আমাদের পকেটে বাস করছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুপ্তচর-২

0
551

(প্রথম পর্বের পরে)

দ্বিতীয় পর্ব

-ময়ূখ দেবনাথ 

প্রত্যেকেই এক একজন টার্গেট

৯/১১ র ঘটনার পর আমেরিকার সরকার তাদের আন্তরিক সুরক্ষার জন্য ৪০ বীলিয়ন ডলার বরাদ্দ করে। আগামী দু বছরে আরো অনেক অর্থ বরাদ্দ করা হলো। কিন্তু এত টাকা দিয়ে কি হবে? সারা বিশ্ব যখন খাদ্য সংকটে ভুগছে, তখন আমেরিকা এত টাকা খরচ করছে! ২৬৩ টি নতুন গোপন সংগঠন তৈরি করা হলো। এর মধ্যে ছিল ডিপার্টমেন্ট অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটি। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থাগুলি ৭৫ বিলিয়ন ডলারের গোয়েন্দা বাজেটের প্রায় ৭০% কার্যক্রমকে আউটসোর্স করে দেয়, যা ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাজেটের প্রায় দ্বিগুণ। এনএসএ অনুমতি ছাড়াই দেশীয় আমেরিকান উত্স থেকে সমস্ত তথ্য সংগ্রহ করতে শুরু করে।

ব্ল্যাক ওয়াটারের মতো সংস্থাগুলি ইরাকের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে অংশীদার হয়ে ওঠে এবং দ্রুত বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভাড়াটে সেনাবাহিনীর খেতাব অর্জন করে। লকহিড মার্টিন, আইবিএম, বুুজ এলেন এর মত সংস্থাগুলি সিআইএ, পেন্টাগন এবং এনএসএর সাথে অংশীদার হয়ে ইন্টেলিজেন্সের কারুকাজকে, গুপ্তচরবৃত্তির ব্যাবসায় পরিণত করে। এই কর্পোরেশনগুলি বিদেশে গুপ্তচর নেটওয়ার্ক চালানো, সন্ত্রাসীদের সন্ধান, তাদের জিজ্ঞাসাবাদ এবং তথ্য বিশ্লেষণের মতো গোয়েন্দা কাাজ সম্পাদনে সহায়তা করছিল।

এবারে যেই আমেরিকান কোম্পানি গুলো এই গুপ্তচরবৃত্তির সঙ্গে যুক্ত ছিল, তাদের দিকে নজর রাখা যাক –
১. প্রতিরক্ষা শিল্পে ছিল লকহিড মার্টিন, বোইং, মকদন্যেল ডগলাস।
২. যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ছিল মাইক্রোসফট, আই বি এম, বুজ এলেন প্রভৃতি।
৩. সোশাল মিডয়ায় ছিল গুগল, ফেসবুক, ইউ টিউব যাদের ডাটা মাইনিং করতো বুজ এলেন, পালান্টির, আই২।
৪. মিডিয়া কোম্পানিগুলোর মধ্যে ছিল নিউ ইয়র্ক টাইমস, ওয়াসিংটন পোস্ট, সিএনএন, রয়টার্স।
৫. এছাড়াও ছিল এক্সন মবিল, ফোর্ড, কার্লাইল এর মত সংস্থাগুলি।
এই বিশাল নেটওয়ার্কের দৌলতে ২০১২ সালে আমেরিকার ১৭ টা গুপ্তচর সংস্থা র ২,১০,০০০ জন গুপ্তচর ছিল। শুধুমাত্র কাবুলেই ৭০০ জন এবং প্রায় সমসংখ্যক ইসলামাবাদ এ উপস্থিত ছিল। এফবিআই এর কাছে ১৩২ গুলো বহুমূল্য র সার্ভিলেন্স করার প্লেন ও হেলিকপ্টার ছিল যেগুলো র ওপর বিভিন্ন কোম্পানির মালিকানা ছিল। শেষ দশকের মাঝামাঝি প্রায় ৪৭ টি প্রাইভেট কোম্পানি আমেরিকাকে তাদের গুপ্তচরবত্তি করতে সাহায্য করেছিল।

২০১১ সালের মধ্যে আমেরিকা একটি বিশাল বৈদ্যুতিন দুর্গে নিজেকে ঘিরে ফেলেছিল যা বাইরের কথা শুনত পশ্চিম ভার্জিনিয়ার একটি বিশাল লিসেনিং পোস্ট দিয়ে এবং ওয়াশিংটন রাজ্যের পশ্চিম উপকূলে র আর একটি পোস্ট দিয়ে যা প্রতি ঘন্টায় কয়েক মিলিয়ন ফোন কল এবং ইমেল বার্তাগুলি রেকর্ড করত। ফোর্ট মেইডের সদর দফতর ছাড়াও এনএসএ উটাতে ২ বিলিওন ডলারের একটি অফিস তৈরি করে উপগ্রহ থেকে,বিদেশী এবং গার্হস্থ্য নেটওয়ার্ক থেকে ও বিশ্বের বিশাল ভূগর্ভস্থ এবং সমুদ্রের নিচে থাকা কেবলগুলির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক কমিউনিকেশন বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণের কাজ করত । মার্কিন সিস্টেমগুলি বিশাল আকারের ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মতো কাজ করতে শুরু করে যা প্রচুর পরিমাণে ডেটা প্রতি মুহুর্তে সংগ্রহ করত, যা একা মানবের পক্ষে করা সম্ভব নয়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত দেশগুলি সহ শত শত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি সেল ফোন প্রযুক্তিতে সুরক্ষার দুর্বলতাগুলি আবিষ্কার করার এবং নজরদারি করার চেষ্টা করে। ২০১৩ সালের মধ্যে এনএসএ একদিনে ১ বিলিয়ন ফোন কল রেকর্ড করছিল এবং PRISM একে ক্ষমতা দিয়েছিল রিয়েল টাইম ডিজিটাল কথাবার্তা শোনার। ২০১৪ সালের মধ্যে এটি বিশ্বজুড়ে প্রতিদিন ২০০ মিলিয়ন টেক্ট মেসেজ সংগ্রহ করে একজন মানুষের অবস্থান, পরিচিতি এবং ক্রেডিট কার্ডের বিশদ সম্পর্কিত ডেটা আহরণের কাজ করতে থাকে। পুরো এই বিষয়টির মোটো ছিল, ” Everybody’s a target; everybody with communication is a target”।

এনএসএ এবং জিএইচকিউ-র দ্বারা প্রচুর পরিমাণে ইন্টার্সপ্ট যুক্তরাষ্ট্রে এবং যুক্তরাজ্যের মধ্যে ব্যতীত বিশ্বজুড়ে শক্তিশালী শোনার পোস্টগুলির দ্বারা পেত। সাইপ্রাসে একটি ব্রিটিশ লিসেনিং পোস্ট বেইজিং বিমানবন্দরে বিমানের অবতরণ শুনতে পেত যা পুরানো দিনগুলির তুলনায় একেবারে বিপরীত ছিল যখন ক্লিনার, ফটোকপি ইঞ্জিনিয়ার এবং টেলিফোন লাইনম্যান হিসাবে থাকা এজেন্টদের দ্বারা অফিসে এবং বাড়িতে ট্রান্সমিটার ও বাগ লাগানো হত। এনএসএ এবং জিএইচকিউ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় গুপ্তচর সংগঠন হয়ে উঠেছিল, যা পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় কথোপকথনকে গোপনে শুনতে সক্ষম হয়েছিল। শুধুমাত্র মার্চ,২০১৩ তেই ৯৭ বিলীয়ন তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছিল। কি ভয়ঙ্কর!! স্বয়ং ভগবান ও ভয় পেতে বাধ্য।

একটি ছোট কোম্পানি যার নাম SDL Government, এমন একটা সফটওয়ার তৈরি করেছিল যা মুহূর্তেই হাজারো টুইটার ও ফেসবুক পোস্টকে ইংলিশে অনুবাদ করে তার মধ্যে আতঙ্কবাদী হামলা বা সাইবার ক্রাইমের ক্লু খুঁজতে পারতো।

২১ শতাব্দীর পুঁজিবাদের এক বড় উদাহরন ছিল মার্কিন ভোট যখন ফেসবুক ও ক্যামব্রিজ আনালিটিকা ডোনাল্ড ট্রাম্প কে ভোটে জিততে সাহায্য করেছিল। এই পুঁজিবাদের কারখানায় যে পণ্য তৈরি হয়েছিল, তা ছিল একজন মার্কিন রাষ্ট্রপতি। ক্যামব্রিজ আনালিটিকা ভারত থেকেও প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করেছিল এবং সেগুলো হইতো এখন অন্যান্য গুপ্তচর সংস্থার কাছে। এইসব তথ্য গুলো ব্যাবহার করেই ভোটে কারচুপি করা হয়, ভুয়ো খবর ছড়ানো হয় এবং গুপ্তচর তৈরি করা হয়। এই সংস্থার পেরেন্ট সংস্থা, যার নাম SCL, তাদের হাতে ব্রিটিশ ডিফেন্স মিনিস্ট্রির অধীনে থাকা তথ্যের অ্যাকসেস ছিল এবং ২০১২ এ তারা ১৫ সাইকোলজিকাল অপারেশন গ্রুপ নামক সেনাবাহিনীর একটি গ্রুপকে ট্রেনিং দিয়েছিল।

এবার একেকজন মানুষের সম্মন্ধে যে এত তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলো দিয়ে কি লাভ হল? কমার্শিয়াল কোম্পানি গুলো এগুলো দিয়ে তাদের ক্রেতার সংখ্যা বাড়াবে, ক্রেতার পছন্দ অপছ্দের বিচার করে। এই তথ্য গুলো বাজারে রীতিমতো চড়া মূল্যে বিক্রি করা হয়। ক্রিমিনালরা ব্ল্যাকমইল, চুরি, জালিয়াতির জন্য এই তথ্য ব্যাবহার করে। আতঙ্কবাদিরা তাদের বিভিন্ন কাজে এগুলো ব্যাবহার করে। বিভিন্ন দেশ তাদের শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে এগুলো ব্যাবহার করে।

ইন্টারনেট ব্যবহারকারী গ্রাহক নয় বরং বাজারে বিক্রি করার পণ্য

ডেমোগ্রাফিক্স হ’ল বয়স, লিঙ্গ, জাতি এবং এগুলোর সাথে সম্পর্কিত ডেটা যা বিভিন্ন দেশ বিদেশের সরকার, এনজিও এবং বেসরকারী কর্পোরেশনগুলি বাজার গবেষণা এবং নীতি নির্ধারণের জন্য ব্যবহার করে। মনোবিজ্ঞান আরও বিস্তারিত এবং ব্যক্তিগত একটি বিষয়। এটি হ’ল ব্যক্তিত্ব, মতামত, আগ্রহ, জীবনধারা, অভ্যাস এবং পছন্দসমূহের অধ্যয়ন। সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মগুলি এই ডেটা সংগ্রহ করে, এটি বিশ্লেষণ করে তা বিক্রিও করে। উদাহরণস্বরূপ একজন ফেসবুকের ব্যবহারকারীর জন্য গড় আয় ৫.২ ডলার ধরা হয়েছে এবং এই কমিউনিটি বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখন বাজারে এমন ডেটা ব্রোকার রয়েছে যার একমাত্র মিশন এই ডেটা সংগ্রহ করে বিক্রয় করা।

এই তথ্য সমস্ত সম্ভাব্য উত্স থেকে সংগ্রহ করা হয় – সরকারী রেকর্ড, আদালত মামলা, বিবাহ, জন্ম, মৃত্যু এবং বিবাহবিচ্ছেদ রেকর্ড, ড্রাইভিং লাইসেন্স, পেশাদার রেকর্ডস, চিকিত্সার বিবরণ, প্রতিটি সম্ভাব্য ওয়েব ব্রাউজিং ক্রিয়াকলাপ, ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারের বিশদ, ছুটির গন্তব্য ইত্যাদি। এই সমস্ত তথ্য বিশ্লেষণ করা, একীভূত করা এবং অজানা সংস্থাগুলির কাছে বিক্রি করার জন্য ব্যক্তিগত এবং সামাজিক প্রোফাইলগুলিতে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়। গোপনীয়তা শব্দটির খুব কম বাকী আছে আজকের দিনে।

যাঁরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন তারা হলেন সেলুলার নেটওয়ার্কের ব্যবহারকারীরা। সেলুলার নেটওয়ার্কগুলি ডিভাইসের অবস্থানের আপ-টু-মিনিটের রেকর্ড এবং আগত এবং বহির্গামী যোগাযোগের লগগুলি বজায় রাখে। সরকারগুলি প্রায়শই পরিষেবা সরবরাহকারীদের কাছ থেকে রেকর্ড অনুসন্ধান করে তবে পশ্চিমে এই তথ্যগুলো এখন সরকারী এজেন্সিগুলিতে বা অর্থ প্রদানে ইচ্ছুক যে কোনও ক্রেতার কাছে বিক্রয়ের জন্য উপলব্ধ।

আমাদের মধ্যে অনেকেই হইতো ভেবে দেখেছি যে কিভাবে আমাদের জিজ্ঞাসা না করেই রেস্তোঁরা, ছুটির গন্তব্য এবং ঔষধের বিজ্ঞাপন ইমেইল রূপে আমাদের মেলবক্সে নিয়মিতভাবে আসতে থাকে। আমরা কি এতই জনপ্রিয় হতে উঠেছি? পশ্চিমে একটি অত্যন্ত প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসা রয়েছে যা এতে বিশেষী এবং এই ব্যবসাটি ভারতে পৌঁছতে শুরু করেছে। এটি পুরোপুরি স্পষ্ট যে তথ্য যুদ্ধে ডেমোগ্রাফিক এবং সাইকোগ্রাফিক্সের ব্যবহার নতুন সাধারণ ব্যাপার।

সাইবার অপরাধী, সন্ত্রাসবাদী সংগঠন, এমনকি বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলির এই ডেটাতে অ্যাক্সেস রয়েছে। চীন এবং রাশিয়া উভয়ই তাদের তথ্য যুদ্ধের প্রচার চালানোর জন্য সিস্টেমগুলি ভালভাবে তৈরি করেছে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় কৌশলগত তথ্যযুদ্ধ চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে। অভিযোগ করা হয়েছিল যে ভোটে প্রচারের সময় সাইবার অপারেশনগুলির মাধ্যমে প্রাপ্ত ডেটা প্রকাশ করা হযেছে এবং রাশিয়ান গোয়েন্দা ব্যবস্থা দ্বারা গোপন প্রচারগুলি অবহিত করেছে এবং নির্বাচনী প্রচারকে সক্ষম করেছে।

গুগলের ব্র্যান্ডের মূল্য আজ ৮২ বিলিয়ন ডলার।যখন গ্রাহক গুগল, ইউ টিউব, ফেসবুক বা টুইটারকে পরিষেবাগুলির জন্য কিছুই দেয় না, তখন অর্থ কোথা থেকে আসে? একটি ব্যাখ্যা হতে পারে যে এগুলি হ’ল মেগা জনহিতকর সংস্থা যা এই ক্রমবর্ধমান প্রযুক্তিগত বিশ্বে মানবতার প্রয়োজনে এমন পরিষেবা সরবরাহ করে তবে মুক্তবাজার পুঁজিবাদের কার্যকারিতার ব্যাখ্যা হিসাবে কেউ এটিকে গ্রহণ করবে না। যেখানে মানুষের আগ্রহ আছে, সেখানে দরকষাকষি হতেই পারে; এটি অ্যাডাম স্মিথিয়ান তত্ত্ব। বাস্তবতাটি হ’ল ব্যবহারকারী গ্রাহক নয় বরং পণ্য। এটি কিভাবে কাজ করে তা মার্ক গুডম্যান দ্বারা অত্যন্ত ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

প্রদত্ত প্রতিটি পরিষেবাদি নিজের জীবন সম্পর্কে ডেটা প্রকাশ করার জন্য ব্যবহারকারীদের নানাভাবে বিভ্রান্ত ও লালায়িত করে। এটি বেশ সাধারণ ভাবেই শুরু হয় তবে তারপরে ইন্টারনেটে ব্যবহারকারীর দ্বারা করা প্রতিটি অনুসন্ধান, প্রতিটি লিঙ্ক ক্লিক করা, উত্থাপিত প্রতিটি প্রশ্নের গুগল সংরক্ষণাগারগুলিতে সংরক্ষণ করা হয়। পাঠানো এবং প্রাপ্ত সমস্ত মেল রেকর্ড রক্ষণ করা হয়। ব্যবহারকারীর প্রোফাইলগুলি নিয়ন্ত্রণ ও পরিমার্জন করা হয়। গুগল যখন অনলাইনে যোগাযোগ তালিকাগুলি সঞ্চয় করার সুযোগ প্রবর্তন করে, তখন এটি কোনও ব্যক্তির সামাজিক নেটওয়ার্কের আকার, ক্রয় ক্ষমতা প্রভৃতি মূল্যায়ন করে। এর নিখরচায় জিপিএস সহ গুগল ম্যাপ পরিদর্শন করা স্থানগুলির ট্র্যাকিং সক্ষম করে; গুগল ভয়েস যেকোন নাম্বার বা নাম পরীক্ষা করতে পারে এবং ভয়েস মেইল ​​বার্তাগুলি ভয়েস স্বীকৃতি এবং ভয়েস ট্রান্সক্রিপশন সফ্টওয়্যার দিয়ে প্রতিলিপি করতে পারে।

ফ্রি অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং পরিষেবা গুগলকে তাদের স্মার্টফোনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের ট্র্যাক করতে সক্ষম করে। সমস্ত প্রশ্ন, ইমেল, ভয়েসমেইলস, ফটোগ্রাফ, মন্তব্যসমূহ এবং অবস্থানগুলি ২০১২ সালের পর থেকে আরও নিয়মতান্ত্রিকভাবে এবং সম্পূর্ণরূপে সঞ্চিত এবং বৈশিষ্ট্যযুক্ত হয়েছে, যখন এটি ঘোষণা করেছিল যে এটি তার পণ্যগুলি থেকে সমস্ত তথ্য এক কেন্দ্রীভূত স্থানে মার্জ করছে। গুগল কোনও ব্যক্তি তার ফোনের চারপাশে থাকা সমস্ত কথোপকথনের ভয়েস রেকর্ড করতে এবং রাখতে পারে। এমনকি সাধারণ কথোপকথনগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে রেকর্ডিং ফাংশনটিকে সক্রিয় করতে পারে। ফেসবুক এনক্রিপশন প্রবর্তন করার পরিকল্পনা করেছে তবে এমনভাবে যাতে এটি বার্তাগুলি পড়তে সক্ষম হয়। ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা সংস্থাগুলি দ্বারা পরিচালিত সমস্ত অনুসন্ধানগুলি আকাশে একটি বড় কম্পিউটার অ্যালগরিদমের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হয়, পেটাবাইটগুলিতে একত্রিত হয়ে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে এগুলো মুক্ত বাজারে বিক্রি করা হয়। সত্যই গুগল কিছু ভুলে যায় না এবং গুগল কিছু মুছে দেয় না।

অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়া সাইটের বিষয় আশয় একই রকম। বেশিরভাগ ব্যবহারকারী যা পড়েন না তা হ’ল পরিষেবার শর্তাদি যা প্রতিটি ওয়েবসাইট বা পরিষেবা নির্ধারিত করে, প্রায়শই গোপনীয়তা রক্ষার তথাকথিত স্বার্থে। অসম্পর্কিত ব্যবহারকারী দীর্ঘ এবং সংশ্লেষিত সূক্ষ্ম মুদ্রণের দিকে খুব কম মনোযোগ দেয়। ৫০ টি পৃষ্ঠার একটি নথিতে ছোট ফন্ট, একক ব্যবধানযুক্ত পাঠ্য এবং মার্জিন বেশিরভাগের পড়তে ভাল লাগে না। কার্নেগি মেলন বিশ্ববিদ্যালয় গণনা করেছে যে কোনও আমেরিকান যদি সাধারণভাবে ব্যবহৃত পণ্যগুলির পরিষেবার শর্তাদি পড়েন তবে তার বছরে ৭৮১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে ৭৬ কার্যদিবসের ক্ষতি হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল গণনা করেছে যে এই ওয়ান সাইডেড নীতিগুলি আমেরিকান পরিবারকে বছরে ২৫০ বিলিয়ন ডলার প্রতারণা করে। তা সাত্ত্বেও, ইন্টারনেট জনপ্রিয় হয়।

গোপনীয়য়তার আরও একটি গুরুতর দিক রয়েছে যা কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। ব্যবহারকারীদের ক্রমবর্ধমান ট্র্যাকিংয়ের ফলে উদ্ভূত গোপনীয়তা সম্পর্কিত উদ্বেগ সম্পর্কে মন্তব্য করতে জিজ্ঞাসা করা হলে গুগলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এরিক স্মিথ মন্তব্য করেছিলেন, “আপনার যদি এমন কিছু থাকে যা আপনি কারও কাছে জানাতে না চান, তাহলে সম্ভবত আপনার সেই কাজটি করা উচিত নয় “। উদাহরণস্বরূপ ফেসবুকের বেশ কয়েকটি বছর আগে ১৭০ টি বিকল্প সহ ৫০ টির মতো বিভিন্ন গোপনীয়তার সেটিংস ছিল। ফেসবুকের সিইও মার্ক জুকারবার্গের অনুরূপ মন্তব্য হয়েছিল যখন তিনি বলেছিলেন যে “গোপনীয়তা এখন আর সামাজিক নিয়ম নয়”।

এইসব আমেরিকান সংস্থাগুলির কথা খুব কম লোকই শুনেছে – Acción, Épsilon,Datalogix, RapLeaf, Reed Elsevier, BlueKai, Spokeo এবং Flurry। এগুলি এবং আরও কয়েকটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান ডেটা নজরদারি শিল্পের অংশ এবং তারা বার্ষিক ১৫৬ বিলিয়ন ডলারের ব্যবসায়িক উত্পাদন করে। এটি মার্কিন সরকার তার গোয়েন্দা যন্ত্রপাতিতে ব্যয় করা পরিমাণের দ্বিগুণ। এই সংস্থাগুলি কর্পোরেট বিশ্বে অবকাঠামো, সরঞ্জাম এবং উপলভ্য কৌশল নিয়োগ করে; তারা যে কোনও নাগরিকের জীবনে নজর রাখতে পারে এবং সম্ভবত তাদের কংগ্রেসের তথা পার্লামেন্টের অনুমোদনের দরকার নেই।

শেষের কথা…

বর্তমান সময়ে দাঁড়িয়ে গোপনীয়তা বা প্রাইভেসি একটি ইতিহাস। আমরা যাই করি না কেন, প্রতিমুহূর্তে বিশ্বজুড়ে হাজারো চোখ সেগুলো দেখছে, সেগুলোর ওপর নজর রাখছে। আজকের দিনে তাই সবাই জনপ্রিয়। প্রযুক্তির বাজারে এক একজন মানুষকে হাজারো বার কেনা হচ্ছে, বিক্রি করা হচ্ছে, অথচ কেউ কিছু জানতে পারছে না। মানবতা আজকাল পণ্য সামগ্রী হয়ে গেছে। আমাদের পকেটে সর্বদা মোবাইল নামক বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী গুপ্তচর আমাদের ওপর নজর রেখে চলেছে, কি করছি, কি খাচ্ছি, কি পড়ছি, তিনি সবই দেখছেন। ঈশ্বরত্ব এক নতুন মানে পেয়েছে বর্তমান বিশ্বে। তাই শেষও করতে হবে জর্জ অরওয়েলের সেই বিখ্যাত উক্তি দিয়ে, ” The big brother is watching you”.