নরেন্দ্র মোদি আপন করে নিলেন বাংলাকে আর দুর্গতিনাশিনীকে, বিরোধীরা মজলেন দুর্গানিন্দায়

0
1838

পুষ্যমিত্র

 

এবছর বাঙালির দুর্গাপুজোর সীমিত আয়োজনকেও অপরিসীমিত শুভেচ্ছায় ভরিয়ে তুললেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মাননীয় শ্রী নরেন্দ্র মোদী। মূলতঃ নিজের রাজনৈতিক দলের মঞ্চ থেকে মহাষষ্ঠীর দিন দেবী আবাহনের আবহে উপনীত হলেও নরেন্দ্র মোদী বুঝিয়ে দিলেন তিনি সকলের সেবক। তাঁর বার্তায় কোথাও কোনো রাজনৈতিক বিভেদ ছিল না। কথার ছত্রে – ছত্রে ধরা পড়ল বাঙালির ঐতিহ্যের অলংকার। সুষমায়, লালিত্যে প্রতিটি ক্ষেত্রে বাঙালির মহিমা মণ্ডন করলেন তিনি। নিন্দুকে বলে, নরেন্দ্র মোদি বড় আমিত্বে ভরা। কিন্তু কোথায় তাঁর আমিত্ব? কুজনের কূজনকে প্রায় স্টেপ আউট করা ছক্কায় উড়িয়ে দিয়ে তিনি বঙ্গজাতির গরিমা নিয়ে যা যা বললেন, তা মুগ্ধ করল আপামর ভারতবাসীকে। 

সাহিত্যের ক্ষেত্রে শ্রী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কবিগুরু রবি ঠাকুর, শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কথা পাড়লেন। কাজী নজরুল ইসলামের গুণগান করলেন। বিজ্ঞানসাধক বঙ্গপুত্র হিসাবে উঠে এল শ্রী জগদীশ চন্দ্র বসুর মতো বিরল প্রতিভাদের নাম। কী কবিতা, কী সিনেমা কিছুই বাদ রাখলেন না প্রধানমন্ত্রী। এবং নজরকাড়ার মতো ব্যাপার হল অনতি অতীতের যে সকল প্রতিভা নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক দলের পরিচিত আদর্শের বিপক্ষে মতও রাখেন, তাদের প্রতিভার কদর করতেও তিনি পিছপা হননি। এ এক অভূতপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপিত হল প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে।

স্বাধীনতার আন্দোলনে বঙ্গসন্তানদের ভূমিকা নিয়েও বলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বাঘা যতীন থেকে মাস্টারদা সূর্যসেন প্রত্যেককে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করেন তিনি। কথা বলতে – বলতে বারংবার বাংলার ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধায় জোড় হয়ে যায় তাঁর হাত। 

যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের মূল বিষয় ছিল দেবী দুর্গার আবাহন, তাই তিনি উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট নিয়ে বিশেষ জোর দেন। নারীশক্তির উন্নয়ন বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পের প্রণয়ন এবং তাদের সাফল্য নিয়ে কিছু কথা রাখেন। এগুলো একজন প্রজাপালক প্রশাসকের পক্ষ থেকে অত্যন্ত কাম্য বক্তব্য। সাদামাটা দর্শনে সাধারণ মানুষের কাছে নিজের কৃত এবং কর্তব্যের তালিকা মেলে ধরার প্রয়াস। এই পুরো চালচিত্রটাই ইউটিউবে, ফেসবুকে ফুটে উঠছিল লাইভে। আর সেখানেই শুরু হয়ে যায় এক নোংরা খেলা। হু হু করে ডিসলাইক বাড়তে থাকে। একটা সময়ে লাইকের সংখ্যাকেও ছাড়িয়ে যায় ডিসলাইক। এ ভারী মজার ব্যাপার। বছরের পর বছর ইভিএম মেশিনে ছাপ ফেলতে না-পারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কি তাহলে এবার সোশ্যাল মিডিয়াতে মাত দিয়ে দিচ্ছে নরেন্দ্র মোদির জনপ্রিয়তাকে?

সোশ্যাল মিডিয়া এক আজব জায়গা। যে যখন জিতে যায় সোশ্যাল মিডিয়া হয়ে যায় তারই। নরেন্দ্র মোদির উত্থান, বিজয় ইত্যাদির পিছনে গেরুয়া বাহিনীর আইটি সেলের ভূমিকা নিয়ে লাখ – লাখ নিউজ প্রিন্ট খরচ করে মিডিয়া। কান পাতলে শোনা যায় মিস্টার মালব্যই নাকি কৃষ্ণের মতো করে রক্ষা করেন বিজেপির অন্দরমহলকে। যদি একথাই সত্যি হয় তাহলে শ্রী নরেন্দ্র মোদির ভাষণে ডিসলাইকের বন্যা বয়ে যাওয়ার পরেও আইটি সেল রিসারফেস করছে না কেন? উত্তরটা হয়তো ঝুলে আছে আদর্শের সুতোয়।

যে বা যারা অবাংলাভাষীদের গুটখাখোর, গোসন্তান, চাড্ডি গোত্রের বিবিধ অভিধায় ভূষিত করেছেন, তাঁরা এবারটাতে কনফ্লিক্টের মুখে এনে ফেলেছেন নিজেদের স্বার্থকেই। হিন্দির আগ্রাসন নিয়ে হাজারো কথা তোলা হয়। প্রধানমন্ত্রীর ভাঙা বাংলায় বলা ভাষণ নিয়ে খিল্লি হয়েছে। কেউ বাংলাকে আপন করে নিয়ে বাংলায় কথা বলছেন এর থেকে বড় গর্ব কিছু হতে পারে কি? অমিতাভ বচ্চনের বাংলা বলা শুনলে আমরা গর্ব করি, আর প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক পরিচিতির জন্যে তাঁর বাংলা বলাটা পরিহাসের বিষয় হয়ে গেল?

প্রধানমন্ত্রী যখন বাংলার বীর বিপ্লবীদের কথা বলতে বলতে শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছেন, তখন তাঁর বিনয়কে মাড়িয়ে গেছে কতিপয় মানুষের দুরাচার। প্রতিটা অপছন্দের বুড়ো আঙুল অসম্মান করেছে বাংলার শিল্পীদের, কবিদের, লেখকদের, সিনেমার কুশীলবদের। প্রধানমন্ত্রীর কথায় যখন নারীশক্তির উত্থান এসেছে, বিভিন্ন প্রকল্পে মহিলাদের কষ্ট দূর করার পরিকল্পনা এসেছে, নারীর সম্মান নিয়ে খেলা করলে তাকে কঠোরতম শাস্তি পেতে হবে এহেন বাক্য যখন ইথারসমুদ্রে ভেসে এসেছে, তখন প্রতিপক্ষের ধারালো তলোয়ার ডিসলাইক হয়ে দেখা দিয়েছে দুর্যোধন দুঃশাসন রূপে। লজ্জা, এই লজ্জা রাখবেন কোথায়? তিন তালাকের বিরোধ করার সৎ সাহস দেখানো মুখকে আমাদের বুদ্ধিজীবী ভারতীয় ভাইবোনেরা বুড়ো আঙুল নয় কলা দেখাচ্ছেন। তাহলে কোনটা ভালো ছিল? নারীকে তিন তালাকে ফালাফালা করা? নারীর সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলার পরেও তাকে হিংস্র পশুর মতো সমাজে ঘুরতে দেওয়ার স্বপক্ষে বলা? চাইলেই প্রভাব খাটিয়ে হয়তো ভাষণের বুক থেকে ওই অপছন্দের আঙুল মুছে ফেলা যেতে পারত, কিন্তু তা করা হয়নি একদিক থেকে ভালোই। হাতেনাতে স্বরূপ চিনিয়ে দেওয়ার খেলা বন্ধ করলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয়। 

টিকটক, পাবজি ব্যান হওয়ার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদির প্রতিটা ভাষণে ডিসলাইকের বন্যা বয়ে গেছে। এর পিছনে জনৈক প্রতিবেশী দেশের অতি সক্রিয়তার হাত থাকার কথাও উঠেছে। তবে যে – ই করুক, যা-ই করুক, যা ঘটছে, তা বারে বারে প্রমাণ করছে নরেন্দ্র মোদীর সক্রিয়তাকেই। বিরোধ করা হচ্ছে মানে তার অস্তিত্ব আছে। শূন্যের কি কোনো বিরোধ হয়? হয় না।

রাষ্ট্রের স্বার্থে নিজের ব্যক্তিচরিত্রের সাংঘাতিক বিরোধকেও আমল দেন না শ্রী মোদী। সঙ্ঘের পাঠশালা থেকে উঠে আসা ব্যক্তিত্বদের এটাই স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। এ এক অনন্য সন্ত-ভাবনা। হার বা জিত নয়, চাই রাষ্ট্রের বিজয়। হতে পারে তা তর্কে, হতে পারে তা সীমান্তে, হতে পারে দেশের ভিতরে। রাষ্ট্র হবে দুর্গের মতো। অভেদ্য। এক এমন গড়, যেখানে বাসিন্দারা থাকবেন নিরাপদে। এই দুর্গ-ভাবনাই জন্ম দিয়েছে মা দুর্গাশক্তির।

রাষ্ট্রই দুর্গা। একবার বিলেতে দশেরার একটি মঞ্চ থেকে গান্ধীজি ভারতের প্রাণপুরুষ প্রভু শ্রীরামের কথা বলেছিলেন। আর ওই একই মঞ্চ থেকে বীর সাভারকর দিয়েছিলেন দুর্গামন্ত্রের দীক্ষা। আজ আমাদের রাষ্ট্র রামচন্দ্রের ঐতিহ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছে, আবার দুর্গাশক্তির পরম্পরাকে অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মধ্যে কারো কারো অপছন্দের বাধা আসছে। কিন্তু তাতে কী? প্রধানমন্ত্রী নিজের বক্তব্যে বাংলার আরেক গৌরব শ্রী অবনীন্দ্রনাথ থাকুরের ভারতমাতা ছবির কথা তুলেছেন। দুর্গার রাষ্ট্ররূপ বলুন বা রাষ্ট্রের দুর্গারূপ, চিত্রায়ণ তো এটাই। গণতন্ত্রে নিন্দুকের কোনো স্থান নেই। প্রয়োজন হল বিরোধের এবং সমালোচনার। নিন্দুকের দল আর সমালোচক হয়ে উঠতে পারবেন কি? প্রধানমন্ত্রীর আসনে আসীন ব্যক্তির নিন্দা নাহয় করাই যায়, কিন্তু বাংলার নিন্দা, বাঙালির নিন্দা, দুর্গার নিন্দা, রাষ্ট্রের নিন্দা করলে কি সমালোচক হয়ে ওঠা যায়?