প্রথা মেনে কৃষ্ণনবমীর দিন শুরু হল ঐতিহ্যমণ্ডিত মালদার সেন বাড়ির দুর্গাপুজো

0
1704

বঙ্গদেশ ডেস্ক: বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গাপুজো। পুজোর ওই কয়েকটি দিনের জন্য বাঙালি সারা বছর ধরে প্রতীক্ষা করে থাকে। শুধু বাংলা বা ভারত নয় পৃথিবীর যে প্রান্তেই বাঙালি থাকে সেখানেই দুর্গা পুজো হয়।বর্তমানে সারা বাংলা জুড়ে বিভিন্ন ক্লাব অনেক বড় বড় পুজো করে থাকে।

বড় প্যান্ডেল, চিত্তাকর্ষক থিম, আলোর ঝলকানি তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। তবুও গ্রাম বাংলার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যবাহী দুর্গাপুজোগুলোকে ঘিরে মানুষের আলাদাই একটা আকর্ষণ থাকে। সেই সব পুজোর সঙ্গে জড়িত থাকে বহু ইতিহাস।

সাধারণত গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের রাজা, জমিদাররা সূচনা করেছিলেন ওই পুজোগুলি।শত শত বছর পরেও প্রথা মেনে আজও হয়ে আছে সেই পুজো। এমনই এক ঐতিহ্যবাহী পুজো হল মালদা জেলার সেন বাড়ির দুর্গাপুজো।

প্রায় পাঁচ শত বছরের পুরনো এই পুজো। পুরাতন মালদার বাচামারি এলাকায় পুজোর সূচনা করেছিলেন মহেশ চন্দ্র সেন। সেনদের তিনটি পরিবার মিলে করত এই পুজো। তাই এলাকাবাসীর কাছে এটি সেন বাড়ির পুজো নামে খ্যাত। বর্তমানে সেই বংশের আর কেউ নেই।

এখন এই পুজো চালিয়ে আসছেন সেখানকারই দাশগুপ্ত পরিবার। দাশগুপ্তদের পাঁচটি পরিবার মিলে করে এই পুজো। আজও প্রথা মেনে নিয়ম পালন করেই পুজো হয়। প্যান্ডেলের আড়ম্বরতা বা আলোর ঝলকানি হয়তো নেই৷ কিন্তু এই পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অদ্ভুত এক ইতিহাস।

দাশগুপ্ত পরিবারের প্রবীণ সদস্য প্রলয়প্রতিম দাশগুপ্ত আমাদের সেই ইতিহাসের গল্প শোনালেন। মা দুর্গার স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পুজো শুরু করেছিলেন সেন পরিবারের মহেশচন্দ্র সেন। প্রথমে শুরু হয় ঘট পুজো,তারপর পট পুজো এবং শেষে মায়ের মূর্তি তুলে পুজোর প্রচলন হয়।

কথিত আছে, সেই সময় সেন পরিবারের নারায়ণ ঠাকুরের সেবায়েত একদিন সন্ধ্যাবেলা পার্শ্ববর্তী নদীর ঘাটে যান। হঠাৎ দেখেন, ঘাটের পারে একটি নৌকো দাঁড়িয়ে আছে। সেই নৌকা থেকে নেমে আসছে এক রমণী।সঙ্গে তাঁর দুই ছেলে, দুই মেয়ে। সেই রমণী এসে সেবায়েতকে জিজ্ঞাসা করেন সেন পরিবারের ঠিকানা।

তখন সেই সেবায়েত তাকে সেন বাড়ি যাওয়ার রাস্তা বলে দেন। কিন্তু তার মনে প্রশ্ন জাগে এই সন্ধ্যায় ঘাটের পারে কে এই রমণী? সাক্ষাৎ দেবী প্রতিমার মত রূপ! এইসব ভাবতে ভাবতে তিনি নিজের বাড়িতে ফিরে যান। তারপর সকালবেলা সেন বাড়িতে গিয়ে জিজ্ঞাসা করেন এরকম কেউ এসেছিল নাকি?

কিন্তু, না গত সন্ধ্যায় সেন পরিবারে এরকম কোনও রমণী তার ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসেননি। বা কারও আসার কথাও ছিল না। এদিকে গত রাতেই মহেশচন্দ্র সেন স্বপ্নে এরকমটাই দেখেছেন। সঙ্গে মা দুর্গা আদেশ দিয়েছেন ওঁর পুজো শুরু করার। পুরোহিতের সন্ধ্যায় ঘাটের পাশেই রমণীকে দেখা এবং সেনবাবুর স্বপ্নাদেশ।উপস্থিত প্রত্যেকেই সেই সময় অবাক হয়ে যায়। তারপর সকলে ছুটে যান সেই ঘাটে। সেখানে দেখতে পান পুজোর পুষ্পপত্র অন্যান্য জিনিস এবং বলির খড়গ পড়ে আছে ঘাটের পারে। আজও নাকি সেই সব জিনিস দিয়েই পুজো হয়ে আসছে। এইভাবে শুরু হয় সেন পরিবারের দুর্গাপুজো।

এই পুজোর বেশ কিছু বিশেষত্ব রয়েছে। মায়ের বোধন হয়ে যায় কৃষ্ণ নবমীর দিন। আর সেই প্রথা মেনেই গতকাল হয়ে গিয়েছে মায়ের বোধন। শুরু হয়ে গিয়েছে মায়ের পুজো। পুজোর পূজারী, মৃৎশিল্পী, ঢাকিরা সকলেই বংশপরম্পরায় এই পুজোর সঙ্গে যুক্ত। ঢাকের সাজে সাজানো হয় দেবী প্রতিমাকে।

এখনও বলি প্রথা চালু রয়েছে পুজোয়। ঘাটের পারে পাওয়া সেই খড়গ দিয়েই এখনও নাকি বলি হয়। নবমীর দিন হয় বলি। আড়ম্বরতা না থাকলেও ভক্তির টানে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পুজো দেখতে ছুটে আসে বহু মানুষ। আগে নবমীর দিন অনুষ্ঠান হত এখন সেটা বন্ধ।

সবথেকে বেশি ভিড় হয় অষ্টমীর সকালে। মালদা শহর সহ বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওইদিন অগণিত ভক্তরা পুজো দিতে আসে। সেই দিন সেখানে মায়ের বীরাষ্টমী কথা হয়। তারপরে হয় অঞ্জলি। বীরাষ্টমী কথা শোনার জন্য ভিড় জমান বহু ভক্ত। প্রলয় প্রতিম দাস গুপ্ত বাবু বলেন, “আগে নবমীতে মেলাও হত। হত বিভিন্ন অনুষ্ঠান।নাট্যমঞ্চ ছিল। কিন্তু সেসব এখন ইতিহাস। নাট্যমঞ্চ ভেঙে গিয়েছে। তবুও ভক্তির টানে দূর-দূরান্ত থেকে বহু মানুষ আসে। পুজো যেমন হওয়ার তেমনই হবে। করোনা পরিস্থিতির কারণে চেষ্টা করব সমস্ত রকম স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার। বা বাইরে থেকে যারা পুজো দিতে আসে অনুরোধ করব তারা যাতে মাস্ক পড়ে আসে।আর মায়ের কাছে প্রার্থনা করব এই মারণ রোগের হাত থেকে মা যাতে বিশ্ববাসীকে মুক্তি দেয়।”

দাশগুপ্ত পরিবারের আরেক সদস্য শুভেন্দু দাস গুপ্ত বলেন, “সেন বাড়ির পুজো বলে পরিচিত হলেও এই পুজো বর্তমানে আমরাই করে আসছি। মাঝে মন্দিরের অবস্থা একদম জরাজীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। আমরা উদ্যোগ নিয়ে বেশকিছু প্রতিবেশীদের সহায়তায় দুই বছর আগে মন্দিরটা আবার ঠিক করি। পুজোর এই কয়েক দিনের জন্য আমরা প্রত্যেকে অপেক্ষা করে থাকি। পরিবারের সদস্যরা যে যেখানেই থাকুক পুজোতে সবাই বাড়িতে আসে। প্রত্যেকদিন খাওয়া-দাওয়া এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। এই পুজোকে কেন্দ্র করে এলাকাবাসীর মধ্যে প্রবল উন্মাদনা থাকে। সপ্তমী সন্ধি এবং নবমীতে বলি হয়। নবমীর দিন অনেকের মানতেরও বলি হয়। বছর বছর সম্পূর্ণ প্রথা মেনে হয়ে আসছে ঐতিহ্যমণ্ডিত সেন বাড়ির দুর্গাপুজো।”

২০২০ সাল ব্যতিক্রমী। আর কিছুদিন পরেই মহালয়া। মহালয়া মানেই বাঙালির পুজো শুরু হয়ে যায়। কিন্তু এবার আশ্বিন মাস শাস্ত্রমতে মলো মাস। এই মাসে কোনও রকম শুভকাজ বা পূজা হবে না। ফলে এবার মহালয়ার ১ মাস ৫ দিন পরে পুজো। তাই মহালায়া চলে এলেও পুজো পুজো ভাব এখনো তেমন আসেনি।তারপর করোনার জেরে বিপর্যস্ত সারাবিশ্ব। অনেকেই মজার ছলে বলছে মা দুর্গা এসে এবার কোয়ারেন্টাইনে থাকবে। তাই মহালয়ার একমাস পরে পুজো। কিন্তু প্রথা মেনে সেনবাড়ির পুজোতে ঢাকে কাঠি পড়ে গেল কৃষ্ণ নবমীর দিন থেকে। সেন বাড়িতে আগাম চলে এল উমা।