ভারতবর্ষে জেহাদি দাবি ও বন্দে মাতরম্ গানটির সাথে তার নিবিড় সম্পর্ক

0
2503

বন্দেমাতরম গানটি আধুনিক বাংলা উপন্যাসের জনক শ্রী বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত। অনেকেই ভেবে থাকেন যে গানটি আনন্দমঠ উপন্যাস রচনার সময়ে লেখা হয়েছিল। কিন্তু এটি সঠিক নয় এই গানটি রচনা করা হয় আনন্দমঠ রচনার ৬ বছর পূর্বে অর্থাৎ ১৮৭৫ সালে।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জন্ম ১৮৮৫ সালে আল্যান অক্টাভিয়ান হিউমের হাত ধরে ১৮৮৫ সালে অর্থাৎ আনন্দমঠ রচনার তিন বছর পর । শুরুর থেকেই বন্দেমাতরম কে জাতীয় সংগীত হিসাবে মান্যতা দেয়া হয়। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনে এটি গাওয়াও হয়। ১৮৮৬ সালের কলকাতা অধিবেশনে। গীতিকার ছিলেন শ্রী হেমচন্দ্র বন্দোপাধ্যায়। সেই গানের কয়েকটি পংক্তির অর্থ হলো

প্রেম আলিঙ্গনে করে রাখি কর,

খুলে গেছে হূদি হূদে পরস্পর

এক প্রাণ সবে এক কণ্ঠস্বর

মুখে জয়ধ্বনি ধরিল।

১৮৯৬ সালের জাতীয় কংগ্রেসের সভাতে গানটি গেয়েছিলেন স্বয়ং কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। গানটির প্রথম দুটি স্তবকে সুরারোপ করেন উনি নিজে স্বয়ং, গানটির বাকি অংশেনার অনুরোধে ওনার ভাগ্নী শ্রীমতী সরলা দেবী কবিগুরু অভিভাবকত্বে সুরারোপ করেন। রেকর্ড করার জন্য রবি ঠাকুর নিজে গানটি গেয়েও ছিলেন।

১৯০৫ সালে বড়লাট কার্জনের কুখ্যাত বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে যখন অবিভক্ত বাংলাতে স্বদেশী আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পরে তখন এই বন্দেমাতরম গানটি দারুণ সাড়া ফেলে সমাজের ওপর। ১৯০৬ সালে জাতীয় কংগ্রেসের বরিশালের (বর্তমানে বাংলাদেশের অন্তর্গত) আঞ্চলিক সভাতে এই গানটি গেয়েছিলেন তৎকালীন বিশিষ্ট মুসলিম আইনজীবী জনাব আব্দুল রসুল। এই সভার সভাপতিও তিনি ছিলেন। গানটি এতো জনপ্রিয় হয়ে যে জেলা শাসক এমেরসন সাহেব গানটিকে মুক্তমঞ্চের সভাসমিতিতে গাওয়া সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করে দেন।

১৯২১ সাল অবধি কারুর কোনোরূপ আপত্তি এই গানটিকে নিয়ে ছিল না১৯২১ সালে গান্ধীজি যখন “খিলাফত” আন্দোলন নামক একটি সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক আন্দোলনকে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণা করেন তখন থেকেই বন্দেমাতরম গানটি নিয়ে নানারূপ ওজর আপত্তি উঠতে শুরু করে। খিলাফত আন্দোলনকারীরা আপত্তি জানায় “ত্বং হি দুর্গা” বাক্যটিতে কারণ তাদের মতে এটি একজন ইসলাম ধর্মাবলম্বীর কাছে অবমাননাকর কারণ সে কেবল আল্লাহ ছাড়া কাউকে উপাসনা করে ন।। মুসলিম লীগ এদের সমর্থনে এগিয়ে আসে। তারা প্রচার শুরু করে যে এই বাক্যের মাধ্যমে আসলে দেবী দুর্গাকে উপাসনা করা হয়েছে।

যেখানে আব্দুল রসুলের মতো একজন শিক্ষিত ব্যারিস্টার এই গানটিতে কোনো আপত্তিকর কিছু পান নি, সেখানে কতিপয় আন্দোলনকারী যারা সুদূর তুরস্কে খলিফাকে (যিনি সম্পূর্ণ ভাবে একজন ধর্মীয় নেতা ছিলেন) তার পূর্বতন পদমর্যাদা ফিরে পেতে সাহায্যের জন্য আন্দোলন শুরু করে তারা এই গানটি তে খুঁত বের করে; ব্যাপারটি খুবই হাস্যকর। কবিগুরু জওহরলাল নেহেরুকে পত্র মারফত লেখেন,

I freely concede that whole of Bankim’s Vande Ma Taram poem read together with its context is liable to be interpreted in ways that might wound Moslem susceptibilities, but a national song though derived from it which has spontaneously come to consist only of the first two stanzas of the original poem,need not remind us every time of whole of it,much less of the story with which it was accidentally associated. ”

এর থেকেও দুঃখজনক যে ১৯৩৭ সালে জাতীয় কংগ্রেসের পরিচালন পরিষদ ঠিক করে যে ভবিষ্যতে গানটির কেবল প্রথম দুটি স্তবক গাওয়া হবে। এটি ছিল একদল জেহাদির কাছে জাতীয়তাবাদের পূর্ণ আত্মসমর্পণ।

১৯৩৭ সালে দেশনায়ক সুভাষ চন্দ্র বসু পত্র মারফত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়কে  (হিন্দু মহাসভার নেতা) লেখেন যে উনি গান্ধীজিকে আর্জি জানিয়েছেন যে বন্দেমাতরম গানটিকে যেন সম্পূর্ণ অবিকৃত অবস্থাতে গ্রহণ করা হয় , কিন্তু দুর্ভাগ্য পরিচালন সমিতির তিনি কেবল একমাত্র সদস্য যিনি এটি চান সুতরাং স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর প্রস্তাব খারিজ হয়ে গেছে।

এরপর ১৯৩৮ সালে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সেই কুখ্যাত ১১ দফা দাবী সনদ পেশ করে যার মধ্যে প্রথমটিই ছিল

বন্দেমাতরম গানটি বাতিল করতে হবে

এর থেকে সহজেই বোঝা যায় যদি জেহাদিদের একটি অন্যায্য দাবীকে প্রশ্রয় দেওয়া হয়, তারা তৎক্ষণাৎ আরো একটি অন্যায্য সাম্প্রদায়িক দাবী নিয়ে উপস্থিত হয়। সুতরাং জেহাদিদের অন্যায্য দাবীকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা বাঞ্ছনীয়।

লেখক জয়দীপ চৌধুরী একজন বিজ্ঞানী।