নয়া কৃষি সংস্কার বিল কৃষকদের উন্নতির ক্ষেত্রে তীব্র প্রত্যাশা জাগিয়েছে

0
1058

ড: শুভব্রত দত্ত

ভূমিকা

প্রাচীনকালের কৃষি ছিল একটি অত্যন্ত সম্মানজনক তথা গুরুত্বপূর্ণ পেশা, যা ভারতীয় অর্থনীতির একটি মূল বিষয়। তাই বর্তমান যুগে কৃষিকাজ তার গুরুত্ব হারাচ্ছে এবং দেশের জিডিপিতে বড় ধরনের অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। সাম্প্রতিক জলবায়ুর অসঙ্গতির কারণে, কৃষিকাজ ভীষণ রূপে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং যার ফলে অনিশ্চিত পারিশ্রমিকের বৃত্তিতে পরিণত হয়। ঘনঘন বন্যা ও ব্যাপক খরার সৃষ্টি, ভূগর্ভস্থ জলের স্তরের হ্রাস ঘটা, উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি, চাহিদা সরবরাহ ভারসাম্যহীনতার কারণে দামের অস্থিরতা, মধ্যস্থতাকারী এবং দালালদের হস্তক্ষেপ এবং বেসরকারি অর্থ ঋণদাতাদের প্রবেশর ফলেই ভারতীয় কৃষির অবনতি ঘটে। এজাতীয় দুর্বল দেশের খাদ্য সুরক্ষা, পৌর উন্নয়ন, দারিদ্র দূরীকরণ, ক্ষুধা ও অনাহারে সৃষ্টি করে। কয়েক মাস আগে, দেশের দুস্থ কৃষকরা বিভিন্ন স্থানে সহিংস বিক্ষোভ শুরু করে। এই সহিংস আন্দোলনের সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উত্থাপিত হয়, এবং বেশ কিছু দাবি তুলে ধরা হয় কৃষক সম্প্রদায় কর্তৃক। তবে এখানে কৃষি অর্থনীতির মৌলিক বিষয়গুলিকে স্পর্শ না করে তাদের দাবি তুলে ধরা হয়।

বিগত কয়েক দশক গুলিতে, পূর্ববর্তী ভারতীয় সরকার এমন কিছু নীতি গ্রহণ করেছে এবং অধিক বিদ্যুৎ ব্যয়কারী প্রযুক্তি ব্যবহার করেছে কৃষি ক্ষেত্রে, যার ফলস্বরূপ উৎপাদনের ব্যয় বৃদ্ধি ঘটেছে। সরকার এবং গবেষকরা মূলত কিভাবে ফলন বাড়ানো যায় সেই বিষয়ে মনোনিবেশ করেছেন। এই প্রক্রিয়াতে কৃষিকাজ ব্যয়বহুল হয়ে গেছে, কারণ এখন ব্যয়বহুল সার, কীটনাশক এবং ব্যবসায়িক বীজ ব্যবহারের ফলে। যদি কোনো কারণে ফসল ফলন করতে ব্যর্থ হয়, তখন অধিক ব্যয়ের কারণে প্রচুর ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। ছোট এবং প্রান্তিক কৃষকরা ভারতের কৃষক সম্প্রদায়ের ৮৬%, এই সমস্ত কৃষকদের পর্যাপ্ত সংস্থান নেই, ফলে এরা ক্ষতি পূরণ করতে পারেনা। এই কারণে কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা প্রতিনিয়তের ঘটনায় পরিণত হয়।

 

নয়া বিল

বর্তমান মোদি সরকার দুর্ঘটনা কবলিত কৃষক সম্প্রদায়কে সহায়তা করার জন্য বেশ কিছু নীতি গত পরিবর্তন করেছে নয়া কৃষি বিলের মাধ্যমে। যেটি পূর্ববর্তী তিনটি অধ্যাদেশকে পরিবর্তন করে। এই দুটি নতুন কৃষি বিল “The Farmers Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation)” বিল এবং “The Farmer (Empowerment and projection) Agreement of Price Assurance and Fram Services” বিল কার্যকরী হয়। অপর একটি বিল The Essential Commodities (Amendment) বিল প্রবর্তন করা হয়। এই নতুন বিলের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য বর্তমান।

প্রথম কৃষি বিল “The Farmers Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation)”, এ কৃষকদেরকে সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব উৎপাদিত কৃষিজাত দ্রব্য বাজারে বিক্রি করতে স্বতন্ত্র প্রদান করা হয়েছে এবং এক্ষেত্রে APMC (Agricultural Produce Market Committee) অথবা কিষাণ মান্ডি বাইরে যাতে কৃষকরা স্বাধীন এবং স্বতন্ত্রভাবে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাদের উৎপাদিত দ্রব্য উচ্চমূল্যে বিক্রয় করতে পারে তার স্বাধীনতা দেওয়া হয়।

দ্বিতীয়তঃ, এই বিলটি আন্তঃরাজ্য বাণিজ্যের প্রসার সাধন করে। এটি সমগ্র রাজ্যের সীমানা জুড়ে বিভিন্ন কৃষিজাত দ্রব্য এবং খাদ্যশস্য চলাচলের সকল প্রকার বাধানিষেধকে সরিয়ে দেয়। ভারতে কৃষি বাজার গুলি খন্ডে খন্ডে বিভক্ত এবং এখানে ক্ষুদ্র প্রান্তিক কৃষকদের সাথে বাজারের বিক্রেতাদের মধ্যে সুসম্পর্কের অভাব আছে। কৃষকদের আর্থিক অবস্থার উন্নতির জন্য বাজারে উন্নয়ন ঘটানো আবশ্যক। এই সকল কৃষিজাত বাজার ব্যবস্থার আইনের পরিবর্তন একমাত্র সম্ভব নতুন বিল আনার মাধ্যমে, এর মধ্যে দিয়ে সরাসরি খুচরো ব্যবসায়ী, রপ্তানিকারক এবং বড় বড় ব্যবসায়ী সংস্থাগুলো কৃষকদের থেকে সরাসরি কৃষিজাত পণ্য ক্রয় করতে পারে। AMPC এর বাজার নিয়ন্ত্রণের বাইরে এর ফলে বাজার ব্যবস্থার মান উন্নয়ন ঘটে এবং এর মধ্য দিয়ে একটি সুস্থ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হয় এবং কৃষকেরা সঠিক মূল্য পেতে পারে। উপরন্ত কৃষিজাত দ্রব্য গুলি কৃষি মান্ডির বাইরে স্বাধীনভাবে বিক্রির ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে পরিবহনের ব্যয় হ্রাস পেয়েছে, এছাড়াও মাল তোলা নামানোর যে ব্যয় সেই ব্যয় অনেক হ্রাস পেয়েছে।

দ্বিতীয় কৃষি বিল “The Farmer’s (Empowerment and Protection) Agreement of Price Assurance and Farm Services Bill, 2020” এটি চুক্তি ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থার সাথে সংযুক্ত। এই আইনটি কৃষকদেরকে খাদ্য প্রস্তুতকারী ব্যবসায়িক কোম্পানী গুলির সাথে, বড় বিক্রেতা, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কোম্পানী গুলির সাথে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চুক্তিতে অংশগ্রহণ করার কথা বলেছে। এই চুক্তি ব্যবস্থাটি কৃষক সম্প্রদায়ের মধ্যে খুবই ফলপ্রসূ হবে। এই চুক্তি ভিক্তিক কৃষিব্যবস্থা বড় বড় বেসরকারি কোম্পানি গুলিকে কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তি উন্নয়নে এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবস্থা প্রদানে উৎসাহ প্রদান করবে। এই চুক্তির অপর আকর্ষণীয় দিক হলো যে এই চুক্তি কেবলমাত্র কৃষিজাত দ্রব্যের জন্য, কৃষি জমির উপর নয়। এই আইনের সুদৃঢ় প্রয়োগের থাকা কৃষি জমির হারানোর কোন ভয় নেই। এই আইনের অপর একটি ইতিবাচক দিক হল এই যে, আবশ্যিক বস্তু উৎপাদনের আওতায় পড়েছে, যার ফলে সমস্ত রকম প্রতিবন্ধকতা মুক্ত থাকছে। একই সঙ্গে যদি কোনো কারণে বিরোধ বাধে তার জন্য বিচার ব্যবস্থার অধীন হতে হবে না, এর জন্য আলাদা বিরোধ নিষ্পত্তি মুলক সংস্থা গঠন করা হয়েছে।

The Essential Commodities (Ammendment) Bill, 2020, হল অপর একটি সংস্কার মূল আইন যার দ্বারা কৃষক এবং প্রাইভেট সংস্থা উপকৃত হবে। এই সংশোধনী আইন বেসরকারি সংস্থাগুলিকে উৎসাহ প্রদান করেছে, যাতে তারা কৃষি ক্ষেত্রে আরো অর্থ বিনিয়োগ করে। কিন্তু অত্যাবশ্যকীয় সামগ্রী যেমন খাদ্যশস্য, ডাল, আলু, পেঁয়াজ, তেল শস্য জাতীয় সামগ্রী সমূহ, মজুত করা এবং বিক্রয় করার আওতার বাইরে। সরকারি নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হওয়ার ফল, বেসরকারি কোম্পানি গুলি প্রযুক্তি এবং উন্নতমানের যন্ত্র ব্যবহারের জন্য অর্থ বিনিয়োগ করবে, যার ফলে উৎপাদনের হার বৃদ্ধি ঘটাবে।

 

আন্দোলন

 এই বিল পাস এর ফলে ব্যাপক হারে দেশজুড়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, বিভিন্ন কৃষকরা এবং কৃষকদের নেতারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অধীনস্থ নেতারা ব্যাপক বিরোধিতা শুরু করেছে। যে সকল রাজনৈতিক দল বৃথা করেছে তার মধ্যে অন্যতম হলো কংগ্রেস, CPI(M), DMK, DMC এবং BSP প্রভৃতি।

প্রথমতঃ, সকল বিরোধী দলগুলি যুক্তি দিয়ে বলে যে, এই বিলটি পাস করার ফলে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা ন্যূনতম মূল্যের ব্যবস্থা Minimum Support Price (MSP) ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। উন্নত মানের ব্যবস্থা ভেঙে ফেলার ফলে খাদ্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কৃষক সম্প্রদায়কে ধ্বংস করা হবে এবং বৃহৎ খাদ্য উৎপাদক সংস্থাকে শক্তিশালী করবে এবং দুস্থ কৃষক সম্প্রদায়ের উপর শোষণ বৃদ্ধি পাবে।

দ্বিতীয়তঃ, এই বিল পাস করলে “মান্ডি ব্যবস্থা” কে সমাপ্ত করবে, এবং মান্ডি ব্যবস্থা ধ্বংস হলে তার প্রভাব পড়বে রাজ্য সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থায়, যাতে ব্যাপক ধস নামবে।

তৃতীয়তঃ, এই বিলের মাধ্যমে কৃষকদের জমির মালিকানা যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বড় বড় সংস্থাগুলি এবং পুঁজিপতিদের দ্বারা সকল ধরনের কৃষকরা এর দ্বারা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই তিনটি একসাথে “ভারতীয় কৃষি ব্যবস্থার ওপর তিনটি হামলা” হিসাবে অভিহিত করা হয়।

 

ভবিষ্যতের প্রত্যাশা

তবে এত বিরোধিতা ও বিতর্কের পরেও কোন পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। আমার অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে, এটা বলা যেতে পারে যে MSP এবং APMC সবসময় ক্ষুদ্র এবং প্রান্তিক কৃষকদের জন্য কার্যকারী হয় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, একজন কৃষকের কাছে ১০ কুইন্টাল ধান রয়েছে যা তিনি কেন্দ্রের কাছে বিক্রি করতে চান, সেক্ষেত্রে তাকে কমপক্ষে এক দিনের কাজ হারাতে হয়েছে, বহন খরচা ব্যয় করতে হচ্ছে (ধানের গুণমান বজায় রাখতে ৬-১০ কেজি) মূল্য প্রদান করতে হয় রাজনৈতিক মধ্যস্থতাকারীদের। ১০ কুইন্টাল বিক্রয় করতে তাকে প্রায় ১ কুইন্টাল মতো হারাতে হয়। এক্ষেত্রে, সুবিধা গুলি হিসেবে পাওয়া যায় এবং ১০ কুইন্টালের কম হলে সেক্ষেত্রে কোনো রকম লাভ হয় না। এবং তদুপরি এক্ষেত্রে কৃষক সমস্ত ধানটা একসময়ে বিক্রি করতে উৎসাহী নাও হতে পারে। যদিও কেন্দ্রীয় সরকার MSP এবং APMC ব্যবস্থাকে সুনিশ্চিত করছে এবং এটিকে বহাল রাখছে। এই বিলের মাধ্যমে দুস্থ কৃষক সম্প্রদায়ের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। এই বিলগুলো দেশের কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আনবে, কৃষকদের আয় বৃদ্ধি ঘটবে এবং কর্মসংস্থানের বৃদ্ধি ঘটবে। এই নীতির বার্তাটি স্পষ্ট। এই বিলটির মাধ্যমে দারিদ্র, গ্রামীন অনুন্নয়ন, ক্ষুধা এবং মন্দার তথা কৃষক আত্মহত্যা অবসান ঘটাবে।

লেখক Professor of social work and former Head of the department at Assam Central University, Silchar মতামত লেখকের ব্যক্তিগত, বঙ্গদেশ দায়ী নয়।