– শমীক লায়েক
পকেট থেকে সিল্ককাট এর প্যাকেট টা বার করে একটা সিগারেট ধরায় সুমন্ত। সামনের অ্যাশট্রেটা প্রায় ভর্তি হয়ে এসেছে, কিন্তু রান্না ঘর পর্যন্ত গিয়ে আর ছাই গুলো পরিষ্কার করতে ওর ইচ্ছা করছে না। চায়ের কাপ থেকে তলানি টুকু গলায় ঢেলে নেয় ও। আজ রবিবার বলে ওর কোনো তাড়া নেই সকালে। শুধু সীমন্তিনী উঠলে ওকে জিজ্ঞাসা করে বাজার টা করে নিয়ে আসবে, কিন্তু তার এখনো অন্ততঃ মিনিট কুড়ি দেরি আছে। ৮ টার আগে সীমন্তিনী বিছানা ছাড়বে না আজ। সিগারেট আর অ্যাশট্রে হাতে নিয়ে ব্যালকনি তে এসে দাড়ায় সুমন্ত। সকালের কলকাতা, অনেক নিচে, অন্ততঃ ১০০ ফুট। এত ওপর থেকে লোকজন আর তাদের ব্যস্ততা সবই কেমন ছোট দেখায়, আর ব্যালকনি থেকে ঝুঁকে ১০০ ফুট নিচে দেখলে শরীরের নিচের থেকে একটা শিরশিরানি উঠে আসে, ও বলে অধঃপতনের ভয়। সীমন্তিনীর এই ফ্ল্যাটে দুটো বেডরুমের সাথে দুটো ব্যালকনি, এই ঘরেরটা পূর্ব মুখী, আর সীমন্তিনীর ঘরেরটা দক্ষিণ।
এই ফ্ল্যাটে এটাই সুমন্তর রুম।
“সুমন্ত….” ঘরের ভেতর থেকে ভেসে আসা ডাকটা অনুসরণ করে সীমন্তিনীর ঘরে আসে সুমন্ত।
“চা করেছিস” জানতে চায় সীমন্তিনী।
“তুই তোর গতরটা একটু নাড়া, বাইরের ঘরে এসে বসলে তবে চা পাবি” উত্তর দিয়ে মুচকি হেসে রান্না ঘরের দিকে হাঁটা দেয় সুমন্ত।
পেছন থেকে চেঁচায় সীমন্তিনী, “এই শালা…. গতর বলবি না, কেমন একটা নোংরা গন্ধ যেন কথাটায়“।
বিছানার পাশ থেকে ঘড়ি টা হাতে নিয়ে দেখে প্রায় ৮ টা বেজে গেছে….. “এবার উঠতে হয়, নয়তো সে ব্যাটাচ্ছেলে খ’চে যাবে এবার” নিজের মনে বলে বিছানা থেকে উঠে সোজা বাথরুমে ঢুকে যায় সীমন্তিনী।
সুমন্ত দুজনের জন্য আরেক প্রস্থ চা বানিয়ে নিয়ে হল ঘরে বসতে বসতেই সীমন্তিনীও এসে বসে।
সকালের খবরের কাগজ টা নিয়ে চোখ বোলাতে থাকে সীমন্তিনী।
“কেন যে আজকের দিনে খবরের কাগজ নিস, অনলাইন সাবস্ক্রাইব করে নে” খোঁচায় সুমন্ত।
“মাইরি এই সক্কাল সক্কাল চা এর সাথে এটা হাতে না পেলে পেট পরিষ্কার হয়না যে, কি করবো বল” কাতর স্বর ভেসে আসে সীমন্তিনীর।
“কনস্টিপেশনের রুগি কোথাকার, কিন্তু কাগজওলারা জানতে পারলে তোকে নিয়ে গিয়ে বাঁধিয়ে রাখবে” আবার চিমটি কাটে সুমন্ত।
“কেন সকাল থেকে পেছনে লাগছিস বলত, যা বাজার যা দেখি। গুছিয়ে সারা সপ্তাহের বাজার করে নিয়ে আসিস” সীমন্তিনী এড়ানোর চেষ্টা করে সুমন্তর খোঁচা গুলো।
“গুছিয়ে বাজার আমি করতেই পারি, কিন্তু সেটা খাবে কে? তুই তো খাস এইটুকু, তায় দিনের বেলা খাস অফিসে” উত্তর দেয় সুমন্ত।
“কেনো, রাত্রে এসে দুজনে খাবো তো, নাকি? যা না, একটু গুছিয়ে বাজার করে দে মনা” উত্তর দিয়ে ওর হাতে একটা লিস্ট ধরিয়ে দেয় সীমন্তিনী। ও জানে, সুমন্তর বাজার করে আসতে এখন প্রায় একঘণ্টা লাগবে, রবিবার সেই মত রান্নার দিদিকে ৯.৩০এ আসতে বলে রেখেছে।
সুমন্ত বেরিয়ে যেতে সীমন্তিনী গিয়ে ঢোকে সোজা রান্না ঘরে। রবিবার সকালের ব্রেকফাস্ট সাধারণতঃ ও নিজেই বানিয়ে নেয়, আজ সুমন্ত বানিয়ে রেখে গেছে। টেবিলে বসে ব্রেকফাস্ট করতে করতে টিভি টা চালিয়ে এম টিভি তে গান শুনতে থাকে। সুমন্ত থাকলে ঘরের মধ্যে একটা উত্তাপ ছড়িয়ে থাকে যেন, ভাবে সীমন্তিনী।
মোবাইলের রিংটোনের সুর ওর চিন্তার জাল কেটে দেয়। হাতে নিয়ে দেখে তিয়াসার ফোন, ওর বান্ধবী, একই অফিস চাকরি করে দুজনে।
“বল ডার্লিং, সক্কাল সক্কাল কি মনে করে“….. হাসতে হাসতে বলে সীমন্তিনী। অসম্ভব সুন্দরী এই তিয়াসা, অফিসে প্রথম দিন আলাপ হওয়ার সময়েই ও বলেছিল তিয়াসাকে যে ও যদি ছেলে হতো, তিয়াসাকে প্রপোজ করত প্রথম দিনেই।
“এই শোন, আমি বিকেলে একটু মার্কেটিং এ যাবো, তুই যাবি তো সাথে“, জিজ্ঞাসা করে সীমন্তিনীকে।
একই পাড়ায় থাকে দুজনে, তাই ওদের অফিস যাওয়া আসা আর এইরকম ছুটির দিনে টুকটাক বেরোনো সবই একসাথেই হয়।
“নারে, আজ বেরোবোনা বিকেলে,” উত্তর দেয় সীমন্তিনী।
“ধুর বাবা, কি করবি ছুটির দিন ঘরে বসে, সুমন্ত থাকলে ওকে নিয়ে চল, তা না ঘরে বসে শুধু ল্যাদ খাবি।“…. তিয়াসা নাছোড় গলায় বলে।
“নারে, আজ বিকেলে কোথাও বেরোতে ইচ্ছা করছে না, জাস্ট ঘরে বসে গল্পের বই পড়বো। এবার বাড়ি গেছিলাম যখন বাবা শরদিন্দুর ঐতিহাসিক উপন্যাস খন্ডটা দিয়েছে।“… উত্তর দেয় সীমন্তিনী।
তিয়াসার ফোন ছেড়ে দিয়ে সোফার চেয়ারে দুপা উঠিয়ে গুটিসুটি পাকিয়ে বসে।
তিয়াসা আর সুমন্ত এদের কথা ভাবতে ভাবতেই দরজায় কলিংবেলের শব্দ। ওর রান্নার দিদি রত্না এসেছে নিশ্চই ভেবে দরজা খুলে দেয় গিয়ে।
রত্না ঘরে ঢুকেই জিজ্ঞাসা করে “দিদি, বাজারে কে গেছে, সুমন্তদা“?
“হ্যাঁ” ছোট্ট করে উত্তর দেয় সীমন্তিনী।
এসবের মধ্যেই সুমন্ত বাজার নিয়ে ফেরে। ফিরেই সীমন্তিনীকে বলে “শোন, আমি আজ দুপুরেই চলে যাবো“।
“কোথায়, তোর ফ্ল্যাটে“? জানতে চায় সীমন্তিনী।
“হ্যাঁরে, আমার মাসতুতো ভাই প্রকাশ আসছে আজ, তুই চিনিস তো ওকে। কাল থেকে তার এখানে কি পরীক্ষা আছে দুচার দিন,” কথাটা বলে বাইরের ঘরের সোফায় বসে পড়ে টিভির রিমোট হাতে নিয়ে।
“ঠিক আছে, দুপুরে খেয়ে বেরোস তাহলে” সীমন্তিনীর গলা ভেসে আসে রান্না ঘর থেকে, “আর এখন আগে ব্রেকফাস্ট করে নে“।
সুমন্ত দুপুরের খাওয়া দাওয়া করে বেরিয়ে যায় নিজের ফ্ল্যাটে যাবার জন্য। এখন যদিও গরম নেই, নভেম্বরের শেষ দিকের এই সময়টায়, তবে সেরকম ঠান্ডাও নেই কলকাতায়। যাদবপুরের একটা মিনি পেয়ে চেপে পড়ে সুমন্ত।
সুমন্তর ফ্ল্যাট যাদবপুরের সুলেখায়। সীমন্তিনীর ওখানে মাঝে মধ্যে এরকম গিয়ে থেকে আসে কয়েকদিন।
সীমন্তিনীর সাথে ওর পরিচয় যে ক্যান্টিনে ও খেতে যায় সেখানে। সীমন্তিনী আর ওর দুজনেরই অফিস ইকোস্পেসে একই ব্লকে, আর ওরা দুজনেই একই ক্যান্টিনে খেতে যেত। রোজ দেখা হতে হতে টুকটাক কথা শুরু হয়, তারপর আস্তে আস্তে বন্ধুত্ব হয়ে যায়।
সন্ধ্যে নাগাদ প্রকাশ এসে পৌঁছয় সুমন্তর ফ্ল্যাটে। দুর্গাপুরে থাকে প্রকাশ ওর বাবা মা এর সাথে, ওখান থেকে এসবিএসটিসি ধরে সোজা ধর্মতলা এসে ওখান থেকে মিনি ধরে যাদবপুর এসেছে।
রাত্রি ৮.৩০ নাগাদ সুমন্ত প্রকাশকে নিয়ে রাতের খাবার জন্য রুটি তড়কা আর সাথে চিকেন কাবাব নিয়ে আসে।আজ আর রান্না করতে ইচ্ছা করছিল না সুমন্তর।
রাত্রে খাওয়াদাওয়া সেরে হলে বসে সিগারেট ধরায় সুমন্ত। প্রকাশের দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দেয় কিছু না বলে। কিছুক্ষণ দুই ভাই বসে কথা বলে, তারপর সুমন্ত প্রকাশকে বলে “ভাই, তুই এবার শুয়ে পর। তোর সেন্টার তো হাজরাতে, বেশি দূর নয় এখন থেকে। তুই এক কাজ করিস একটা চাবি রেখে নিস তোর কাছে, আমি অফিসে থাকব যখন তুই ফিরবি“।
পরেরদিন সকালে প্রকাশকে বাসে তুলে দিয়ে সুমন্ত ইকোস্পেস যাবার একটা শাটল ধরে। গাড়িতে উঠে সীমন্তিনীকে মেসেজ করে “দুপুরে দেখা হবে ক্যান্টিনে“। হোয়াটস্যাপটা বন্ধ করতে গিয়ে চোখে পড়ে সীমন্তিনীর স্ট্যাটাসে – মরন রে, তুঁহু মম শ্যাম সমান। সাথে সাথে চিনতে পারে রবীন্দ্রনাথের এই অতি জনপ্রিয় লাইন টা।
সুমন্তর মনে পড়ে যায় প্রথম পরিচয়ের কয়েকদিন পরের কথা যেদিন ও সীমন্তিনীকে কবি আনিসুল হক এর লেখা ওর প্রিয় কবিতার প্রথম কয়েকটা লাইন শুধু লিখে পাঠিয়েছিল। লিখেছিল
“তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া।
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।
তুই কি আমার দুঃখ হবি?”
উত্তর এসেছিল কবিতায়, তবে সীমন্তিনীর নিজের ভাষায়
“বন্ধু, পথের এই দেখা,
ক্ষণিক ভালো লাগা,
রইলো নাহয় এইটুকুই।
ভালো লাগার এই রোদ্দুর এক চিলতে,
রাখলেম মোর স্মৃতির ঝাঁপিতে আগলে।
কয়েক যুগের পরে,
অশক্ত মন যখন উচাটন একটু উষ্ণতার তরে,
আদর করে রোদ্দুর টুকু মাখব সোহাগ ভরে,
ভাববো সেদিন তুমি আমার ছিলে,
শুধু আমি রাখিনি হাত ধরে।“
সুমন্তর ভালোলাগাটা প্রেমে পরিণতি না পেলেও, তার বদলে খুব ভালো বন্ধু হয়ে গেছিল ও সীমন্তিনীর।
লাঞ্চ পর্যন্ত দিনটা ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে কাটে সুমন্তর। দুপুরে ক্যান্টিনে দেখা হয় সীমন্তিনী আর তিয়াসার সাথে।
“কিরে, ভাই এর যত্ন আত্তি করেছিস তো ঠিকঠাক“…… জিজ্ঞাসা করে সীমন্তিনী।
“হ্যাঁ, একদম। সে আর বলতে, যতই হোক তোর মুবোলা দেওর বলে কথা।“
সুমন্তর উত্তর শুনে হাসতে থাকে সীমন্তিনী।
“কি ব্যাপার”? জানতে চায় তিয়াসা।
“আর বলিস না, সে ছেলের ধারণা সীমু আমার গার্লফ্রেন্ড, তো সে সীমুকে বৌদি বলে” উত্তর দেয় সুমন্ত।
“তবে শুধু তাই নয়, কিছুটা ইনফাচুয়েশন ও আছে” বলেই সীমন্তিনী সুমন্তর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।
“তুই চাপ খাস না এসব শুনে” সুমন্ত তিয়াসার দিকে তাকিয়ে বলে হাসতে থাকে। তিয়াসা যেন একটু লাল হয় যায় সুমন্তর কথা শুনে।
রাত্রে ঘরে ফিরে তিয়াসা দেখে হোয়াটস্যাপে সীমন্তিনীর মেসেজ, তাতে কটা কবিতার লাইন –
মরণ, তুঁহুঁ মম মাধব, তুঁহুঁ মম দোসর,
তুঁহুঁ মম তাপ ঘুচাও।
মরণ তু আও রে আও।
তিয়াসার মনে পড়েনা কোন কবিতার লাইন এটা, এ ব্যাপারে ওর কোন উৎসাহই নেই। শুধু একটা থাম্বসআপ দিয়েই ছেড়ে দেয়। সীমন্তিনীর সাথে গত কয়েকমাস যাবৎ একটা সম্পর্কের মধ্যে থাকলেও, ও জানে এর কোনো ভবিষ্যৎ নেই, কারণ এই সম্পর্কটা নিয়ে ও কোথাও লড়াই করতে পারবে না। ওর মা কিছু তেই মেনে নেবেনা এটা, উনি এটাও মেনে নিতে পারবেন না যে ওনার মেয়ে একজন লেসবি। নিজের জীবনে সিকিউরিটি কে ভীষণ মূল্য দেয় তিয়াসা। ছোট বয়সে বাবা মারা গেছিল তিয়াসার। ওর মা একার হাতে মানুষ করেন তিয়াসাকে। কিন্তু মায়ের জীবনের সেই ইনসিকিউরিটি তিয়াসা কিছুতেই ভুলতে পারেনা। অনেক কম বয়সেই যেন বড়ো হয়ে গেছিল ও, আর তখনই নিজেকে কথা দিয়েছিল জীবনে এমন কিছুই করবে না যাতে ওকে বা ওর মাকে ইনসিকিউরিটিতে ভুগতে হয়।
তিয়াসার কাছ থেকে উত্তরের আশায় বেশ কিছুক্ষণ বসে থাকে সীমন্তিনী, কিন্তু কোনো উত্তর আসে না। সীমন্তিনীর মনে পড়ে যায়, যেদিন তিয়াসাকে ও মনের কথা জানায়, সেদিন কবি শহীদ কাদরির লেখা কয়েকটা লাইন মেসেজ করেছিল রাত্রে:
“শুধু একটি বার বল ভালবাসি
তোমাকে আর কোনদিন ভালবাসতে হবে না।
মরুভূমির তপ্ত বালিতেও পা দিতে হবে না।
আমার জন্য তোমকে নিশি রাতে পা ভিজাতে হবে না।
আকাশ বাতাস শুনুক তোমার প্রতিধ্বনি।
সবাই জানুক কেউ আমাকে ভালবেসেছিল।
আমার হৃদয়ের ডাকে কেউ সাড়া দিয়েছিলো।
শুধু এতটুকুই আমি চাই, এর চেয়ে বেশি চাই না।
কাছে আস বা না আস, তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।”
এর মানানসই কোনো উত্তর সেদিন তিয়াসা দেয়নি। আস্তে আস্তে জানতে পারে, মানসিক পছন্দ অপছন্দ গুলো দুজনের একেবারেই মেলে না।
ওর পছন্দ যে একটু অন্য রকম সেটা সীমন্তিনী বুঝতে পেরেছিল ওর কলেজ লাইফেই। ছেলেদের সাথে সাথে ওর মেয়েদেরও ভালো লাগতো। আস্তে আস্তে বুঝতে পারে ও কোনো বিজাতীয় প্রাণী নয়, ওর মতো অনেকেই আছে সমাজের ভয়ে শুধু প্রকাশ পায়না। কিন্তু অসুবিধা অন্য কোথাও। শরীর সাড়া দিলেও, সবার সাথে মনের সুর মেলেনা। তবে অসুবিধা শুধু এটুকুই নয়, ওর শৈশব ওর বর্তমানের সম্পর্কে এসে ছায়া ফেলে। কোনো স্থায়ী সম্পর্কে ও যেতে চায়না, একটা ভয় এসে গ্রাস করে এসে। ছোট থেকে দেখে এসেছে ওর বাবা মায়ের সম্পর্কে আর যাই থাক ভালবাসা ছিলনা কখনোই। দুর্বিষহ সেই সম্পর্ক তারা দুজনেই বয়ে নিয়ে যেত শুধু মাত্র তার মুখ চেয়ে। নিত্যকার সে অশান্তি, ঘরের পরিবেশ টাকেই কেমন দমবন্ধ করে তুলেছিল। সন্দেহ, দোষারোপ, ঝগড়া এগুলোই ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার ওর বাবা মায়ের সম্পর্কের মধ্যে। চাকরি করতে এসে যখন কোনো সম্পর্কই থিতু হতে পারছে না, তখন একদিন সুমন্তকে খুলে বলেছিল সব, তার পছন্দ, তার মনের আরাম, তার ভয়, তার শৈশব, লুকোয়নি কিছুই। সুমন্তর পরামর্শেই গেছিল এক সাইকোলজিস্ট এর কাছে, শুনেছিল ছোটবেলায় দেখা বাবা মা এর সম্পর্ক, এক ধরনের ভীতি তৈরি করেছে ওর মধ্যে, কমিটমেন্ট ফোবিয়া বলে যাকে।
পরের দিন অফিসে তিয়াসার মুখভার লক্ষ্য করে সীমন্তিনী জিজ্ঞাসা করে, “ডার্লিং, মুখভার কেনো তোর। কি হলো”?
জিজ্ঞাসা করতেই একরাশ অভিযোগ ঝরে পড়ে তিয়াসার কথায় “তুই আর সুমন্ত তো সংসার বসিয়ে ফেলেছিস। সুমন্তর ভাই তোকে বৌদি ডাকছে, ওর বাবা মা ও নিশ্চই তোকে বৌমা ভাবছে। বাঃ খুব ভালো, তাড়াতাড়ি বিয়ে টা সেরে নে আরকি, আমরাও একটা ভোজ খাই”।
“তুই জানিস যে আমার আর সুমন্তর মধ্যে সেরকম কিছু নেই, আমরা মোটেও কোনো রিলেশনশিপে নেই”, উত্তর দেয় সীমন্তিনী।
“কেনো , ও তোর ফ্ল্যাট এ যায়না, রাত্রে থাকেনা? তুই ও তো গেছিস ওর যাদবপুরের ফ্ল্যাটে। কিছুই হয়নি তোদের মধ্যে”….. তিয়াসার কথার ঝাঁজ বাড়তে থাকে।
“কি বোকা বোকা কথা, কারুর সাথে কিছু হলেই তাকে বিয়ে করে ফেলতে হবে? হ্যাঁ একবার হয়েছে, ব্যাস্ ওই একবারই। আমি তোকে তো বলেইছি কোনো ছেলের বউ হয়ে আমি সারা জীবন থাকতে পারবোনা। আর তোর আমার তো অনেক কিছু হয়েছে, তোকে তো বলেওছি কতবার, চল আমরা একসাথে কিছু ভাবি। কই তুই কখনো সাড়া দিস নি তো”।
“তুই জানিস সেটা এই মুহূর্তে সম্ভব নয়, কেউ মেনে নেবেনা, আমার মা মেনে নেবেনা। আর তুই তো আমার মত নোস, তোর তো ছেলে মেয়ে কোনো কিছুতেই …..” কথা শেষ না করেই থেমে যায় তিয়াসা।
থম মেরে যায় সীমন্তিনী এতসব শুনে, চোখের কোণে একফোঁটা জল চলে আসে। তাড়াতাড়ি উঠে নিজের সিটে চলে যায়।
ক্যান্টিনে এসে সুমন্ত রোজকার মত সীমন্তিনীকে দেখতে না পেয়ে মেসেজ করে “তুই কোথায়? খেতে আসবিনা”?
ছোট্ট করে উত্তর আসে “তুই খেয়ে নে, আমার দেরি হবে আজ”।
সারাদিনে দুজনের আর কোনো কথা হয়না। সন্ধ্যে বেলায় অফিস থেকে বেরিয়ে ফোন করে
সীমন্তিনীকে “তুই কোথায়, জিতেনের চায়ের দোকানে আয়”।
মিনিট পাঁচেক দাড়ানোর পর সীমন্তিনীকে আসতে দেখতে পায়।
“সিগারেট দে” এসেই বলে সুমন্তকে।
কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে সুমন্ত বলে “কি হয়েছে? অফিসের ঝাড় তো এটা নয়, তাহলে? তিয়াসার সাথে ঝামেলা? কারণটা কি”? অনেক গুলো প্রশ্ন পর পর ছুড়ে দেয় ও।
“শালা, তোকে নিয়েই তো ঝামেলা। আমরা নাকি বিয়ে ঠিক করে ফেলেছি, ওকে কিছু জানাই নি”।
“সীমু, একটা কথা বল আমায়, তোর কি মনে হয়, তিয়াসা সমস্ত বাধা পার করে তোর সাথে এসে থাকবে? আমার তো মনে হয় না”।
“হুম, সেটা ও নিজেও আজ জানিয়ে দিয়েছে” এটুকুই বলে এক মুখ ধোঁয়া ছাড়ে সীমন্তিনী।
সুমন্তর মনে পড়ে প্রথম প্রথম যখন ও জানতে পেরেছিল তিয়াসার কথা, অনেকবার বলেছিল সীমন্তিনীকে এই সম্পর্ক টিকবে না, তিয়াসা সব ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারবে না হয়তো। মানতে চায়নি সীমন্তিনী। উল্টে ওকে বলেছে, তুই হিংসা করছিস তিয়াসাকে। কিন্তু সেসব কথা আজ আর তোলে না সুমন্ত, শুধু বলে “তুই আমার সাথে যাদবপুর চল, নিজের ফ্ল্যাটে গিয়ে তো একলা ড্রিংক করবি। তার থেকে আমার ফ্ল্যাটে চল, ওখানে গিয়ে গিলবি”।
সীমন্তিনী তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ সুমন্তর দিকে, তারপর বলে “ কেন, কেন করছিস বলতো এসব”।
সুমন্ত একটু হেসে বলে “আমার ফ্ল্যাটে চল, রাত্রে বলবো”।
ওরা দুজন একটা উবের ভাড়া করে যাদবপুরের জন্য। সীমন্তিনী ফোন করে রত্না কে বলেদেয় আজ রাত্রে ও ফিরছে না, কাল রান্না করতে আসার আগে একবার যেনো ফোন করে নেয়।
ঘরে ঢোকার আগে সিগনেচারের একটা বোতল কেনে সুমন্ত, প্রকাশ ও আছে ওর আজ পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। সীমন্তিনী রাতের খাবার কেনে তিনজনের।
অনেক রাত্রে, বারান্দায় দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে সীমন্তিনী জিজ্ঞাসা করে “বললি না তো, কেন”?
“সব কেনোর কি পছন্দ মত উত্তর হয়” বলে সীমন্তিনীর একটা হাত ধরে সুমন্ত, তারপর আবার বলে “আকাশের এই একফালি চাঁদ, তুই আর আমি এখানে কে কাকে সঙ্গ দিচ্ছে বল দেখি। আকাশের চাঁদ ও বড়ো একলা, ও সঙ্গ দেবার সময় সঙ্গ খোঁজেও। আমি ভালোবাসি তোকে, কিন্তু যদি বলিস কেমন সে ভালোবাসা, কত টা ভালোবাসি, তাহলে তার উত্তর হয়তো দিতে পারবনা। তুই আমার বন্ধু। আমার আত্মার সবথেকে কাছের মানুষ, তাই আমার আত্মীয়। তুই আমার মনের আরাম” এই বলে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে সুমন্ত, তারপর সদ্য কাল রাত্রে লেখা লাইন কটা আবৃত্তি করে সীমন্তিনীর মুখের দিকে তাকিয়ে
“বঁধুয়া, আমার প্রাণ সজনী তুই।
ইচ্ছে, তোর মন সাগরে শুক্তি হয়ে রই।
সখী, আমার চোখের তারা তুই।
তাইতো আজি জোছনা রাতে,
চাঁদের সাথে আমিও জেগে রই।
বান্ধবী, আমার হৃদয় বীণায়, শুধুই
তোর প্রেমের আলাপন।
তোর খেয়ালের আনাগোনায়,
নিত্য মোর হৃদমাঝারে সুরের উদযাপন”।