কলিযুগের মাৎস্যন্যায়

0
2492

ইতিহাস সেরকম ভালো লাগতো না ছোটোবেলায়, তবুও পড়তে হত নাহলে মায়ের ঠ্যাঙ্গানি অবধারিত। তারমধ্যে এই লকডাউনের বাজারে ঘরের থেকে বেরোনো যাচ্ছে না, ফলে ভুলভাল ভাবনা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছুদিন আগেই বাংলা নববর্ষ গেলো । তো সেই নিয়ে বিশাল হৈচৈ শুনতে পেলাম ফেসবুকে । টন টন বুদ্ধিবিক্রেতারা বলতে শুরু করেছেন আকবর নাকি এই বঙ্গাব্দ চালু করেছিলেন। এখন তার সপক্ষে যুক্তিগুলো বেশ হাস্যকর লাগলেও জ্ঞানের অভাব বলে চুপচাপ দেখে গেলাম। বিরোধীপক্ষের দাবি অনুযায়ী শশাঙ্ক হলেন বঙ্গাব্দের প্রণেতা, সেখানে বেশ কতগুলো যুক্তি মনে ধরলো। এখন গরীবের জ্ঞানভান্ডার উইকি গিয়ে দেখলাম ভদ্রলোকের এলেম ছিল বটে।

হূন আক্রমণে গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের পর শশাঙ্কের উত্থান সপ্তম শতকের দিকে গৌড়াধীপতি হিসেবে। তার সমসাময়িক শাসকের মধ্যে পড়েন রাজা হর্ষ, ভাস্করবর্মা প্রমুখ। রাজ্যজয় তো করেছিলেনই, কিন্তু সেইসময় বাংলার স্বর্ণযুগ তার হাত ধরেই এসেছিল। বৌদ্ধদর্শন থেকে শৈবদর্শনের দিকে বাংলাকে নিয়ে যাওয়ার পেছনে তার অবদান অসামান্য। বলা হয় উড়িষ্যার লিঙ্গরাজ মন্দির তিনিই বানিয়েছিলেন। এগুলো ইতিহাসের নীরস সত্য। কিন্তু সমস্যাটা হলো এই মহীরুহ যখন তার শাসনকাল শেষ করলেন তখনই দেখা গেল বিপর্যয়, মাৎস্যন্যায় বা জঙ্গল রাজ বলা চলে। কোন আইনের শাসন নেই, বড় মাছ যেমন ছোট মাছকে গিলে ফেলে সেরকম। বাঙালির জীবনে জাতি হিসেবে এটি একটি কলঙ্কিত সময় । এই অবস্থা পরবর্তীতে বাংলাতে গোপালকে শাসক হিসেবে নিয়ে আসে।

এরপর দক্ষিণ রায়, মুকুট রায় এবং পরবর্তীকালে পঞ্চদশ শতকে রাজা গণেশ ইসলামিক শাসনকে অনেকটাই প্রতিহত করেছিলেন। কিন্তু দার্শনিক ভাবে এবং বৌদ্ধিকস্তরে বাঙালিকে তার মূলে ফিরিয়ে এনেছিলেন শ্রীচৈতন্য। এখন শশাঙ্কের সাথে চৈতন্যের তুলনা বেশ অদ্ভুত মনে হতে পারে । কিন্তু আসলে একটা অদ্ভুত মিল আছে দুজনের ক্ষেত্রে – দুজনেই বাঙালিকে ঘোর অমনিশার থেকে তুলে একটা রাজনৈতিক এবং বৌদ্ধিক দিশা এনে দিয়েছিলেন। শ্রীচৈতন্যকে একজন সাধারণ বাঙালি চেনে (নাকি চেনানো হয়?) ভক্তি আন্দোলনের প্রবক্তা, প্রেমময় গৌরাঙ্গ হিসেবে। কিন্তু চৈতন্যের “সিংহগ্রীব সিংহবীর্য সিংহের হুংকার” রূপ টা আমাদের সামনে সুকৌশলে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এর কারণ সহজেই অনুমেয়। আরব সাম্রাজ্যবাদের মুখ হিসেবে কাজীর অত্যাচার যখন বৈষ্ণবদের কীর্তনের উপর নৃশংস হয়ে উঠতে শুরু করলো, শ্রীচৈতন্য মুখ বুজে থাকেননি। তিনি বলে উঠেছিলেন
“ভাঙ্গিব কাজীর ঘর কাজীর দুয়ারে।
কীর্তন করিব দেখি কোন কর্ম করে।।
তিলার্ধেকও ভয় কেহ না করিও মনে।”
বৃন্দাবন দাশের চৈতন্যভাগবতে উল্লেখ আছে :
“আসিয়া কাজীর দ্বারে প্রভু বিশ্বম্ভর।
ক্রোধাবেশে হুঙ্কার করয়ে বহুতর।।
ক্রোধে বলে প্রভু, ‘আরে কাজি বেটা কোথা।
ঝাট আন ধরিয়া কাটিয়া ফেলো মাথা।।
নির্যবন করো আজি সকল ভুবন।
পূর্ব্বে যেন বধ কৈলুঁ সে কাল যবন।।
প্রাণ লঞা কোথা কাজী গেল দিয়া দ্বার।
ঘর ভাঙ্গ ভাঙ্গ প্রভু বলে বার বার।।

ভাঙ্গিলেন যত সব বাহিরের ঘর।
প্রভু বলে,– অগ্নি দেহ বাড়ির ভিতর।।
পুড়িয়া মরুক সব-গণের সহিতে।
সর্ব বাড়ী বেড়ি অগ্নি দেহ চারি ভিতে।।
দেখোঁ মোরে কী করে উহার নরপতি।
দেখোঁ আজি কোন জনে করে অব্যাহতি।।”

এই সময়টা শশাঙ্কের রাজত্বকালের মতই বাঙালির একটা স্বর্ণযুগ ছিল। বণিক শ্রেণীর অবদান এই উত্থানকে ত্বরান্বিত করেছিল। ভক্তিবাদকে শুধু একটা দার্শনিক মতবাদ হিসেবে দেখা মনে হয় খুবই অবিচার। আরব সাম্রাজ্যবাদের বিরোধিতা লক্ষ্য করলে বলা যায় শ্রীচৈতন্যের এই রাজনৈতিক দিকটাই বাঙালিকে টেনে তুলেছিল। এখন সেটা অনেকেরই পছন্দ হয়নি, বিভিন্ন গবেষণা থেকে জানা যায় যে এর ফলেই হয়তো তাকে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছিল । কিন্তু সেটা একটি আলাদা আলোচনার বিষয়। শ্রীচৈতন্যের মতাদর্শ একটি প্রতিস্পর্ধী রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে উঠে এসেছিল যা আরব সাম্রাজ্যবাদের পথের কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। এরপর নিত্যানন্দ আচার্য কর্তৃক নিযুক্ত দ্বাদশ গোস্বামীরা এই ধারাকে অনেক এগিয়ে নিয়ে গেলেও দুর্নীতি ক্ষমতার মোহ আবার গ্রাস করে এই আন্দোলনকে। এই জন্যই সিরাজের দলের পক্ষে রাজ্যপাট চালানো এত সহজ হয়ে উঠেছিলো। এটাকে দ্বিতীয় মাৎস্যন্যায় বললে তাই মনে হয় অত্যুক্তি করা হয় না।

বাঙালি চিরকালই ভারতের বাকি অংশকে একটা বিকল্প দার্শনিক ভাবনা দিয়ে এসেছে। এই প্রবণতা আজকের নয়, সহস্র বছরের পুরোনো। কিন্তু বৌদ্ধধর্মের অষ্ট-আঙ্গিক মার্গের অহিংসা আর চৈতন্যের ভক্তিবাদের অহিংসার মধ্যে একটা পার্থক্য হল এটা যে চৈতন্যের অহিংসা জীবের বেঁচে থাকার অধিকারকে প্রাধান্য দেয়। একই ধারণা আমরা শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের “ফোঁস করবি তো” উপাখ্যানেও পাই। বৌদ্ধিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে বাঙালি যখনই উন্নতির শিখরে উঠেছে, নিজেদের এই ফোঁস করার ক্ষমতটা হারিয়ে ফেলেছে।

এরপর ব্রিটিশ শাসনের যুগে বাংলাতে আবার স্বর্ণযুগ এসেছে, ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র, বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ, আচার্য জগদীশচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, স্বামীজী, নেতাজীর হাত ধরে। কিন্তু এই যুগের পরে বাঙালি তার স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মাৎস্যন্যায়কে ভুলে যায়নি – সেটাও এসেছে। চৈতন্যের সাম্যবাদ ছেড়ে বাঙালির চিন্তন মননে স্থান করে নিয়েছে সাম্যবাদের নামে বর্বরতা। তারফল আজকেও ভুগছে বাঙালি। এই যুগের দুর্নীতি, মধ্যমেধার চর্চা বাঙালীকে শুধু বৌদ্ধিকভাবে পিছিয়ে দিয়েছে তাই নয়, অর্থনৈতিক ভাবেও দুর্বল করে দিয়েছে। রে রে করে তেড়ে আসার আগে ভাবুন যাদেরকে বাঙালি বলে গর্ব করেন তাদের কতজন বাংলা কে কর্মক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন?

১৯৮০ সালে ভারতের জিডিপিতে বাংলার অবদান ৭.২ শতাংশ থেকে কমে এখন ৫.৫ শতাংশের আশেপাশে। ১৯৮০-৮১ সালে গোটা দেশের ইন্ডাস্ট্রিয়াল আউটপুটে পশ্চিমবঙ্গের শেয়ার ছিলো ৯.৮ শতাংশ ,যা ১৯৯৭ সালে এসে দাঁড়ায় ৫ শতাংশে ৷ ১৯৮০-৮১ রাজ্যের অর্থব্যাবস্থায় ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্পের শেয়ার ছিলো ২১ শতাংশ,যা ২০০০ – ০১ সালের শেষে কমে হয় ১৩ শতাংশে। প্রায় ৫৬০০০ কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে, শ্রমিকদের চাকরি চলে গেছে। মানবসম্পদ উন্নয়ন সূচকে পশ্চিমবঙ্গকে নিচের দিক থেকে খুঁজলে তাড়াতাড়ি পাওয়া যায়। বিদ্যাসাগরের মাটিতে বাল্য বিবাহ চলে রমরমিয়ে। আরব সাম্রাজ্যবাদের সামনে আইনের শাসনের কি অবস্থা তা কালীয়াচক থেকে মুর্শিদাবাদে রেল পোড়ানোর মহোৎসব থেকেই বোঝা যায়। এই সব তথ্যের দিকে তাকালে বুঝতে অসুবিধা হয় না এটা আরেকটি মাৎস্যন্যায়।

নিরীশ্বরবাদী দর্শনের ভূমি হলেও নিরাশাবাদী নয় এই বাংলা। ষড়দর্শনের মধ্যে যেগুলো প্রশ্নবাচক যেমন কপিলের সাংখ্য দর্শন, ন্যায় দর্শনের উপর বাঙালির সহজাত আকর্ষণ আশা করি বাঙালীকে আবার ভাবতে এবং প্রশ্ন করতে শেখাবে, চৈতন্যের সাম্যবাদ আশা করি বর্বর, খুনী সাম্যবাদকে বঙ্গোপসাগরে ছুঁড়ে ফেলে দেবে এবং সর্বোপরি মাৎস্যন্যায় থেকে বেরিয়ে এসে আরব সাম্রাজ্যবাদের সামনে বাঙালি রুখে দাঁড়াবে।