‘পলান্ন, মাংসদন’ অপভ্রংশ ‘বিরিয়ানি’

0
618

পঞ্চম পর্বের পর

কুমারসম্ভবম্

অধ্যায় ৭ — রজস্তম ইতি গুণাঃ পলান্ন

মনুষ্য তিন প্রকার, অর্থাৎ ত্রিগুণের সমাহার বা গুণত্রয় — এই ত্রিগুণের ফলেই মনুষ্য জীবনে মান-অভিমান, নিষ্কাম প্রেম-সকাম প্রেম, মোহ, আসক্তি, কামশক্তি উৎপত্তি হয়ে জীবাত্মাকে আবদ্ধ করে।

যথা সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ।

পরমাত্মা ঈশ্বরের ব্রহ্ম শক্তিতে উৎপন্ন সারা বিশ্বের সমস্ত জীবজগৎ সমগ্র বিশ্ব তথা প্রকৃতি সম্ভূত গুণসমূহে কি ভাবে আবদ্ধ হয় সেই সম্পর্কে পুরুষোত্তম বাসুদেব শ্রী কৃষ্ণ শ্রীমদ্ভাগবত গীতায় বলেছেন —

सत्त्वं रजस्तम इति गुणा: प्रकृतिसम्भवा:।
निबध्नन्ति महाबाहो देहे देहिनमव्ययम् ॥१४, ५॥

সত্ত্বং রজস্তম ইতি গুণাঃ প্রকৃতিসম্ভবাঃ।
নিবধ্নন্তি মহাবাহো দেহে দেহিনমব্যয়ম্ ॥১৪, ৫॥
অর্থাৎ,
জড় তথা স্থূল্‌ (স্থুল্‌) শক্তি তিনটি গুণের সমন্বয়ে গঠিত, যথা – সত্ত্ব (ধার্মিক), রজঃ(অহঙ্কারী), এবং তমঃ(অজ্ঞতা)। এই গুণ বা চারিত্রিক বৈশিষ্ট চিরন্তন অবিনশ্বর আত্মাকে নশ্বর দেহের সঙ্গে আবদ্ধ করে।

এই তিন গুণের অধিকারীদের যথাক্রমে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক বলা হয়; তাঁদের খাদ্যও সেই প্রকারের হওয়া বাঞ্ছনীয়। প্রাচীন ভারতবর্ষের আয়ুর্বেদশাস্ত্র সেই খাদ্যের নানা বর্ণনা দিয়েছে যা মহাভারতীয় তথা তৎপূর্ব রামায়ণীয় যুগে বর্ণিত হয়েছে।

সদোপবাসী মনুষ্য সাধারণতঃ দুবার ভোজন করে থাকেন — দিবাভাগে মধ্যাহ্ন ভোজন ও রাত্রে নৈশভোজ। মহাকাব্য মহাভারতেও উল্লিখিত প্রধান খাদাদ্রব্যের মধ্যে ব্রীহি (ধান্য) ও যব প্রধান খাদ্য বলে বিবেচিত — যথা, ব্রীহিরসং যবাংশ্চ।

রামায়ণ মহাকাব্যে অন্যান্য খাদাদ্রব্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল …. মৎস, পলল, দুগ্ধ, দধি, ঘৃত, গুড়, পিঠা, অম্ল, নানাবিধ ফলমূল এবং মশলা ইত্যাদি সহযোগে প্রস্তুত আচার ও বিভিন্ন রকমের শাকসবজি প্রভৃতি। মহাভারতে দেখা যায়, চতুর বর্ণাশ্রমের মানুষ যথা শূদ্র, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য নির্বিশেষে প্রায় সকলেই সব রকমের পলল (মাংস) আহার করতেন। যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞে ব্রাহ্মণদের মৃগ (হরিণের) ও বরাহ (শূকরের) মাংস পরিবেশন করা হয়েছিল। বনবাসের সময় পাণ্ডবদের অন্যতম প্রধান খাদ্যও ছিল পলল এবং পলান্ন।

অধ্যায় ৮ — অন্নদামঙ্গলের সঘৃত পলান্ন

১৮৫৩ সনে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায় মহাশয় রচিত অন্নদামঙ্গল কাব্যে তিনি একাধিক স্থানে ‘পলান্নের’ উল্লেখ করেছিলেন।

অন্নদামঙ্গল কাব্যের‘শিবে অন্নদান’ অংশে তিনি দেবী অন্নপূর্ণার দেবাদিদেব মহাদেব শিবকে অন্ন পরিবেশনের বর্ণনা করেছেন:-

“অন্নপূর্ণা দিলা শিবেরে অন্ন।
অন্ন খান শিব সুখ-সম্পন্ন॥
কারণ অমৃত পুরিত করি।
রত্নপাত্র দিলা ঈশ্বরী॥
সঘৃত পলান্নে পুরিয়া হাতা।
পরশেন হরে হরিষে মাতা॥
পঞ্চমুখে শিব খাবেন কত।
পুরেন উদরে সাধের মত্॥”

তৎপর অন্নদামঙ্গল কাব্যের ‘অন্নপূর্ণাবন্দনা’ অংশেও ‘পলান্নের’ উল্লেখ পাওয়া যায়।

যথা:-

“রত্ন হাতা ডানি হাতে সঘৃত পলান্ন তাতে –
কিবা দুই ভুজ সুললিত॥”

উক্ত উদ্ধৃতি থেকেও এটা স্পষ্ট হয় যে ‘পলান্ন’ শব্দের অর্থ — ‘পলল’ (বিশেষ্য পদ) মিশ্রিত অন্ন কারণ ‘পলল বা পল’ শব্দের প্রাথমিক অর্থ হল মাংস।

অধ্যায় ৯ — বিদ্যাসাগরীয় হরিণং পলায়

১৮৯০ সনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত ‘শ্লোকমঞ্জরী’ গ্রন্থেও ‘পল’ শব্দের উদ্ধৃতি লক্ষ্যণীয়:-

মুক্তাফলায় করিণং হরিণং পলায়,
সিংহং নিহন্তি ভুজবিক্রমসূচনায়।
কা নীতিরীতিরিয়তী রঘুবংশবীর
শাখামৃগে জরতি যত্তব বাণমোক্ষঃ (১) ॥৫৩॥

অর্থাৎ —
স্বীয় সহোদর সুগ্রীবকে কপিরাজ্য থেকে নির্ব্বাসিত করার ফলে রামবাণে ভূপতিত কপিরাজ বালী প্রভু শ্রীরাম চন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেন –
যেমন মুক্তাফলের বিক্রম সূচনার জন্য তথা
পলল (বা মাংসের) আহরণ হেতু সিংহ হরিণ শিকার সম্পন্ন করে,
তেমন, কোন কারণে প্রভু শ্রীরাম চন্দ্র তাকে বাণবিদ্ধ করে
প্রাণবধ করেন?

চলবে