-
ভারতে হালাল কসাইখানা যথেষ্ট আইনত। তারা শুধুমাত্র মুসলিম কসাইদের নিয়োগ করে যারা পশুদের গলা চিরে ফেলার আগে ইসলামিক পদ্ধতিতে প্রার্থনা আউড়ে থাকে।
-
কিন্তু সেক্ষেত্রে, কেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে মালিক এবং কর্মচারীরা হিন্দু এমন দোকানগুলিকে “ধার্মিক“( ধরুন) বলে শংসায়িত করার এবং অনুমতি দেওয়া হবে না?
ভারতে আইনের শাসন একটি মস্করা। এবং তীক্ষ্ণবুদ্ধি ব্যক্তিরা অনেক আগে থেকেই এই ব্যাপারে অবগত।
১৯৯৯ সালে স্বপন দাশগুপ্ত লিখেছিলেন:
ভারত একটি খুব সহজ আদর্শের সাথে কাজ করে: “ব্যক্তিটিকে আমাকে দেখান এবং আমি আপনাকে আইন দেখিয়ে দেব।” থানার সবচেয়ে বিনীত শান্তিরক্ষক থেকে শুরু করে দেশের প্রধান মন্ত্রী পর্যন্ত সকলেই এই বিষয়টি জানেন। আইনের চোখে কোন সমতা নেই। ফলে, কোন আইনই নেই। এবং কোন বাধাও নেই।
কিন্তু ভারতে আইন কীভাবে কাজ করে সেই নিয়ে দুঃখের কাহিনী প্রয়োগ বা এটা যে কীভাবে তা প্রতিষ্ঠার ভিত্তিতে বিভিন্ন ব্যক্তির ক্ষেত্রে বাছাই করে লাগু হয়, শুধুমাত্র এই ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটাও বাস্তব যে আইন বিভিন্ন দলের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ভাবে কার্যকরী। তাই আমাকে স্বপন দার আদর্শের সাথে আরেকটি আদর্শ যোগ করতে দিন। সেটা হল: আমাকে দলটি দেখান এবং আমি আপনাকে আইন দেখিয়ে দেব।
আমরা জানি এটা বাস্তব যে ভারতে যে ব্যক্তির সামাজিক প্রতিপত্তি যত উঁচু, আইনি ঝামেলা থেকে নিস্তার পাওয়া তার পক্ষে তত সহজ। আমরা এই বাস্তব সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল যে ভারত রাষ্ট্র নরম হয়ে পড়ে যখন ব্যাপারটি বিশেষ কিছু দল বা সম্প্রদায়ের আইন লঙ্ঘনের কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করার হয়– নির্দিষ্টভাবে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের এবং বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে। তাহলে এর থেকে এই দলগুলি সম্পর্কে কী জানা যায়? এটা সমাজে তাদের বিশেষ সুবিধাসম্পন্ন মর্যাদাকে দর্শায়।
এই সম্প্রদায়গুলির ক্ষেত্রে দল হিসাবে রাষ্ট্রের তরফে পরিমাপ করে দেওয়া এই ব্যবহার মনে করিয়ে দেয় কীভাবে একটি পথ দুর্ঘটনার দুজন অভিনেতার সাথে পুলিশরা ব্যবহার করে থাকে– বড় গাড়িটি যে চালাচ্ছিল, দোষ সেই চালকেরই এরকম সর্বদা মনে করে নেওয়া হয়। প্রায় সবসময়ই ছোট গাড়ির চালককে পীড়িত ধরে নেওয়া হয়। তথ্য এক্ষেত্রে গৌণ।
পথ দুর্ঘটনার দুজন অভিনেতা এবং বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আলাদা আলাদা ব্যবহার পাওয়ার মধ্যে পার্থক্য হল, প্রথম ক্ষেত্রে অন্যায় ব্যক্তিগত স্তরে সংঘটিত হচ্ছে এবং তা ছোঁয়াচে নয় কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে এটি চরম মাত্রায় ছোঁয়াচে এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে যা সমাজে ফাটলের দিকে মোড় নিতে পারে এবং বিভাজনের অবস্থা তৈরি হতে পারে।
চেন্নাইয়ের একজন রুতিওয়ালা, যিনি একজন জৈন, গ্রেফতার হয়েছেন হোয়াটসঅ্যাপে এই মর্মে বিজ্ঞাপন দেওয়ার জন্য তাঁর কোন মুসলিম কর্মচারী নেই এবং সমস্ত খাদ্যদ্রব্য জৈনরাই তৈরি করে। তিনি তাঁর কর্মচারীদের ধর্মীয় পরিচয় সম্পর্কে একটি সরল তথ্য পেশ করেছিলেন শুধুমাত্র।
প্রথমত, তাঁর বক্তব্যে কোনকিছুই পক্ষপাতমূলক ছিল না। তিনি বলেননি যে তিনি মুসলিমদের কাজে রাখবেন না। তিনি এও বলেননি যে তিনি মুসলিমদের জন্য রুটি তৈরি করবেন না। তাঁর বিরুদ্ধে কোনভাবেই কোন মামলা দাঁড়ায় না।
তবুও, এই রুটিওয়ালার ওপর ভারতীয় দণ্ডবিধির ২৯৫ এ ধারা ( পমানের মাধ্যমে কোন সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতিকে ইচ্ছাকৃত, বিদ্বেষপরায়ণ কাজ দ্বারা আঘাত ) এবং ৫০৪ নং ধারা ( যেন ব্যক্তি যে ইচ্ছাকৃতভাবে কোন ব্যক্তিকে অপমান করে, এবং তৎদ্বারা সেই ব্যক্তিকে উস্কানি দেয়, এই উদ্দেশ্যে বা এটা জেনে যে সেই উস্কানি সেই ব্যক্তির গণশান্তি ভঙ্গ করার কারণ হবে) চাপানো হয়।
যেহেতু এই রুটিওয়ালার বিজ্ঞাপনে ইচ্ছাকৃত, বিদ্বেষমূলক বা অভিপ্রেত কোনকিছুই ছিল না, তাঁর জেল খাটার সম্ভাবনা কম কিন্তু এই ঘটনা ইতিমধ্যেই তাঁর হয়রানির কারণ হয়েছে।
এই ধরণের ঘটনার ক্রমে এটি নবতম সংযোজন যেখানে দোকানদাররা তাদের অমুসলিম বৈশিষ্ট্য দর্শাবার চেষ্টা করেছে বিজ্ঞাপন দিয়ে বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সাহায্যে হোর্ডিং টাঙিয়ে অথবা তাদের দোকানের মাথায় একটি গেরুয়া ঝান্ডা উড়িয়ে। এবং বহু রাজ্য সরকারই এমন দোকানদারদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছে।
যদিও তাদের জেল খাটার সম্ভাবনা খুবই কম, হয়রানির এবং বাধা দানের উদ্দেশ্য কিছু মাত্রায় সফল হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, এই বিষয়ে আমাদের নিজেদের মনোযোগ তৈরি করা প্রয়োজন, কাল যদি কোন দোকানদার বলে যে সে কোন মুসলিম কর্মচারী রাখবে না, যে কারণেই হোক, তাহলে? তাকে কি গ্রেফতার করা বা জেলে পোরা উচিত? যদি সে বলে যে সে শুধুমাত্র একটি বিশেষ ধর্মের লোকজনকেই কাজে রাখবে, তখন? সেই ক্ষেত্রে কি অবস্থার পরিবর্তন হবে?
প্রথম বক্তব্যটি অবশ্যই পরেরটি থেকে বেশি অসুবিধাজনক এবং ভারতীয় সংবিধান অনুযায়ী তা অনুমতিযোগ্য নয়।
উদাহরণস্বরূপ, ১৫ নং আর্টিকলের দুই নং শর্ত পরিষ্কারভাবে জানায় যে, “কোন নাগরিকের ওপরেই, ধর্ম, জাতি, বর্ণ, লিঙ্গ, জন্মস্থান বা এই কোনকিছুর ভিত্তিতে কোন অক্ষমতা, দায়, বাধা বা শর্ত আরোপিত হবে না এই ক্ষেত্রে
ক) দোকান, সাধারণ রেস্তরাঁ, হোটেল এবং গণ বিনোদনের স্থানে প্রবেশ; অথবা
খ) পাতকুঁয়া, জলাধার, স্নানের ঘাট, রাষ্ট্রের টাকায় আংশিক বা পুরোপুরিভাবে চালিত জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য উৎসর্গকৃত রাস্তা বা স্থান ব্যবহার।”
কিন্তু পরবর্তী কথাটি, “আমি কেবল একটি বিশেষ ধর্মের মানুষকেই কাজে নিয়োগ করব” বাক স্বাধীনতা বলে ধরা হয়, অন্তত কিন্তু বিশেষ দলের ক্ষেত্রে।
ভারতে হালাল কসাইখানা যথেষ্ট আইনত। তারা শুধুমাত্র মুসলিম কসাইদের নিয়োগ করে যারা পশুদের গলা চিরে ফেলার আগে ইসলামিক পদ্ধতিতে প্রার্থনা আউড়ে থাকে
কিন্তু সেক্ষেত্রে, কেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে মালিক এবং কর্মচারীরা হিন্দু এমন দোকানগুলিকে “ধার্মিক”( ধরুন) বলে শংসায়িত করার এবং অনুমতি দেওয়া হবে না?
কিন্তু যেটা আরো গুরুতর সেটা হল কীভাবে এই একই মানসিকতা ভারতীয় রাষ্ট্রেরও যা আপাতভাবে ধর্মনিরপেক্ষ এবং ধর্মের ভিত্তিতে কোনরূপ পক্ষপাত থেকে মুক্ত।
কিন্তু কেন্দ্রে এবং রাজ্যে বিশেষ সংখ্যালঘু কার্যকলাপ দফতর আছে যারা কেবল কয়েকটি সংখ্যালঘু তকমাপ্রাপ্ত ধর্মীয় দলকে সেবা প্রদান করে থাকে।
কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরে বিবিধ সংখ্যালঘু কমিশন কাজ করে যেগুলি ধর্মনিরপেক্ষ কর প্রদানকারীদের টাকায় চলে, সেগুলি স্পষ্টভাবে বলে যে বিশেষ কোন ধর্মের লোকজনেরাই সদস্য বা সভাপতি হতে পারবে। সংখ্যালঘু শিক্ষা সংস্থার জাতীয় কমিশনেরও একই কথা।
তাহলে ব্যাপারটা কি এই বিষয়ে নয় যে
রাজনৈতিক ভাবে সঠিক হওয়ায় কে বেশি দক্ষ। “মুসলিম কর্মচারী নেই” বলার থেকে ” শুধু সরলভাবে “জৈন ধর্মাবলম্বীরা আমাদের কর্মচারী” বলতে পারে কেউ অথবা দোকানের বাইরে একটি বোর্ডে কর্মচারীদের নাম লিখে আরো সহজতর করতে পরে বিষয়টিকে।
এই তথ্যে অবশ্যই একটি সত্য রয়েছে যে বিশেষ ধর্মের গোঁড়ামিই একমাত্র ভারতে হালাল (শ্লেষ দ্রষ্টব্য), সম্ভবত এই কারণে যে উল্লেখিত ধর্মগুলির এটা একটা অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ধার্মিক অনুষ্ঠান।
উদাহরণ হিসাবে হালালকে নেওয়া যাক। মুসলিমরা তাদের ধর্মের মতবাদ দেখিয়ে শুধু মুসলিমদের নিয়োগ করাকে সঠিক প্রমাণ করতে পারে। কিন্তু একজন জৈন কি পারবে তার ধর্মগ্রন্থের প্রমাণ দেখিয়ে কেবল জৈনদের নিয়োগকে যথোচিত প্রমাণ করতে? একজন শিখ পারবে? একজন হিন্দু?
যদি উচ্চতম ন্যায়ালয়ের (সুপ্রীম কোর্ট) বর্তমান নজিরগুলি অনুসরণ করা হয় তাহলে আব্রাহামিক ধর্মগুলির প্রভূত সুবিধা আছে এই ক্ষেত্রে। ( সুপ্রীম কোর্টের আবিষ্কার করা অতি প্রয়োজনীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরীক্ষা হল একটি মতবাদ যা সেইসমস্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সুরক্ষা দেয় যেগুলি কোন বিশেষ ধর্মের ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় এবং অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত।)
মূলত, বিশেষ সম্প্রদায়ের গোঁড়ামিই একমাত্র ভারতে হালাল (শ্লেষ দ্রষ্টব্য), শুধু এই কারণে যে এগুলি তাদের ধর্মের অতি প্রয়োজনীয় অঙ্গ কিন্তু অন্য সম্প্রদায় এই একই কাজ করলে তা আইনের চোখে বেআইনি।
অরিহন্ত পাওয়ারিয়ার মূল লেখাটি স্বরাজ্য পত্রিকায় প্রকাশিত। লেখক পত্রিকার বরিষ্ঠ সম্পাদক। অনুবাদ করেছেন শুভম ক্ষত্রী।