৃদ্ধি করা সংবেদনশীল হ্যাশট্যাগ ও মন্তব্য ব্যবহার করেন, তা কখনই যথাযথ নয় ও দায়িত্বপূর্ণ কথা নয়”।

আশ্বস্ত হবার ব্যাপার এই যে দিল্লী পুলিশ এই বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে এই নথির স্রস্টাদের বিরুদ্ধে মামলা দাখিল করেছে, এবং তাদের তদন্ত শুরু করেছে।


মূল লেখাটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।