হিন্দুত্ববাদ, ভারতীয় সংস্কৃতি ও শবরীমালা – ১

0
598

সুপ্রীম কোর্ট শবরীমালা মন্দিরে সব বয়সের মহিলাদের প্রবেশের অধিকার দিয়েছে। কিন্তু শবরীমালা মন্দিরের ও ভগবান আয়াপ্পার ভক্তরা এই রায়ের বিরুদ্ধে গর্জে উঠে মন্দিরে এই নারীবাদীদের প্রবেশ রুখে দেন। বাংলা গণমাধ্যমের সৌজন্যে আপনি শুধু একটা দিক জানেন যে এই বিংশ শতাব্দীতেও নারীদের বিরুদ্ধে কি রকমের লিঙ্গ-বৈষম্যতা রয়েছে। আজ আপনাদের মুদ্রার উল্টো পিঠের ঘটনাসমূহ যুক্তি সহকারে উপস্থিত হোক।

এই বিষয় নিয়ে আলোচনা করার আগে একটু ভাবুন তো এই সমাজে অতীতের চেয়ে মহিলাদের বেশি সশক্তিকরন হয়েছে। শহরাঞ্চলে মহিলারা বেশ স্ব-নির্ভর কিন্তু গ্রামাঞ্চলে ছবিটা এখনও কিছু করুণ। একটা মন্দির যেখানে রজস্বলা অবস্থায় মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ সেই মন্দিরে প্রবেশ করলে কি মহিলাদের ওপর হওয়া অত্যাচার কমে যাবে? ভারতে কত হাজার মন্দির আছে সেখানে ৫ টা বা ৬টায় নারীপ্রবেশ নিষিদ্ধ, বাকি মন্দিরগুলোতে কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু শবরীমালাতে গিয়ে সবাইকে প্রবেশ করতে হবে। শবরীমালাতে গিয়ে ঢুকলে ধর্ষণ কমে যাবে, নারী নির্যাতন কমে যাবে, পণের দাবীতে বধূহত্যা কমে যাবে,কন্যাভ্রুন হত্যা আর হবে না, দেহ ব্যবসা আর হবে না ,রাস্তা ঘাটে মহিলাদের শ্লীলতাহানি আর হবে না। নারীবাদীরা শবরীমালাতে ঢোকার ব্যাপারে যতটা সক্রিয় ততটা যদি নারীদের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জন-সচেতনতা গড়ার কাজে মনোযোগ দিতেন, শবরীমালাতে ঢোকার জন্য ও ভগবান আইয়াপ্পার বিরুদ্ধে প্রচার না করে,  গ্রামে গ্রামে গিয়ে ক্যাম্প করে নারী-শিক্ষার গুরুত্ব, লিঙ্গভেদ অপরাধ এসবের পক্ষে প্রচার করতেন তাহলে আজ হয়তো সমাজে নারীদের মান আরও কিছুটা বাড়তো।কিন্তু না এটা ভারতবর্ষ, এখানে সব কাজের  দায় সরকারের, দেশ সরকারের, আমার আপনার না, আমার আপনার কোনও দায় নেই দেশের ভালো-মন্দে, সব  দায় সরকারের।

বিশেষ করে এখন যখন কেন্দ্রে মোদীজী বিরাজমান এবং তিনি একজন হিন্দু রাষ্ট্রবাদী নেতা। শবরীমালা ইস্যুতে এখন আপনিও হয়তো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে সত্যি আমাদের হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতি গুলো বড্ড অপ্রচলিত/সেকেলে। বর্তমান সমাজব্যবস্থায় তা চলে না। নারীদের কেন অধিকার নেই ঢোকার? আসলে এটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ধর্মের বেড়াজালে নারীকে বেঁধে ফেলার এক চক্রান্ত মাত্র। তবে আপনার এই সব মানসিক দ্বিধাকে কাটিয়ে দিতে হিন্দুত্ব, সংস্কৃতি ও ভারত সম্পর্কে বিস্তারিত বলি।

শবরীমালা ইস্যুতে বলা হচ্ছে ভারতবর্ষে নারী অধিকার পুরুষতান্ত্রিক নিষ্পেষক হিন্দু সমাজ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত; তাই তাই এই ধর্মীয় নিয়ম। কিন্তু আপনি কি জানেন ভারতে এমন মন্দিরও আছে যেখানে পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ। সবচেয়ে বড়ো এর উদাহরণ হল পৃথিবীর একমাত্র ব্রম্ভদেবের মন্দির বা রাজস্থানের পুষ্করের ব্রম্ভা মন্দির। এখানে পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ। আরও প্রায় ৪-৫ টি মন্দিরে পুরুষের প্রবেশ নিষেধ। সুতরাং বুঝলেন হিন্দু ধর্মের দোহাই দিয়ে ভারতীয় পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার উদাহরণ শবরীমালা না। এটা একটা ধর্মীয় বিশ্বাস ও সংস্কৃতি যা যুগ যুগ ধরে মানুষ পালন করে আসছে। এবার আসছে রজঃস্বলার বিষয়টি। রজঃস্বলা অবস্থায় মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ, ভারতীয় সংস্কৃতিতে এটা একটা ট্যাবু। তাই কি? আসামের কামাখ্যা মন্দির, পুরাণ অনুযায়ী এই জায়গায় সতীমায়ের যোনীখন্ড পড়েছিল এবং এই মন্দিরে প্রতি মাসে মাসিক ধর্মের পূজা হয়, এবং তখন এই মন্দিরে পুরুষ প্রবেশ নিষিদ্ধ। সুতরাং মেয়েদের মাসিক ধর্ম ভারতীয় সংস্কৃতিতে ট্যাবু না, লজ্জা না, সন্মানের।

শবরীমালাতে কেন মহিলাদের রজঃস্বলা অবস্থায় প্রবেশ নিষেধ? কেন এহেন নিয়ম?

শবরীমালা মন্দিরে যে ভগবান রয়েছেন তিনি হলেন ভগবান আয়াপ্পা। আয়াপ্পাকে একই দেহে হর ও হরি রূপে কল্পনা করা হয়। লোককথা অনুযায়ী কথিত আছে এই শবরীমালা মন্দির নির্মাণ করেন স্বয়ং বিষ্ণুর অবতার পরশুরাম। এখানে ভগবান আয়াপ্পা বানপ্রস্থ জীবন অতিবাহিত করেন, অর্থাৎ তিনি ব্রম্ভচারী। তার কাছে আসতে হলে শুদ্ধ চিত্ত ও দেহে আসতে হয়। এবার এখানে আপনি চেঁচাবেন জানি রজঃস্বলা অবস্থায় কি মেয়েরা তাহলে অশুদ্ধ? এর উত্তর হল আংশিক, কিছুটা। কেন? আপনি কি মলত্যাগ করে সেই অবস্থায় নিজের বাড়িতে ঘুরে বেড়ান কাজ করেন? নিশ্চয়ই না। কেন? কারন আপনার সংস্কৃতি। আপনার সংস্কৃতি কোথা থেকে এসেছে? আপনার ধর্ম থেকে। হিন্দু ধর্মানুযায়ী নিজ শরীর বা অন্য কোনও প্রাণী শরীর (গোরু বাদে) থেকে নির্গত বর্জ্য অশুচি। তাই আপনি মলত্যাগ করে জল শৌচ করেন আর ইউরোপীয়ানরা টয়লেট পেপারে মুছে নেয়। রাস্তা ঘাটে কুকুর-বিড়ালের মল মাড়িয়ে ফেললে স্নান করেন বা পরিষ্কার করে হাত পা ধোন। আর এই সংস্কারটি যে যথেষ্ট বিজ্ঞানসন্মত তা নিশ্চয়ই জানেন। কারন প্রানী শরীরের বর্জ্যে জীবানু সংক্রমন হয়। এবার মহিলাদের মাসিক ধর্মে আসুন। সেটা কি? একপ্রকার বর্জ্যই তো। ডিম্বাশয় থেকে নির্গত ডিম্বকোশ যা একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত জরায়ুতে থাকে শুক্রকীটের সাথে নিষেক ঘটানোর জন্য যখন তা না হয়, ডিম্বকোশের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলে তা প্রাকৃতিক ও শারীরবৃত্তীয় নিয়মে দেহ থেকে বেরিয়ে যায়। এটি প্রাণীদেহ থেকে নির্গত একটি বর্জ্য ও এটি অশুদ্ধতা। ভারতে কত মন্দির রয়েছে ৫-৬ টা বাদে আর কোথাও তো এ হেন নিয়ম নেই, সেখানে যান।

শবরীমালা সম্পর্কে এটি মানুষের বিশ্বাস যা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। আপনার মনে হতেই পারে এটি কুসংস্কার।  কিন্তু আপনি এই কথা বলে কারো বিশ্বাসের অপমান বা ব্যাঙ্গ করতে পারেন না যখন এই সংস্কারের জন্য কেউ মানসিক বা শারীরিক ভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হন না। আর সুপ্রীম কোর্টের বিচারে শবরীমালা ভার্ডিক্টে বিপরীত মত পোষণ করা একমাত্র মহিলা বিচারপতি শ্রীমতী ইন্দু মালহোত্রা ঠিক এই কথাটাই বলেছেন। শবরীমালা ইস্যুর রায়দান করেন তিন বিচারপতির বেঞ্চ। প্রধান বিচারপতি শ্রী রঞ্জন গোগই ও বিচারপতি শ্রী ডি•ওয়াই•চন্দ্রচূড় শবরীমালাতে মহিলাদের অবাধ প্রবেশের পক্ষে রায়দান করেন ও মহিলা বিচারপতি শ্রীমতী ইন্দু মালহোত্রা বিপরীত মত পোষণ করে বলেন, এই প্রথা মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস। এই প্রথা সতীদাহের মতো কোনও দুষ্ট প্রথা না, এই প্রথা সতীদাহের প্রথার মতো হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোনও অশাস্ত্রীয় প্রথা না, যুগ যুগ ধরে চলে আসছে এই প্রথা। এবং পরিশেষে এই প্রথার দ্বারা কাউকে শারীরিক বা মানসিক যন্ত্রণা দেওয়া হয় না। এই ছিল শ্রীমতী মালহোত্রার রায়ের সারমর্ম।

কিন্তু ২-১ এর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় শবরীমালাতে মহিলাদের প্রবেশাধিকার স্বীকৃত হয়। যদিও আজ পর্যন্ত কোনও মহিলা সেখানে ঢুকতে পারেননি। শবরীমালা মন্দির বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়েই খোলা হয় ও পূজা হয়। এমনও না যে প্রতিদিন তার পূজা হয়। শবরীমালাতে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে পূজা হয় ও তার আগে ৪১ দিন পর্যন্ত ভক্তরা সন্ন্যাস পালন করেন, ফল ও নিরামিষ দুগ্ধজাত আহার করেন, নারীসঙ্গ ত্যাগ করেন, ক্রোধ সংযম করতে হয়। যেমন চড়কের মেলার আগে আমাদের বাংলায় ব্রতপালনকারী সন্ন্যাসী দেখা যায়, তেমনই শবরীমালার এই সন্ন্যাসীরা মন্ত্রঃপুত রুদ্রাক্ষ বা তুলসীর মালা ও পরনে কালো বা নীল রঙের ব্রতকালীন বস্ত্র পরিধান করেন। এই হলো শবরীমালা উপাখ্যান। মিডিয়া আপনাকে এসব কিছু বলবে না শুধু নারী প্রবেশ নিয়ে বলবে। এবার আরও একটা তথ্য জানুন শবরীমালাতে শুধুমাত্র ঋতুমতী অবস্থাতেই মহিলাদের প্রবেশ নিষিদ্ধ, সব মহিলার না। কিন্তু কোনও মহিলা যদি যায় এবং তাঁকে এই প্রমাণ দিতে হয় যে সে ঋতুমতী কি না? সেটা অশালীন তাই একটা নির্দিষ্ট বয়সের মহিলাদের প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে।

পঞ্চাষোর্ধ মহিলারা এই মন্দিরে প্রবেশাধিকার পান। এখন এটা সংস্কার নাকি কু-সংস্কার সেটা বিশ্বাস-অবিশ্বাসের বস্তু। এমন অনেক ধর্ম ও তার রীতি নীতি আছে যা কু-সংস্কার এবং তার দ্বারা একজনের ক্ষতিসাধন হচ্ছে কিন্তু তার বেলা সব চুপ। তিন তালাক, নিকাহ হালালা, খৎনা নিয়ে কেউ কোনও কথা বলে না। রুটি পুড়ে যাওয়ার জন্য তালাক দিয়ে দিলে সেই মহিলার অধিকার সুরক্ষিত থাকে, কত নারীকে তার মতের বিপক্ষে বোরখায় মুড়ে দেওয়া হলেও সেখানে নারী অধিকার সুরক্ষিত থাকে কিন্তু শবরীমালাতে নারী প্রবেশ না করতে পারলে নারী অধিকার প্রশ্নের মুখে পড়ে। এই শবরীমালা ইস্যু নিয়ে কিছু স্বঘোষিত সেকুলার বুদ্ধিজীবি দেশে বিদেশে হিন্দুত্ব ও ভারতের চূড়ান্ত অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে। 

(ক্রমশঃ)