শবরীমালা কি কেরালার নন্দীগ্রাম হতে চলেছে?

মালয়ালি হিন্দুরা যথেষ্ট  শোষিত, কিন্তু তাঁদের আপন, বাস্তব অবস্থা অনুভব করতে বহু বিলম্ব হয়ে গেছে। শবরীমালার উপর সুপ্রীম কোর্টের  রায় লাগু করার বিতর্কের পরিপ্রেক্ষিতে হিন্দুরা গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের বক্তব্য, “অনেক সয়েছি, আর নয়।”  জাতি, অর্থনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত বা সামাজিক স্তর, কোন কিছুই আর তাদের ঐক্যের পথে প্রতিবন্ধক নয়। শবরীমালা মালয়ালি হিন্দুদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে দিয়েছে। বহুদিন ধরে যে ক্ষোভ প্রচ্ছন্ন ছিল, শবরীমালা তাকে প্রকট করে দিয়েছে। ক্রোধের পুঞ্জীভূত এই বহিঃপ্রকাশ সাধারণত হয় ভীষণ এবং পরিণতি হয় ভয়াবহ।

এই ভীষণ সমস্যার জন্য আর কেউ নন – মুখ্যমন্ত্রী শ্রী পিনারাই বিজয়ন স্বয়ং দায়ী।  সুপ্রীম কোর্ট সমস্ত মহিলাদের মন্দিরে প্রবেশের জন্য  রায় হয়ত দিয়েছেন, কিন্তু বিজয়ন কোন চেষ্টাই করেন নি কোর্টের এই অনধিকার হস্তক্ষেপ থেকে হিন্দুদের রক্ষা করতে। তিনি আপন কঠোর ভূমিকার দ্বারা হিন্দুদের ক্রোধের অগ্নিতে ঘৃতাহুতি দিয়েছেন। তাঁর সব বক্তৃতায় আর সংবাদপত্রদের সামনে রাখা বক্তব্যে তুলে ধরেছেন একটিমাত্র কথা, তা হল তাঁর রাজ্যের “সেকুলার ভাবমূর্তি” বিনষ্ট হচ্ছে “সংঘ পরিবারের ষড়যন্ত্রের” ফলে। শবরীমালার পুরো বিষয়টিই নাকি সংঘ পরিবারের বানানো। এই পরিপ্রেক্ষিতে করা তাঁর অনেক মন্তব্যই মূর্খোচিত। যেমন তিনি বলেছেন, বিজেপি কেন কোর্টের কাছে নিজের বক্তব্য রাখছে না! মুখ্যমন্ত্রী ভুলে গেছেন যে তাঁর আসনে বসে তিনি কোন একতরফা বক্তব্য রাখতে  বা পক্ষপাত করতে পারেন না। তিনি শবরীমালা মন্দির অপবিত্রকরণকেই তাঁর প্রাথমিক কর্তব্যের মধ্যে রেখেছেন। তাছাড়া আর কোন কিছুই ব্যাখ্যা করতে পারে না তাঁর প্রশাসনের জঘন্য কীর্তিকলাপ এবং অনর্থক দ্রুততাকে।

একই কথা বলা চলে কেরালা সরকারের ক্ষমতা প্রদর্শনে। তাঁরা, ১৬ থেকে ২২ শে অক্টোবর পর্যন্ত, এক অহিংস প্রতিবাদের মোকাবিলায় ৩,০০০ এর ও অধিক ব্যাক্তিকে গ্রেফতার করেছে। এ এক ষ্ট্যালিনীয় টুঁটি টিপে ধরা নীতি। কমিউনিস্ট দর্শনে একটি কথা বলা হয় – party controls the gun – এক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম নেই। কেরালা পুলিশের হাতে সমস্ত  ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে; তারা ভক্তদের মন্দিরে প্রবেশ করতে বাধা  দিতে পারে। শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার অজুহাতে তারা মন্দিরের নিকটবর্তী অঞ্চলগুলিতে যা খুশি তাই করতে পারে।  কেরালার উচ্চ ন্যায়ালয়ও এতে উদ্বিগ্ন। অবশ্যই ভারতের তথাকথিত উদারপন্থীরা মুখে কুলুপ এঁটেছেন।

কেরলের কমিউনিষ্ট পার্টি এবং অন্যান্য বামপন্থীরা রাজ্যের সর্বত্র যে নামজপ যাত্রা হয়েছিল, সেই শক্তিতে ভয়ভীত হয়ে গেছে। শত সহস্র প্রতিবাদকারী, কেরলের সর্বক্ষেত্রে – উত্তরে কাসরগড় থেকে সর্ব দক্ষিণে তিরুবন্তপুরম্ পর্যন্ত, ওয়াইনাড়ের পাহাড় থেকে আলাপ্পুঢ়ার খাঁড়ি, সুপ্রীম কোর্টের রায় আর কেরালা সরকারের নীতির বিরোধিতা করেছেন। অধিকাংশ প্রতিবাদই হয়েছে অত্যন্ত স্বতঃস্ফূর্তভাবে। বিক্ষুব্ধ হিন্দুদের এক করে আয়াপ্পা সংঘমগুলি পরিচালনা করেছে। সমস্ত প্রতিবাদেরই নেতৃত্বে ছিল মহিলা ভক্তবৃন্দ। তাঁরা কেউই চাননি স্বামী আয়াপ্পার নৈষ্ঠিক ব্রহ্মচর্য কেউ ভঙ্গ করে তাঁদেরকে সমানাধিকার প্রদানের অজুহাতে ।

কমিউনিষ্ট পার্টি প্রথমে বলে যে এই প্রতিবাদগুলি “উচ্চবর্ণের” হিন্দুরা আয়োজন করছে। তারা শবরীমালার ব্যাপারে হিন্দুদের ঐক্যকে নষ্ট করতে জাতপাতের ভেদাভেদকে কাজে লাগাতে চেয়েছিল। কিন্তু তা কাজ করেনি কারণ বহু আন্দোলনকারী সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্গ থেকে ছিলেন। তখন কমিউনিষ্ট পার্টি নতুন পোঁ ধরল।  এই বিষয়টি নাকি রাজ্যে সাম্প্রদায়িকতাকে উস্কে দেবার কারণ! শবরীমালার যে ভক্তরা কোর্টের রায়ের বিরোধিতা করছে, তাঁদের চরিত্র কালিমালিপ্ত করতে কোন চেষ্টাই কমিউনিষ্ট পার্টি বাদ রাখে নি। এই বিষয়ে প্রধান টেলিভিশন চ্যানেলগুলিতে যে অসম্ভব তীব্র মিথ্যা এবং অপপ্রচার চলছে, সে সব কিছুই বাম মনোভাবাপন্ন এবং বাম-ঘেঁষাদেরই অপকীর্তি।

যাঁরা কমিউনিজম নিয়ে পড়াশুনা করেছেন এবং এই কর্মপদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত, তাঁদের কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টির কীর্তিকলাপ দেখে বিস্মিত হবার কারণ নেই। তারা এই বিষয়টি সামাজিক ন্যায় বলছেন এবং শবরীমালার রায়কে সমতার দিকে একটি প্রকাণ্ড পদক্ষেপ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। মার্ক্সবাদীরা বারংবার কেরালার নিম্নবর্ণের মানুষের প্রবেশে যে বাধা ছিল তার দিকে দৃষ্টি ফেরানোর চেষ্টা করেছেন। ভাইকম এবং গুরুওয়ায়ুর সত্যাগ্রহের কথা তাঁদের মুখে মুখে ফিরছে যা নিম্নবর্গের মানুষের জন্য মন্দির প্রবেশে বিধিনিষেধের স্খালনের উদ্দেশ্যে করা হয়েছিল। এই সবই চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ আয়াপ্পা ভক্তরা এবং জনসাধারণ এই মন্দিরের রীতিনীতির সাথে সুপরিচিত। তাঁদের কাছে নিম্নবর্ণের মন্দির প্রবেশের সাথে এই বিষয়টির কোন সাদৃশ্য ধরা পড়ে নি। কেরলার হিন্দুধর্মালম্বীদের মধ্যে শবরীমালার প্রতি আছে অসম্ভব শ্রদ্ধা, বিশেষ করে তথাকথিত নিম্নবর্ণের মধ্যে। প্রায় প্রত্যেক মালয়ালিই জানে যে এই মন্দিরে তীর্থযাত্রা করার জন্য ভক্তদের কিপ্রকার কঠিন ব্রত নিষ্ঠা সহকারে পালন করতে হয়। অন্যদিকে মন্দিরে ঢোকার জন্য ধর্মমতের ভিত্তিতে কোন প্রতিবন্ধকতাই নেই, হিন্দু বা মুসলমান বা খ্রীষ্টান যাই হোক না কেন, একজন ব্রতধারণ করলেই এখানে প্রবেশ করতে পারে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে কেরালার প্রায় সব মন্দিরেই হিন্দু ছাড়া বাকিদের প্রবেশ নিষেধ।

এটিও ঠিক, অনেকভাবে দেখতে গেলে কেরালায় কমিউনিষ্ট পার্টি হিন্দুদের স্বার্থ দেখে। তার একটি কারণ হল যে বিরোধী ইউ ডি এফের পার্টিরা যেমন কেরালা কংগ্রেস (মণি) এবং ইণ্ডিয়ান ইউনিয়ন মুসলিম লীগ, যথাক্রমে খ্রীষ্টান এবং মুসলমানদের স্বার্থ দেখে। এই পার্টি হিন্দুদের আনুষ্ঠানিক ঐতিহ্যের সাথে জড়িত সারস্বত কলার প্রসারে পৃষ্ঠপোষকের কাজ করেছে। রক্ষণশীল হিন্দুদের প্রচ্ছন্নভাবে এবং সরাসরিভাবে মদত দিয়েছে। এখন বিজেপি, তন্ত্রী (মন্দিরের পুরোহিতদের) ইত্যাদিদের আক্রমণ করা সত্ত্বেও, মুখ্যমন্ত্রী নায়ার সেবা সমাজের (এন এস এস) ভূমিকা নিয়ে কোন কথাই বলেন নি। এখানে উল্লেখযোগ্য বিষয় এই যে এন এস এস উচ্চবর্ণের নায়ার জাতির মুখপাত্র। এই সংস্থা এবং এর সাধারণ সম্পাদক সুকুমারণ নায়ার শবরীমালার ব্যাপারে আপন বিরোধিতা ব্যক্ত করেছেন। তাঁরা কোর্টে এর বিরুদ্ধে আপন বক্তব্য রেখেছেন, প্রতিবাদও করেছেন সুপ্রীম কোর্টের এবং রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। কিন্তু এঁদের সমালোচনা করতে পিনারাই বিজয়ন পরাঙ্মুখ।

রাজ্যের কট্টর কমিউনিষ্টরা এক কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। কিভাবে তাঁদের সর্বৈব নেতা পিনারাই বিজয়নের ভূমিকার বিরুদ্ধে জনমানসের তীব্র ক্ষোভকে প্রশমিত করা যাবে – এই চিন্তায় তাঁরা একপ্রকার দিশাহারা। শ্রী বিজয়ন তাঁর নির্ভীক নেতৃত্বের জন্য শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার সময়  যে ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছিলেন, তা আজ ধূলিসাৎ প্রায়। তাঁর গোঁয়ার্তুমির জন্য পার্টি এরকম এমন এক বিরাট সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে যা পশ্চিমবঙ্গে সিঙ্গুর এবং নন্দীগ্রাম পার্টির সামনে নিয়ে এসেছিল।

আমি শৈশব থেকে ছিলাম কমিউনিষ্ট পার্টির সমর্থক। তাদের মহৎ সব লক্ষ্য যেমন সামাজিক পরিবর্তন এবং সকলের জন্য অর্থনৈতিক উন্নতির আমি ছিলাম একনিষ্ঠ সমর্থক। এই সব কথার অন্তরালের অন্তঃসারশূন্যতা এবং এই সব অসম্ভব ভালো শব্দের লক্ষ্যগুলির বাস্তব সমস্যাগুলি যত বড় হয়েছি আমার সামনে ধরা পড়েছে। আমি বাধ্য হলাম আমার জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গী পরিবর্তন করতে জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অসমর্থনীয় ঘটনাবলীর পর। আজ লক্ষ লক্ষ মালয়ালিদের কাছে সেই দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হচ্ছে এই কয়েক সপ্তাহে। শবরীমালা হতে চলেছে কেরালার নন্দীগ্রাম। কংগ্রেসের পতনের ফলে বামেরা নিরঙ্কুশ ক্ষমতায় এসেছিল, কিন্তু কালের গতিতে পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। শ্রী অমিত শাহ শনিবার ঘোষণা করেছেন যে বিজেপি শবরীমালা নিয়ে আয়াপ্পা ভক্তদের সাথে দৃঢ়ভাবে আছে এবং থাকবে। ভক্ত হিসাবে আমার একান্ত প্রার্থনা যে মন্দিরের অনুষ্ঠান এবং রীতিনীতি যেন আগামী সপ্তাহগুলিতে ভঙ্গ করা না হয়। রাজনীতিতে যাই হোক, এটাই আমার আন্তরিক কামনা।

স্বামিয়ে শরণম্! আয়াপ্পা শরণম্! স্বামিয়ে শরণমায়াপ্পা!