তৃতীয় অধ্যায়: কাশী

0
681

অনুবাদক: বৈষ্ণবাচারী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

মথুরার মহারাণীদের অভ্যর্থনা করার জন্য নদীর ঘাটে কেউ উপস্থিত ছিল না। প্রাপ্তিও বেশ হতচকিত হয়ে পড়লেন। তিনি জানতেন যে কেন তাঁরা কাশীতে এসেছেন কিন্তু তিনি তাঁর ঠাকুমা আপন ভ্রাতাদের সঙ্গে কাশীতে আছেন কি না তা নিয়ে বিশেষ কিছু জানতেন না। প্রবলকে বাধ্য হয়ে তাঁদেরকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মুদ্রার বিনিময়ে পালকির বন্দোবস্ত করতে হল এবং প্রায় দীর্ঘ দুই ঘটিকা (৪৮ মিনিট) পরে তাঁরা বরুণা নদীর তীরে রাজপ্রাসাদের দ্বারে উপস্থিত হলেন। তাঁদেরকে দ্বাররক্ষীরা আটকাল।

আবার দুই ঘটিকা লেগে গেল প্রবলের দ্বাররক্ষীদেরকে বোঝাতে। শেষে তাঁদের ভিতরে প্রবেশ করতে দিলেও রাজকীয় অন্তঃপুরে প্রবেশ করতে দেওয়া হল না বরং অন্যরাজ্যের দূতদের জন্য নির্দিষ্ট অতিথিগৃহে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানেই তাঁরা পালকি থেকে অবতরণ করে একটি ক্ষুদ্র গৃহে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন।

সেই রাতে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে কেউই এলেন না। উপরন্তু সারা রাত চারিদিক থেকে তাঁরা শুনতে পেলেন “কৃষ্ণম্ বন্দে জগদ্গুরুম্” মন্ত্রোচ্চারণ। অস্তিও হতচকিত হলেন। এই মন্ত্রোচ্চারণ ভেসে আসছিল রাজভবনের দিক থেকেই। তিনি বৃন্দাবনের এক ভুবনমোহন গোপালকের কথা পূর্বে শুনেছিলেন যে গোপনারীদের তো বটেই এমনকি পুরুষদেরও তার বংশীধ্বনি এবং মিষ্টহাসির দৌলতে মোহিত করতে পারত। তার বালক্রীড়াকালীন কীর্তিকলাপ আর তার অলৌকিক ক্ষমতার অবিশ্বাস্য সব গাথা লোকের মুখে মুখে ফেরে। তবে তাঁর আপন পিতামহীর মাত্রালয়ে এই সব গাথার শ্রবণ ছিল তাঁর পক্ষে অভাবনীয়।

মথুরার রাজপরিবারের সদস্যরা রাতটি সেখানে কাটালেন যেন তাঁরা আর্যাবর্তের অন্য কোন এক রাজ্যের সামান্য অতিথিমাত্র।

পূর্ব দিগন্তের কালোরঙ যখন ফিকে হচ্ছে, তখন এক বৃদ্ধা মহিলা অতিথিগৃহে এলেন। কাশীতে সাধারণতঃ সবাই ঘুম থেকে ওঠে ব্রহ্মমুহূর্তে, কিন্তু মথুরায় তেমনটি হয় না। এই বৃদ্ধা ছিলেন ভগিনীদ্বয়ের পিতামহীর ভ্রাতৃবধূ। বিধবা এবং কাশীনরেশের মাতা। রাজমাতা।

দ্বারের অর্গলের তীব্র খট্খটানিতে অস্তি আর প্রাপ্তির নিদ্রাভঙ্গ হল।

প্রাপ্তি তাঁর নৈশপোশাকেই বাইরে বেরিয়ে এসে রাজমাতাকে দেখতে পেলেন। রাজমাতা কক্ষে প্রবেশ করে ভিতর থেকে দ্বাররুদ্ধ করলেন।

দুই ভগিনী রাজমাতার চরণস্পর্শ করলেন। রাজামাতা খুবই শান্ত এবং সৌম্যা। তিনি দুই রাজকন্যার দিকে তাকালেন এক মিষ্টি হাসির সাথে এবং তাঁদেরকে নাম ধরে ডাকলেন। “অস্তি, প্রাপ্তি, তোমরা কোন খবর ছাড়াই এলে যে। মথুরায় সব খবর ভালো তো?”

প্রাপ্তি ভেঙ্গে পড়লেন। গত দু’দিন ধরে খবরটি গুপ্ত রাখার পীড়া বেরিয়ে এল তীব্র অশ্রুধারায়। তিনি রাজমাতাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন, চক্ষের জল আর বাঁধ মানতে চায় না। অস্তি বিস্মিত বিভ্রান্ত হয়ে তাকিয়ে রইলেন। কেন যে তাঁর সাহসী ভগিনীটি কাঁদছে তা অনুধাবনে তিনি অক্ষম। নিদারুণ বিপদেও ইতিপূর্বে তিনি দেখেন নি তাঁর ভগিনীকে কাঁদতে।

রাজমাতাও অবাক হলেন, কিন্তু তিনি প্রাপ্তির কেশে আপন হাত মৃদুভাবে রেখে তাঁকে আদর করতে থাকলেন আর তাঁকে জিজ্ঞাসা করে যেতে লাগলেন, কি হয়েছে।

প্রাপ্তি সজোরে কঁকিয়ে বলে উঠল, “মাতঃ, মথুরা নরেশকে এক গোয়ালা হত্যা করেছে।”

অস্তি কথাটা শোনা মাত্র মূর্ছিত হয়ে পড়লেন।

রাজমাতা প্রাপ্তির গায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন আর কীর্তন করতে লাগলেন, “কৃষ্ণম্ বন্দে জগদ্গুরুম্।”

প্রাপ্তি সজোরে রাজমাতার বাহু থেকে নিজেকে আলাদা করে নিলেন। ক্ষোভে ফেটে পড়লেন তিনি। রাজমাতাকে জিজ্ঞেস করলেন কেন তিনি কৃষ্ণের স্তুতিসূচক কীর্তন করছেন। “আপনি কি জানেন না এই সেই ছেলেটি যে আমার স্বামীকে হত্যা করেছে?”

“শান্ত হও বাছা। এইগুলি কর্মের অতি সূক্ষ্ম দিক। আমাদের আগেই মনে হচ্ছিল যে মথুরায় সব কিছু ঠিকঠাক চলছে না।”

এতক্ষণে প্রাপ্তি একটু স্বাভাবিক হয়েছেন। রাজমাতা দ্বার উন্মুক্ত করলেন, বাইরে দৃষ্টি মেলে ডাকলেন তাঁর দাসীদের, বললেন অস্তির যত্ন নিতে। তারা জল নিয়ে এল এবং অস্তিকে জলের ঝাপটা দিল। ইতিমধ্যে রাজমাতা প্রাপ্তিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমরা দুজনেই কি কুটিল ধর্মে দীক্ষা নিয়েছ?”

এইবার প্রাপ্তির বিস্মিত হবার পালা। “তা কি করে সম্ভব মাতঃ? আমরা ভারতবর্ষের শ্রেষ্ঠ শিবভক্ত জরাসন্ধের কন্যা। এই খেয়াল কেবল মথুরা নরেশেরই ছিল। কিন্তু আপনি কি করে জানলেন এত কিছু? আমার স্বামীর হত্যাকারীর নাম আপনি জপই বা করছেন কেন?”

বৃদ্ধা প্রাপ্তির প্রশ্নটি উপেক্ষা করলেন। “ও, তোমরা এখনও সনাতনী? আমরা আগে শুনেছিলাম যে মথুরার পুরো রাজপরিবারই কুটিল ধর্মে দীক্ষা নিয়েছে। ওদের হিংসায় সামিল হয়েছে। এই কারণেই বাছা আমরা তোমাদের কাল রাতে অন্তঃপুরে ঢুকতে দিইনি। চল তোমাদের অন্তঃপুরে নিয়ে যাই। তোমরা তো আমাদের আপনজন।”

প্রাপ্তি শান্ত হলেন। তিনি বৃদ্ধাকে ফিসফিসিয়ে বললেন, “মাতঃ, মহারাজ কংস কুটিল মুনির শিষ্য ছিলেন।”

রাজমাতা তাঁর কথা মনোযোগের সাথে শুনলেন। তাঁর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হল এ সব কিছুই তাঁর জানা। “আমরা জানতাম যে তাকে ঐদিকেই যেতে হবে। আঙ্গিরারা (ঋষি অঙ্গিরার পরম্পরার সন্ন্যাসীরা) আমাদের সবকিছুই জানান। তাঁরা বৃন্দাবনের এই অদ্ভূত বালকের কথাও বলেছেন। আঙ্গিরারা এই বালককে নিযুদ্ধ এবং সামরিক শিক্ষা দেবার জন্য অনেক শিক্ষককে ওখানে পাঠান। তাঁরাই বলেছেন যে এই বালক অদ্ভূত প্রতিভাবান। ওঁনার সঙ্গী গোপালকেরা ওঁকে শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক দিশায় উদ্বুদ্ধ করেছে। উনিই হয়ত এই পৃথিবীর নেতা হিসাবে গড়ে উঠছেন।”

অস্তির জ্ঞান ফিরে এসেছে। তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদছিলেন। রাজমাতা তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন এবং রাণীদের অন্তঃপুরে নিয়ে যাবার জন্য দাসীদের পালকি আনতে বললেন।

রাজপরিবারের সদস্যদের যেমন প্রাপ্য তেমনি মর্যাদার সাথে প্রাসাদের অন্তঃপুরে মথুরার ভূতপূর্ব দুই রাণীর বসবাসের ব্যবস্থা করা হল। অস্তি আর প্রাপ্তি তখনও কাঁদছিলেন। গত দু’দিন ধরে প্রাপ্তির উপর গেছে ধৈর্যের পরীক্ষা। অস্তির কাছে এই দুইদিন ছিল নিরবিচ্ছিন্ন নিদ্রা আর নিদ্রালুতার সময়। তার প্রকোপ থেকে নিজেদের ফিরে পেতে ক্রন্দনই ছিল একরকম পন্থা। অনেক মহিলাই তাঁদের কাছে এসে তাঁদের সান্ত্বনা দিলেন। দুই ভগিনী একটু স্বস্তি ফিরে পেয়ে একসময় স্নানাদি শৌচের জন্য গেলেন। তিন দিন পরে প্রথম পূর্ণাঙ্গ স্নান। স্নানের পর তাঁরা শৃঙ্গার (রকমারি সাজসজ্জা) পরিহার করে বিধবার বেশে বেরিয়ে এলেন। দাসীরা তাঁদের মহলে এসে তাঁদের খাদ্যপানীয়ের ব্যবস্থা করে দিল। তারপর অন্তঃপুরের মূলভবনে এক প্রথাগত শোকসভা হল।

শোকসভা চলল প্রায় এক প্রহর (তিন ঘণ্টা)। সভাভঙ্গের পর সবাই বিদায় গ্রহণ করলেন। রাজমাতার সঙ্গে দুই মগধ রাজকন্যা রইলেন।

রাজমাতা কথা বিশেষ বলছিলেন না, কিন্তু নিঃশ্বাসে-প্রশ্বাসে “কৃষ্ণম্ বন্দে জগদ্গুরুম্” জপ করে যাচ্ছিলেন। তিনি এই জপ মনে মনে করছিলেন, কারণ দুই রাজকন্যার কাছে, তিনি অনুমান করলেন যে, কৃষ্ণের নাম শোনা বেশ পীড়াদায়ক হবে।

প্রাপ্তি এই মন্ত্রজপ দেখে আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। এই মন্ত্র তিনি কেবল রাজমাতার মুখেই শোনেননি, বরং কাশীর রাস্তায় এবং অন্যান্য মহিলাদের মুখেও শুনেছিলেন। কেন তাঁদের স্বামীর হত্যাকারী জগদ্গুরু হিসাবে তাঁদেরই প্রমাতুল ভবনে সম্মানিত হচ্ছেন?

“মাতাশ্রী, আপনারা সকলে কেন এক সাধারণ গোপালকের স্তুতি করছেন? সে আমাদের স্বামীকে হত্যা করেছে। চারিদিকে তার সম্বন্ধে নানারকম উপকথা শোনা যাচ্ছে। সে কি কোন মহামানব নাকি? কেন কাশীতে তার পূজা হচ্ছে? আমাদের স্বামীকে এই ঘৃণ্য আততায়ীই মেরেছে। আর আমাদের এখানে বসে বসে নারীদের মুখে তার গুণকীর্তন শুনতে হচ্ছে।” প্রাপ্তির প্রশ্নে নিহিত ছিল অনতিবিলম্বে উত্তরের জন্য উপরোধ। অস্তি পুরো সময়টাই ছিলেন নির্বাক, যেন তিনি আজ বলার ক্ষমতা হারিয়েছেন।

রাজমাতার মুখে ফুটে উঠল স্বস্তির বিনম্র হাসি। তিনি তাঁর হাত স্নেহভরে অস্তির কাঁধে রাখলেন আর তাঁকে কাছে টেনে নিলেন। “বাছা, কৃষ্ণ কোন এক সাধারণ গোপালকের নাম নয়। এই নাম এক প্রেরণা। আমি খুব অবাক যে তোমরা তাঁর নাম শোননি যদিও তিনি থাকেন মথুরার কয়েক যোজনের মধ্যেই। তোমরা ওঁনার কীর্তির কোন কিছুই শোননি। তোমাদের এই গাথা শোনা দরকার।

“আঙ্গিরারা কাশীতে নিয়মিত আসে। আমরাও প্রয়াগে বছরে দুবার যাই, মাঘী সংক্রান্তিতে স্নানের জন্য আর চৈত্র নবরাত্রিতে। প্রয়াগে গেলেই, আমরা আঙ্গিরাদের আশ্রমে যাই। সেখানে তাঁরা আমাদের ক্রিয়া আর কর্মের পার্থক্য শেখান। গত দুতিন বছর ধরে তাঁরা আমাদের কৃষ্ণের উদাহরণ দেন, কিভাবে তিনি প্রকৃত কর্মযোগী হিসাবে গড়ে উঠছেন। আঙ্গিরারা তাঁকে বৃন্দাবনে সমরবিদ্যা আর কলাবিদ্যাও শিক্ষা দিয়েছেন। তাঁর কাছে শিখেছেনও অনেক কিছু, যেমন তাঁর নির্মোহী স্বভাব এবং কর্মপ্রতিভা।

“এই গল্পের সবচেয়ে আশ্চর্য অংশ এটাই যে তিনি এক মেয়েকে তাঁর গুরু হিসাবে গ্রহণ করেছেন আর মেয়েটি তাঁকে আপন সাথী মনে করে। তাঁকে শিক্ষা দেবার সময় আঙ্গিরারা কেবল শেখান না, তাঁরা কৃষ্ণের কাছে থেকে শেখেনও। আশ্রমের বর্তমান মোহান্ত মহারাজ, আচার্য ঘোর-আঙ্গিরস, তাঁকে জগদ্গুরুর উপাধি দিয়েছেন। তিনিই আমাদের এই শ্লোক শিখিয়ে তা জপ করতে বলেছেন। তিনি আরও বলেছেন যে আমাদের কৃষ্ণের অনুকরণ করার চেষ্টা করা অনুচিত। কৃষ্ণের কথাগুলিই অনুসরণ করা উচিত, তাঁর কর্ম নয়। সাধারণ মানুষের পক্ষে তাঁর মত নির্মোহী হওয়া অসম্ভব। তাই তাঁর কর্মপ্রণালীও সাধারণ লোকের পক্ষে অনুসরণ করা সম্ভব নয়। সেই জন্য সাধারণ মানুষের তাঁকে অনুকরণ না করে কেবল গুরু হিসাবেই নেওয়া উচিত। সন্ন্যাসী হিসাবে তাঁর সদ্গতি লাভের পূর্বে আচার্য ঘোর আঙ্গিরস নিজেও যাদব গোষ্ঠীর অংশই ছিলেন।” রাজমাতা থামলেন।

প্রাপ্তি এই গল্পে অভিভূত হলেন। “সন্ন্যাসী হিসাবে সদ্গতির মানে কি?”

রাজমাতার আধ্যাত্মিকতায় ছিল ভীষণ উৎসাহ। যখন তিনি ছিলেন তরুণী রাণী, তখনও তিনি কাশী এবং গঙ্গার শান্ত সৌন্দর্যে অভিভূত হতেন। তিনি গঙ্গার তীরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতেন এবং শিবলিঙ্গের জপ করতেন। তরুণী রাণী অবস্থায়ই তাঁকে সবাই গৌরী মা বলে ডাকত। তিনি ছিলেন যেন মহাগৌরীর অন্য রূপ। মহারাজের মৃত্যুর পরও তিনি তাঁর পথ পরিবর্তন করেন নি। তিনি ঋষি-মুনিদের সঙ্গে দীর্ঘ সময় যাপন করেছিলেন এবং বহু ভ্রমণও করেছিলেন। তাঁকে ঋষিণী বললেও ভুল বিশেষ কিছু হবে না।

রাজমাতা প্রাপ্তির প্রশ্নে আনন্দিত হলেন। তাঁর মুখে তখন প্রশ্রয়ের হাসি। “বাছা, সন্ন্যাসীর এক নতুন জন্ম হয়। সন্ন্যাসী হবার সময় তাঁকে নিজের অন্তিম ক্রিয়াকলাপ সাঙ্গ করে তবেই সন্ন্যাসী হতে হয়। কারণ তাঁর অতীতের সব বন্ধনকে, যেমন পরিবার, জাতি, গোষ্ঠী এবং আগেকার সমস্ত স্মৃতিকেও ভুলে যেতে হবে। সন্ন্যাসী তাঁর চিত্তবৃত্তিগুলি নিরোধ করার এক ব্রত নেয়। একে বলে ক্রিয়া যোগ যা পরিশেষে কর্মযোগের রূপ নেয়। তোমাকে ক্রিয়া আর কর্মের পার্থক্য জানতে হবে।”

প্রাপ্তি আলোচনার গভীরে গমন করছিলেন। “রাজামাতা, আমার তো মনে হয় না যে ক্রিয়া ছাড়া কোন কর্ম হতে পারে। প্রত্যেক ক্রিয়া তার কর্মের জন্ম দেয়।”

রাজমাতা ধৈর্যের সাথে বললেন, “বাছা আমার, এখানেই আমরা ভুল করি। ক্রিয়া কেবল শরীরের কাজ। তুমি হয়ত আমার চরণস্পর্শ করলে শ্রদ্ধার অঙ্গ হিসাবে। কিন্তু মনে মনে হয়ত আমাকে অভিশাপ দিচ্ছ। চরণস্পর্শ তোমার ক্রিয়া। তার কারণ এই যে ভদ্রগৃহে বড় হয়ে তুমি শিষ্টাচার শিখেছ। কিন্তু তোমার ক্রিয়ার যে প্রেরণা তাকে বলে কর্ম। গুরুদেব ঘোর আঙ্গিরস আমাদের বলেছেন যে কৃষ্ণ তাঁর কাজে পুরোপুরি নির্মোহ হয়েছেন। এর মানে এরকম যে তাঁর বাহ্যিক ক্রিয়ার সাথে কর্মের কোনই  সম্বন্ধ নেই। গুরুদেব বলেছেন, এরকম মানুষ এক যুগে কেবলমাত্র একজনই জন্মান। আমরা এঁনার কাছে শিক্ষালাভে ব্যাকুল। তুমি বললে যে তিনি তোমার স্বামীকে হত্যা করেছেন। এ তাঁর ক্রিয়ামাত্র। আমাদের প্রতীক্ষা করে দেখতে হবে, এই ক্রিয়ার পিছনে প্রেরণা কি আছে।”

তিনি একটু থামলেন, তারপর আবার বলে চললেন, “আমরা জানি যে তোমার স্বামী ছিলেন কুটিল মুনির শিষ্য। জনসাধারণের উপর অকথ্য অত্যাচার করতেন। তিনি মন্দির ধ্বংস করছিলেন এবং গোহত্যাও করছিলেন। তাঁর ছিল শত শত রক্ষিতা। তিনি ঋষি গর্গাচার্যের সুপরামর্শ উপেক্ষা করতেন। শুধু তাই নয় সুধর্মসভা নামে যে সুন্দর প্রতিষ্ঠান আছে, তাকেও তিনি উপেক্ষা করতেন।

“যতক্ষণ না আমরা স্বয়ং কৃষ্ণের কাছ থেকে শিখতে পারছি, আমরা এই মন্ত্রজপ করেই যাব যাতে আমরা তৈরী হতে পারি কৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য। যখন ভাগ্যক্রমে এই সুযোগ আসবে, তখন আমাদের হৃদয়ের ভক্তি তাঁর প্রতি থাকতে হবে। আচার্য ঘোর আঙ্গিরস জানিয়েছেন যে কৃষ্ণ তাঁর কাছে নিশ্চয়ই আসবেন কারণ তিনি কয়েকটি বিদ্যা জানেন যা অন্য কেউ শিক্ষা দিতে অসমর্থ। তাঁর কাছে সাধারণতঃ মুনিরাই সর্বোচ্চ স্তরের বিদ্যালাভের জন্য আসেন। তিনি আমাদের কথা দিয়েছেন যে কৃষ্ণ এলেই তিনি আমাকে তাঁর সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেবেন। মহাদেবই জানেন কখন সেই সুযোগ হবে, আর আমি ততদিন জীবিতও থাকব কিনা। ততদিন আমি তাঁকে গুরু হিসাবেই নেব আর শ্রদ্ধা জানাব। এই মন্ত্রজপ প্রথম কয়েকজনের সঙ্গে আমিই শুরু করেছিলাম। তবে এখন দেখছি কাশীর বহু লোকই এই মন্ত্র জপ করছে। হর হর মহাদেব আর রাম রামায়ই নমঃ এই দুটি মন্ত্রের পর এটিই এখন কাশীর সবচেয়ে জনপ্রিয় মন্ত্র।

রাজমাতা বিদায় নিতে উঠে দাঁড়ালেন। তিনি জানালেন যে ভগ্নিদ্বয়ের মগধের দিকে যাত্রা একদিন পর শুরু হবে। মগধে দূত প্রেরিত হয়েছে। তাঁদের সম্মতি পাওয়া মাত্র, রাজকীয় বজরায় তাঁরা পাটলিপুত্র যাবেন, সেখান থেকে পাঁচ যোজন দূরেই তো গিরিব্রজ।

(ক্রমশ )

 

 

মূল গ্রন্থ: Krishna Gopeshvara (2018)

অঙ্কনশিল্পী: শ্রীমতী পৌলমী গঙ্গোপাধ্যায়

সৌজন্য: Bloomsbury India