দক্ষিণের কফির কাপে – ৩

0
389

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

“কিরে!! এত সকালে এলি কি করে? ঘুম ভাঙলো?” – মুখে একগাল হাসি নিয়ে প্রশ্নটা করলো শান্তনুদা। কারণ একটাই। আমার ভোর বেলায় ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস নেই। আর যখন ওর বাড়িতে আমরা পৌঁছলাম তখন বাজে ভোর চারটে চল্লিশ! 

– “হ্যাঁ। একটা উবের বুক করে চলে এলাম দুজনে।”
– “বাহ্। ভালো করেছিস।”
– “এসো আলাপ করিয়ে দিই। আমার বন্ধু মিঠুন। আমরা কলেজ লাইফের বন্ধু।”
– “হ্যাঁ, নমস্কার। পরীক্ষা কেমন হলো?”
– “ভালো হয়েছে।”
– “ও পাস করে গেছে দাদা।”
-” ওহ তাই !!! বাহ্। দারুণ খবর। তাহলে তোরা একটু বোস। আমি স্নান সেরে তৈরী হয়ে আসছি।”
– “বেরোতে দেরি হয়ে যাবেনা? আড়াইশো কিলোমিটারের ওপরে জার্নি!”
– “চিন্তা করিস না, হাইওয়েতে উঠেই গেলেই তিন ঘন্টায় ঢুকিয়ে দেব। তোর আমার গাড়ি চালানো নিয়ে কোনো ধারণা নেই।”
– নাহ। সত্যিই কোনো ধারণা তার আগে অবধি ছিলোনা। স্রেফ বেঙ্গালুরুর ভেতরে একটু এদিক ওদিক কাজ ছাড়া দাদার সাথে গাড়ি নিয়ে ঘোরার অভিজ্ঞতা তেমন ছিলোনা। এটাই ফার্স্ট লং ড্রাইভ। তাই দাদা স্নানে যেতেই মিঠুন ভয় মেশানো গলায় বললো,
– “ভাই, ওনাকে একটু আস্তে চালাতে বলিস।”
– “চাপ নিসনা। সামলে নেবো।”

সকাল সাতটা দশ। টুমকুর রোড জংশন এর একটা চায়ের দোকানে আমরা থামলাম। চা পানের বিরতি। বেঙ্গালুরুর জ্যাম বিখ্যাত। তবে সকাল পৌনে ছটাতেও যে তার ব্যতিক্রম হবেনা তা ভাবিনি। তাই শহর ছেড়ে বেরিয়ে ন্যাশনাল হাইওয়ে ৭৫ এ বেঙ্গালুরু ম্যাঙ্গালোরের রাস্তায় আসতে এত সময় লাগবে ভাবিনি। যাই হোক, এত সকালে ব্রেকফাস্ট করার অভ্যেস নেই, বলেই আমরা ঠিক করলাম যে আগে আমরা আমাদের সকলেশপুর পৌঁছাবো। আর ওখানে গিয়ে খাবার খাবো যদিনা একান্তই রাস্তায় খিদে পায়। নাহলে আমরা রাস্তায় কোনো রোড সাইড ধাবা বা রেস্টুরেন্টে খেয়ে নেবো।

অবশেষে আমাদের যাত্রা শুরু হল। শান্তনুদার নির্দেশ,”জানলার কাঁচটা তুলে দে। নইলে হাওয়ার শব্দে আমি গাড়ি চালাতে পারবোনা।

অগত্যা। জানলার কাঁচ তুলে দিলাম। আর গাড়ির স্পিড কিছুক্ষনের মধ্যেই ঘন্টায় ৮০ কিলোমিটারের মাত্রা অতিক্রম করলো। সবার প্রথমেই যেটা অনুভব করলাম তা হলো ন্যাশনাল হাইওয়ে ৭৫-এর বৈশিষ্ট্য। বেশ চওড়া। ৪ খানা গাড়ি অনায়াসে পাশাপাশি আশা যাওয়া করতে পারে। তার থেকেও বেশি যেটা মনে ধরেছিলো সেটা হলো রাস্তার পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা আর সৌন্দৰ্য্যায়ন। যাত্রাপথের বেশ অনেকটাই হাইওয়ের মাঝের ডিভাইডারে নানান রকমের বাহারি ফুলের গাছ লাগানো। যা হাইওয়ের সৌন্দ্যর্যের একটা আলাদা মাত্রা যোগ করেছে। যে ব্যাপারটা আমি আগে কখনো দেখিনি। সুতরাং যাত্রার শুরুতেই মনটা ভরে গেলো। তবে বলে রাখা ভালো হাসান জেলায় ঢোকার পর থেকে রাস্তা কিন্তু কিছুটা সরু হয়ে এসেছে। ফলে হাইওয়ের ব্যাপারটা সকলেশপুরের দিকে প্রায় নেই। সাধারণ বড়ো রাস্তার মতোই।

গাড়ির স্পিড এখন ১০০ কিলোমিটার প্রতি ঘন্টার আশেপাশে। প্রায় ১ ঘন্টা ছুঁইছুঁই, দুপাশের দৃশ্য ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে। শহুরে সভ্যতা ছাড়িয়ে এখন নীল আকাশের নিচে হাইওয়ে ধরে তীব্র গতিতে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। শুরুর কিছুক্ষণ পর গাড়িতে তেল ভরানোর জন্য একটা পেট্রল পাম্পে ৫ মিনিটের জন্য দাঁড়িয়েছিলাম। এছাড়া গাড়ি থামেনি। দুধারে যেদিকেই তাকাই সবুজ আর সবুজ। মাঝে মাঝে গ্রাম। আর দূরে দিগন্ত রেখা বরাবর পাহাড়ের ইতিউতি উঁকি। মাঝে মাঝে ছোট ছোট টিলার উপর বিশাল বিশাল হাওয়াকল। সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে। যেন সাদর অভ্যার্থনা জানাচ্ছে দাক্ষিণাত্যের গ্রামে।

আমি কলকাতার ছেলে। তবে গ্রামবাংলা বরাবরই আমার কাছে প্রিয়। গ্রামের চালাঘর, কুঁড়েঘর, ধানের গোলা কিংবা সবুজ ধানক্ষেত আর আঁকাবাঁকা আল। তার মধ্য দিয়ে নীল হাফ প্যান্ট অথবা নীল স্কার্ট আর সাদা জামা পড়া শিশুদের এক মুখ হাসি নিয়ে এক অনাবিল আনন্দে ছুটে চলা। এই সব দৃশ্যই বড়োই চেনা চেনা লাগছিলো। মনে হচ্ছিলো কোথাও কোনো অতীতে হারিয়ে যাওয়া আর নিজের ছেলেবেলা খুঁজে পাওয়া।

একটু দাঁড়াতে বললাম শান্তনুদাকে। গাড়ি থামতেই, রাস্তা থেকে নেমে একটা ধানক্ষেতের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আহ!! একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। অনুভব করলাম, যান্ত্রিক জীবনের যাঁতাকলের যন্ত্রণাটা হালকা করে মিলিয়ে যেতে শুরু করলো। পেছন থেকে ততক্ষণে দাদা আর মিঠুনও আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

– “কিরে? ভালো লাগছে?”
– “হ্যাঁ।
– “এই নে, একটু জল খা।” বলে দাদা জলের বোতলটা এগিয়ে দিলো।

সে এক অদ্ভুত তৃপ্তি। তবে জলের পিপাসা মিটলেও ঘুরতে যাওয়ার পিপাসাটা যেন আরো অনেকটা বাড়িয়ে দিলো। তাই জায়গাটা ছেড়ে যেতে ইচ্ছা করছিলো না। তাই একটা সিগারেট ধরালাম।

এখানকার গ্রামের মাটি একটু রুক্ষ প্রকৃতির। লালমাটির ব্যাপারটাও নেই। তবে বাকি জিনিস গুলো প্রায় একই। বরং যেগুলো পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে সেগুলো হলো, সৌরবিদ্যুৎ, পাকারাস্তা, হাওয়াকল ইত্যাদি। এখানে হাইওয়ের ধারে যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা সার বেঁধে দাঁড়িয়ে থাকা ঝুপড়ি জাতীয় দোকানগুলো নেই। লোকালয় বা তার আশেপাশে কিছু হোটেল বা ধাবা জাতীয় খাবার দোকান থাকলেও তার সামনে জঞ্জালের স্তূপ নেই। এমনকি রাস্তায় গর্তও নেই! অর্থাৎ সাজানো গোছানো ব্যাপারটার চিহ্ন চোখে পড়ছে। এখানে গ্রামের প্রকৃতিও যেন কথা বলছে। তবে সেপ্টেম্বর মাসে আকাশে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ থাকলেও, ধানক্ষেতের পাশে কাশফুল নেই।

– “ভাই, সবাই মিলে একটু সেলফি তুলি চল।”

এতক্ষণ পর মিঠুন অবশেষে একটু মুখ খুললো। তাই সবাই মিলে একটু ছবি তোলার পালা চললো। তারপর দাদা তাড়া দিয়ে বললো, “আর নয়। এবার রওনা দেব। নইলে পৌঁছতে দেরি হয়ে যাবে।” তাই আবারো গাড়ি চলতে শুরু করল সকলেশপুরের উদ্দেশ্যে।

“নে, তোর সকলেশপুর হাজির। এবার কোনদিকে যাবো গাইড করবি। আর একটু কফি পাওয়া যাবে কিনা দ্যাখ। আমি ততক্ষণে গাড়ির সামনের টায়ার দুটো চেক করে নিই।”

সকাল ৯:৪০। মাইলস্টোন বলছে সকলেশপুর ৭ কিলোমিটার। এবার একটু বিরতি। রাস্তার ধারে একটা ছোট দোকানে গাড়ি দাঁড় করালো দাদা।

দুকাপ কফি অর্ডার করলাম। মিঠুন কফি খায়না; তাই ও চা নিলো। আসার পথে হাসান জেলায় ঢোকার পর থেকেই প্রকৃতি আর আবহাওয়ার একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। কখনো মেঘলা আকাশ, টিপ টিপ বৃষ্টি পরছে তো পরক্ষণেই রোদ্দুর। অথচ ঠান্ডার একটা রেশ আছে। সুজিতের বলা কথাগুলো মনে পড়লো। সুজিত? ও আমার স্কুলের বন্ধু। বেঙ্গালুরুতে আছে প্রায় আট বছর। দক্ষিণ ভারতের অধিকাংশ জায়গাই ওর ঘোরা। সকলেশপুরও তার ব্যতিক্রম নয়। তাই এখানে ঘুরতে আসার আগে ওর থেকেও কিছু উপদেশ পেয়েছিলাম, তার মধ্যে আবহাওয়াজনিত ব্যাপারটাও ছিল। সেটা যে এভাবে মিলবে এতটা ভাবিনি। তবে বেশ ভালোই লাগলো।

কফি শেষ করে আমরা আবারো রওনা দিলাম। বেশ খানিকটা এগিয়ে যাওয়ার পর লক্ষ্য করলাম, যে আমাদের মোবাইল ফোনগুলো প্রায় কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। দাদার ভোডাফোনের নেটওয়ার্ক নেই। মিঠুনেরও তাই। আমার বিএসএনএল আর এয়ারটেল দুটোরই নেটওয়ার্ক যাতায়াত করছে। সকলেশপুর বাজার অবধি যাওবা ছিল সেটা পেরিয়ে যাওয়ার পর সেটুকুও আর রইলোনা। ফলে ইন্টারনেট কানেকশনহীন হয়ে পড়লাম। গোটা রাস্তার প্রায় সবটাই জিপিএস-এর ওপরে নির্ভর ছিলাম। তাই ব্যাকআপ হিসেবে রুটম্যাপ এর প্রিন্টআউট আর প্রি-সেভড গুগলম্যাপ অফলাইন জিপিএস-এর ভরসায় এগোতে থাকলাম। তবে মুশকিল যে আরো বাড়বে সেটা আরো খানিকটা যাওয়ার পর টের পেলাম। ততক্ষণে পাহাড়ি রাস্তা শুরু হয়ে গেছে। শাল আর সেগুন গাছের জঙ্গল। আর তার পাশাপাশি কফির বাগান। ফাঁকে ফাঁকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালা দেখা যাচ্ছে। এখানে বলে রাখি যে ম্যাপ আমার কাছে ছিল তা জিপিএস আর প্রিন্টআউট যেটা ইমেইল মারফত হোমস্টে কর্তৃপক্ষ আমাদের দিয়েছিলো। সেগুলো শুধুমাত্রই সালুগুদ্দা হোমস্টের। ওখানে কোথাও মানাজারাবাদ ফোর্টের উল্লেখ ছিলোনা। তাই ঠিক করলাম যে খানিকটা এগিয়ে রাস্তায় কাউকে জিজ্ঞেস করবো যে কোনদিক দিয়ে যাওয়া যায়। কিন্তু দুঃখের বিষয় ভাষাগত সমস্যার জন্য কেউই ঠিকমতো কথা বুঝতে পারলোনা। আরো বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দেখি পাহাড়ি রাস্তা দু-দিকে ভাগ হয়ে গেছে। একেতো পাহাড়ি রাস্তা উপরন্তু রাস্তায় প্রায় কেউ নেই বললেই চলে। পেছনে একটা ছোট্ট বাজার মতো ফেলে এসেছি বটে কিন্তু সেটাও প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে। কিছুতেই আর মানজারাবাদ ফোর্টের রাস্তা আর খুঁজে পাইনা। অগত্যা ঠিক করলাম, সোজা হোমস্টেতেই যাবো। আগামীকাল ফেরার পথে যদি সম্ভব হয় তাহলে মানজারাবাদ ফোর্টে আমরা ঘুরবো ভালমতন রাস্তার খোঁজখবর নিয়ে। অগত্যা গাড়ি ঘুরিয়ে আবারো সেই ছোট্ট বাজারটার কাছে ফিরলাম যার আগে থেকে রাস্তা দু-ভাগে ভাগ হয়েছে। কপাল ভালো যে, ওখানে একজন ভদ্রলোকের সাথে দেখা যিনি ইংলিশটা বোঝেন। ইনিও বাইরে থেকে এসেছেন কোনোএকটা কাজে ওখানকার কোনো এক কফি এস্টেটে। ওনাকে সালুগুদ্দা যাওয়ার রাস্তা জিজ্ঞেস করায় আর ম্যাপের প্রিন্টআউটটা দেখাতেই উনি বললেন যে আমরা ভুল রাস্তায় এসেছি। তাই উনি সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিলেন এবং কিভাবে যাবো সেটাও বুঝিয়ে দিলেন।

এবার বেশ অনেকটা উঁচুতে চলে এসেছি। এখান থেকে পশ্চিমঘাট পর্বতমালার শৃঙ্গগুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। যেদিকেই তাকাই শুধু সবুজ পাহাড় আর পাহাড়। নীচের দিকটায় ঘন সবুজ জঙ্গল। আর পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ঘন বেগুনিলাল রঙের কফি বাগান। সে এক অপূর্ব নৈসর্গিক দৃশ্য। যা বলে বা লিখে বোঝানো যাবে না। পাহাড়ি রাস্তার ধারে বেশ খানিকটা ফাঁকা মাঠ। এখান থেকে পাহাড়গুলো পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। গাড়িটা আরো একবার থামাতে বললাম দাদাকে। গাড়ি থেকে নেমে আমি আর মিঠুন ঝোপ ঝাড় ঠেলে ফাঁকা মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম। দুজনে শুধু ১ মিনিট ধরে বুক ভরে বেশ কয়েকবার শ্বাস নিলাম। এ হলো মুক্তির নিশ্বাস।

– “উফফ ভাই। দারুন লাগছে। কি বলিস?” মিঠুনকে আমি জিজ্ঞেস করলাম।
– “অসাধারণ!! অসাধারণ!! বিশ্বাস কর, এই ব্রেকটা দরকার ছিল। দম আটকে আসছিলো।”
– “সত্যিই তাই।”
– “বিগত ১ বছর শুধু পরীক্ষার প্রিপারেশনের জন্য কোত্থাও যাইনি। না নিজেকে, না পরিবার, কাউকেই সময় দিতে পারিনি। আজ অনেকটা মুক্ত লাগছে।”
“একদম। এই অফিস আর বাড়ি এই তো জীবন হয়ে গেছে রে ভাই। তাই আজ আমারো অনেকটা আরাম লাগছে।”

প্রায় মিনিট দশেক ওখানে কাটিয়ে আবারো এগোনো শুরু করলাম সালুগুদ্দার উদ্দেশ্যে। রাস্তায় ক্রমশ ঢালু হয়ে এসেছে। বুঝলাম যে এবার আমরা কফি বাগানের মধ্যে দিয়ে এগোবো। কিছুটা এগোতেই একটা সাইনবোর্ডে দিক নির্দেশ দেয়া দেখতে পেলাম। বিভিন্ন রিসোর্টের নামের পাশাপাশি সালুগুদ্দা হোমস্টের নাম দেখে অনেকটা আশ্বস্ত হলাম যে আমরা ঠিক দিকেই এগোচ্ছি। এখন দুপাশে শুধুই বড়ো বড়ো গাছ আর কফি এস্টেট। মাঝখান দিয়ে পিচঢালা আঁকাবাঁকা কালো রাস্তাটা শুকনো ঝরা পাতা দিয়ে ঢাকা। গাছপালার পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো স্পটলাইটের মতো পরে মায়াবী চেহারা নিয়েছে এই পথ। ততক্ষণে গাড়ির জানলার কাঁচ নামিয়ে দিয়েছে শান্তনুদা। ভেতরে চলতে থাকা মিউসিক সিস্টেমটাও বন্ধ করে দিল। নিমেষে জায়গাটার মজাটা অনুভব করলাম। নিস্তব্ধ নির্জন কফি বাগান আর জঙ্গলে শুধুই নানানরকম পাখির কলতান। গতিবেগ কম থাকায় গাড়ির টায়ারের তলায় শুকনো পাতার মর্মর শব্দও যেন অন্য মাত্রা যোগ করেছে। যেন এগিয়ে যাওয়া কোনো মায়াবী পথ ধরে অজানা উদ্দেশ্যে।

হুস করে দুটো ফরেস্ট রেঞ্জার গাড়ি আমাদের গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে গেলো। বুঝলাম এখানে বনবিভাগের কর্মীরা বা বনরক্ষকরা ভীষণ রকমের সক্রিয় বনকে রক্ষা করতে। সত্যিই তো! যদি বনজঙ্গল গাছপালা পশুপাখি না থাকে তাহলে এই প্রকৃতি তো তার ভারসাম্য হারাবে। তখন মানুষ কিভাবে বাঁচবে? তফাৎগুলো ভীষণ ভাবে মনে হতে লাগলো। যেমন আমাদের উত্তরবঙ্গ প্রকৃতিগত দিক থেকে ঠিক এরকমই। কিংবা এর থেকেও হয়তো সুন্দর ছিল। কিন্তু বাস্তবে আমি তার যা রূপ দেখেছি তাতে প্রকৃতি ধ্বংসের রূপটাই বারবার প্রকট হয়েছে। ডুয়ার্স হোক কিংবা ছোটোনাগপুরের (হাজারীবাগ, পালামৌ ইত্যাদি) মালভূমি। আমি সব সময়তেই লক্ষ্য করেছি যে, পাহাড়ের রূপ অনেকাংশেই সবুজবিহীন রুক্ষ। জঙ্গলের মধ্যে যত্রতত্র বাজার আর লোকালয়। একটু ফাঁকা জায়গা হলে তো কোনো কথাই নেই, কারণ তা পিকনিক পার্টির দখলে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে যানবাহন চলছে তারস্বরে হর্ন বাজিয়ে। আর যদি কোনো দর্শনীয় স্থান থাকে, তাহলে তার কমপক্ষে ১০কিলোমিটার আগে থেকে বাজার বস্তি ইত্যাদি। যত এগোনো যাবে ততই বাড়বে হরেকরকম জিনিসের দোকানের ভিড়, যার থেকে ভেসে আসা হিন্দি কিংবা ডিজে গানের জোরালো আওয়াজে কান পাতা দায়। আর বিশেষ করে খাবারের দোকান গুলোর সামনে লম্বা লাইন। পুরুষ ,মহিলা শিশু থেকে দোকান কর্তৃপক্ষ সবাই খাবারের উচ্ছিষ্টগুলো ফেলে জায়গাটা নোংরা করছে। কারোরই কোনোরকম তাগিদ দেখিনি কখনোই প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার।

যেই সাহিত্যিকের হাত ধরে জঙ্গলের সাথে আমার প্রথম পরিচয়, সেই বিভূতিভূষণ বন্দোপাধ্যায়ের আরণ্যকের কয়েকটা লাইন বারবার মনে হচ্ছিলো।

“এমন সময় আসিবে হয়তো দেশে, যখন মানুষে অরণ্য দেখিতে পাইবেনা।
শুধুই চাষের খেত আর পাটের কল, কাপড়ের কলের চিমনি চোখে পড়িবে।
তখন তাহারা আসিবে এই নিভৃত অরণ্য প্রদেশে, যেমন লোকে তীর্থে আসে।”

ইতিমধ্যে কফি বাগান ছাড়িয়ে পিচের রাস্তা ছেড়ে গাড়ি ততক্ষণে জঙ্গলের রাস্তায় প্রবেশ করেছে। সামনে আবারো সাইনবোর্ডে বিভিন্ন হোমস্টেতে যাওয়ার রাস্তার দিক নির্দেশ সহ বিধিসম্মত সতর্কীকরণ। জঙ্গলে গাড়ির হর্ন বাজানো, গান বাজানো আর আগুন জ্বালানো বারণ। কারণ এই এলাকা পশুপাখিদের বাসভূমি। তাই জঙ্গলের শান্তি বিঘ্ন করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।

(ক্রমশ)