শতবর্ষে পদার্পণ নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের, রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য স্কুলে উদযাপন ‘‌আ মরি বাঙ্গলা ভাষা’‌

0
1397

বঙ্গদেশ ডেস্ক:বারাণসীতে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের শতবর্ষ উৎসব গতকাল থেকে শুরু হয়েছে। বাঙ্গালী ও বাঙ্গলা সাহিত্যের এই সংগঠনের ডাকে সাড়া দিয়ে, ১৯২৩ সালে কাশীতে, সম্মেলনের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ বলে উঠেছিলেন, “আজ যেন বসন্ত উৎসবের দিনে দক্ষিণসমীরণের অর্ভ্যথনায় বিশ্ব প্রকৃতি পুলকিত হয়ে উঠছে, ধরণীর বক্ষে নব কিশোলয়ের উৎস উৎসারিত হয়েছে, আজকের সাহিত্য সম্মিলনের উৎসবে তেমনি একটি বসন্তের ডাক আছে। এ ডাক আজকের ডাক নয়।“

রবীন্দ্রনাথ যে সভাগৃহে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেই ভবনটি এখন গ্রন্থাগার। সেখানেই সকালে অতুলপ্রসাদ আর রবীন্দ্রনাথের ছবি সামনে রেখে স্থাপিত হয়েছে মঙ্গলঘট। গাওয়া হয়েছে ‘‌মোদের গরব মোদের আশা, আ মরি বাঙ্গলা ভাষা’‌। বিকেলে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রেক্ষাগৃহে হয়েছে বারাণসী শাখার অনুষ্ঠান। বছর জুড়ে ভারতের বিভিন্ন শহরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের বিভিন্ন শাখা-সংগঠন উদযাপন করবে সর্বভারতীয় সাহিত্য মঞ্চের শতবর্ষ। আগামী ডিসেম্বরে সমাপ্তি অনুষ্ঠান হবে কলকাতার নিউটাউনে সিস্টার নিবেদিতা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। এই খবর নিশ্চিত করে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সত্যম রায়চৌধুরী। তিনি বলেছেন, বাঙালি আজ বিভিন্ন দুর্যোগে আক্রান্ত সাহিত্যসঙ্গ আর সাহিত্যবোধের মঞ্চকে ঘিরে আলোর দিশা খুঁজবে জাতি।

কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা, গুজরাট থেকে মেঘালয়, যেখানে বাঙ্গালী সেখানেই এই সংগঠনের শাখা। আর প্রতি বছর পালা করে এক এক শহরে অনুষ্ঠিত হয় বাঙ্গালীর মিলনমেলা। সমগ্র ভারত থেকে হাজার হাজার সদস্য ভিড় করে এই উৎসবে। খ্যাতনামা শিল্পী-সাহিত্যিকেরা উৎসুক হয়ে থাকেন ডাক পাওয়ার জন্য। আগে অবশ্য এই সংগঠন এই নামে পরিচিত ছিল না। বাংলা সাহিত্য শুধু বঙ্গদেশে কেন সীমাবদ্ধ থাকবে, কেন‌ই বা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রবাসী বাঙ্গালীর দল তার স্বাদ থেকে বঞ্চিত হবে?‌ এই ভাবনা মাথায় আসতেই ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন কানপুরে আয়োজন করেন বঙ্গ সাহিত্য সমাজের বার্ষিক উৎসব। সেখানে তিনি আমন্ত্রণ জানান উত্তর ভারতের কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙ্গালীকে। লখনউ থেকে এসেছিলেন অতুলপ্রসাদ সেন, রাধাকমল মুখোপাধ্যায় ও রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, শ্রীশচন্দ্র সেন প্রমুখ। ডঃ সেনের প্রস্তাব মতো অতুলপ্রসাদকে সামনে রেখে ১৯২২ সালের ২ ফেব্রুয়ারি তৈরি হয়েছিল উত্তর ভারতীয় বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। ১৯২৩ সালে কাশীতে অনুষ্ঠিত হয় এই সম্মেলনের প্রথম অধিবেশন। সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরে প্রয়াগে দ্বিতীয় অধিবেশনে সংগঠনের নাম বদলে রাখা হয় প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন। বর্তমান নাম অর্থাৎ নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন অবশ্য অনেক পরে গৃহীত হয়েছে, ১৯৫৩ সালে। সেই বছরই কটকের অধিবেশনে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় দৃপ্তকন্ঠে বলেছিলেন, “অন্য কোনো ভাষার ঊর্দ্ধে মাতৃভাষাকে স্থান দেওয়ার নাম যদি প্রাদেশিকতা হয়, তাহা হইলে অকুণ্ঠচিত্তে বলিব, সে প্রাদেশিকতা আমাদের মধ্যে আছে এবং তাহা না থাকিলে আমরা সর্বহারা হইয়া যাইব। “

বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের বাড়তি পাওনা বলতে দূর-দূরান্তের বাঙ্গালীর সঙ্গে পরিচয় ও বন্ধুত্বের সুযোগের হাতছানি। কে না আসেননি গত একশো বছরে নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের ডাকে?‌ কাজী নজরুল, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় থেকে প্রমথনাথ বিশী, সত্যেন্দ্রনাথ বসু থেকে সরলা দেবী চৌধুরানী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অন্নদাশঙ্কর রায়, আশাপূর্ণা দেবী, সমরেশ বসু, শংকর, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং আজকের প্রায় সব বিখ্যাত ‌ লেখকেরা। দীর্ঘ ১২ বছর নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সভাপতির পদে আসীন ছিলেন ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়। ২০১৮ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের ঢাকাতে। সেই আন্তর্জাতিক বাংলা সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন হয়েছিল বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে, সমাপ্তি ঘটেছিল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাতে।

শতবর্ষ প্রাচীন এই সংগঠনের বর্তমানে দেশ জুড়ে শাখার সংখ্যা শতাধিক, আজীবন সদস্য সংখ্যা ১৫ হাজারেরও অধিক। এ ছাড়াও রয়েছেন বহু সংখ্যক সক্রিয় অনুরাগী। এই বছর অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের সর্বভারতীয় অধ্যক্ষ প্রবীণ কংগ্রেস সাংসদ প্রদীপ ভট্টাচার্য। তিনি প্রথমেই জানিয়েছেন, নিখিল ভারত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনের কোনও রাজনৈতিক বা ধর্মীয় পরিচয় নেই। তাঁর আশা, নবীনদের হাত ধরে শতবর্ষ পেরিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে এগিয়ে চলবে এই সংগঠন। এর পাশাপাশি শুক্রবারের অনুষ্ঠানে বক্তব্য পেশ করেছেন হিন্দু বয়েজের অধ্যক্ষা নীরু বহেল, নিখিল ভারতের সাধারণ সচিব অনিলকুমার ধর ও অন্যান্য কর্মকর্তারা। সংগঠনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক সত্যম রায়চৌধুরী অনিবার্য কারণবশত উপস্থিত ছিলেন না, তাঁর লিখিত ভাষণ পাঠ করেছেন বিপ্লব গাঙ্গুলি এবং সঙ্গীত পরিবেশন করেন শান্তনু রায়চৌধুরী। রবীন্দ্র স্মৃতিধন্য এই বিদ্যালয়ে এক অবাঙ্গালী কিশোরের গলায় ‘‌তুমি রবে নীরবে হৃদয়ে মম’‌ আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছে ‘‌আ মরি বাঙ্গলা ভাষা’‌।