ভারতের শিল্পায়নের অভাবের জন্য দায়ী বিচিত্র শ্রমিক আইন

0
846

প্রশ্ন : ভারত কেনই বা একটি শিল্পপ্রধান দেশ (ম্যানুফাকচারিং জায়াণ্ট) হয়ে উঠতে পারেনি?

উত্তর : এর জন্য আমাদের বিচিত্র শিল্পায়ন বিরোধী শ্রমিক আইন দায়ী

বেশ কয়েকদিন ধরেই দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকটা ভারতীয় রাজ্য রীতিমত ঘোষণা করে শ্রমিক আইনের সংস্কার করবে বলে জানিয়েছে।

আবার মধ্য প্রদেশের মত কয়েকটা রাজ্য কৃষিজ পণ্য আইনের বদল আনছে।

বিশেষত্ব হচ্ছে যেসব রাজ্যের এই ধরণের আইনি সংস্কার হতে দেখা যাচ্ছে, সেগুলি সবই হয় একক ভাবে বিজেপি শাসিত, নয় বিজেপির সমর্থিত জোট সরকার।

এটা ভাবলে মোটেই ঠিক হবে না যে, করোনাভাইরাস সঙ্কটের মোকাবিলা শুধুমাত্র কেন্দ্রীয় সরকারের একক দায়িত্ব। সকল ২৯ রাজ্যেরই দায়িত্ব আছে।

আমরা সবাই জানি যে, করোনাভাইরাস পরবর্তী যুগের ভারত যে অর্থনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়তে চলেছে, তা কেবল গ্রেট ডিপ্রেশনের সাথেই তুলনীয় হতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য গ্রেট ডিপ্রেশন ১৯২৯ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত টিকে ছিল।

যে কাজটা প্রত্যেক রাজ্য সরকারের করার কথা ছিল, তা এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র বিজেপি শাসিত রাজ্যেই করতে দেখা যাচ্ছে। tআরা একের পর এক সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েই চলেছে, বিশেষ করে ম্যানুফাকচারিং সেক্টরে। তারা যেভাবে রাজ্যে ইনভেস্টমেন্ট বাড়াবার জন্য খাটছে, তা অভাবনীয়।

আর এই সংস্কার নীতি গ্রহণ করাতেই বোঝা যাচ্ছে এযাবৎ ধরে চলে আসা নেহেরুভিয়ান সোশ্যালিস্ট নীতি চরম ব্যর্থ। ১৯৯১ সালের বিখ্যাত আর্থিক সংস্কারের পরেও ভারতে যেটুকু সোশ্যালিস্ট নীতির ‘ভূত’ টিকে ছিল, তাকে করোনাভাইরাস একেবারে লাথি মেরে ফেলে দিতে চলেছে।

এখানে বলে রাখা দরকার, এখন যেসব সংস্কারের কাজ হচ্ছে, তা কিন্তু অনেক বছর আগেই নামীদামী অর্থনীতিবিদরা করতে বলেছিলেন, বিশেষ করে শ্রমিক আইন বদলাবার কথা। সাথে জমি নীতিও। কিন্তু জনসমর্থন হারাবার ভয়ে কোনও সরকার সেটা করার সাহস দেখাতে পারেনি।

উদাহরণ হিসাবে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডিস্পিউট অ্যাক্টের কথাই বলা যেতে পারে। আগে প্রত্যেক কোম্পানিকে ন্যূনতম ৩০০ শ্রমিক থাকলে ছাঁটাই করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হত। এখন তা কমিয়ে ১০০ শ্রমিক থাকলেই ছাঁটাই নীতি কার্যকর করা হয়েছে।

যেসব শ্রমিক বয়স হয়ে যাওয়ার দরুন সেভাবে কাজ করতে পারছেন না, তাকে ছাঁটাই করে নতুন যুবা শ্রমিক নিতে পারত না কোনও শ্রমিক। এখন তা পারবে। ফলে স্বাভাবিক ভাবেই কর্মসংস্থান অনেক বাড়বে।

একইভাবে আইন বদলে আউটসোর্সিং করার মাত্রা আর বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। যেখানে অসম্ভব কর্মদক্ষতা না থাকলে কাজ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

ভারত এভাবে কোম্পনির সাইজ ছোট রেখেই বেশি কাজ করার সুযোগ এনে দিচ্ছে।

আমাদের পরিকাঠামো এতদিন পর্যন্ত আমাদের কোম্পানিকে বড় মাপের কিছু করার সুযোগ এনে দেয়নি ত বটেই, সাথে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় লড়ার মত মানসিকতা আনতেও সফল হয়নি।

ভারতের মত এত বড় বাজার থাকতেও আমাদের পক্ষে অদ্যাবধি এমন কোনও বড় মাপের কোম্পানি তৈরী করা সম্ভব হয়নি, যারা বিশ্বের যে কোনও বহুজাতিক সংস্থার সাথে পাল্লা দেবার যোগ্য। কিন্তু তা কেন হয়নি সে নিয়ে সমীক্ষা এতদিন করা হয়নি। আর তাই আমরা এতদিন জানতেও পারিনি আমাদের বাণিজ্য নীতিই আমাদের উন্নতির পক্ষে সবচেয়ে বড় বাধা।

আমাদের দেশের আইন ও বিধান এমন ভাবে তৈরী করা হয়েছে, যা শ্রমিকদের স্বার্থ চূড়ান্ত রাখা হয়েছে।

এখন প্রশ্ন হল — এতে কি আদৌ শ্রমিকদের বা শিল্পপতিদের আদৌ লাভ হয়েছে?

উত্তর একটাই — না।

যেখানে অসংগঠিত শ্রমিকদের জন্য প্রায় কোনও সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়নি, সেখানে সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকদের এমন মাথায় তোলা হয়েছে যে, তাদের পাহাড় প্রমাণ অযোগ্যতা সত্ত্বেও ছাঁটাই করা যায়না। এদিকে কর্মসংস্থানের সুযোগ সঙ্গত কারণেই কমছে। ফলে কোম্পানির লাভের চেয়ে লস বেশি হচ্ছে। ফলে ইনভেস্টমেন্টও দিনকেদিন কমছে।

এভাবে গুটিকতক মানুষের কর্মজীবন সুরক্ষিত রাখতে গিয়ে ভারতের একটা বড় অংশের মানুষের কর্মজীবন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও সেভাবে হচ্ছে না। কৃষিক্ষেত্র হচ্ছে এরকমই একটা অবহেলিত জায়গা।

নতুন আইন, প্রবিধানের পর ম্যানুফাকচারিং সেক্টরে একটি নতুন বিপ্লব উঠলে আশ্চর্য হবেন না যেন। এবং তা ভারতের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করবেই।

উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশের মত রাজ্যে, যার আশপাশে কোনও উপকূল নেই, সেখানে এই ধরনের শ্রমনীতি খুবই কাজ দেবে, তা আর বলতে হয়না।

আমাদের সরকারগুলি শুধু যে শ্রম আইন বদলাচ্ছে তা নয়, সাথে কর্পোরেট ট্যাক্সও কাটছে, যা কিনা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় ট্যাক্স কাটার ঘটনার একটা।

চীনকে পাল্টা দিতে হলে উপরোক্ত পদক্ষেপ বিনা উপায় নেই। বিদেশী কোম্পানিকে টানতে হলে এসব পদক্ষেপ নিতেই হবে এবং বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি তা নিচ্ছেও।

এখন দেখা যাক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে এর ভবিষ্যৎ কি?

আমরা লক্ষ্য করে দেখেছি, যেসব রাজ্যে কংগ্রেস শাসিত বা বিজেপির বিরোধী দল ক্ষমতায় আছে, সেখানে এই ধরণের শ্রম আইন বদলাবার নীতি গ্রহণ করা হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে এমন সম্ভাবনা নেই। যদি না হয়, সেক্ষেত্রে বিজেপি শাসিত রাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ওইসব রাজ্যের তুলনায় বেশি হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিজেপি শাসিত রাজ্যে নতুন ইলেক্ট্রিসিটি বিল, ভূমি অধিকার আইনেও বদল আনা হচ্ছে, যাতে বিদেশি কোম্পানিগুলিকে আকৃষ্ট করা যায় সেখানে বিনিয়োগের জন্য।

এইসব রাজ্যের সাফল্য অত্যন্ত জরুরি। কেননা তা বাকি ভারতকে নতুন উন্নয়ন মডেল গ্রহণ করতে বাধ্য করবে। যা আখেরে ভারতের জন্য কার্যকর হবে।

ভারতে যদি এই মডেল সফল হয়, সেক্ষেত্রে অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশও গ্রহণ করবে। তাতে ভারতের সুনাম বাড়বে বলাই বাহুল্য।

আমাদের শুধু ধৈর্য ধরে কয়েক মাস অপেক্ষা করতেই হবে।

করণ ভাসিনের মূল প্রবন্ধটি প্রকাশিত হয় স্বরাজ্য পত্রিকায়। অনুবাদ করেছেন রিচার্ড জুনিয়াস জয়বর্ধনে।