দেশভাগের খাবার

দেশভাগ আমি চোখে দেখিনি। ঠাকুরদা ছিলেন ঢাকা রামকৃষ্ণ মিশনের ইংরেজি টিচার। বলার মতন বিঘে বিঘে জমি কিংবা ঘড়া ঘড়া  সোনা, কোনটাই ছিল না। ছিল না তাই রক্ষে, নইলে ফেলে আসতে হত। থাকার মধ্যে ছিল বসত ভিটাটুকু আর কুলদেবীর মূর্তি। দেশ ছাড়ার সময় বলার মতন তেমন কিছুই আনতে পারেননি হাতে করে। আলাদিনের প্রদীপ থাকলে হয়তো ভিটা-টাকেই উড়িয়ে এনে এপারে স্থাপন করে দিতেন। যদিও আলাদিন নাম হলে তো আর ঘর ছাড়তেই হত না।

তবে হিন্দুর কাছে ভিটার টান বড় টান। ভিটা আনতে না পারলেও নস্যির কৌটায় করে এসেছিল ভিটাবাড়ির এক খাবলা মাটি। ভারতের মাটি ছোঁয়া অব্দি আগলে আগলেই এসেছিল সেসব। ভারতে এসে ঠাকুমা আতান্তরে পড়লেন। ঠাকুরদা তো পুরুষ মানুষ, সকাল হতে না হতেই বেরিয়ে পড়েন বাইরে। বাড়িতে থাকেন ঠাকুমা আর এক ডজন ছেলেপুলে। সর্বক্ষণ তাদের খাই খাই, অথচ ঘরে তেমন খাবার নাই। আর বাড়িতে খাবার না থাকলেই খিদেটা বেশি পায়।

এত এত বাচ্চা-কাচ্চা, না খাইয়ে তো রাখতে পারেন না। সবই মা ষষ্ঠীর দান। কিন্তু মা ষষ্ঠীর দয়া থাকলেও, মা লক্ষ্মীর কৃপা নাই। রেশনের চাল আসে, তবে সে চালে প্রচুর কাঁকর, ভাত-ও লাল লাল, মোটা মোটা। তা যতই মোটা ভাত হোক, লেবু ভাত কি নুন ভাত কতক্ষন আর পেটে থাকে। বাড়ন্ত পেট সব। তাই ভাতের ফ্যান-ও ফেলা যেত না। নুন-লেবু-লঙ্কা সেই ফ্যানে গুলে তৈরি হত ‘’ফ্যানের শরবত’’। খিদে পেটকে এক পলকে ঠাণ্ডা করে দিত সেই টক-ঝাল ‘’ফ্যানের শরবত’’।

রোজকার বাজারে কোনোদিন বাড়িতে ঢুকত 6 টা ডিম, কোনোদিন অল্প কিছু সবজি আর রোববারে কিছু কুচো মাছ। ডিম জিনিসটা ছেলেমেয়েদের খুব প্রিয়, কিন্তু 6-7 টা ডিমে 14-15 টা মানুষের দুবেলার খাবার হবে কেন? ঠাকুমা বুদ্ধি বের করলেন, ডিমের সাথে মিশালেন ময়দা, ডিম-ময়দা গুলে ডিমভাজা করতেই মামলেটের সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণেরও কিছু বেশি হল। সেই মামলেটের ঝোল ছেলেমেয়েদের দিনের বরাদ্দ, 6 টা ডিমের 14 খানা মামলেট। প্রতি বেলায় সবার ভাগে আধখানা করে।

ময়দা মিশিয়ে মামলেট বাড়ানোর বুদ্ধির পরেই রান্নাঘরে খাবার বাড়ানোয় ঠাকুমা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলেন। আলুর চোকলা, কুমড়োর চোকলা, পটলের খোসা বেমালুম ভাজা হয়ে যেত। ডালের সাথে ভাতের পাতে “খোসা ভাজা”। কিংবা শিলনোড়ায় বেটে তৈরি হত ঝাল ঝাল খোসা ভর্তা। এমনি করেই ব্যবহার হয়ে যেত ফুলকপির ডাঁটা, কুমড়োর বীচি, কাঁচকলার খোসা। ফুলকপির ডাঁটার চচ্চড়ি হত, কুমড়ো বীজের ভাজা তরকারি আর কাঁচকলার খোসা বাটা। রান্নাঘর-টাকে সত্যিই “কিছুই_যায়_না_ফেলা” করে তুলেছিলেন ঠাকুমা।

অবশ্য এক্কেবারে একদম_কিচ্ছু_না দিয়েও কিছুমিছু রান্না করার ওস্তাদ ছিলেন আমার ঠাকুমা। কোন সবজি ছাড়াই বানাতেন “সর্ষের টক”। সর্ষে-শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে তেতুলের ক্কাথ-এর ঝোল। লঙ্কার ঝোল বা লেবুপাতার ঝোল-ও করতেন একই ভাবে। যে পাতা বাটা যায়, সেটা শিলে পেষাই। যে পাতা ভাজলে ভাল, সেটা ভাজায়। আর যেটা বাটাও যায় না, ভাজাও যায় না, কেবল গন্ধ ছড়ায়, সে পাতার ঝোল।

আর যদি কোনোদিন বাড়িতে নারকেল এসে পড়ল, তাহলে তো সেটা রান্নাঘরে পড়তে পেত না। একখানা নারকোলে এক কিলো আলু মিশিয়ে, অমনি হয়ে যেত আলু-নারকোলের তরকারি। বাঁধাকপি বা ফুলকপি আসত মোটে একটা কি দুটো, তা দিয়ে এতজনের কুলোবে কিভাবে? কুচি কুচি করে বাঁধাকপি কেটে বড়া বানিয়ে তার ঝোল করে ফেলা হত। একটা দিয়েই সবার সুন্দরভাবে হয়ে যেত। একটুখানি জিনিসকে বাড়িয়ে বাড়িয়ে কিভাবে এতখানি করতে হয়, সেটাও শেখার মতন করে শিখে ফেলেছিলেন ঠাকুমা।

ঠাকুরদা-ও কম যেতেন না। দৈনিক বাজারের যে টাকা থাকত, তাতে মাছ-মাংস তেমন হয় না। আর বড় মাছের যা দাম, সেই টাকায় প্রত্যেকের এক টুকরো মাছ হওয়া সম্ভব না। খুব সরু সরু ফালি করে মাছ কাটলেও নয়। তাই ঠাকুরদা আনতেন খালি ছোট মাছ, কম হোক তবু দু-চার পিস সকলের মুখে তো পড়বে।

মাংস খুব প্রিয় ছিল ঠাকুরদার। তবে মুরগি ঢোকা তো নিষিদ্ধ বাড়িতে, আর পাঠার মাংস মহার্ঘ্য। তাই ঠাকুরদা আনতেন পাঠার চর্বি, প্রায় ফেলে দেওয়ার দামে। সেই চর্বি ডালে পড়ত, চর্বি ভেজে বড়া হত, আলু-চর্বির তরকারি হত; তেলতেলে চর্বি খেয়ে ছেলেমেয়েদের-ও পেটগুলো ভরা ভরা থাকত। আর মাঝে মাঝে আসত পাঠার মাথাটা, এসব কেউ খেত না তখন। সেই মাথার লোম-চামড়া ছাড়িয়ে, কাটারী দিয়ে টুকরো টুকরো করে গরম জলে সেদ্ধ বসানো হত। রান্নার আগে সেদ্ধ করতেই হত কারণ পাঠার মাথার ভিতরে অনেক সময়েই পোকা থাকে। জল ফুটতে শুরু করলেই পোকা গুলো বেরিয়ে জলের উপর ভেসে উঠত। তারপর সে জল ফেলে, ভাল করে ধুয়ে, “মুড়োর ঝোল” রান্না হত। কখনো আবার মুড়োর ডাল। সেসব দিনে বাড়িতে লোকে দুবার ভাত বেশি খেত।

কখনো মুড়ো না পাওয়া গেলে আনতে হত পাঁঠার পায়াগুলো, দুটো কিংবা চারটে। সে পায়ার টুকরো ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র করলেও, তাতে এতগুলো মানুষের দুবেলা হবার নয়। তাই সে পায়া ছাড়িয়ে অনেকক্ষণ সেদ্ধ করার পর, নামিয়ে মিহি করে বেটে আবার তার ঝোল করা হত। ঠাকুমা বলতেন, ‘’হাড় গলা রস’’। পিসিরা বলতেন ‘’হাড়ের ঝোল’’। এইরকম সব নাম না জানা নতুন আবিষ্কার রাঁধতে রাঁধতেই নাবালক থেকে সাবালক হয়ে উঠল গোটা পরিবার।

টানাটানির সংসার সামলাতে সামলাতে আরো যে কত নতুন রান্না বানিয়েছিলেন ঠাকুমা, সেসবের আর আজ হিসেব নেই। অভাবের উপরেও যে নিজের প্রভাব খাটানো যায়, ঠাকুরদা-ঠাকুমা মিলে সেটা দেখিয়ে গিয়েছেন। ওলটপালট করে দেওয়া অঘটনগুলো সবকিছু শেষ করতেই আসে, তবে তারই মধ্যে আবার দু-চার কুচি ছেড়ে দিয়ে যায়। ভিটাছাড়া হবার স্মৃতি দুঃস্বপ্নের মত। হাহাকার, বেদনা, কান্না; প্রাপ্তি বলতে নতুন এই কয়টা রান্না। প্রয়োজন আর জরুরি দরকার, এই দুয়ের চাপেই তৈরি হয় নতুন নতুন আবিষ্কার। তাই দেশভাগের খবরগুলোর সাথে সাথে “দেশভাগের খাবার” গুলো-ও যোগ করে রাখা চাই।