বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার উৎস ও ব্যাপ্তি

0
1570

বঙ্গদেশে দুর্গাপূজার সূচনাকাল নিয়ে একাধিক জনশ্রুতি প্রচলিত রয়েছে। কেউ তাহেরপুরের কংসনারায়ণকে, কেউ বা নদিয়ার কৃষ্ণচন্দ্র রায়কে, আবার কেউ ব্রিটিশদের পৃষ্ঠপোষক একাধিক বাঙ্গালী জমিদার ও বণিক সমাজকে দুর্গাপূজার সূচনাকর্তা হিসেবে দাবি করে থাকেন। কিন্তু জনশ্রুতিগুলির কোনোটিরই কোনো যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ নাই।  বাঙ্গালী ঐতিহাসিকগণ উল্লেখ করেছেন যে মহিষাসুরমর্দিনী পাল যুগের  প্রধান দেবী ছিলেন। তার মানে কি ধরে নিতে হয় পাল যুগই মহিষাসুরমর্দিনী উপাসনার সূচনা কাল? কথাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয় তবে পাল যুগে যে মহিষাসুরমর্দিনী উপাসনা জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছিল এই কথা অস্বীকার করা যায় না। বঙ্গদেশে মহিষাসুরমর্দিনীর উপাসনার বিবর্তনকে কালনুযায়ী চারটি প্রধান অধ্যায়ে ভাগ করা যায় – (১) আদি যুগ বা ধ্রুপদী যুগ (খ্রিস্ট পূর্ব দ্বিতীয় শতক থেকে ষষ্ঠ শতক) (২) আদি মধ্য যুগ (সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক) (৩) মধ্যযুগ (ত্রয়োদশ শতক থেকে অষ্টাদশ শতক) (৪) আধুনিক যুগ (অষ্টাদশ শতক থেকে বর্তমান কাল)।

আদি যুগ বা ধ্রুপদী যুগ

আদি যুগে মহিষমর্দিনী উপাসনার সূত্রপাত হয়। বঙ্গদেশে প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন মহিষমর্দিনীর মূর্তিগুলি কুশান শাসনকালের। মূর্তিগুলি পাওয়া গেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার সুন্দরবনের উপকূলবর্তী প্রত্নস্থলগুলিতে যথা সাগরদ্বীপ, নামখানা, পাথরপ্রতিমা, রাইদিঘি ও ধঞ্চি জঙ্গলে, পূর্ব বর্ধমান জেলার পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে, বাংলাদেশের বগুড়া জেলার মহাস্থানগড় ইত্যাদি স্থানে। মূর্তিগুলির সিংহভাগই টেরাকোটায় নির্মিত। সেই যুগে মৃৎপ্রতিমা তৈরি হত কিনা তা আজ জানার কোনো উপায় নেই। বঙ্গদেশে এই অঞ্চলগুলির ভৌগলিক অবস্থান বলে দেয় এখানে পাথর কতটা অপ্রতুল। হয়তো সেই কারণেই এই সব অঞ্চলে দেবী প্রতিমা রূপায়ণে টেরাকোটার প্রাচুর্য দেখা যায় এবং শীলারূপী দেবী বিগ্রহের তেমন কোন চিহ্ন মেলেনি।

প্রাপ্ত মহিষমর্দিনীর মূর্তিগুলি সকলই চতুর্ভুজা, বাহুতে ত্রিশূল, ঢাল ও খড়গ বিদ্যমান। দেবী মহিষ মর্দন করছেন। এই সকল মহিষমর্দিনী মূর্তিতে সিংহ বা অসুরের কোনো অস্তিত্ব মেলেনি। অধিকাংশ ঐতিহাসিক এই মহিষমর্দিনী দেবীকে কৃষি দেবী বলে মনে করেন। যুক্তি হিসেবে তাঁরা দাবি করেন, তৎকালীন কৃষিভিত্তিক সমাজে  মহিষ কৃষি সম্পদ নষ্ট করত বলে মানুষ দেবীরূপী মহিষ মর্দনকারিণীকে উপাসনা করত।

আদি মধ্য যুগ

আদি মধ্যযুগের প্রারম্ভে রচিত হয় মার্কণ্ডেয় পুরাণের ‘দেবী মাহাত্ম্য’ অংশটি যা শ্রীশ্রীচণ্ডী নামে পরিচিত। শ্রীশ্রীচণ্ডীর আখ্যানের মধ্যে দিয়েই মহিষমর্দিনীর উত্তরণ ঘটে মহিষাসুরমর্দিনীতে। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লিখিত রাজা সুরথের রাজধানী ছিল বীরভূম জেলার বোলপুরের নিকটস্থ সুপুরে গ্রামে। এখনও সেখানে তার প্রতিষ্ঠিত সুরথেশ্বর শিব মন্দির রয়েছে। রয়েছে তার নামাঙ্কিত প্রত্নস্থল ‘সুরথ রাজার ঢিবি’। স্থানীয় দের মতে এই ঢিবিই রাজা সুরথের প্রাসাদ। অনতিদূরে দুর্গাপুরের নিকটে গড়জঙ্গলে রয়েছে শ্রীশ্রীচণ্ডীতে উল্লিখিত ঋষি মেধসের আশ্রম। এই যুগের শেষের দিকে দেবীর মাহাত্ম্য প্রচারের জন্য রচিত হয় শাক্ত ধর্মের প্রধান গ্রন্থ দেবী ভাগবত পুরাণ বা দেবী ভাগবত। দেবী ভাগবত বঙ্গদেশেই রচিত বলে মনে করা হয়।

এই যুগে পাল শাসনকালে বঙ্গদেশ এক বৃহৎ সাম্রাজ্যে পরিণত হয়। মহিষাসুরমর্দিনী হয়ে ওঠেন সবচেয়ে জনপ্রিয় দেবী। এই সময়ের প্রচুর মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া গেছে ভারতের বিভিন্ন স্থানে। তার মধ্যে বঙ্গদেশে প্রাপ্ত মূর্তির সংখ্যা সর্বাধিক। অধিকাংশই পাথরের মূর্তি। চতুর্ভুজা, অষ্টভুজা, দশভুজা, ষোড়শ ভুজা এমনকি অষ্টাদশ ভুজা মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তিও পাওয়া গেছে। পাল শাসনকালে পাথরের পাশাপাশি টেরাকোটা এবং মাটির মূর্তিতেও মহিষাসুরমর্দিনীর পূজা হত। রাজা মহীপালের সমসাময়িক রাঢ় বঙ্গের জগৎমল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে মাটির তৈরী মহিষাসুরমর্দিনীকে কুলদেবী রূপে পূজার প্রচলন করেন। সেই মৃন্ময়ী বিগ্রহ আজও বাঁকুড়ার  মল্লরাজদের রাজধানী বিষ্ণুপুরের মৃন্ময়ী মন্দিরে বিদ্যমান। এমনকি সপরিবারে মহিষাসুরমর্দিনী আরাধনাও এই যুগ থেকেই সূত্রপাত। অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, পাল সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতাতেই মহিষাসুরমর্দিনী উপাসনা সমগ্র ভারতে ছড়িয়ে পড়ে।

পুরুলিয়ার দেউলঘাটায় প্রাচীন ভগ্নপ্রায় জৈন দেউলে পাল শাসনকালের একটি ব্যতিক্রমী শিল্প রীতির মহিষাসুরমর্দিনীর মূর্তি দেখতে পাওয়া যায়। মূর্তির শীর্ষ স্থানে ভগবান বুদ্ধের ধ্যানমগ্ন মূর্তি প্রমাণ করে এই দেবীর উপাসকরা বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী ছিলেন। সিংহ ও অসুরের স্থান পরিবর্তন এই মূর্তিকে ওই যুগের অন্যান্য মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি থেকে পৃথক করেছে। হয়তো সনাতন ধর্মের উপাসকদের থেকে নিজেদের আলাদা করতেই শিল্পীর ওই অভিনব প্রয়াস। কিন্তু, সে যুগে ধর্মমত নির্বিশেষে সকলেই যে মহিষাসুরমর্দিনীর একান্ত ভক্ত ছিলেন তার বড় প্রমাণ এই বিগ্রহ যা আজও স্বমহিমায় জৈন দেউলে পূজা পাচ্ছে।

শরৎকালে মহিষাসুরমর্দিনী পূজা বা শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রচলনও এই যুগেই। শ্রীশ্রীচণ্ডীতেই উল্লিখিত আছে রাজা সুরথ ও সমাধি বৈশ্য শরৎকালে পরপর তিন বৎসর দুর্গাপূজা করেন। চর্যাপদে উল্লিখিত আছে সিদ্ধাচার্য ভুসুকু পা শারদীয়া পূজা উপলক্ষে অস্ত্র পূজার জন্য কাঠের তরবারি পরিষ্কার করছেন। আজও রাঢ় দেশে দুর্গাপূজায় তরবারি পূজার প্রচলন রয়েছে। অর্থাৎ কৃত্তিবাসের রামায়ণে রামচন্দ্র অকালবোধন করার বহু পূর্বেই বঙ্গদেশে শারদীয়া দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল।

মধ্য যুগ

এই যুগের শুরুর দিকে স্মার্ত পণ্ডিত জিমূতবাহন, বাচস্পতি মিশ্র প্রমুখ ব্যক্তিগণ বাৎসরিক শারদীয়া দুর্গাপূজার বিধান ও পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু বঙ্গদেশে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সনাতন ধর্ম তথা বাঙ্গালীর শক্তি উপাসনা একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়ে। রাজ পৃষ্ঠপোষকতা না থাকায় বঙ্গের প্রান্তিক জনপদ থেকে পাথর আনিয়ে মূর্তি নির্মাণ সাধারণ বাঙ্গালীর কাছে দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। তাই দুর্গা প্রতিমা নির্মাণে মাটির বহুল ব্যবহার শুরু হয়। মুসলিম শাসনের শুরু এবং সেন রাজত্বের অবসানের সন্ধিক্ষণে বঙ্গের প্রান্তিক জনপদগুলিতে পাল রীতিতে নির্মিত প্রচুর মহিষাসুরমর্দিনী মূর্তি পাওয়া যায়। পুরুলিয়া জেলার দেবী মূর্তিগুলি এবং ত্রিপুরার উনকোটি এই যুগের কীর্তি।

মুসলিম শাসকদের শত প্রতিরোধ সত্ত্বেও মধ্যযুগে কতিপয় বাঙ্গালী নৃপতি মহিষাসুরমর্দিনী উপাসনা ধরে রাখার চেষ্টা করেন। বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহিরপুরের জমিদার কংসনারায়ণ তাদের মধ্যে অন্যতম। এছাড়াও যুগাবতার শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু উড়িষ্যার কটকে রাজগৃহে প্রথম দুর্গাপূজার সূত্রপাত করেন। নবদ্বীপের পণ্ডিত রঘুনন্দন ভট্টাচার্য দুর্গাপূজার বিধি সম্পর্কে তিনটি গ্রন্থ রচনা করেন।

আধুনিক যুগ

আধুনিক যুগে শারদীয়া দুর্গাপূজার পুনঃরুত্থান ঘটে। মধ্যযুগে মুসলিম শাসনে শারদীয়া দুর্গাপূজা কোনঠাসা হয়ে পড়লেও মুসলিম শাসনের অবসানে বাঙ্গালী জমিদার ও ব্রিটিশ শাসকদের আনুকূল্যে শারদীয়া দুর্গাপূজা নতুন রূপ পায়। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, কলকাতার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার, নবকৃষ্ণ দেব পরিবার তাঁদের অন্যতম। মুসলিম শাসনের পতন বাঙ্গালীদের মধ্যে আশার সঞ্চার ঘটায়। পলাশীর যুদ্ধের বিজয় উৎসব হিসেবে ক্লাইভের আনুকূল্যে দুর্গাপূজার আড়ম্বর বৃদ্ধি পায়।

পৌরাণিক দুর্গাপূজাকে আজকের দুর্গোৎসবের চেহারা দেওয়ার পেছনে এই বাঙ্গালী জমিদার ও বনেদী পরিবার গুলির ভূমিকা অনেক খানি। আজকের দুর্গোৎসবের রূপরেখা অনেকটাই এদের হাতেই তৈরি। বর্তমানে কয়েকটি প্রাচীন বনেদি পূজায় আজও পালযুগের পাথরের মূর্তির ধ্রুপদী নির্মাণ শৈলীকে অনুসরণ করে মৃৎপ্রতিমা নির্মাণ করতে দেখা যায়। যেমন কৃষ্ণনগর রাজবাড়ীর প্রতিমার মধ্যে দিয়ে পালযুগের শিল্পরীতি আজও ধারাবাহিকভাবে বাহিত হচ্ছে।  এই সব প্রতিমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পৌরাণিক বৈশিষ্ট্য হলো দেবীর বাহন সিংহ। বর্তমান লেখকগণ সেই সিংহকে দেবসিংহ, গোঘটক, গোধা কিংবা পৌরাণিক সিংহ ইত্যাদি নানা নামে বলে অভিহিত করে থাকেন। দাবার বোর্ডে সিংহের সাথে মিল থাকা ধ্রুপদী  সিংহ মূর্তির অদ্ভুত চেহারার শৈল্পিক নাম  ‘ভায়ালা’ ইংরেজিতে যাকে ‘Vyala’ বা ‘Yali’ বলা হয়। যা ভারতীয় ধ্রুপদী শিল্প রীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।

এই যুগে দুর্গাপূজা দুর্গোৎসবের চেহারা নেওয়ার পর আরও নানা প্রকার বিবর্তন হয়েছে। বারোয়ারী পুজোর প্রচলন হয়েছে, যেখানে পল্লীর সকল বাঙ্গালী একজোট হয়ে দুর্গাপূজা করেন। দুর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বাঙ্গালী কবিতা-গান-নাটক ইত্যাদি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে মেতে ওঠে। বাঙ্গালী যেখানেই গেছে সেখানেই দুর্গাপূজার প্রচলন হয়েছে। ধীরে ধীরে দুর্গোৎসবের ব্যাপ্তি বঙ্গদেশের সীমানা সমগ্র ভারতে ও বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে।