“বল্লাল সেনের মা বিলাস দেবীর করা হোমাশ্ব যজ্ঞের কথা উল্লেখ ক’রে তাম্রফলক উৎকীর্ণ করা হয়েছিল”

0
1033

প্রথম কিস্তির পর

ডঃ ঠাকুর : আগেই বলেছি যে কাটোয়া মহকুমা অঞ্চল নানাবিধ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সমাহারে ঐতিহাসিক উপাদানগতভাবে খুবই সমৃদ্ধ। এই ধরণের প্রত্ননিদর্শনসমৃদ্ধ অঞ্চলকে এখানে ডাঙা বলা হয়ে থাকে। এ অঞ্চলে এরকম অনেকগুলি ডাঙা রয়েছে। আমি মূলতঃ যে কাজটি করেছি, বা বলা ভালো যে কাজটি এখনো করে চলেছি, তার গুরুত্ব হচ্ছে এই – যে অঞ্চলটিকে কেন্দ্র ক’রে আমার ক্ষেত্রসমীক্ষার কাজটি আবর্তিত হয়েছে, সেটি একদিকে যেমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমৃদ্ধ, তেমনি আবার স্থাপত্যনিদর্শনেরও বহুল প্রাচুর্য এখানে লক্ষ্য করা যায়। ব’লে রাখি যে এখানে প্রচুর প্রাচীন পাথরের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে। এইসব নিদর্শন মূলতঃ বৈষ্ণব সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত – উদাহরণ হিসেবে বলা যায় যে এই অঞ্চলের গ্রামে গ্রামে পাল-সেনযুগের বিষ্ণুমূর্তি প্রচুর সংখ্যায় পাওয়া গেছে। আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করবেন : মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যদেব নীলাচলে যাবার আগে নবদ্বীপে থেকে যে লীলা ক’রে গেছেন তার প্রভূত প্রভাব রাঢ় অঞ্চলে পড়েছিল। সেই কারণে এই অঞ্চল অনেক বৈষ্ণব কবির জন্ম দিয়েছে। জ্ঞানদাসের জন্ম এখানে, গোবিন্দদাস কবিরাজের জন্মস্থান এখানে, আবার বাংলা মহাভারতকার কবি কাশীরাম দাসের জন্মও এখানে। একই কারণে [শ্রীচৈতন্যদেবের গৌড়ীয় বৈষ্ণব প্রভাবের ব্যাপকতার কারণে] এখানে অসংখ্য দারুবিগ্রহ পাওয়া যায়। এই বৈষ্ণব ধারা এবং একটি সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতি (লোকনৃত্য, রণপা, রায়বেঁশে নাচ) ও লোকশিল্প (শোলার কাজ, মাটির কাজ, লোহার কাজ) কাটোয়া মহকুমার প্রায় চারশো সংখ্যক গ্রামে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। সেই কারণে আমি ঠিক করি যে এই গ্রামগুলিতে সমীক্ষা চালানো খুব জরুরি। আমার মনে হয়েছিল যে এখানকার সংস্কৃতিকে জানতে হ’লে এবং সেই সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হ’লে এই কাজটি সম্পন্ন করা খুবই প্রয়োজনীয়। এই উদ্দেশ্যে আমি ১৯৯৫-৯৬ সাল থেকে শুরু ক’রে উক্ত গ্রামগুলিতে ঘুরে বেড়াতে শুরু করি। চাকরিতে যোগ দেবার পর থেকে ছুটির দিন পেলেই আমি এইভাবে এই গ্রামগুলি পর্যটন করতে বেরিয়ে পড়তাম – আজও তা ক’রে থাকি। এই পর্যটন থেকে উঠে আসা পর্যবেক্ষণ ও ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলাফল হিসেবে যে বিশাল তথ্যভাণ্ডার আমার কাছে জমা হয়েছে, সেইগুলির উপর ভিত্তি করেই আমি এখনো লেখালেখি ক’রে চলেছি। আমার পত্রিকা, অন্যান্য পত্রিকা এবং আমার লেখা যে বইগুলি প্রকাশিত হয়েছে, সেসবের মাধ্যমে আমি মূলতঃ এই ক্ষেত্রসমীক্ষাজাত তথ্যগুলিকেই পরিবেশন করেছি। এখনো অব্দি আমি প্রায় তিনশোর কাছাকাছি সংখ্যক গ্রামে আমি আমার ক্ষেত্রসমীক্ষা চালাতে সমর্থ হয়েছি।

বঙ্গদেশ : এর অর্থ এই দাঁড়াচ্ছে যে ঐ গ্রামগুলিতে যে ধরণের হস্তশিল্প পরম্পরাগতভাবে গড়ে উঠেছে, যার উপর এই অঞ্চলের নিজস্বতার ছাপ রয়েছে, সেরকম শিল্পকলার তালিকা ও তাদের বর্ণনা আপনার এই ক্ষেত্রসমীক্ষাজাত তথ্যভাণ্ডার থেকে পাওয়া যাবে?

ডঃ ঠাকুর : অবশ্যই। আপনাদের একটা উদাহরণ দিই, তাতে ব্যাপারটা আরেকটু স্পষ্ট হবে। শোলার কাজের কথাই ধরা যাক্‌। আমাদের পত্রিকা ‘কৌলাল’-এর অনলাইন সংস্করণে কিছুদিন আগে এই ব্যাপারে একটি বিশদ তথ্যসম্বলিত লেখা প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া রয়েছে মালার কাজ, পুঁতির শিল্প, অসাধারণ কারুকার্য দেখতে পাওয়া যায় এমন কাঠের শিল্প, মাটির কাজ ইত্যাদি অনেক রকম হস্তশিল্প। বিশেষ ক’রে বলি মাটির কাজের কথা, যাতে সৌন্দর্য ও দক্ষতার অনবদ্য মেলবন্ধন দেখতে পাওয়া যায় – মৃৎপাত্র থেকে শুরু ক’রে মাটির পুতুল, মূর্তি ইত্যাদি মাটির তৈরি সব জিনিসপত্রেই এই অঞ্চলের একটি সমৃদ্ধ কুম্ভকারশৈলীর পরিচয় মেলে। এখানে এখনো আপনি এমন অনেক পরিবার ও মানুষজন পাবেন, যাঁরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধ’রে এইসব শিল্পধারা বয়ে নিয়ে চলেছেন। বিশেষ ক’রে মূর্তি তৈরিতে এই অঞ্চলে যে বিপুল বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়, তা এককথায় অদ্বিতীয়। শুধু শ্রীগৌরাঙ্গের [অর্থাৎ শ্রীচৈতন্যদেবের] একারই যে কতরকম মূর্তি এখানে দেখতে পাওয়া যায় তার ইয়ত্তা নেই। তাছাড়া রাধাকৃষ্ণের মূর্তি আছে, শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের মূর্তি আছে, শ্রীরামচন্দ্রের মূর্তি আছে, সীতার মূর্তি, হনুমানের মূর্তি – অভাবনীয় বৈচিত্র্য! আবার যদি এখানকার শিবপূজার ধারাটিকে লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন প্রাগৈতিহাসিক সংস্কৃতির সঙ্গেও একটা অবিচ্ছিন্নতা বজায় আছে, এখনও! নরমুণ্ড নিয়ে নাচ-গানের ঘরানাতে সেই প্রাগৈতিহাসিকতার সঙ্গে একটা যোগসূত্র লক্ষ্য করা যায়। আর লোকদেব-দেবীর তো ছড়াছড়ি! কত ধরণের যে লোকদেবতা এখানে রয়েছে – আমার হিসেবে শুধু এই কাটোয়া মহকুমা অঞ্চলেই অন্ততঃ একশো লোকদেব-দেবী রয়েছেন। আমি আমার ক্ষেত্রসমীক্ষা সম্পন্ন করবার জন্য এই অঞ্চলের চারশোটি গ্রাম বেছে নিয়েছি। এই বেছে নেওয়া অঞ্চলটি আয়তনে ছোট, কিন্তু ভৌগলিক এবং ঐতিহাসিক দুদিক থেকেই অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। ভৌগলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ কারণ এর একদিকে রয়েছেএই অঞ্চলের একমাত্র শহর কাটোয়া, তার পূর্বদিক দিয়ে বয়ে গেছে ভাগীরথী নদী, পশ্চিমে বইছে অজয় – আর অজয় এবং ভাগীরথীর সম্মিলন ঘটছে কাটোয়াতে। কিছুদূর এগিয়ে গেলে আপনি পাবেন বাদলা নদী, যা ময়ূরাক্ষীর একটি শাখানদী। এখানে অজয়ের অপরপারটি উত্তর রাঢ় এবং এপার দক্ষিণ রাঢ় নামে পরিচিত ছিল। কাটোয়া মহকুমা অঞ্চল এই দুই রাঢ়ের মধ্যবর্তী হওয়ায় একে বলা হ’ত মধ্য রাঢ়। এই মধ্য রাঢ় অঞ্চল দিয়ে যেহেতু ভাগীরথী এবং অজয় দুইই বয়ে গিয়েছে, সেই কারণে এই অঞ্চল নৌ-বাণিজ্যের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী ছিল। প্রকৃতপক্ষে এখানকার অর্থনীতি নদীপথের উপরেই নির্ভরশীল ছিল। আর গঙ্গাতীরবর্তী হওয়ায় এখানে হিন্দু সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল। এই অঞ্চলের কাছেই রয়েছে হুগলী জেলা, ভাগীরথীর অপর পারে রয়েছে নদীয়া জেলা, আবার উত্তরদিকে কেতুগ্রামের সীমান্তেই রয়েছে নবাবী তন্ত্রের পীঠস্থান মুর্শিদাবাদ। একসময় কাটোয়া মহকুমাকে বলা হ’ত নবাবী তন্ত্রের প্রবেশদ্বার। কাজেই প্রাচীনকাল থেকে শুরু করেই কাটোয়া মহকুমা অঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। এখানেই বল্লাল সেনের মা বিলাস দেবী একটি হোমাশ্ব যজ্ঞ করেছিলেন। এই যজ্ঞের কথা উল্লেখ ক’রে তাম্রফলক উৎকীর্ণ করা হয়েছিল – সেই তাম্রফলকও কাটোয়া অঞ্চলের একটি গ্রাম থেকে পাওয়া যায়। এই ঐতিহাসিক বৈচিত্র্যের কারণেই এখানে বিচিত্র সংস্কৃতির সহাবস্থান ঘটেছে। এই বিষয়টা আমার মনে শুরু থেকেই দাগ কেটেছিল। তাই আমি এই অঞ্চলকে আমার গবেষণা-সমীক্ষার ক্ষেত্র ক’রে তুলতে চেয়েছিলাম। এখানকার ঐ চারশো গ্রামের প্রত্যেকটিতে চিরুনি তল্লাশি চালিয়ে এই অঞ্চলের সংস্কৃতি সম্পর্কে যেটুকু তথ্য এবং অভিজ্ঞতা আহরণ করা যায় তা আমি করতে চেয়েছি। ২০১১ সাল থেকে আমি এককভাবে এই কাজটি চালিয়ে আসছি। আমার মনে এই ভাবনা ছিল যে এই কাজটি জনসমক্ষে তুলে ধরবার জন্য এবং এই ক্ষেত্রসমীক্ষালব্ধ বিশাল তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষণের জন্য আমি কোনো পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা প্রকাশক পাই অথবা না পাই, আমার এই কৌলাল পত্রিকাটির মাধ্যমে আমি তা ক্রমশঃ তুলে ধরবো। সেই ভাবনা থেকেই কৌলালের জন্ম ও বিকাশ। শুরুতে কাগজে ছাপা পত্রিকা হিসেবে প্রকাশিত হয়ে এখন কৌলালের অনলাইন সংস্করণও বেরিয়ে গেছে। ছাপা এবং অনলাইন – দুই সংস্করণেই কৌলাল অধুনা প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে।

বঙ্গদেশ : আচ্ছা, ‘কৌলাল’ নামটাই পত্রিকার জন্য বাছলেন কেন? সেটা কি এই কারণে যে আপনাদের কাটোয়া মহকুমা অঞ্চলে কুম্ভকারদের শিল্পের রমরমা রয়েছে এবং প্রাচীন প্রত্ন-নিদর্শন হিসেবেও নানারকম মাটির মূর্তি পাওয়া গিয়েছে – এই কারণগুলোই কি আপনাদের পত্রিকার নামের পিছনে মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে?

ডঃ ঠাকুর : প্রথমতঃ আমার ক্ষেত্রসমীক্ষার জন্য বেছে নেওয়া এই অঞ্চলটি অর্থাৎ কাটোয়া মহকুমা অঞ্চল একটি ইতিহাস-সমৃদ্ধ জায়গা। এখানকার স্থাপত্য-নিদর্শন হিসেবে যে অসংখ্য মন্দির রয়েছে তাদের কথা নাহয় বাদই দিলাম, আপনি এখানে সুলতানি আমলের পাঁচটি মসজিদও দেখতে পাবেন – যদিও সেগুলি সবই ভগ্নপ্রায়। এগুলির মধ্যে একটি আবার হোসেন শাহের আমলের মসজিদ। কাজেই বুঝতে পারছেন যে এই মসজিদগুলি বেশ পুরনো। এই মসজিদগুলির স্থাপত্যশৈলী কিন্তু টেরাকোটার কাজে সমৃদ্ধ। হোসেন শাহের মসজিদটিতে এই টেরাকোটার কাজ লক্ষ্যণীয়। চৈতন্যদেব দীক্ষালাভ করেছিলেন ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দে, এই কাটোয়াতেই। আর এই মসজিদটি থেকে ইতিহাসবিদ তথা প্রত্নতত্ত্ববিদ শ্রী রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় যে শিলালিপিটি উদ্ধার করেছিলেন তার থেকে জানা যায় যে ঐ ১৫১০ খ্রিষ্টাব্দেই এই মসজিদটি তৈরি হয়েছিল। টেরাকোটার কাজে মাটির ছোঁয়া, আর তাছাড়া আপনারা যে বিষয়টির উল্লেখ করলেন, সেই কুম্ভকার সম্প্রদায়ের মৃৎশিল্পকীর্তি তো রয়েইছে – মাটির পুতুল, মৃত্তিকানির্মিত প্রত্নবস্তু – এইসব এই অঞ্চলকে তার নিজস্ব পরিচিতি প্রদান করেছে। এই সংস্কৃতিটি বিকশিত হওয়ার দরুণ মাটির সঙ্গে নিজের সংযোগ কখনো বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি – তা সম্ভবও ছিল না। এখানকার মাটির অত্যধিক উর্বরতা, জলের আধিক্য, নদীমাতৃকতা, খাল-বিল-পুকুর-ডোবা প্রভৃতি থেকে শিকার করা মৎস্যের উপর নির্ভরতা, জলপথের উপর এখানকার অর্থনীতির নির্ভরশীল হওয়া এসবই একেবারে পৃথিবীর মাটির সঙ্গে এখানকার বিচিত্র ও জটিল সংস্কৃতির জন্ম এবং বিকাশের আত্মিক যোগাযোগকে নির্দেশ করে। ধরণীর মৃত্তিকাকে উপাদান হিসেবে ব্যবহার ক’রে এবং কুলালের [অর্থাৎ কুম্ভকার তথা মৃৎশিল্পীর] মতোই প্রযুক্তি ও দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এই সংস্কৃতির প্রস্ফুটিত হওয়াটিকে একটি মাত্র শব্দে ধরতে চেয়েছিলাম – সেই থেকেই পত্রিকার নাম হয়েছে কৌলাল।

বঙ্গদেশ : আপনার নিজের পারিবারিক পরিচয়, বংশোদ্ভবের স্থান সম্পর্কে যদি কিছু জানান…যেমন আমাদের খুব জানতে ইচ্ছে করছে যে আপনার পরিবার কি রাঢ় অঞ্চলের ব্রাহ্মণদেরই শাখা থেকে উদ্ভূত, নাকি আপনারা পূর্ববঙ্গীয়?

ডঃ ঠাকুর : আমরা প্রকৃতপক্ষে রাঢ়ী ব্রাহ্মণ। আমাদের বংশের পূর্বপুরুষদের যে পরম্পরাগত ইতিহাস পাওয়া যায়, সেখান থেকে জানতে পারি যে শ্রীচৈতন্যদেবের অন্যতম পার্ষদ কমলাকর পিপিলাই, যিনি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার খালীজুলি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তিনি খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীতে হুগলীর মাহেশে এসে সেখানকার বিখ্যাত রথযাত্রার সূচনা করেন। এই কমলাকর পিপিলাই-ই হচ্ছেন আমাদের পূর্বপুরুষ। অষ্টাদশ শতাব্দীতে যখন বর্গী আক্রমণ হয়, সেই সময় থেকে শুরু ক’রে তাঁর বংশের শাখাপ্রশাখা বিস্তার ক’রে নানাদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কাশিমবাজারের রাজসভার রাজা মণীন্দ্রচন্দ্র নন্দীদের বংশের আদি নিবাস ছিল মঙ্গলকোট অঞ্চলের একটি গ্রামে। এই স্থানীয় রাজা এবং অভিজাতরা অষ্টাদশ শতাব্দীতে নবাবদের প্রতিপত্তির কালে মুর্শিদাবাদ ও নিকটবর্তী অঞ্চলে ক্ষমতার কেন্দ্রিকতা ও বণ্টনের স্বাভাবিক নিয়মেই এসে জড়ো হয়েছিলেন। আমাদের পূর্বপুরুষদের মাহেশ থেকে এখানে নিয়ে আসা হয় এঁদেরই কুলগুরু হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবার জন্য। সেই থেকে আমাদের পূর্বপুরুষরা কাটোয়া মহকুমা অঞ্চলে এসে বসবাস শুরু করেন। প্রথমে তাঁরা মণীন্দ্রচন্দ্রের পূর্বপুরুষদের আদি বাসস্থানের কাছাকাছি যজ্ঞেশ্বরডিহি নামক এক গ্রামে বসত গড়ে তোলেন। এখানকার তিনটি পরগণা মিলিয়ে ১৮৪৭ খ্রিষ্টাব্দে কাটোয়া মহকুমা স্থাপন হয়। তখন থেকে আমাদের পরিবার ঐ অঞ্চল সংলগ্ন গ্রামগুলিতে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। আমাদের পরিবারের বৃত্তি মূলতঃ ছিল গুরুগিরি করা। কে রাজগুরু পদে আসীন হবে তা নিয়ে শ্রীখণ্ডের বৈদ্যদের সাথে আমাদের একটা প্রচ্ছন্ন লড়াই ছিল। সেকালে এঁরা ঐ অঞ্চলের বৈষ্ণব সমাজের শীর্ষস্থানীয় ছিলেন। তবে ব্রাহ্মণ হবার সুবাদে আমার পূর্বপুরুষেরাই শেষমেশ রাজকুলগুরু পদ লাভ করেছিলেন। তো এই হ’ল মোটামুটি আমাদের পরিবারের ইতিহাস। তবে আমরা মূলতঃ চৈতন্যপন্থী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অনুসারী।

বঙ্গদেশ : আপনাদের পরিবারের যে ‘ঠাকুর’ পদবী রয়েছে তা কীভাবে বিবর্তিত হয়েছে সে বিষয়ে কিছু আলোকপাত করবেন?

ডঃ ঠাকুর : আপনাদের আগেই জানিয়েছি যে আমাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন কমলাকর পিপিলাই। এই পিপিলাই পদবীটি ব্রাহ্মণদের মধ্যে দেখা যেত। এই পদবীধারীদের মধ্যে আরেকজন বিখ্যাত উদাহরণ হলেন মনসামঙ্গলের কবি বিপ্রদাস পিপিলাই, যাঁর মনসাবিজয় কাব্য শ্রীসুকুমার সেনের সম্পাদনায় এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত হয়। আমাদের দেশে তো অনেকসময়ই পদবী আসলে স্থাননাম, বৃক্ষনাম তথা গ্রামের নামসূচক। শব্দটি পিপুল বা অশ্বত্থ গাছের নাম থেকে এসেছে। এরপর আমাদের বংশের পদবী হয়ে দাঁড়ায় ‘অধিকারী’। এদেশে পদবীগুলি বারবার পরিবর্তিত হয়েছে। আবার যখন আমরা বৈষ্ণব মন্ত্র দান করবার অধিকারী হলাম, তখন থেকে আমাদের পদবী হয়ে দাঁড়াল ঠাকুর। মধ্যযুগে যাঁরাই গুরুগিরি করতেন, ঠাকুর পদবীটি তাঁদের একচেটিয়া সম্পত্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। নিজেদের প্রয়োজনে তাঁরা নিজেরাই এই পদবী গ্রহণ করেছিলেন।

বঙ্গদেশ : কৌলাল পত্রিকার বিবর্তন বিষয়ে একটু বলুন।

ডঃ ঠাকুর : ২০১১ খ্রিষ্টাব্দ থেকে আমি কৌলাল পত্রিকা চালাতে শুরু করি। তখন পত্রিকার সম্পাদনা থেকে শুরু ক’রে এর সমস্ত দিক দেখাশুনো করা সবই আমায় একা হাতে করতে হ’ত। সেসময় এটি শুধু প্রিন্ট আকারেই প্রকাশিত হ’ত, এবং তখন খুব ছোট আকারে, অনিয়মিতভাবে পত্রিকাটি বের করতাম। কখনো কখনো বছরে মাত্র তিনটে কি চারটে সংখ্যা বেরিয়েছে – এমন সময় গিয়েছে যখন একশোর বেশি কপি ছাপাইনি, কারণ তখনও কৌলালের তেমন পরিচিতি গড়ে ওঠেনি। কিন্তু প্রথম থেকেই আমরা ক্ষেত্রসমীক্ষালব্ধ তথ্যের উপর ভিত্তি ক’রে রচিত প্রবন্ধ ছাপায় জোর দিয়েছি। তথ্যগত মূল্যের দিক থেকে দেখলে সেই প্রবন্ধগুলি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এগুলি একটা-দু’টো ক’রে যখন গুণীজনদের নজরে পড়তে শুরু করে, তখন তাঁরা আমায় উৎসাহ দিতে থাকেন। প্রথমদিকে প্রায়শঃই শুনতে পেতাম – কেন আপনি পত্রিকাটি বড় আকারে নিয়মিতভাবে প্রকাশ করছেন না? তখন উত্তরে বলতাম যে আমরা তো লেখক পাই না! তবু তাঁরা হাল ছাড়তে বারণ করতেন। সেসময় এই পত্রিকাটি চালানোর পাশাপাশি আমি খবরের কাগজে নিয়মিত কলাম লিখতাম। প্রথমদিকে উত্তরবঙ্গ সংবাদ, পরে এই সময় দৈনিকে লিখতে শুরু করি। এছাড়া বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায় লেখা তো ছিলই। এদের মধ্যে বঙ্গদর্শন ও সপ্তডিঙা ব’লে দুটি পত্রিকার কথা উল্লেখ করলাম। তারপর আস্তে আস্তে আমার পত্রিকার আয়তন বাড়াতে চেষ্টা করতে থাকলাম, একজন সহযোগীও জুটে গেলেন – নবারুণ মল্লিক, উনি একজন খুব প্রথিতযশা সংগ্রাহক – তিনি পত্রিকার সম্পাদক হলেন। এতে পত্রিকার পালে হাওয়া লাগল, বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক সংখ্যা বের করতে লাগলাম – যেমন কখনো কবিগান বিষয়ক সংখ্যা, কখনো কোনো বিশেষ দেবদেবীকে কেন্দ্র ক’রে সংখ্যা বেরিয়েছে; আবার কখনো বা লোকখেলার উপর, আমাদের এলাকার বিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ আয়ুব হোসেনের উপর – এইভাবে কাজ এগিয়েছে এবং পাঠকদের আশীর্বাদে পত্রিকার পরিচিতিও বেড়েছে। তবে বই বা পত্রপত্রিকার বাজারের অত্যধিক কলকাতা-কেন্দ্রিকতা আমাদের পক্ষে অসুবিধের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। আমি যেখানে থাকি সেখান থেকে কলকাতা দেড়শ’ কিলোমিটারের দূরত্বে অবস্থিত। যেতে আসতেই দিন কেটে যায়। ফলে কলকাতার বই বাজারে গিয়ে নামডাক আছে এমন পত্রিকার স্টলে আমাদের পত্রিকার কপি রেখে আসব আর পরিচিতি বা বিক্রির জন্য ওঁদের উপরেই নির্ভর করব – এভাবে চলছিল না। তাছাড়া পত্রিকার স্টলগুলি নানান অজুহাতে বেশি কপি রাখতে চাইত না। পঞ্চাশটা দিতে চাইলে বলত কুড়িটার বেশি রাখতে পারব না – আমাদের জায়গা কম – কুড়ি কপি আগে বিক্রি হোক তারপরে আবার আপনাকে ডাকব। মূলতঃ এইসব কারণেই প্রযুক্তির প্রয়োজনটা অনুভব করলাম আর সেই থেকে কৌলালের অনলাইন সংস্করণ প্রকাশ করবার তোড়জোড় শুরু হ’ল।

(ডঃ স্বপন ঠাকুরের বক্তব্যের মধ্যে যখনই অনুলিখনকারের মন্তব্য এসেছে, তা [ ] বন্ধনীর মধ্যে রাখা হয়েছে। – সম্পাদক)
(ক্রমশঃ)