“দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, কারো দানে পাওয়া নয়” — আবেগ না বাস্তবতা?

0
1716

ভারত সাহায্য না করলে ঠিকই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো…। না, এগুলো জামাত-শিবির বিএনপি করা লোকজনই কেবল দাবী করে তা ঠিক নয়, খাঁটি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লোকজনদের কথাও এগুলো। একটা গান আছে, ‘দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা কারো দানে পাওয়া নয়/দাম দিছি প্রাণ লক্ষকোটি জানা আছে জগৎময়’ -গানটায় আবেগ ছাড়া বাস্তবতা নেই। লক্ষ-কোটি প্রাণ দিলেও বাংলাদেশ আজ পর্যন্ত স্বাধীন হতো না যদি বিশ্ব রাজনীতির পাশা খেলায় জেতা না যেতো। পাকিস্তান আমেরিকা-জাতিসংঘকে ধরে যে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব প্রায় বাস্তবায়ন করে ফেলেছিলো সেটা হলে মুক্তিযুদ্ধ তিন-চার খন্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ত এক সময়। একটার নাম হতো ‘তাজউদ্দীন গ্রুপ’, শেখ মনির নেতৃত্বে ‘মুজিব বাহিনী’, কমিউনিস্টদের হাতে আরেকটা গ্রুপ। এছাড়া ‘কাদেরিয়া বাহিনী’, ‘খালেদ মোশাররফ’, ‘কর্ণেল তাহের গ্রুপ’ ‘মেজর জলিল গ্রুপ’ নামে সবাই বিভক্ত হয়ে পড়ত। সবাই নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র প্রতিনিধিত্বকারী বলে দাবী করত। সারা পৃথিবীতে এরকম স্বাধীনতাকামীদের মধ্যে বিভাজন আমরা দেখতে পাই। এমন কি যাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার আন্দোলন তারাই কোন একটা গ্রুপকে পৃষ্ঠপোষকতা করে। কাজেই আমেরিকা চীন কোন একটা গ্রুপকে টাকা দিয়ে অস্ত্র দিয়ে আজকের দিন পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতো। সঙ্গে ইন্ডিয়ার হাতে থাকত আরেকটা গ্রুপ। সবগুলো গ্রপ ভারত বাংলাদেশ সীমান্তে আন্ডারগ্রাউন্ডে থেকে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতো। ভারতের স্থায়ী হতো একটি বিশাল শরণার্থী শিবির।

৯ মাসে যুদ্ধ যেতা তাও ভয়ংকর শক্তিশালী পাকিস্তানী আর্মির সঙ্গে – খালি গান গেয়ে আর আবেগ দিয়ে সম্ভব হয়েছে? হ্যাঁ, বন্দুকের মুখে খোলামকুচির মত জীবন দিয়েছে এদেশের মানুষ। সমস্ত বীরত্ব, জাহাজের নিচ মাইন বেধে আসা, পাকিস্তানী ক্যাম্পে জীবন বিপন্ন জেনেও মুক্তিযোদ্ধারা অসীম সাহসে পিছুপা হয়নি। কিন্তু এসবই একটা যুদ্ধে জেতার জন্য যথেষ্ঠ নয়। তাজউদ্দীনের অসীম সাংগঠনিক দক্ষতা, রাষ্ট্র পরিচালনা করার বিপুল মেধা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তিনি নিজেকে একটি বৈধ সরকার বলে কিছুতে গ্রহণযোগ্য করতে পারতেন না যদি না ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্বব্যাপী কুটনৈতিক দৌড়ঝাপ, জাতসংঘে বাংলাদেশ পক্ষে লবিং না করতেন। বাংলাদেশের যুদ্ধটাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেখানোর সব সুযোগ পাকিস্তানের ছিলো। সেটা পারেনি কেবল ভারতের কারণে।

স্বাধীনতার পর পরই একটা কথা চাউর হলো, ভারতীয় বাহিনী লুটপাট করে বাংলাদেশের সম্পদ সব জাহাজ বোঝাই করে নিজ দেশে পাচার করে নিয়ে গেছে। অসম্ভব রকম প্রচার পেল কথাটি। তখনই লোকজন বলাবলি শুরু করে দিলো- ভারত কি নিজ স্বার্থ ছাড়া আমাদের সাহায্য করেছে নাকি?…

এদিকে দুই কোটি শরণার্থী ভারতীয় সরকার নয় মাস পর্যন্ত বহন করেছে। মার্চ মাসে হামলা শুরু হবার পর থেকে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বিশ্বনেতাদের কাছে বলেন, পাকিস্তান যেন তাদের দেশের বাঙালিদের ওপর এই চরম অত্যাচার বন্ধ করে। কারণ এতে ভারতে যে বিপুল শরণার্থীর স্রোত ঢুকছে, সেই ভার বহন করা ভারতের ক্ষমতার বাইরে’। এতো গেলো শরণার্থীদের আশ্রয় দানের কথা, মূল বিষয়টা হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধাদের টেনিং দিয়ে অস্ত্র জুগিয়ে পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পাঠানো। যুদ্ধে পাকিস্তানীদের কোণঠাসা হয়ে পিছু হঠার মূল কাজটা করে দিয়েছিলো ভারতীয় সরকার। ভারত পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতর বিমান চলাচল বন্ধ করে দিলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাতে গোলা বারুদ রসদ অনেক ঘুর পথে অনেক সময় ক্ষেপন করে পৌছাত। ভারতীয় জেনারেল রায়চৌধুরী এ সম্পর্কে বলেন, ‘…সে সময় ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা কাঠমান্ডু-দিল্লি ফ্লাইটকে ছিনতাই করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাওয়ালপিন্ডিতে। পাল্টা ব্যবস্থা নিয়ে ভারত তখন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ভেতর বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয় – অর্থাৎ নিজেদের আকাশসীমা তাদের ব্যবহার করতে দেয় না। ফলে পাকিস্তান ভারী সামরিক সরঞ্জাম, রসদ বা সৈন্যসামন্ত সরাসরি আকাশপথে পূর্বদিকে আনতেই পারেনি, তাদের সে সব পাঠাতে হয়েছিল অনেক ঘুরে শ্রীলঙ্কা হয়ে সমুদ্রপথে’।

ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধটা মাত্র দুই সাপ্তাহ ধরে চলছিলো। ভারতীয় বাহিনী বাইরে থেকে আর মুক্তিবাহিনী ভেতর থেকে। সামরিক বিশেষজ্ঞ শ্রী দীপঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বিশ্লেষণ করে বলেন, ‘সেটা (যুদ্ধটা) তেরো দিনের বেশি টানলে ভারত হয়তো চাপে পড়ে যেত – বঙ্গোপসাগরে মার্কিন সেভেন্থ ফ্লিটের আনাগোনাও হয়তো ততদিনে শুরু হয়ে যেত। যুদ্ধটা এত তাড়াতাড়ি শেষ হল দুদিক থেকে একযোগে আক্রমণ চালানো গিয়েছিল বলেই। ভেতর থেকে মুক্তিবাহিনী আর বাইরে থেকে ভারতীয় ফৌজ মিলে একসঙ্গে অভিযান চালিয়েছিল বলেই সেটা সম্ভব হল। নইলে ডিসেম্বরে তো আমরা দেখছিলাম, আমেরিকা ও পশ্চিমী দেশগুলো যেভাবে ভারতের ওপর ক্রমশ চাপ বাড়াচ্ছিল তাতে যুদ্ধটা বেশিদিন টানলে আমরা হয়তো কখনওই তা শেষ করতে পারতাম না’। জেনারেল জ্যাকব যে আত্মসমর্পণের দলিল টাইপ করে নিয়ে নিয়াজীকে রীতিমত বোকা বানিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছিলেন তার বিস্তারিত বর্ণনা এখানে করার স্থান নেই।

একটা দেশের জন্মের সময় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের এতখানি ভূমিকা থাকার পর তাদের প্রতি অবিশ্বাস সন্দেহ দ্রুত ডালপালা মেলা তখনই সম্ভব হয় যখন আপনার মনের ভেতর আগে থেকে ঘৃণা বিদ্বেষ বজায় থাকে। মাত্র ৬ বছর আগে যে দেশের মানুষ পাকিস্তানী বাহিনীতে যারা ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তাদেরকেই অস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে, একসঙ্গে যুদ্ধ করেছে যে ভারতীয়রা তাদের বিরুদ্ধে লুটপাটের অভিযোগকে সদ্য যুদ্ধ শেষের কৃতজ্ঞ জনগণ কেমন করে লুফে নিলো? মানছি অভিযোগটা স্বাধীনতা বিরোধীরা ছড়িয়েছিলো, কিন্তু সেটা তো লুফে নিয়েছিলো এদেশের সাধারণ মানুষ। আজন্ম হিন্দু বিরোধীতা যা আসলে ‘ভারত’ নামক রাষ্ট্রের লেবেলে রাজনৈতিক চেহারা পায় তা কি আমরা অস্বীকার করতে পারি?

বারোশো ভারতীয় সৈনিক বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মারা গিয়েছিলো। একটা কৃতজ্ঞ জাতি কেমন করে ৭২ সালেই সেটা ভুলে যায়? যেখানে বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশী টাকায় সেই ৭১ সালের ডলারের দর ধরে ৩২ হাজার কোটি টাকা পায়, যুদ্ধের নয় মাস ধরে পাকিস্তানী বাহিনীর সীমাহীন লুটপাট প্রত্যক্ষ করে কেমন করে স্বাধীনদেশের লোকজন এত সহজে ভুলে গেলো? ৭৪ সালে জুলফিকার আলী ভুট্টকে দেখতে ‘বীর বাঙালী’ রাস্তায় ভেঙ্গে পড়ল কেন? ‘ভারত সাহায্য না করলেও বাংলাদেশ ঠিকই স্বাধীন হতো’ এই তত্ত্ব আমদানি হলো কেন?

শেষের এই তত্ত্বটি আসলে আমাদের নিউক্লিয়াসে দ্বিজাতি তত্ত্ব যা বশংগতির ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে। মেজর জলিলের কথা মনে করুন, এই সেক্টর কমান্ডর প্রচন্ড ভারতীয় বিদ্বেষ প্রসন করত। বস্তুত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট (পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে বাঙালী সৈনিকদের জন্য আলাদা ব্যাচ) যারা ছিলেন তাদের সবাই ছিলো পাকিস্তান তত্ত্বের প্রতি বিশ্বস্ত অটল নির্ভিক সৈনিক। তারাই মুক্তিযুদ্ধে ভারতে আশ্রয় নিয়ে ভারতীয় সৈনিকদের পাশে থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। মাওলানা ভাষানী যেমন যুদ্ধের সময় ইন্দিরা গান্ধির কাছে ভারতের প্রশংসা স্তুতি করে সেদেশে স্থায়ী বসবাসের আবেদন করেছিলেন। তারপর দেশ স্বাধীন হবার পর ডানপন্থি রাজনীতির উত্থান পর্বে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ করেছিলেন ‘ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের’ বিরুদ্ধে! আহমদ ছফা যেমন মুক্তিযুদ্ধের সময় নয় মাস আনন্দ পাবলিশার্সে আড্ডা মেরে সময় কাটিয়েছিলো, দেশ স্বাধীন না হলে ভারতের নাগরিত্ব নেয়ার পরিকল্পনা করে যিনি ৭২ সালে ঢাকায় পা দিয়েই হয়ে গিয়েছিলো ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে এক রুদ্রমূর্তির বিপ্লবী। যিনি ভারত থেকে পশ্চিমবঙ্গ আলাদা করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন এক ইন্টারভিউতে! রাজাকার আল বদর নয়, বিজয়ে যারা উল্লসিত ছিলো আমি কেবল তাদের কথাই বলছি। তারা কি কখনই দ্বিজাতি তত্ত্বকে ত্যাগ করেছে?

১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এটি রাষ্ট্রীয় এক কর্মসূচী ছাড়া জনগণের বিপুল বিশাল অংশের কাছে কোনই আবেগ বহন করে না এই ২০১৮ সালে এসে। কারণ যুদ্ধটা হয়েছিলো দ্বিজাতি তত্ত্ব – মুসলিম মিল্লাত তথা মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে; সেক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধ ছিলো তার ব্যত্যয়। যুদ্ধটা ভারতের বিরুদ্ধে হলে ১৬ ডিসেম্বর হতো এদেশে সবচেয়ে বড় উৎসবের নাম! এটাই সত্য।