হিন্দু ধর্মের অপব্যাখ্যা কে করছে? হিন্দুধর্মের হিন্দুবিদ্বেষী সংস্করণ

0
1470

ইন্ডিয়া/ হিন্দুস্তান / ভারতের একটি বহু পুরাতন ইতিহাস রয়েছে। অন্ততপক্ষে হিন্দু ধর্মের সংস্কৃতি কিছুটা বর্ণনা না করে ভারতীয় সংস্কৃতি বর্ণনা করা যায় না।  ভারতের সুপ্রিম কোর্ট হিন্দু ধর্ম বা হিন্দুত্বকে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে যে এটি কেবল একটি ধর্ম নয় বরং একটি “জীবনযাপনের পদ্ধতি”। যখন আমরা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কথা বলি আমরা প্রায়শই সনাতন ধর্ম- ধারণা/পরিভাষাটি শুনি।  হিন্দু ধর্মের সাথে সনাতন ধর্মের কী সম্পর্ক?  হিন্দু ধর্ম সনাতন ধর্মের ভিত্তিস্বরূপ কাজ করে (এটি সাধারণ অর্থে চিরন্তন মূল্যবোধ/কর্তব্য ইত্যাদি হিসাবে ব্যাখ্যা করা যায়) যা প্রকৃতিতে আগে থেকেই অন্তর্ভুক্ত। সনাতন ধর্ম আপনাকে ভাগ করতে শেখায় না, জোর করে ধর্মান্তর করে না, জোরজবরদস্তিমূলক কিছু করে না, এবং এটাও শেখায় না যে আমরা/আমাদের ধর্ম পুরোপুরি সঠিক এবং অন্যরা ভুল। এটি একজন নির্দিষ্ট কাউকে স্বীকার করলেও, তাঁর সেবা করার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পন্থা ও ভিন্ন ভিন্ন পথ স্বীকার করে নেয়।

ভারতে আক্রমণের ইতিহাসটি সুদীর্ঘ। আমি যখন স্কুলে ছিলাম, তখন আমি ভাবতাম যে কেন আমরা ইতিহাস পড়ছি। তবে সম্প্রতি আমি বুঝতে পেরেছি যে কেন ভারতের ইতিহাসের সঠিক চর্চা আমাদের জাতি, তার সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা অর্জন করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ছিল। দুঃখের বিষয়, ভারতীয় ইতিহাসের একটি বৃহৎ অংশটি সেই শক্তিগুলি দ্বারা চালিত হয়েছিল যারা সেই বিকৃত ইতিহাসকে অতীতের সঠিক সংস্করণ হিসাবে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করেছিলেন। যেসব আক্রমণকারীরা দেখতে পেল যে ভারতবর্ষ তার সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা সমৃদ্ধ, তারা ভারতের সমৃদ্ধ বহুপর্বের ইতিহাসকে মুছে ফেলতে বা নির্মূল করতে বা এমনকি গোপন করে ফেলার জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা করেছিল।

দেশের বিদ্যমান সামাজিক পরিস্থিতি এবং প্রকৃতির বৈচিত্র্যকে এই আক্রমণকারী বাহিনীর সুবিধার জন্য অপব্যবহার করা হয়েছিল, এর ফলে দেশের নাগরিকদের অতীতের প্রতি অসম্মানের পাশাপাশি জনগণের মধ্যে উপজাতীয়তাবাদ ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষও জন্ম নিয়েছিল।  দুর্ভাগ্যবশত, স্বাধীনতার পরেও আমরা এই দেশের মানুষ বহু ক্ষেত্রে এই ঔপনিবেশিক, সাম্রাজ্যবাদবাদী শিক্ষাব্যবস্থা অনুসরণ করে চলেছি যা ‌ঔনিবেশিক ব্রিটিশদের দ্বারা প্রবর্তিত হয়েছিল এবং পরবর্তীকালে অন্যান্য হিন্দু বিরোধী/ ভারত বিরোধী দলসমূহ এটিকে অনুমোদন করেছিল অথবা আরও শক্তি প্রদান করেছিল।  এইভাবে, কোথাও কোথাও, আমরা সনাতন ধর্মের মূল ভাবটি হারিয়েছি যা আসলে ভারতীয় সংস্কৃতির মেরুদণ্ড গঠন করত।

সম্প্রতি, আমি লক্ষ্য করেছি যে সনাতন ধর্ম সম্পর্কে প্রচুর মিথ্যা প্রচার রয়েছে। আমি সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচুর সংখ্যায় পোস্ট দেখতে পাচ্ছি, যেগুলি ভারতীয় সংস্কৃতি বা ঐতিহ্যকে ক্ষুণ্ণ করার চেষ্টা করছে এবং তাদের কুসংস্কার ও সামাজিক কুরীতিতে ভরা সাংস্কৃতিক ক্ষেত্র হিসাবে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে চলেছে।  বহু লোকের মগজ ধোলাই হয়ে গেছে ইতিমধ্যে নিঃসন্দেহে এবং হিন্দু/ভারতীয় সংক্রান্ত সমস্ত বিষয় সম্পর্কে একটি নেতিবাচক এবং প্রত্যাখ্যানমূলক মনোভাব তৈরি হয়েছে। দুঃখের বিষয়, এর মধ্যে বেশিরভাগ‌ই হ’ল ভারতের শহুরে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চ-মধ্যবিত্ত যুবকরা, যারা হৃষ্টপুষ্ট এবং আদুরে, কিন্তু কোণঠাসা ও বিচ্ছিন্ন।

জনসাধারণের মধ্যে হিন্দু ধর্মের একটি নতুন ব্যাখ্যা চালু করা হয়েছে যা মূল হিন্দু সংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ পৃথক।  সনাতন ধর্মের এই নতুন, হিন্দুভীতির সংস্করণটিকে ভারতীয় সমাজের সমস্ত সামাজিক কুফলের জন্য দোষী হিসাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এই হিন্দুভীতির হিন্দুত্ব এর মূল বৈশিষ্ট্যগুলি হল:

  • শ্রীমদ্ভাগবত গীতা, বেদ, স্মৃতি, শ্রুতি, ন্যায় শাস্ত্র ইত্যাদির মাধ্যমে এটিকে এমন ধর্ম হিসাবে দেখানো হয়েছে যা বর্ণপ্রথা এবং সুবিধাভোগীদের বর্জনকে সমর্থন করে। ভগবান রাম, ভগবান কৃষ্ণ এবং অন্যদের মতো হিন্দু সংস্কৃতির মূল রূপগুলিকে সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে, যাঁরা তথাকথিত নিম্নবর্ণের অন্তর্ভুক্ত, তাঁদের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করেন এবং যাঁরা উচ্চ বর্ণের তাঁদের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট আচরণ করেন। ভগবান রাম বা ভগবান কৃষ্ণ যে অসুর বা লোকদের যুদ্ধে হত্যা করেছিলেন, দেবী দুর্গা যে মহিষাসুর নিধন করেছিলেন, প্রায়শই তাঁদের এই “নিম্ন বর্ণের” প্রতিনিধি হিসাবে বিবেচনা করা হয়, যাঁদের উপর “উচ্চ বর্ণ” অপরিসীম প্রভাব বিস্তার করেছিল এবং তাঁদের প্রতি অবিচার করেছিল। উক্ত প্রচারটি কেবল মিথ্যা ও ঘৃণ্য নয়, বরং বিচ্ছিনতা ও বিরোধকে উৎসাহিত করার জন্যই এটি নির্মিত হয়েছে।
  • আর্য আক্রমণ তত্ত্ব (এআইটি) প্রায়শই হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম ধর্মের এই ব্যাখ্যার সাথে সংযুক্ত থাকে, যা মোটামুটিভাবে অনুবাদ করা হয়েছে এবং “বর্ণপ্রথা” হিসাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। দাবি করা হয় যে আর্যরা উচ্চ বর্ণের লোক ছিলেন, যাঁরা বেদ, ভগবত গীতা এবং অন্যান্য পবিত্র গ্রন্থগুলিকে বাকী জনগোষ্ঠীর অনুগ্রহপূর্বক ও অধিকার বিস্তার করার জন্য রচনা করেছিলেন। স্পষ্টতই, এই আর্যরা ছিল “বহিরাগত”, যারা ভারতকে “আক্রমণ” করেছিল এবং বর্তমানের দলিতদের “দ্রাবিড়” নামে অভিহিত করে ভারতের আদি অধিবাসীদের পরাধীন করে রেখেছিলেন।
  • হিন্দু বিদ্বানরা হিন্দুদের ইতিহাস এবং সাংস্কৃতিক স্মৃতি নিয়ে কারচুপি করে প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণগুলি পৌরাণিক, যদিও এই মহাকাব্যগুলিকে হিন্দু পণ্ডিতেরা ইতিহাস হিসেবে বিবেচনা করেছেন। কেউ কেউ ইতিহাস থেকে কিছু নির্দিষ্ট তারিখের দিকেও ইঙ্গিত করে বলেছিল যে রামায়ণ বা মহাভারতের ঘটনা কখনই ঘটেনি কারণ মানুষের তখনও অস্তিত্ব ছিল না। এটি মূলত বিশ্বসাহিত্যের দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের সাথে যুক্ত মহৎ ঐতিহ্যের সরাসরি প্রত্যাখ্যান।  এত গভীর বিকৃতি ঘটানো হয়েছে যে ভারতীয় লেখার এই অসামান্য নমুনাগুলি ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির বেশিরভাগ সাহিত্য বিভাগগুলিতেও শেখানো হয় না।
  • এই ব্যাখ্যানটির সাথে যুক্তিযুক্ত হবার জন্য হিন্দু সংস্কৃতিকে নির্দিষ্টভাবে তৈরি করা উদাহরণগুলির মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর হিসেবে দেখানো হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে সতী প্রথার প্রসার, ঋতুস্রাবকালে মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ, শবরীমালায় আয়াপ্পা মন্দিরের গর্ভগৃহে প্রবেশ নিষেধ, সীতার প্রতি রামের ব্যবহার ইত্যাদি সম্পর্কে একটি বড় মিথ্যাচার রয়েছে।
  • অভিযোগ করা হয় যে ভগবত গীতা সহিংসতা বা হিংসার প্রচার করে। এই মহান পাঠ সম্পর্কে হিন্দুভীতিমূলক যে আখ্যান বিশ্বজুড়ে কয়েক মিলিয়ন মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে তা হ’ল যোদ্ধা অর্জুন শান্তি কামনা করেন, যুদ্ধকে পাপ বলে বিশ্বাস করেন, কিন্তু মহাভারতের যুদ্ধের পিছনে শ্রীকৃষ্ণই ছিলেন প্রধান প্রেরণা। যুদ্ধ-সমর্থক বনাম শান্তি-সমর্থনের বিবরণটি বিশেষত আধুনিক হিন্দুদের মন ও হৃদয়ে গীতার আধ্যাত্মিক মর্যাদাকে হ্রাস করার লক্ষ্য বলে মনে হচ্ছে।
  • প্রতিমা উপাসনার সমালোচনা এবং “মূর্তি পূজারী”দের আব্রাহামীয় ধারণাগুলি প্রসারিত করা। এর মধ্যে “বানর দেবতা” (ভগবান হনুমানের কথা উল্লেখ করা হয়), “হাতি দেবতা” (ভগবান গণেশের কথা উল্লেখ করা হয়), এবং “অবিশ্বস্ত স্বামী” (ভগবান রামের কথা উল্লেখ করা হয়) এর মতো সম্বোধনগুলির সংক্ষিপ্ত ব্যবহার জড়িত আছে।
  • কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নিহত দুর্যোধন ও কর্ণের মতো ধর্মবিরোধীদের এই মহাকাব্যে গৌরবান্বিত করার প্রবণতা রয়েছে। কর্ণকে এমন একজন মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে যিনি প্রচুর ত্যাগ ও দাতব্য ত্যাগ বা ত্যাগ ও দান করেছিলেন, তবুও শ্রীকৃষ্ণের পরিকল্পিত প্রতারণার দ্বারা তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল। কর্ণকে এমন একটি চরিত্র হিসাবেও চিত্রিত করা হয়েছে যিনি “সুত পুত্র” হিসাবে যথেষ্ট পরিমাণে স্বীকৃতি পাননি – সামাজিকভাবে কুন্তীর পুত্র হিসাবে তাঁর “ন্যায়সঙ্গত” পদ থেকে বঞ্চিত ছিলেন। এখানে অঙ্কিত চিত্রটি প্রথম আলোচ্য বিষয়ের সাথে সম্পর্কিত – শ্রীকৃষ্ণ এবং পাণ্ডবরা হলেন “উচ্চ বর্ণ” এবং একলব্য, কর্ণ এবং অন্য যাঁরা কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধ করেন, তাঁরা “নিম্ন বর্ণের” প্রতিনিধি।

গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে মতামতের পাশাপাশি গবেষণার কাজের ক্ষেত্রেও এই বিষয়গুলি বারবার ছলচাতুরির মাধ্যমে তৈরি করা হয়। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে শর্ট পোস্ট এবং ফিল্ম, উপন্যাস ইত্যাদির স্টোরিলাইনগুলি এই হিন্দুভীতিমূলক বিবরণগুলিকে প্রচার করে। দিনের শেষে, সন্দেহ নেই যে তরুণরা হিন্দু হিসাবে তাদের পরিচয়কে অস্বীকার করে এবং তাঁরা এই জাতীয় প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে শুরু করে:

  • কেন আমি হিন্দু ধর্ম/সনাতন ধর্মকে অনুসরণ করার চেষ্টা করব যাকে লোকেরা উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে?
  • রাম, কৃষ্ণ, শিব এবং হিন্দু দেব-দেবীদের মূর্তি সম্পর্কে পড়া এবং শিক্ষা লাভের প্রাসঙ্গিকতা কী?
  • কোনও জাতির সংস্কৃতিগত মূল্যবোধকে কেন সম্মান করব যখন তাঁর প্রবক্তারা (তথাকথিত আর্যরা) আদিবাসীদের (দ্রাবিড়দের) উপর অত্যাচার চালিয়েছে এবং ভারতে তাঁদের (আর্যদের) সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করেছে?

সনাতন ধর্ম আমাদের কোনও কিছুতে অন্ধভাবে বিশ্বাস করার পরামর্শ দেয় না। এটি আমাদের জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন দিক – আমাদের সর্বনিম্ন লালসা থেকে শুরু করে আমাদের সর্বোচ্চ আত্মানুসন্ধানে কারণ, যুক্তি এবং বিশ্বাস উভয়ের মাধ্যমেই অনুপ্রাণিত করে।  বর্তমানে, আমরা যখন সনাতন ধর্ম সম্পর্কিত ধারণা এবং বিষয়গুলিকে স্পষ্ট করার চেষ্টা করি, তখন আমরা বর্ণবাদ, স্ত্রীবিদ্বেষের প্রর্বতক হিসেবে গণ্য হ‌ই এবং কোনো “স্বর্ণযুগ”-এর প্রসঙ্গে ফিরে যাওয়া মানুষ হিসেবে বিবেচিত হ‌ই।  অতএব এই সময়ের প্রয়োজন হ’ল, ভারতের বহুমুখী ইতিহাসকে সুস্পষ্ট বোধগম্যতা করে তোলা এবং হিন্দুদের ও হিন্দু ধর্মকে আসুরিক রূপ দেওয়ার আনুষ্ঠানিক প্রয়াসকে চ্যালেঞ্জ করা।

হিন্দুভীতি প্রচারমূলক সংস্থাগুলির ক্রমবর্ধমান সংখ্যা ভবিষ্যতে প্রজন্মকে ভারতীয় সংস্কৃতি এবং সনাতন ধর্মের মৌলিক আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য এবং চরিত্র সম্পর্কে শিক্ষিত করার জরুরি প্রয়োজনের আহ্বান জানায়। হিন্দুবিরোধী ও ভারতবিরোধী শক্তির সংখ্যা বৃদ্ধি রোধে সকল শ্রেণি ও পরীক্ষার জন্য বিদ্যমান হিন্দুভীতি পাঠ্যক্রমটির পরিবর্তন করার এটাই এখন সঠিক সময়। দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে, আসুন আমরা এই চিন্তাভাবনা বন্ধ করি যে ধর্ম নিজেকে স্বয়ং রক্ষা করবে এবং ধর্মকে রক্ষা করার পরিবর্তে আমাদের জাতিকে রক্ষা করার জন্য তৎপর হতে হবে।

মূল লেখাটি ইন্ডিয়া ফ্যাক্টস পত্রিকায় প্রকাশিত, লিখেছেন মেঘা রমেশ। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা।