বিধাতার হাতে লেখা গান-৪৫

অভীক মুখোপাধ্যায় 

(চতুর্চত্বারিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৪৫

১৯৬২ সালের ভারত – চিন যুদ্ধকে অনেকে যুদ্ধ বলে গণ্যই করেন না। দুদেশের কেউই সীমারেখা অতিক্রম করেনি। মানে, দুদেশের নিজ – নিজ সীমারেখানিজেরাই লঙ্ঘন করেনি আর কি। ইংরেজ সাহেব ম্যাকমোহন কাগজের ওপরে একটা সীমারেখা এঁকে দিয়েছিলেন, সেটাকে মাটিতে টানেননি। ওই বিজন জনপ্রান্তরের রুক্ষ্ম বুকের ওপরে কোথায়, কোনখানে কতবড় কাল্পনিক দাগ টানা হয়েছে, তা কেবল এই দুদেশের মাথারাই বলতে পারবেন।চিন যুদ্ধ শুরু করলেও তিন সপ্তাহের জন্যে একটা বিরতি দিয়েছিল, এর মধ্যে কিন্তু এগোয়নি। কিন্তু কেন?

চিন প্রাথমিক ভাবে আক্রমণাত্মক মনোভাব দেখালেও তার অভ্যন্তরীণ অবস্থা ভালো ছিল না। অর্থনীতির ক্ষেত্রে গ্রাফের দশ শতাংশ নিম্নমুখীতা দেখা গিয়েছিল সেইসময়ে। সত্যি বলতে গেলে সেদিনের ভারত তুলনামূলক ভাবে দুর্বল হলেও ভারত –বিজয়ের সাধ বা সাধ্য কোনওটাই সেদিনের চিনের মনে ছিল না। ভুলে গেলে চলবে না যে, এশিয়া কখনও সাম্রাজ্যবাদী শক্তির জন্ম দেয়নি। চিনও সাম্রাজ্যবাদী ছিল না।

তাহলে চিন কী?

চিন হল একটি প্রভুসত্তাবাদী রাষ্ট্র।

তাই বলে কি চিন হাত – পা ছড়ায়নি?

দিব্যি ছড়িয়েছে। তিব্বত জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। কিন্তু চিন যখন যা করেছে, তা নিজের সীমান্তকে সুরক্ষিত করতে করেছে। এমনকি ২০২০ সালের গালওয়ানে চিন – ভারত দ্বৈরথ ভারতকে সাবধান করতে গিয়েই ঘটিয়েছিল চিন।  

যুদ্ধ থামিয়ে চাউ এন লাই ২৮শে অক্টোবর দিল্লিতে একটি সমঝোতা পত্র পাঠালেন। তিনটি শর্তের কথা লেখা ছিল —

১. সীমান্ত – বিবাদের শান্তিপূর্ণ সমাধান

২. দুটি দেশই লাইন অব কন্ট্রোল থেকে কুড়ি কিলোমিটার করে পিছিয়ে যাবে এবং

৩. দুদেশের প্রধানমন্ত্রী একসঙ্গে বার্তা দেবেন।

এই অফার ১৯৫৯ সালেও পেয়েছিলেন নেহরুজি, কিন্তু এর অর্থ আকসাই চিন ছেড়ে দিতে হবে, বদলে পাওয়া যাবে সেই অরুণাচল যা আগে থেকেই আমাদের। তাই ১৯৫৯ সালেও নেহরুজি এই আমন্ত্রণ ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারে? থাং – লা পাসে হেরে যাওয়া ভারতের কাছে এবারের এই সমঝোতা পত্র আমন্ত্রণ ছিল না, এবারে ছিল নিমন্ত্রণ। কিন্তু এবারেও পণ্ডিতজি মানলেন না। এক কথায় নাকচ করে দিলেন। আত্মসম্মানে লেগেছিল। তাছাড়া এর কিছুদিন আগেই গোয়া থেকে পর্তুগিজদের তাড়াতে পাড়ায় সেনাবাহিনীর মনে বেশ শক্তি এবং স্পর্ধা সঞ্চিত হয়েছিল। প্রাথমিক চৈনিক বিপর্যয়ের পরেও তাই পণ্ডিত নেহরুজি সেনার বাহুবলে আস্থা রেখেছিলেন। আর ছিলেন নেহরুজির ক্যাবিনেটের ইভিল জিনিয়াস মেনন। তিনি অদ্ভুত সব পরিকল্পনা বানাতেন। তিনি চাইছিলেন তিব্বতীয় গেরিলারা যুদ্ধে নামুক। ভারতের হয়ে নামুক। শুনতে অদ্ভুতই লাগে এমন যুদ্ধনীতি। তবে আরও একটা বিষয় ছিল বলেই নেহরুজি সেদিন এই সমঝোতা পত্রে সই করেননি। তিনি কেনেডির দেওয়া চিঠি পড়ে মনে জোর পেয়েছিলেন। আমেরিকার আশ্বাস পেয়ে সাহস পেয়েছিলেন। ওই চিঠি না – এলে হয়তো ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো।

কেনেডি কথা রেখেছিলেন। ২রা নভেম্বর থেকে শুরু করে প্রত্যেক দিন আটটা করে মার্কিন বোয়িং বিমান কলকাতায় অস্ত্রবর্ষণ করছিল। এই প্রথমবার মার্কিন সহযোগীতায় ভারতের প্রতিরক্ষার দিকটা সশক্ত হয়ে উঠছিল।  

থাং – লা পাসের দক্ষিণে সে –লা পাসের কাছে ভারতীয় সৈন্যরা একেবারে নতুন উদ্যম নিয়ে ইনফ্যান্ট্রি সামলাতে শুরু করল, কিন্তু পারল কি?

চিনের সীমান্তে নিযুক্ত ভারতীয় স্থলসেনার সংখ্যা চিনের আর্মির অর্ধেক ছিল। তখন চিনের বায়ুসেনা ভারতীয় বায়ুসেনার চেয়ে পাঁচ গুণ বড়। ভারতের বড় – বড় স্থলসেনা ইউনিটগুলি তখন পাক – সীমান্তে মোতায়েন। সেখান থেকে তাদের সরানো অসম্ভব। সরালেই পাকিস্তান অনুপ্রবেশ ঘটাবে। তারমানে অশান্তি। যুদ্ধের দামামা বাজবে। দুটি ফ্রন্টে একইসঙ্গে যুদ্ধ করে জেতা কার্যত অসম্ভব। তাই সবদিক খতিয়ে দেখে বোঝা গেল একটাই পাঁচিল আছে যা চিনকে ঠেকিয়ে রাখতে পারে, তা কিন্তু ভারতের আর্মি কিংবা বায়ুসেনা নয়, তা হল হিমালয় পর্বতমালা, দুর্ভেদ্য হিমালয়।

কেনেডি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছিলেন। তিনি পাকিস্তানকে দেওয়া কথা ভেঙে দিলেন যে, আমেরিকা ভারতকে কোনও অস্ত্র দেবে না। এবং তিনি আয়ুব খানকে বার্তা পাঠালেন পাকিস্তান যেন কোনও ভাবেই ভারত – চিন যুদ্ধের ফায়দা লুটতে ভারতকে আক্রমণ না করে।  

আয়ুব খান উত্তর দিলেন, ‘ঠিক আছে। তবে এর পরিবর্তে আমেরিকা আমাদের কাশ্মীরকে ফিরে পেতে সাহায্য করুক। আর যত অস্ত্র আপনি ভারতকে দিয়েছেন, তা যেন কখনওই ভারত – পাকিস্তান সীমান্তে দেখা না – যায়। এমনিতেও ভারতই চিনকে আক্রমণ করেছে। আমেরিকা শুধুমুধুই এসবের মধ্যে ঢুকছে।’

ভারতে তৎকালীন মার্কিন রাজদূত গালব্রেথ পণ্ডিত নেহরুজিকে বললেন, আপনিও একটা চিঠি লিখুন। কিন্তু নেহরুজি সাফ মানা করে দিলেন। বললেন যে, কাশ্মীর ইস্যুতে তিনি কিচ্ছু লিখবেন না। গালব্রেথও নাছোড়বান্দা। এই হ্যাঁ – না, হ্যাঁ –না করতে – করতে শেষ অবধি চিঠি লিখেই ফেললেন পণ্ডিত নেহরুজি। আয়ুব খানকে লিখলেন। তবে পণ্ডিতজিও ক্ষুরধার স্টেটসম্যান পলিটিসিয়ান, চিঠিতে প্রশংসা দিয়ে আরম্ভ করলেন, কাশ্মীর নিয়ে একটি কথাও রাখলেন না —

‘ফিল্ড মার্শাল, আপনি নিজে একজন সৈনিক ছিলেন, আর এটাও জানেন যে চিন আমাদের আক্রমণ করেছে। যখন কোনও দেশকে কেউ আক্রমণ করে, তখন সেদেশের সৈনিকের আত্মধর্ম কী হওয়া উচিত তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আমরা নিজেদের দেশের সীমান্তের সুরক্ষার জন্যে দায়বদ্ধ।’

একইসঙ্গে দুটো ফ্রন্টে যুদ্ধ করে জয় পাওয়া যেমন ভারতের পক্ষে সোজা কাজ ছিল না, তেমন আবার এটাও সত্যি যে আর্মি চিনকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও ভারতীয় বায়ুসেনা এবং নৌবাহিনী কিন্তু বসেই ছিল। তাই পাকিস্তান এদিকে তাকানোর সাহস করেনি। ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো খবর পেল চিন সিকিমের পথে এসে শিলিগুড়ি করিডোরে দখল নিয়ে মুরগির গলা কাটার মতো কেটে দেবে ‘চিকেন নেক’। চিনতে পেরেছেন তো চিকেন নেক’কে? পশ্চিমবঙ্গের মানচিত্রের দিকে তাকালে মাথায় দার্জিলিং নিয়ে যে সরু মতো গলাটা দেখা যায়, ওটাই চিকেন নেক। তাই নেহরুজি একটা ক্যালকুলেটিভ রিস্ক নিলেন। পাকিস্তানের সীমান্ত থেকে স্থলসেনাকে সরিয়ে উত্তর – পূর্বের চিন সীমান্তে পাঠাতে লাগলেন। নেহরুজিকে তাই এই রিস্কটুকু নিতেই হয়েছিল।

১৪ – ২০ শে নভেম্বর, ১৯৬২। এই একটা সপ্তাহে চিন তেড়ে এলে ভারতের দিকে। আক্রমণের তীব্রতা আগের চেয়ে অনেক বেশি মনে হল। ততদিনে আমেরিকা থেকে অস্ত্রশস্ত্র এসে গেছে ভারতে, হলে কী হবে সেগুলোকে চালানোর মতো প্রশিক্ষণ নেই। এসব মাইনাস পয়েন্ট নিয়েই কুমায়ুন রেজিমেন্ট মেজর শয়তান সিং – এর নেতৃত্বে দুর্ধর্ষ ভাবে লড়লেন। অসংখ্য গুলিতে বিদ্ধ হয়েও মেশিনাগান চালাতে – চালাতে শত্রুপক্ষকে নিকেশ করে তবেই শহিদ হয়েছিলেন শয়তান সিং। চিন সেদিন হারাতে পারলেও ভারতকে ভাঙতে পারেনি।

আকসাই চিনের গোটাটাই তখন চিনের কবলে। চিন এবার এগোচ্ছিল লেহ সেক্টরের দিকে। অরুণাচলের এলাকা মিলিয়ে প্রায় ৩২০০০ স্কোয়ার কিলোমিটার তখন চিনের পায়ের নীচে। বিজ্জি কৌল যা হোক করে প্রাণ বাঁচিয়ে দিল্লি পালিয়ে এলেন।

১৯শে নভেম্বর নেহরুজি কেনেডিকে চিঠি লিখলেন। এই চিঠি এরপর প্রায় ৫০ বছর গোপন নথিপত্রের মধ্যে রাখা হবে, সার্বজনীন করা হবে না ভারতেরই অনুরোধে। ২০১০ সালে সামনে আসবে কেনেডিকে লেখা চিঠিখানি। আমেরিকা অস্ত্র পাঠালেও নিজে কিন্তু মাঠে নামেনি। নেহরুজি লিখেছিলেন, মার্কিন বায়ুসেনা যুদ্ধে আসুক। তিনি শঙ্কা জানিয়েছিলেন যে, যদি আমেরিকান এয়ারফোর্স না – আসে, তাহলে হয়তো সম্পূর্ণ উত্তর – পূর্ব ভারতটাই ভারতের হাতছাড়া হয়ে যাবে।

ভারতের কি বায়ুসেনা ছিল না?

ছিল। কিন্তু সেই বায়ুসেনা একলা লড়তে গেলে তার যে প্রত্যঘাত আসত, তা হতো কল্পনাতীত। অনেকেই আজ প্রশ্ন তোলেন যে সেদিন ভারত নিজের বায়ুসেনাকে কেন পাঠায়নি। একথা কি তাঁরা ইচ্ছে করে ভুলে যান যে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত চিনা বায়ুসেনার সামনে আমাদের দেশের বায়ুবাহিনী তাসের ঘরের মতোই ভেঙে পড়তে পারত? পরিসংখ্যান মাথায় রেখেই নেহরুজি সেদিন কেনেডিকে লিখেছিলেন, অন্ততপক্ষে ১২টি সুপারসনিক ফাইটার স্কোয়াড্রন, ২টি B – 47 বোম্বার স্কোয়াড্রন, আর ১০০০০ ট্রুপ দরকার।  

কেনেডি চটপট উত্তর পাঠালেন, ‘আমি এখুনি বঙ্গোপসাগরে আমাদের নৌবাহিনী পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

পণ্ডিত নেহরুজি নৌসেনা চাননি, তবুও কেনেডি ওটার কথাই বললেন কেন? কারণ কেনেডি যুদ্ধ এড়াতে চাইছিলেন। বায়ুসেনা পাঠালে যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী ভাবে বেড়ে যেত। নৌসেনা পাঠালে তা ভারতের কাজে না – লাগলেও চিনের কাছে একটা মেসেজ যাবে, আমেরিকা ভারতের সঙ্গে আছে। চিন যুদ্ধ থামিয়ে দেবে। আর ঠিক তা-ই হল। ম্যাজিকের মতো!

ঠিক তার পরদিন, মানে ২০শে নভেম্বর, মাও ঘোষণা করলেন, ‘আমরা যুদ্ধ থামিয়ে দিচ্ছি। কথা দিলাম, ডিসেম্বরের এক তারিখের আগেই লাইন অব কন্ট্রোল থেকে কুড়ি কিলোমিটার পেছনে সরে আসব। কিন্তু ভারতীয় সেনাও যেন এল ও সি থেকে কুড়ি কিলোমিটার ভেতরে সরে যায়, আর কখনও এদিকে আসার হিম্মত না – করে।’

সেদিন রাতে ভারতে শান্তি এল। চোরের মতো। লুকিয়ে – লুকিয়ে।

যুদ্ধ থামার বেশ কয়েকটা কারণ ছিল। যেমন চরমতম আবহাওয়া। ডিসেম্বরে ওই সীমান্তের ভয়াল রূপ কে কতখানি সহ্য করতে পারবে তাও একটা প্রশ্ন ছিল। অন্তিম কারণ ছিল কেনেডির ওই মেসেজ। যেমনটা আগেই লিখেছি, কেনেডিকে নেহরুজি চিঠি পাঠিয়েছিলেন এবং সেই চিঠি গোপন দস্তাবেজ হিসেবে বাইরে আসেনি। এই চিঠিকে কী কারণে এত কনফিডেন্সিয়াল ভাবা হয়েছিল কে জানে? রাজনীতি তথা কূটনীতির ধুরন্ধরেরাই বলতে পারবেন। নইলে এমন সাহায্য চাওয়াচাওয়ি আখছার চলত।

অবশ্য কত কিছুই তো অমন গোপন হয়ে রয়ে যায়। প্রি – এস এম এস যুগের সেই গোপন প্রেমপত্রগুলোর কথাই ভাবুন না। সাহস করে পুরুষালি হাতের মুঠো থেকে চলে যেত কোনও প্রেমিকার আঙুলের ফাঁকে। তারপর চালান হয়ে যেত বইয়ের পাতার ভাঁজে কিংবা বুকের গহীন খাঁজে। আমেরিকা আসলে ভারতের প্রেমিক। সে ভারতকে চেয়েছে বহু আগে থেকেই। ভারতীয় রাজনীতিকদের প্রচ্ছন্ন সোশ্যালিস্ট প্রীতি তাকে ভারত থেকে নজর সরিয়ে রাখতে বাধ্য করেছে। অবশেষে ভারতকে দেওয়া কমিউনিস্টদের ধোঁকা আমেরিকাকে তার বছর পর বছর ধরে অব্যক্ত থাকা প্রেম প্রকাশ করার সুযোগ করে দিয়েছে।

ভারত, চিন আর আমেরিকার এই গল্পটা আসলে একটা প্রেম ত্রিকোণের মতো। এই জট আজও খোলেনি। একে অপরকে ভালোবেসে লুকিয়ে – লুকিয়ে দেখে, বিশ্বাসঘাতকতা করে, সাহায্য করে। এটা চলতেই থাকবে। মহাশক্তিরা এভাবেই চলে। ভারত আর চিনের গল্প খোলতাই করে বলতে গেলে একটা গোটা বইও কম পড়ে যাবে। আমরা বরং আমেরিকার দিকে ফিরে যাই। ওখানে তখন বিপ্লব আসছিল।  

(ক্রমশ)