কোচবিহারের ঐতিহ্যতমণ্ডিত রাসমেলা ও মদনমোহনের ইতিহাস

0
5500

বঙ্গদেশ ডেস্ক: বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। পুজোর আমেজ কাটতে না কাটতে শুরু হয় রাস। আর এই রাস উদযাপনে দক্ষিণবঙ্গের তুলনায় উত্তরবঙ্গের মানুষের আগ্রহ যেন একটু বেশি। এর কারণ অবশ্যই কোচবিহারের মদনমোহন।

কোচবিহারের রাসের মেলা শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, দেশ জুড়ে বিখ্যাত। প্রতি বছর মদনমোহন মন্দিরে রাস উৎসব দেখতে আসেন দেশ, বিদেশের পর্যটকরা। অনেকে মনে করেন, মদনমোহনকে মনে প্রাণে পূজা করলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়।

১৮৮৯ সালে বর্তমান স্থানে মদনমোহন মন্দির নির্মাণ হয়েছিল। কোচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণ ১৮৯০ সালের ২১ মার্চ এই মন্দিরের উদ্বোধন করেন। কোচবিহারের এই রাসমেলা প্রায় ১২৯ বছরের পুরনো। জনশ্রুতি আছে এই মেলা প্রথম শুরু করেন মহারাজা হরেন্দ্রনারায়ণ, ১৮১২ সালে কোচবিহারের ভেটাগুড়িতে।

পরবর্তীকালে এই মেলার স্থান পরিবর্তন হয়। শোনা যায় ভৌতিক উপদ্রবের কারণে ১৮১২ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহার রাজ্যের ভেটাগুড়িতে চলে আসেন মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ। কোচবিহারের প্রবীণদের কথায়, অগ্রহায়ণ মাসের রাসপূর্ণিমার দিন মহারাজ হরেন্দ্রনারায়ণ সন্ধ্যাবেলায় মানসাই নদী পেরিয়ে নতুন রাজধানী ও রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করেন এবং সেখানেই গৃহদেবতা মদনমোহনের রাসমেলার সূচনা করেন।

কোচবিহারের এই মদনমোহন মন্দিরে পাঁচটি কক্ষ রয়েছে। একেক কক্ষে একেক দেবীর বিগ্রহ। পূর্ব প্রান্তে জয়তারা। পশ্চিম প্রান্তে কালী বিগ্রহ। আরেক পাশে ভবানী বিগ্রহ। অন্যদিকে নাটমন্দির। নাটমন্দিরে দুর্গাপুজো বা জগদ্ধাত্রী পুজো হয়। মন্দিরের পাশেই পুষ্করিণী বৈরাগীদীঘি।

আগে এই পুকুরেই সেবাইত বা ভক্তরা স্নান করতেন। তাঁদের জন্য থাকত বিশেষ তাঁবুর ব্যবস্থা। এখন তাঁদের জন্য তৈরি করা হয়েছে আনন্দময়ী ধর্মশালা। মন্দিরে মূল বিগ্রহের কক্ষ হল মদনমোহনের। বিগ্রহটি রুপোর তৈরি। চাদোলাতে রাখা হয়েছে বাবা মদনমোহনকে। সেই চাদোলার চারদিকে চারটে কোণ।

বিগ্রহ বলতে দুটি- একটি বড় মদনমোহন, আরেকটি ছোট মদনমোহন মন্দির। ছোট মদনমোহন অন্তরালেই থাকে। একবারই তিনি জেগে ওঠেন। সেটা হল এই রাস উৎসবের রাস পূর্ণিমার সময়। বৌদ্ধ ধর্মচক্রের আদলে বাঁশ ও শোলা দিয়ে ৩৫ ফুট উঁচু এবং ১০ফুট ব্যাসবিশিষ্ট কাঠামোটি অলংকৃত করা হয়। কাগজের দেবদেবীর মূর্তি দিয়েই হয় এই অলংকরণ।

এখন মদনমোহন মন্দির দেবোত্তর ট্রাস্ট দ্বারা পরিচালিত। আর রাস মেলা পরিচালিত হয় কোচবিহারের পুরসভার মাধ্যমে। তবে কোচবিহার জেলায় এই মদনমোহন মন্দির আরও আছে। যেমন দিনহাটা, মাথাভাঙ্গা, মেখলিগঞ্জ ও তুফানগঞ্জ। পুজো সেসব স্থানেও হয়। কিন্তু পুজো ঘিরে এত বড় মেলার আয়োজন হয় এই মন্দির ঘিরেই।

কিন্তু মদনমোহনের ভাবনা কীভাবে ছড়াল কোচবিহারে। কথিত আছে, ১৭৮৩ থেকে ১৮৩৬ পর্যন্ত কোচবিহারে রাজত্ব করতেন হরেন্দ্রনারায়ণ। তারপর ১৮৪৭ পর্যন্ত রাজত্বকাল ছিল শিবেন্দ্রনারায়ণের। ১৮৬৩ পর্যন্ত নরেন্দ্রনারায়ণ ও শেষে ১৯১১ পর্যন্ত নৃপেন্দ্রনারায়ণ।

এই রাজাদের সময়ই অসম থেকে বিতাড়িত হয়ে এসেছিলেন বৈষ্ণব গুরু শঙ্কর দেব। গবেষক রঞ্জিত দেবের কথায়, শ্রী কৃষ্ণের সঙ্গে রাধারানি বলে কিছু নেই। একই অঙ্গে তার দুই রূপ। তিনিই পুরুষ, আবার তিনিই প্রকৃতি।

কৃষ্ণের এই অদ্বৈত রূপ প্রচার করায় শঙ্করদেব চরম বিরোধিতায় পড়েন। তখন তিনি অসম অঞ্চল ছেড়ে কোচবিহারে এসে প্রচার কাজ শুরু করেন। আর সেই সময়ই তাঁর ভাবনা থেকে কোচবিহারে মদনমোহন বিগ্রহের মূল ভাবনা এসেছে।

রাজবংশের আদি দেবতা হলেন মদনমোহন। বছর পুরনো এই মেলা মদনমোহনের পুজো ও যজ্ঞ দিয়ে মেলা শুরু হয়। পনেরো দিন ধরে চলে এই মেলা। একসময় রাজারা পুজো দিয়ে রাসচক্র ঘোরাতেন। এখন রাজারা নেই। তাঁর পরিবর্তে দেবোত্তর ট্রাস্টের সভাপতি হিসাবে জেলা শাসকেরা পুজো দিয়ে রাসচক্র ঘুরিয়ে উৎসবের সূচনা করেন। এখানকার মানুষদের বিশ্বাস এই পুজো করা হয় জেলার মঙ্গলকামনার জন্য।