লোকসভায় রাফাল বিতর্ক: কয়েকটি পর্যবেক্ষণ

0
898

গত ০৪.০১.২০১৯ (ইং) তারিখে লোকসভায় রাফাল যুদ্ধবিমান চুক্তি সংক্রান্ত বিতর্কে কেন্দ্রের শাসক দলের বেশ কিছু এমপি তথা ক্যাবিনেট মন্ত্রী যেরকম আগ্রাসী ভঙ্গিতে কংগ্রেস-সহ বিপক্ষের প্রশ্নসমূহের প্রত্যুত্তর দিলেন, তা দেখে দেশবাসীর কিছুটা আশ্বস্ত লাগবে ব’লে মনে করি। একথা সত্য যে প্রশ্নগুলি ছিল বালখিল্য, যুক্তি-এবং-তথ্য-রহিত, সেগুলি তোলবার অভিপ্রায় যে দেশবাসীকে বিভ্রান্ত ক’রে আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে অনুষ্ঠিত শেষ সংসদ অধিবেশনের অপব্যবহারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ফায়দা তোলা সেকথা বুঝতেও সমস্যা হয় না; তাই ব’লে শাসক দলের এমপি-মন্ত্রীরা (বিশেষ ক’রে উল্লেখ করা চলে প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রীমতী নির্মলা সীতারামন, অর্থমন্ত্রী শ্রী অরুণ জেটলি এবং এমপি শ্রী অনুরাগ ঠাকুরের কথা) যে ধৈর্য, অনুপুঙ্খতা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে সেসবের উত্তর দিয়েছেন সেজন্য তাঁদের ফুল মার্কস দেওয়াই যায়।

তবে সদ্য সমাপ্ত কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির যা ফলাফল দেখা গেছে, তার অভিঘাত থেকে মুক্ত হবার পক্ষে এই আগ্রাসন অকিঞ্চিৎকর ঠেকে। এর কারণ, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ এবং অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা অভিযোগ-নির্ভর প্রচার বেশ কিছুকাল হ’ল এদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এমত পরিস্থিতিতে কেবল আত্মরক্ষা করবার মাধ্যমে এই দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে কেউ টিকে থাকবার আশা করলে তা মূঢ়তা হবে। কেবল আত্মরক্ষার স্বার্থেও দেখতে গেলে দেখা যাবে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করবার সঙ্গে সঙ্গে সমানতালে আক্রমণ শানানোটাও সমান জরুরি। সেই আক্রমণের জন্য প্রথমে নিজেরা আক্রান্ত হওয়া অব্দি অপেক্ষা করলে চলবে না – বরং আক্রমণ চালিয়ে যাওয়াটা একটা সক্রিয়, তৎপর প্রক্রিয়া হওয়া চাই। এতে শত্রুকে দু’হাত দূরে ঠেকিয়ে রাখা যায়।

লোকসভার ভিতরে শাসক দলের পক্ষ থেকে এইরকম রাজনৈতিক আক্রমণ শানাবার সুযোগ কম থাকতে পারে, কিন্তু সংসদের বাইরে লাগাতার রাজনৈতিক আক্রমণ চালিয়ে যেতে তো কোনো অসুবিধে থাকার কথা নয়। বর্তমান এনডিএ সরকার যদি নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বজায় রাখতে চান, তাহ’লে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এই ধরণের রাজনৈতিক আক্রমণ হানবার জন্য শাসকদল তথা এনডিএ-র হাতে ন্যাশনাল হেরাল্ড, অগুস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড, বোফর্স, সাবমেরিন কেলেঙ্কারি, জিপ কেলেঙ্কারি, ডিএলএফ কেলেঙ্কারি ইত্যাদি নানা হাতিয়ার ইতিমধ্যেই রয়েছে। দেশবাসীকে সদাসর্বদা কংগ্রেসের এই সমস্ত কুকীর্তির কথা স্মরণ করিয়ে ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যাওয়াটা বিজেপির রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজির অঙ্গ হবার কথা ছিল। ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের লোকসভা নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে শাসক দলের প্রথম সারির নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে সেরকম আগ্রাসন খুব একটা দেখা যায়নি। এর কারণ বোঝা শক্ত। হ’লটা কি? ক্ষমতা পেয়ে এঁরা কি আত্মতুষ্ট হয়ে পড়লেন? নাকি বর্তমান সরকারে আসীন কিছু ব্যক্তিবর্গের টুঁটি-টিও কংগ্রেসের ‘খানদান’-এর হাতেই ধরা আছে? তার জোরে কি ক্ষমতায় না থেকেও কংগ্রেস কলকাঠি নাড়ছে? এর জেরে কি পিছনের দরজা দিয়ে কি কোনো লেনদেন হয়েছে? এসব সংশয় দেশবাসীর মনে উঠতে বেশি সময় লাগে না।

ফল যা হবার তাই হয়েছে। কংগ্রেস তথা বামেরা এখন বিপক্ষে, ফলে তাঁদের ধর্মই হচ্ছে নিরন্তর আক্রমণ শানিয়ে যাওয়া – এবং সে কাজটি তারা করছেও। গত সাত দশকে এদেশের তথা বিদেশের মিডিয়া এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আপন বশংবদ লোকজনকে গেঁড়ে বসবার সুযোগ ক’রে দেওয়ায় গণতন্ত্রের তথাকথিত ‘চতুর্থ স্তম্ভ’ মিডিয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দ্বিমুখী প্রচারযন্ত্রও মূলতঃ কংগ্রেসেরই হাতে। রাজনৈতিক প্রচারে ও নিজের সুবিধেমত তথ্য লুকিয়ে অথবা দুমড়ে-মুচড়ে পরিবেশন করবার কাজে এই নেটওয়ার্ক অত্যন্ত উপযোগী। এই নেটওয়ার্ক কংগ্রেস এবং বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলির দ্বারা ১৯৪৭-উত্তর প্রায় ছ’টি দশক ধ’রে অতি সযত্নে এবং নিঃশব্দে করে যাওয়া কাজের ফসল। এজন্য তাদের সাধুবাদই প্রাপ্য – আখেরে মহাযুদ্ধে সেই জয়ী হয়, যুদ্ধক্ষেত্রটি যার কাছে হাতের তালুর মতো চেনা। ক্রীড়াজগতের বেলাতেও তাই – খেলোয়াড়ের পক্ষে তার খেলার মাঠটি পছন্দসই হওয়া চাই। কংগ্রেস ও বামপন্থীরা যুদ্ধক্ষেত্র/খেলার মাঠটি নিজেদের সুবিধে অনুযায়ী গড়ে তুলেছে। সে তুলনায় বিজেপির তথা হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলির নেটওয়ার্ক খুবই নগণ্য। যেটুকু রয়েছে তা-ও কংগ্রেস তথা বামেদের ঠিক করে দেওয়ানীতি-নিয়ম মেনেই এই রাজনৈতিক যুদ্ধ-খেলা খেলে থাকে– তা সে তার ব্যাপ্তি এবং প্রসার যতই বিস্তৃত হোক না কেন (আরএসএস-এর কথা মাথায় রেখেই বলছি)।

পারিভাষিকভাবে এই যুদ্ধ কিংবা খেলার নীতি-নিয়মকে ‘ন্যারেটিভ’ আখ্যা দেওয়া হয়ে থাকে। সাদা বাংলায় একে ‘আখ্যান’ বলা চলে – মোটকথা, এটা একরকম গল্প। তবে গল্প ব’লেই একে গালগল্প ভেবে উড়িয়ে দেবেন না – এ জিনিস ভয়ঙ্কর রকম শক্তি ধরে। এতটাই, যে কখনো কখনো সেই গল্প রাষ্ট্রবিপ্লব তথা সমাজবিপ্লব ঘটাতেও সক্ষম হয়ে ওঠে। রাজনীতি এবং চিন্তার জগতে যাঁরা দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন আনতে ইচ্ছুক, তাঁরা দীর্ঘদিন ধ’রে সক্রিয়ভাবে সযত্নে এই ন্যারেটিভ তৈরি ক’রে থাকেন। আবার ন্যারেটিভ শুধু তৈরি করলেই হবে না, সেই ন্যারেটিভকে প্রচারের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া চাই, জনমানসে দৃঢ়ভাবে গেঁথে দেওয়া চাই। কোনো দেশ অথবা অঞ্চলের যথেষ্ট সংখ্যক মানুষ যদি ঐ ন্যারেটিভে বিশ্বাস করতে শুরু করেন, তখন রাজনীতিবিদ্‌ ও চিন্তাবিদ্‌দের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। এইরকম একটি ন্যারেটিভ তৈরি ও তার প্রচারের ভুরি ভুরি উদাহরণ জগতের ইতিহাসে রয়েছে। যখন মার্ক্স এবং এঙ্গেলস ঠিক করলেন যে তাঁরা সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজে প্রয়াসী হবেন, তখন তাঁরা একটা ন্যারেটিভ অর্থাৎ গল্প খাড়া করলেন। সেই গল্পের শুরুটা এইরকম :

“A spectre is haunting Europe – the spectre of Communism. All the powers of old Europe have entered into a holy alliance to exorcise this spectre: Pope and Tsar, Metternich and Guizot, French Radicals and German police-spies.”

তারপর তাঁরা সেই গল্পে কি লিখলেন? তাঁরা লিখলেন –“The history of all hitherto existing society is the history of class struggles.” এইটেই হ’ল মোক্ষম কথা – এই আপাত-নিরীহ বাক্যটির মধ্যেই মার্ক্স ও এঙ্গেলসের খাড়া করা কমিউনিজম এবং সমাজতান্ত্রিক ইউটোপিয়া সংক্রান্ত গল্পের প্রাণভোমরা লুকনো রয়েছে। এই বাক্যটি সত্য না মিথ্যা তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে – সাধারণ লোকে, যাঁরা এই গল্প শুনছেন, তাঁরা এতে বিশ্বাস করবেন কিনা। অল্পকালের মধ্যেই দেখা গেল, যে লোকে এই গল্পটা খেয়েছে। এবং এই সময় থেকেই ইউরোপে, বিশেষ করে জার্মানি থেকে শুরু ক’রে পূর্ব ইউরোপে কমিউনিজম তথা বামপন্থার জয়যাত্রার শুরু। এমনকী ইংলন্ডেও বামপন্থীরা (ঠিক কমিউনিস্ট নয়, তবে সমাজতন্ত্রী অবশ্যই) এর কিছু সময় পর থেকেই (ঠিক ঠিক বলতে গেলে, পাঁচ দশক বাদে) একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল – লেবার পার্টি – হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়। এই ন্যারেটিভ, যাকে কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো নামে গোটা দুনিয়া চেনে, প্রকাশিত হয়েছিল১৮৪৮ খ্রিষ্টাব্দে। এর মাত্র সাত দশকের মধ্যে রাশিয়ায় নভেম্বর বিপ্লব সংঘটিত হয়, এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন জন্ম নেয়।

এই গেল ন্যারেটিভ-এর শক্তির মাত্র একখানি উদাহরণ।

ভারতবর্ষের দুর্ভাগ্য এই যে এদেশে যাঁরা জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করছেন ব’লে দাবী করেন, তাঁরা এই ন্যারেটিভ তৈরি এবং তার প্রচার-প্রসারের কাজে হতাশাজনকভাবে ব্যর্থ। তাঁরা উষ্মা প্রকাশ করা এবং প্রতিক্রিয়ার রাজনীতি করতেই বেশি অভ্যস্ত, নতুন শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা কিংবা পুরনো প্রতিষ্ঠানগুলিকে জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দুত্ববাদী ধাঁচে ঢেলে সাজানোর কাজে এঁদের অনীহাই (নাকি অজ্ঞতা?) দেখা যায়।

আসলে ভারতবর্ষের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি এবং অভিজ্ঞতার নিরিখে নতুন ক’রে ন্যারেটিভ তৈরি করবার প্রয়োজনও নেই, সেরকম ন্যারেটিভ বহু শতাব্দী পূর্বেই আমাদের পূর্বপুরুষ ঋষিগণ তৈরি ক’রে দিয়ে গেছেন। বেদের মন্ত্রদ্রষ্টাগণ তথা বাল্মীকি, ব্যাস প্রমুখ মহর্ষিরা এই কাজ নিজ নিজ যুগে সম্পাদন করেছেন। বিশ্বামিত্র, বশিষ্ঠ, গৌতম, যাজ্ঞবল্ক্য প্রমুখ ঋষিগণ এই ন্যারেটিভ শ্রুতিবাক্যের মাধ্যমে প্রচার করেছেন; বাল্মীকি সেই একই ন্যারেটিভ রামায়ণ কাব্যের মাধ্যমে ত্রেতাযুগের উপযোগী ক’রে প্রচার করেছেন; কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাস তাকেই আবার স্বরচিত মহাভারত নামক ইতিহাসে বিধৃত করেছেন দ্বাপরে।আমাদের এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হ’ল সেই সনাতন ন্যারেটিভটিকে পুনরুজ্জীবিত করা, এবং তাকে এযুগের উপযোগী ক’রে দেশবাসীকে বলা।

নতুন প্রতিষ্ঠান গড়া এবং পুরনো প্রতিষ্ঠান পুনরুজ্জীবনের কাজ করেছিলেন আচার্য শঙ্কর। তাঁর দ্বারা প্রতিষ্ঠিত দশনামী সন্ন্যাসী সম্প্রদায় এবং ভারতবর্ষের চার প্রান্তে প্রতিষ্ঠিত চারটি মঠ সেই কাজের সাক্ষ্য এখনো বহন করছে। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ ক’রে পরবর্তীকালে একইভাবে সনাতন ধর্মের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন আচার্য রামানুজ, শ্রীচৈতন্যদেব এবং গুরু গোবিন্দ সিংহের মতো ভারতেতিহাসের মহানায়কেরা। এবং ভারতবর্ষের যেখানে যখনই প্রতিষ্ঠান গড়বার কাজ চলেছে সেখানে তখন ভারতবর্ষের সনাতন ন্যারেটিভ-টিও নতুন ভাবে বলা হয়েছে। এবং তারই ফলে ভারতবর্ষ ও তার সনাতন ধর্ম তথা ধার্মিক জনগোষ্ঠীগুলিকে একসূত্রে বেঁধে রেখে বহিঃশত্রুর আক্রমণ এবং তজ্জনিত ধ্বংসের হাত থেকে অনেকাংশে রক্ষা করা গেছে। এখানে প্রশ্ন উঠবে:কি সেই সনাতন ন্যারেটিভ?

সেই সনাতন ভারতবর্ষীয় ন্যারেটিভ বলে : প্রথমতঃ মনুষ্যজীবনের চরম লক্ষ্য হচ্ছে সবরকম বন্ধন থেকে মুক্তি; এবং সে মুক্তি লাভ করবার জন্য মানুষের প্রধান কর্তব্য হ’ল ইহজীবনেই নিজের দৈবী স্বরূপ সম্পর্কে অবহিত হবার জন্য সচেষ্ট হওয়া– যে দৈবী স্বরূপ (আত্মা/ব্রহ্ম) আবার জগতের মূল সত্য ভিত্তিও বটে। অন্তর্মুখী সাধনার মাধ্যমে সংসারবন্ধন থেকে মুক্তিলাভেই জীবনের সার্থকতা–এই একই কথা সামান্য হেরফের ঘটিয়ে বৌদ্ধ ও জৈন সম্প্রদায়গুলিও বলে থাকেন – যে দুটি সম্প্রদায়ের উৎপত্তি এবং বিকাশ হয়েছে এদেশেরই মাটিতে। ফলে সম্প্রদায় বিশেষের মধ্যে জগতের মূল স্বরূপ বিষয়ে সূক্ষ্ম মতপার্থক্য ঘটে থাকলেও ভারতবর্ষের সনাতন ন্যারেটিভটি একই থেকেছে – তাতে কোনো পরিবর্তন ঘটেনি।

দ্বিতীয়তঃ, সেই ন্যারেটিভ আমাদের ব’লে থাকে যে মুক্তির লক্ষ্য পূরণ করবার অন্তর্মুখী সাধনাটি নানাভাবে পালন করা যায়–তবে কোনোভাবেই একটি বিশেষ ধারার সাধনাকে কোনো ব্যক্তিবিশেষের উপর চাপিয়ে দেওয়া প্রকৃতির পরিপন্থী। প্রত্যেক ব্যক্তি নিজের নিজের ক্ষমতা, গুণ, কর্ম ও স্বভাব অনুযায়ী নিজের সাধনপথটি বেছে নেবে,কিন্তু সকলের লক্ষ্যটি এক – মুক্তি।এখানেই বিজাতীয় আব্রাহামীয় সম্প্রদায়গুলির ন্যারেটিভ হ’তে ভারতবর্ষের ন্যারেটিভটি মূলগতভাবে আলাদা। আব্রাহামীয় সম্প্রদায়গুলি সত্যের উপর একচেটিয়া আধিপত্য দাবী ক’রে থাকে – তাদের প্রত্যেকেরই কথা হচ্ছে ‘আমার বিশিষ্ট পথটি বেছে না নিলে তোমার গতি হবে সোজা নরক।’ এজাতীয় অন্ধবিশ্বাস ভারতের চরিত্রের সঙ্গে মানানসই নয়। ভারতবর্ষের স্বতন্ত্র চরিত্রটি অক্ষুণ্ণ রাখতে গেলে এই ধরণের গোঁড়া এবং মৌলবাদী ধারণাকে এদেশে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না।

তৃতীয়তঃ,ভারতবর্ষের সনাতন ন্যারেটিভ অনুযায়ী, ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম (যার অর্থ মূলতঃ কর্তব্য) তাকে আপন পরিবার, সমাজ, জাতি ও দেশের রক্ষায় নিযুক্ত করে; তাকে আপন পিতৃপুরুষের স্মৃতি অক্ষুণ্ণ রাখা ও তাঁদের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করতে প্রেরণা দেয়; আচার্য (বা গুরু), পিতামাতা, অতিথিকে দেবতা জ্ঞান করতে শেখায়; সর্বভূতে নিজের অন্তঃকরণস্থ দৈবী সত্তাকেসমদর্শন করবার দৃষ্টি দান করে।

চতুর্থতঃ, এই সনাতন ন্যারেটিভ ভারতবর্ষীয়কে উৎকর্ষের অন্বেষণে প্ররোচিত করে, বলে ‘চরৈবেতি’; উচ্চারণ করে ‘প্রাপ্য বরান্‌ নিবোধত’ – সেই শ্রেষ্ঠকে না পাওয়া অব্দি থেমো না।

অথচ আমরা আজকের নবীন ভারতবর্ষীয়ের কাছে এই দেশজ, উৎকর্ষ-সন্ধানী, শ্রদ্ধামণ্ডিত ন্যারেটিভ পৌঁছে দিতে পারি না। তার বদলে যে ন্যারেটিভে বিশ্বাস ক’রে তারা এদেশে এবং বিদেশে বেড়ে উঠছে, তা হল : এদেশের ইতিহাস হচ্ছে বঞ্চনা ও নিপীড়ন-নির্যাতনের ইতিহাস, এদেশের অতীতের কর্ণধারেরা দুর্বলের উপর অত্যাচারেই নিজেদের ঐহিক এবং পারলৌকিক চরিতার্থতা খুঁজে পেয়েছেন। অতএব এদেশের সমস্ত পরম্পরাই খারাপ, লজ্জাজনক এবং বিদেশী প্রতিষ্ঠান এবং দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা প্রতিস্থাপনীয়।

এ হ’ল ভারতবর্ষের চরম দুর্ভাগ্য।

ভারতবর্ষের আরো দুর্ভাগ্য এই যে এদেশের সীমান্তরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা নিয়েও এদেশের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলি রাজনীতির চাপানউতোর খেলাটি খেলতে ছাড়ে না – তাতে যদি ঐসকল অস্ত্রের অভাবে দেশের নিরাপত্তা চুলোয় যায় যাক্‌! আরো বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে যে এখনো প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র পেতে ভারতকে বহির্বিশ্বের মুখাপেক্ষী হ’তে হয় – কারণ সর্বাধুনিক ও বিশ্বমানের অস্ত্র তৈরির প্রযুক্তি ও পরিকাঠামো এখনো এদেশে নেই। দেশের দুর্ভাগ্যের এই দ্বিতীয় কারণটির পিছনেও রাজনীতি রয়েছে, সন্দেহ নেই।তার সঙ্গে যোগ হয়েছে অস্ত্র আমদানির ব্যবসায় জড়িয়ে থাকা দালাল এবং কিছু রাজনৈতিক ক্ষমতাবানের ঘুষের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করবার হিসেবনিকেশ। ব্যবসায়িক বুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার না ক’রেও বলা যায় যে মুনাফাসর্বস্ব ব্যবসায়িক বুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত প্রতিরক্ষা-বাজেট আখেরে তার মূল লক্ষ্য (দেশকে সামরিক দিক থেকে আত্মবিশ্বাসী এবং আত্মনির্ভর ক’রে তোলা) থেকে বিচ্যুত হয়, হ’তে বাধ্য। এই ক্ষেত্রে বিশেষ ক’রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, রাশিয়া এবং ইস্রায়েলের মতো রাষ্ট্রগুলির কাছ থেকে ভারতের অনেক শিক্ষণীয় বিষয় রয়েছে।

এখানে প্রশ্ন জাগে যে বর্তমানে যাঁরা সংসদে বিরোধীর আসনে রয়েছেন তাঁরা কি ভারতের শত্রুরাষ্ট্রগুলির স্বার্থরক্ষার কাজ করে চলেছেন?

আমদানির উপর নির্ভর করে থাকতে হ’লে কৃত্রিম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃতভাবে দেশীয় অস্ত্র নির্মাণকারী কারখানাগুলির ক্রমশঃ অবনতি ঘটানো দরকার – যে কাজটি এদেশে স্বাধীনতা-উত্তর সময় থেকে সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়ে আসছে। এক্ষেত্রে ভারতের জাতীয় কংগ্রেস দল এবং তার পরিবারতান্ত্রিক নেতৃবৃন্দের দায় সবচাইতে বেশি, কেননা তাঁরাই ঐ সময়কালের সিংহভাগ জুড়ে দেশের শাসনক্ষমতার শীর্ষে অবস্থান করেছেন। তাই তাঁদের বর্তমান নেতৃবৃন্দের মুখে অন্ততঃ এমন প্রশ্ন অত্যন্ত বেমানান শোনায় যখন তাঁরা বর্তমান এনডিএ সরকারের কাছে জবাবদিহি চেয়ে বলেন যে হিন্দুস্তান অ্যারোনটিক্স লিমিটেড বা হ্যাল-এর মত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে রাফাল চুক্তির অন্তর্ভুক্ত করা হ’ল না কেন।এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা দরকার যে বেশ কয়েক দশক আগেই হ্যাল একটি অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকতে থাকা রুগ্ন সংস্থাতে পরিণত হয়েছে, যাকে প্রায়ই সরকারি সাহায্যের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয় শুধুমাত্র নিজ অস্তিত্ব টিঁকিয়ে রাখবার তাগিদে।

একথা বিশ্বাস করা ভারি শক্ত যে ভারতের মতো রাষ্ট্র, যেখানে দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি রকেটে ভারত সরকারের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ইসরো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় দেশগুলির স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ ক’রে নির্দিষ্ট কক্ষপথে স্থাপনের ব্যবসা গত এক দশক ধ’রে সাফল্যের সঙ্গে ক’রে চলেছে, সেখানে উৎকৃষ্ট যুদ্ধবিমান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামরিক অস্ত্রশস্ত্র বানানোর মত মেধা নিয়োগ করা কিংবা উপযুক্ত কারিগরি প্রযুক্তির পরিকাঠামো গড়ে তোলা খুব একটা দুরূহ কাজ ছিল। আর ইসরোর মতো একটি সফল সরকারি প্রযুক্তি সংস্থা গ’ড়ে তোলা যদি সম্ভব হয়ে থাকে, তবে একটি সর্বাধুনিক মানের সামরিক সামগ্রী তৈরির রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বানানোও অসম্ভব কিছু ছিল না। তবে সে কাজ করবার জন্য প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং নেতৃত্বের অভাব যে কংগ্রেস দলে রয়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। তা নাহ’লে ওঁদের প্রায় ছয় দশকব্যাপী কেন্দ্রীয় শাসনে সে কাজ সম্পন্ন হয়ে যাবার কথা ছিল, এবং আজকের এই রাফাল যুদ্ধবিমান বিষয়ক বিতর্কে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বদলে বেসরকারি সংস্থা কেন বরাত পাবে – এজাতীয় প্রশ্নও উঠত না।

কিন্তু এইধরনের গোমুখ্যু প্রশ্ন না উঠলে সুবিধেবাদী, অজ্ঞতার উপরে নির্ভরশীল রাজনীতি চলবে কীভাবে? অগত্যা।

Previous article“সম্ভবামি যুগে যুগে”
Next articleযোগী আদিত্যনাথের দণ্ডনীতি
শ্রীজিৎ দত্ত
শ্রীজিৎ দত্ত ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্র বিষয়ে গবেষণারত। পড়াশোনা কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে। কিছুদিন কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বিশ্বভারতীতেও পড়াশোনা করেছেন। ইন্ডিয়াফ্যাক্টস, প্রাজ্ঞতা, স্বরাজ্য, মাইইন্ডমেকার্স, টপইয়াপ্স ইত্যাদি পত্রিকায় নিয়মিত ভারততত্ত্ব বিষয়ে লেখালেখি করেন। পেশা অধ্যাপনা, ধ্যানজ্ঞান সঙ্গীত। যোগাযোগ – sreejit.datta@gmail.com