খালিস্তান আন্দোলন (৪): Jab We Met – ভিন্দ্রান‌ওয়ালে আর কংগ্রেসের প্রথম মীটিং

চিন্ময়ানন্দ অবধূত

(তয় পর্বের পর)

এমার্জেন্সির পরে ১৯৭৭-এর নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়েছে আগেই। ইতিমধ্যে পঞ্জাবে আকালি দল আর জনতা দলের কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় এসেছে। আকালি দল আবার কেন্দ্রের জনতা দল সরকারের অংশীদার। মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদল কংগ্রেসের কয়েকজন রাঘববোয়ালকে জেলে পাঠিয়েছেন। ইমার্জেন্সির সময় এদের লাফালাফি খুব বেড়ে গিয়েছিল, মন্দ লোকে বলে, তিনি এর শোধ তুললেন।

সঞ্জয় গান্ধী

পাঞ্জাবে আকালি দল সরকারকে প্যাঁচে ফেলার জন্য সঞ্জয় গান্ধী এবং তার চ‍্যালা কমল নাথ তখন সদা ত‌ৎপর। এইসময় সঞ্জয় গান্ধীর শকুনি মামা হয়ে এগিয়ে আসেন জ্ঞানী জৈল সিং। আকালি দলের মত একটি ‘সৎ শ্রী আকাল’ ছাপ্পা দেওয়া, আলখাল্লা পড়া, রাজনৈতিক দলকে আটকানোর জন্য একজন ধর্মগুরু তথা বোড়ের দরকার হয়। প্রথমে সঞ্জয় গান্ধী আর তাঁর চ‍্যালা কমল নাথ ভেবেছিলেন আকালি দলের ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর মুখ‍্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদল, হরচান্দ সিং লোঙ্গোয়াল আর গুরচরণ সিং তোহরার মধ্যে ভাঙন ধরাবেন। কিন্তু শকুনি মামা জৈল সিং আকালি দলের এই তিন ঘুঘুদের ভালো করে চিনতেন। এক ঘুঘুকে কব্জা করলে বাকী দুই ঘুঘুর কাছাকাছি আসতে বেশি সময় লাগবে না। তাছাড়া আকালিরা কংগ্রেসের প্যাঁচ পয়জার খুব ভালোভাবে চেনে। সুতরাং কোনও নতুন সন্ত বা ধর্মগুরুর সন্ধান করা যাক।

শিখ ধর্মগুরুর অভাব অবশ্য পঞ্জাবে কখনোই ছিল না। জৈল সিং শর্টলিস্ট করেছিলেন তেইশ জন সন্তকে, যাদের মধ্যে জার্নেল সিং ভিন্দ্রান‌ওয়ালে একজন। রাজনৈতিক কারণে ধর্মের তাস খেলতে কংগ্রেসের মত সেকুলার দলের কোনদিন‌ই আপত্তি ছিল না। আগেই বলা হয়েছে এই ব‍্যাপারে ম‍্যাডামের, তাঁর পিতৃদেব জ‌ওহরলালের মত নাক সিঁটকানো ভাব ছিল না।

কিন্তু কে এই জার্নেল সিং ভিন্দ্রান‌ওয়ালে?

১৯৪৭ এর দোসরা জুন পঞ্জাবের “রোড” গ্রামের এক জাঠ শিখ পরিবারে জার্নেল সিং-এর জন্ম। পিতার নাম যোগীন্দর সিং। সাত সন্তানের মধ্যে তিনি কনিষ্ঠতম। ছোটবেলা থেকেই বাড়ির লাগোয়া গুরুদোয়ারায় যাতায়াত। ছয় বছর বয়সেই শিখদের ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘দমদমা সাহেব তকসাল’ -এ যোগদান করেন। দমদমা তকসালের প্রতিষ্ঠাতা বাবা দীপ সিং নামের একজন শিখ ধর্মগুরু। আহমদ শাহ আবদালী অষ্টাদশ শতকে অমৃতসরের স্বর্ণমন্দির আক্রমণ করলে দীপ সিংয়ের নেতৃত্বে পাঁচহাজার শিখ যোদ্ধা আবদালীকে যথেষ্টই প্রতিহত করেছিল। দমদমা তকসালের হেডকোয়ার্টার্স ছিল অমৃতসরের পঁচিশ মাইল দূরের চক মেহতা গ্রামে। ভিন্দ্রান‌ওয়ালে স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নেওয়ার আগে পর্যন্ত এই চক মেহতা ছিল খালিস্তান আন্দোলনের একটি অন‍্যতম কেন্দ্র।

এই প্রতিষ্ঠানের দ্বাদশ শিক্ষাগুরু (প্রধান শিক্ষক বা কোন সংঘের প্রধানের মত ব্যাপার) সন্ত সুন্দর সিংয়ের পৈত্রিক গ্রাম ভিন্দ্রানওয়ালান। তাই সুন্দর সিং এর পর থেকে বাকি শিক্ষাগুরুরা পরিচিত হতে শুরু করেন ভিন্দ্রানওয়ালে নামে।

দমদমা তকসালের চতুর্দশ শিক্ষাগুরু কর্তার সিং এর সময় থেকে পঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক শিখ রাজনীতির খেলা শুরু হয়, কংগ্রেস আর আকালি দলের সৌজন্যে। কর্তার সিং তাঁর শিষ্যদের স্বাধীন শিখ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখাতে শুরু করেন। সময়টা সাতের দশকের মাঝামাঝি। জার্নেল সিং তার কট্টরপন্থী মনোভাবের জন্য কর্তার সিংয়ের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠে।

কর্তার সিং সাধনোচিত ধামে যাত্রা করার আগে দমদম তকসালের কর্তা বানিয়ে যান তাঁর প্রিয় শিষ্য ভিন্দ্রান‌ওয়ালেকে। কর্তার সিংয়ের পুত্র অমৃক সিং ভবিষ্যতে ‘অল ইন্ডিয়া শিখ স্টুডেন্ট ফেডারেশন’ -এর প্রেসিডেন্ট ও ভিন্দ্রান‌ওয়ালের ডান হাত হয়ে ওঠে। অল ইন্ডিয়া শিখ স্টুডেন্ট ফেডারেশনের কাজ ছিল কলেজের ছাত্রছাত্রীদের মনে সাম্প্রদায়িক শিখ রাজনীতির বিষ ঢোকানো।

খুব তাড়াতাড়িই ভিন্দ্রান‌ওয়ালেকে হিরো বানানোর সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল কংগ্রেসের কাছে।

উনিশ শতকে একজন শিখ সন্ত, বাবা দয়াল দাস খেয়াল করেন শিখেদের মধ্যে অনেকে হিন্দু ধর্মাচরণ, যেমন -মূর্তিপূজা, গঙ্গাস্নান ইত‍্যাদিতে ঢুকে গিয়েছে। বাবা দয়াল দাস প্রচার করেন ঈশ্বর নিরাকার (পঞ্জাবীতে নিরঙ্কর), তাই ঈশ্বরের উপাসনার জন্য কোনও মূর্তিপূজার দরকার নেই। বাবা দয়াল দাসের সহজিয়া মতবাদে শিখেরা তো বটেই, হিন্দুরা পর্যন্ত আকৃষ্ট হয়। কিন্তু মুশকিল হল একশ্রেণীর শিখ দয়াল দাসকেই শেষ গুরু বলে মনে করতে থাকে, যেখানে গুরু গোবিন্দ সিং ঘোষণা করে গিয়েছেন তিনিই শেষ গুরু। এমনকি তারা গ্রন্থসাহিবকেও একমাত্র পবিত্র গ্রন্থ মানতে অস্বীকার করে। এই নিরঙ্করীদের, কট্টরপন্থী খালসা শিখেরা বিধর্মী বলে ঘোষণা করে। তারপর যা হয় আর কি। সংঘর্ষ শুধু দুই গোষ্ঠীর কথা কাটাকাটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, মাঝে মাঝে রক্ত ঝরিয়ে নিজেদের মতবাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিতে হয়। পঞ্জাবের ব‍্যবসায়ী গোষ্ঠীর মধ্যে নিরঙ্করীদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল এবং এখনও আছে।

আকালি-জনতা কোয়ালিশন ১৯৭৮ -এর ১৩ ই এপ্রিল অমৃতসরে নিরঙ্করীদের একটি অধিবেশন করতে অনুমতি দিয়ে দেয়। এর অন‍্যতম কারণ হল আকালি-জনতা কোয়ালিশনের অন‍্যতম সদ‍স‍্য ছিল জনসঙ্ঘ। শুধু শিখ নয়, অনেক পঞ্জাবী হিন্দু ব‍্যবসায়ীরাও ছিল নিরঙ্করীদের অন্তর্ভুক্ত। এই হিন্দুরা ছিল জনসঙ্ঘের ভোটব‍্যাঙ্ক আর ফান্ডের উৎস।

কট্টরপন্থী শিখেরা স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি আকালি দল, যারা ইতিমধ্যেই “আনন্দপুর সাহিব রেজল্যুশনের” মত একটা প্রচ্ছন্ন সাম্প্রদায়িক প্রস্তাবনা করে বসে আছে, তারা নিরঙ্করীদের সভা করতে অনুমতি দেবে। তের‌ই এপ্রিল, ফৌজা সিং নামের একজন কট্টরপন্থীর নেতৃত্বে একদল খালসা শিখ স্বর্ণমন্দির থেকে একটা মিছিল বের করে। তারপর নিরঙ্করীদের অধিবেশনে গিয়ে তাদের আক্রমণ করে। ফৌজা সিং নিরঙ্করীদের গুরু বাবা গুরবচন সিংকে তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ করে। গুরবচন সিংয়ের দেহরক্ষীদের গুলিতে ফৌজা সিং নিহত হয়। কট্টরপন্থী শিখ আর নিরঙ্করীদের মধ্যে একটা ছোটখাটো লড়াই চলে । ফৌজা সিং ছাড়াও বারো জন শিখ এবং তিন জন নিরঙ্করী মারা যায়। ভিন্দ্রান‌ওয়ালে প্রথমে ফৌজা সিংয়ের মিছিলে থাকলেও পরে বেগতিক দেখে পালায়। তারপর আকালি দলের বিরুদ্ধে গরম গরম বিবৃতি দিতে থাকে।

জ্ঞানী জৈল সিং

জৈল সিং আর সঞ্জয় গান্ধী ঠিক এইরকম পরিস্থিতির জন‍্য‌ই অপেক্ষা করছিলেন, কেননা ব‍্যাক করার জন্য ডার্ক হর্স তাঁরা পেয়ে গিয়েছেন। আকালি দল কট্টরপন্থীদের এইসব গুণ্ডামিকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন করতে পারে না, কেননা মুখ্যমন্ত্রী প্রকাশ সিং বাদল স্বয়ং আকালি দলের। কংগ্রেসের প্রোপাগান্ডা মেশিন নিরঙ্করী আর খালসাদের লড়াইতে ভিন্দ্রান‌ওয়ালেকে হিরো বানিয়ে ছাড়ল। তেরো জন শিখ নিহত হ‌ওয়ার বেশিরভাগ প্রতিবাদসভা পালিত হল দিল্লির গুরদোয়ারাগুলোয়, সৌজন্যে কংগ্রেসের আনুকূল্য।

কিন্তু ভিন্দ্রান‌ওয়ালেকে প্রমোট করার জন্য একটি রাজনৈতিক দলের দরকার হয়। তাই নতুন একটি দল গঠিত হল, নাম দেওয়া হল “দল খালসা”। এদের প্রথম অধিবেশন হয় চণ্ডীগড়ের হোটেল অ্যারোমায়। ছয়শো টাকার বিল মেটান জৈল সিং নিজে। ১৯৭৮এর ছয়‌ই আগস্ট এরা একটি সাংবাদিক সম্মেলনে ঘোষণা করে। এদের উদ্দেশ্য “স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র” প্রতিষ্ঠা করা। মজার কথা হল “দল খালসা” নিজেদের ভিন্দ্রান‌ওয়ালের অনুসারী বলে ঘোষণা করলেও ভিন্দ্রান‌ওয়ালে কিন্তু কখনও দল খালসার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেনি।

এদিকে কেন্দ্রে তখন জনতা দল সরকারের টালটমাল অবস্থা। কংগ্রেস অপেক্ষা করছে জনতা দল সরকারে পতন কবে হয়!

ফীচারের ছবিটি ভিন্দ্রান‌ওয়ালের। মতামত লেখকের, বঙ্গদেশ পত্রিকা তার জন্য দায়ী নয়। 

(ক্রমশঃ)