লকডাউন-২ : জমি

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

ফোনটা পাওয়ার পর সবটা শোনার আগেই মুখ ফ্যাকাসে, বুক খালি হয়ে গেল মৃন্ময়ীদেবীর। স্থানীয় স্কুল থেকে সবে অবসর নিয়েছেন। ডাঁসা নদীর কাছাকাছি আতাপুরে বড় রাস্তা থেকে অনতিদূরে তাঁর একলপ্তে প্রায় দুই বিঘা জমির বাগান ঘেরা চার কাটার বাড়ি ছিল। তবে বর্তমান আস্তানা একটা করোগেটেড ছাদওয়ালা মোট দুই কামরার ছাউনি।

জীবনসঙ্গী অনিরুদ্ধ চক্রবর্তী জীবন ও সঙ্গ ছেড়ে বেশ কয়েক বছর হল চলে গেছেন। মানুষটা ছিলেন অদ্ভূত সৃষ্টিছাড়া ও একগুঁয়ে প্রকৃতির। জীবন বলতে বুঝতেন রোমাঞ্চ ও চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অধীনে জয়েন্ট বিডিও হিসাবে যোগ দিয়েই বন্দুক কিনে নেন। চাকরির পাশাপাশি সুযোগ পেলেই বন্দুক নিয়ে শিকারে বেরিয়ে যেতেন। সুন্দরবন অঞ্চলে মানুষখেকো রয়্যালবেঙ্গল, চিতাবাঘ ও কুমীর শিকার করে গ্রামবাসীদের কাছে বেশ পরিত্রাতা জিম করবেট মার্কা ভাবমূর্তি খাড়া হয়ে গিয়েছিল।

যেখানে অন্য আধিকারিকরা এইসব অঞ্চল ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচে, সেখানে অনিরুদ্ধ স্বেচ্ছায় এখানেই বাঁধা পড়ে রইলেন বিয়ের পরেও। শিকার, অভিযান ও জনপ্রিয়তার মোহেই সন্দেশখালি সিডি ব্লক-২-এ সস্তায় পেয়ে একেবারে দুই বিঘা বাদা জমি কিনে ফেলেন। জমি কিনলেও হুট করে বসত শুরু করব মনে করলেই করা যায় না। যতদিন সন্দেশখালিতেই পোস্টিং ছিল, ততদিন জমি পড়েই ছিল; সস্ত্রীক থাকছিলেন সরকারি কোয়ার্টারেই। সেখানে স্ত্রীকে একা ফেলেই দপ্তরের কাজে রাজ্যময় টহল দিতেন। মৃন্ময়ীর অমন হিংস্র শ্বাপদ ও দ্বিপদ সংকুল পরিবেশে থাকার এতটুকু ইচ্ছা ছিল না। পুরুলিয়ার বান্দোয়ানে বদলি হ‌ওয়ার পর ভাবলেন, যাক এবার বাঘ কুমীর সাপ-খোপ জলদস্যুদের থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু অনিরুদ্ধ নতুন কর্মস্থলে মৃন্ময়ীকে সঙ্গে করে নিয়ে না গিয়ে জেদ করে সন্দেশখালির আতাপুরের কাছে ঐ জমিতে বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করেন। সুন্দরবনের গ্রামে পোস্টিং দেখেই সরকারি চাকুরের সঙ্গে মৃন্ময়ীর বিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সারা জীবন সেখানেই থেকে যেতে হবে এমন দুঃস্বপ্ন আগে কখনই দেখেননি, এমনকি বাস্তবে হতে দেখেও বিশ্বাস করতে ইচ্ছা করছিল না।

অনিরুদ্ধর নিজের তো পায়ের নীষে সরষে। কিন্তু অদ্ভূত আকর্ষণ এই লবণাক্ত এঁটেল মাটিতে। সেখানে সংলগ্ন থাকবেন বলে শেকড়ের মতো মাটিতে আবদ্ধ করে রাখলেন নিজের অনিচ্ছুক স্ত্রী ও সদ্যজাত কন্যাকে। পুরুলিয়ার পর বদলি বাঁকুড়ার ইন্দাসে, অতঃপর কলকাতার উপকণ্ঠে ব্যারাকপুরে। ভাড়াবাড়িতে থেকে কচি বাচ্চার দেখাশোনা ও সংসার সামলে কখনও ভ্যান রিকশা চেপে, কখনও বা পায়ে হেঁটে দৌঁড়ঝাঁপ করে তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্ণীয়মান বাড়ির তদারকি ও পাহারার প্রায় সব দায়িত্ব মৃন্ময়ীকেই নিতে হয়েছে। অনিরুদ্ধ কর্মস্থল থেকে মাসে একবার কি বড়জোর দু’বার এসে দেখে যেতেন। মৃন্ময়ী অনেক মাথাকুটে কান্নাকাটি করেও আতাপুরের জমি বিক্রি করিয়ে কলকাতার দিকে শহরতলিতে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কেনার জন্য রাজি করাতে পারেননি। বরং মেয়ে একটু বড় হতে অনিরুদ্ধের উৎসাহে ও যোগাযোগে স্থানীয় গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরিতে ঢুকে পড়লেন নিজেই।

মৃন্ময়ীর বাপের বাড়ি বাঘাযতীনে। সুতরাং অনিরুদ্ধের ভাষায় কলকাতার কাছাকাছি থাকা হল ঘরজামাই হয়ে থাকা। শেষ পর্যন্ত আতাপুরে ডাঁসা নদীর ধারে পাকা সড়ক থেকে অনতিদূরে বেশ দেখনশোভা বাড়ি দাঁড়াল ঠিকই, কিন্তু যাঁর বনের প্রতি অত প্রগাঢ় ভালোবাসা তাঁরই থাকা হল না; সাপের কামড়ে ইহলোক ত্যাগ করে এক কন্যাসহ স্ত্রীকে জল-জঙ্গলে একা ফেলে চলে গেলেন। মেয়েকে দস্যু ও পশু পরিবৃত পরিবেশেও বড় করে তোলার দায়িত্ব পড়ল একা মৃন্ময়ীর ওপর। অবশ্য কবেই বা তার বাপ কটা টাকা দেওয়া ছাড়া কাছে থেকে দায়িত্ব নিয়েছে? তবু মানুষটা অনুপস্থিত থেকে অবর্তমান হয়ে যাওয়ার মধ্যে অনেকটাই ফারাক – একটা নির্ভরতা ও অধিকারবোধের মাটি সরে যাওয়া। অনিরুদ্ধর যুক্তি ছিল, মৃন্ময়ীর পছন্দসই জায়গায় বাড়ি করতে হলে খরচ বিস্তর, এত খোলামেলা বাড়ি করাও সম্ভব হবে না, উপরন্তু তোলাবাজিরও চাপ আছে। তাছাড়া গ্রামেও তো মানুষ থাকে; ধীরে ধীরে সর্বত্র উন্নয়ন হচ্ছে ও এখানেও আরও হবে।

শেষের কথাটা খুব ভুল বলেননি। এই কয়েক দশক আগে পর্যন্ত ছিল শুধু জঙ্গল বা জঙ্গল। জনমনিষ্যি নেই, চাষের জমি নেই, নদীর ঘাটও বিরল। ছিল শুধু কাদা আর বাদা। লবণাম্বু উদ্ভিদের এই বনভূমি ভরা কোটালে ডুবে যেত, আবার ভাঁটায় জেগে দিন গুণত কবে জোয়ারের শমন আসে। চ্যাটচ্যাটে ভেজা মাটি ফুঁড়ে উঁচিয়ে থাকা সুন্দরী গরান হেতালদের সূচোলো শ্বাসমূলের বল্লম, আর জল ও ডাঙার গোলকধাঁধায় ওঁৎ পেতে বাঘ, চিতা, কুমীর, হাঙরের মতো শিকারীর ঝাঁক। সেখানেও আজ শহুরে সুবিধার অনেক কিছু পৌঁছে গেছে, এমনকি বহুতল আবাসন গড়ার প্রস্তুতিও চলেছে।

দেশভাগের আগে পরে যখন হিন্দুরা পিলপিলিয়ে পালিয়ে এসে পশ্চিমবঙ্গ ছেয়ে ফেলে, তখন এই চাষাবাদের অযোগ্য যখন-তখন জোয়ারে ভেসে যাওয়া বাদা জমিতে হিংস্র পশুদের সঙ্গে সহবাস করাও পূর্ববঙ্গে থেকে যাওয়ার চেয়ে নিরাপদ মনে করেছিল তারা। খুব আশা করে নির্বাচনে এখানকার উদ্বাস্তুরা গরীব দরদী সরকারকে ক্ষমতায় নিয়ে এল। রাজ্য সরকার শরণার্থীদের মধ্যে থেকে ভোটার সংগ্রহ করার পর ওপারে যারা তাদের উৎখাত ধর্ষণ ও হত্যা করছিল বা করে চলেছে, তাদের প্রতিও কল্পতরু হল। যতদিন শুধু মার খাওয়া মানুষগুলো জলে কুমীর কামট হাঙর, ডাঙায় রয়্যালবেঙ্গল চিতাবাঘ শেয়াল সাপেদের সঙ্গে নিয়েও বাঁচার লড়াই চালাচ্ছিল, ততদিন রাজ্যে আর্থসামাজিক সমৃদ্ধির স্বার্থে মরিচঝাঁপির মতো এলাকায় রিফিউজি নির্বংশ করার ছোটখাটো অভিযান চালানোর খুব প্রয়োজন অনু্ভূত হয়েছিল। কিন্তু রিফিউজিদের ঘাতকরাও যখন জীবিকা ও শিকারের সন্ধানে দলে দলে এদিকে আসা শুরু করল, তখন সেই সাম্যবাদী সরকারের ওপর এইসব সাফাই অভিযান চালানোর চাপটা কমে গেল; কারণ সাফ করার দায়িত্ব নিতে কষাইকুল হাজির।
সন্দেশখালি এক ও দুই নং সিডি ব্লকের সামান্য অংশে নামকা ওয়াস্তে র‍্যাডক্লিফ লাইনসূচক কাঁটাতারের বেড়া আছে, তবে তা অত্যন্ত সছিদ্র। সীমান্তরক্ষীদের কৃপা চলরাশি – কারও আছে কারও নেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ক্ষমতাসীন দলের ব্যালটনীতি ধ্রুবক। বেনো জলে বাঁধ দেওয়ার পরিবর্তে খাল কেটে আমন্ত্রণ জানিয়েছে কুমীর হাঙরদের। ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে খানসেনার অত্যাচারের অজুহাতে হিন্দুদের পাশপাশি মুসলিমও এসেছে প্রচুর। পরে ঝলকে ঝলকে বেড়েছে অনুপ্রবেশ। বাঁধে ফাটল হলে প্রথমটায় খুব আস্তে আস্তে জল চোঁয়ায়। কিন্তু ফাটল বেড়ে গেলে হুহু করে জল ঢোকে। শেষে বাঁধ চুরমার করে সব ভাসিয়ে নিয়ে যায়। ফলে এই দুর্গম স্থানকে যারা বাঁচার তাগিদে বাসযোগ্য করে তুলল, তাদের চেয়ে যারা বাসযোগ্য জমি ছিনিয়ে নিতে ধেয়ে এসেছে, তাদের সংখ্যাগুরুত্ব এখন সরকারি জনগণনাতেও প্রতিফলিত। তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই কথ্য ও শিক্ষার ভাষা যেখানে এক সময় পুরোপুরি বাংলা ছিল, সেখানে এই শতাব্দীর শুরু থেকেই উর্দুর জনপ্রিয়তা উত্তোরত্তর বাড়ছে।

যারা দেশভাগ চায়নি তারা বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় নিলে দেশের বোঝা, কিন্তু যারা দেশের ভাগ নিয়ে আবার ভাগ বসাতে আসছে, তারা “অতিথি দেব ভবঃ”। তাই এখন বেশ শহুরে রেশ। ট্রেন, বাস, ফেরির মতো গণপরিবহণ থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ মোবাইল টাওয়ার – সন্দেশখালির দুইটি ব্লকে কী নেই? চাষাবাদ, গৃহশ্রম ও অন্যান্য জীবিকা তো হাল আমলের, সন্দেশখালিসহ সুন্দরবন এলাকার চিরাচরিত, সবচেয়ে দাপুটে ও সফল শিল্প হল জলদস্যুবৃত্তি, নারী পাচার, ড্রাগ কেনাবেচা, ডাকাতি ইত্যাদি। আর খুন ধর্ষণ তো সমাজের অঙ্গই যা এমন অনুকূল পরিবেশে দ্রুত বিকশিত হয়ে চলেছে। স্বভাবতই মৃগয়ার কারণে নারীর সংখ্যা পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই কম যদিও রয়্যালবেঙ্গল টাইগারের মতো বিলুপ্তপ্রায় হয়ে যায়নি। সবমিলিয়ে হিংস্র প্রাণী বলতে আজ শ্বাপদের চেয়ে দ্বিপদই বেশি। তাদের অতি-পুরুষবাদী সাম্প্রদায়িক অভিপ্রায় খুব স্পষ্ট হলেও ‘অপরাধীর ধর্ম হয় না’ ও ‘একই বৃন্তে দুটি কুসুম’ তত্ত্ব দ্বারা বরাবরই সযত্নে আবৃত। আগে বাম আমলে যদিও বা মাঝেসাঝে ‘দুষ্কৃতি’দের ধরা হত, পরিবর্তনের সরকার আসার পর থেকে সেই দুষ্কৃতিরাই দুষ্টু ছেলেছোকরার উপাধি পেয়ে সাক্ষাৎ উন্নয়ন রূপে রাস্তায় দাঁড়িয়ে পড়ল।

আর মৃণ্ময়ীদেবীরা পালাবার পথ খুঁজতে লাগলেন। অনিরুদ্ধ চলে যাওয়ার পর চাকরিতে ইস্তফা দিয়েও কলকাতায় বাপের বাড়ির কাছাকাছি উঠে যাওয়ার ইচ্ছা পুষে রাখতেন। বাবা তখন অশক্ত। মা তো চেয়েছিলেন বাড়িতেই উঠুক মেয়ে ও নাতনী, অন্তত যতদিন না নিজেদের একটা ফ্ল্যাট বা আস্তানা কিনে নিতে পারছে। মা দুম করে মারা গেলেন। দাদা ও ছোট ভাই ফ্ল্যাট বা বাড়ি খোঁজ খবর করার উদ্দেশ্যে বোনকে মাস খানেকের জন্যও তারই নিজের পৈতৃক বাড়িতে থাকতে দিতেও গাঁইগুঁই করতে লাগল। আর মৃন্ময়ীর পক্ষে সন্দেশখালিতে অতখানি জামি ও অত বড় বাড়ি বিক্রি করে মেয়ে নিয়ে হুট করে কারও সহযোগিতা ছাড়া শহরে চলে আসাটাও সম্ভব ছিল না। পরে মেয়ে চিন্ময়ী আতাপুর কেনারাম উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার পর, বিশেষত সেখানেই বিয়ে করার পর কিছুটা মন বসে গেছে।

মেয়ে ভালোবেসে বিয়ে করেছে স্থানীয় এক বেসরকারি কর্মীকে। নাতনী টিকলি অবশ্য মায়ের স্কুলে নয়, কিছু দূরে বাঘমারায় একটা নামকরা ইংরেজী মাধ্যম স্কুলে পড়ে। নার্সারিতে সুযোগ পেয়ে ভর্তি করা হয়েছিল, একেবারে ‌আইএসসি দিয়ে বেরোবে। নীহার ছেলেটা ভালো। আসা যাওয়া করে, শাশুড়ির খোঁজখবর নেয়। ওদের নরেন্দ্রপুরেও এক টুকরো জমি আছে যা নিয়ে শরিকী বিবাদ চলছে। সেটা মিটলে নরেন্দ্রপুরে বাড়ি করে চলে গিয়ে সেখান থেকে আতাপুর যাওয়া-আসা করা খুব কিছু কঠিন হবে না এবং নরেন্দ্রপুর বা কলকাতার দিকে চাকরির চেষ্টাও করা যায় – ইত্যকার প্রসঙ্গ মাঝেমাঝে উত্থাপিত হলেও সেরকম তাগিদ কারোরই নেই। আর চোখের সামনে মেয়ে ও নাতনীকে দেখতে পেয়ে মৃন্ময়ীরও নোনা গ্রাম ছেড়ে শহরে পালানোর তাগিদটা কমে গেছে। বরং সন্দেশখালিতেই বাসস্থান নিয়ে বেশ বড় একটা পদক্ষেপ নিয়েছেন যাতে মেয়ে জামাইয়ে সম্মতি আছে।

মৃন্ময়ীর বাগান সমেত বাড়ি ও জমি স্থানীয় এক প্রমোটার অনকদিন ধরে কিনতে চাইছিল। বছর দুয়েক আগে নিজের জমিটি তাই বিক্রি করেছেন দুটি বহুতল টাওয়ার বিশিষ্ট ছোট আবাসন করা হবে জেনে। চারপাশে যে হারে অপরাধের রমরমা, তাতে ছোটখাটো আবাসন গড়ে উঠলে কিছুটা নিরাপত্তা তো মিলবে। গ্রাম হলেও সন্দেশখালির আতাপুরের মতো জায়গায় একলপ্তে দু বিঘে জমির বাজার দর কম নয়। কিন্তু রফা হয়েছে নগদ দশ লাখ টাকা, আর আবাসনের একটি টাওয়ারে পাশাপাশি দুটি দক্ষিণ খোলা দুই শোবার ঘর বিশিষ্ট ফ্ল্যাট পাবেন। এর মধ্যে এখন পেয়েছেন পাঁচ লাখ টাকা, বাকিটা পাবেন কাজ শেষ হলে।

এখন থাকছেন নিজেরই মাত্র এক কাটা জমিতে তৈরি করোগেটেড ছাউনি দেওয়া ঘরে। ফলে দু’ বছর ধরে মেয়ে জামাই নাতনীরা এসে ওনার কাছে এই অপরিসর ও গরম জায়গায় থাকতে পারে না, দেখা করে এক আধবেলা কাটিয়ে চলে যায়। মেয়ের বাড়ি যান মাঝেসাঝে। কিন্তু তার যৌথ পরিবারে জায়গা কম, বেশিদিন থাকা যায় না। ফ্ল্যাট হস্তান্তরিত হলে এই ছাউনিটাও মূল ফটকের কাছে নিরাপত্তা গুমটি নির্মাণের জন্য প্রমোটারকে দিয়ে দিতে হবে। কিন্তু দু বছর হতে চলল দেখছেন, নির্মাণ কাজ অল্পবিস্তর হলেও বহুতল টাওয়ারের চিহ্ন নেই। তাঁরই দোতলা বাড়িটার গায়ে ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙ চড়েছে শুধু, সেই সঙ্গে বাড়ির চার কোণে চারটি স্তম্ভ উঠছে। আশপাশের জমিগুলোও তাঁর জমির সঙ্গে একে একে জুড়ে ঘেরা চলেছে। ছোটখাটো বাড়িগুলো আস্তে আস্তে অদৃশ্য হয়ে আবাসনের প্রাচীর দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে চলেছে। খটকা লাগছে বেশ কিছুদিন ধরেই। তবে কাগজে কলমে স্ট্যাম্প পেপারে করা চুক্তিপত্রের ভরসা তো আছে।
প্রমোটার শাহাবুদ্দিনকে প্রশ্ন করে জেনেছেন, তাদের প্রকল্প অনেক বড় কাজের অনুমোদন পেয়েছে, তাই আরও জমি কেনা চলছে। এবার কাজ শুরু হবে। এখন শুধু দুটো টাওয়ার নয়, আটটি টাওয়য়ারওয়ালা বড় কমপ্লেক্স হবে, যেখানে ক্লাবহাউস, সুইমিং পুল, ছোটদের খেলার জায়গা ইত্যাদি সব আধুনিক ব্যবস্থা থাকবে। তবে মৃন্ময়ীদেবীর বাড়তি খরচ নেই। চুক্তি অনুযায়ী তিনি বরাদ্দ মাপের ও অভিমুখের দুটি ফ্ল্যাটই পাবেন। বর্তমান দোতলা বাড়িটা ওদের অফিসঘর। আসল কাজ শেষ হলে ভেঙে ক্লাবহাউস বানানো হবে।
আনন্দে নেচে উঠল মনটা। কলকাতার কাছাকাছি থাকার ইচ্ছা থাকলেও এই ধরণের জীবনযাত্রার স্বপ্নও দেখেননি কোনওদিন। তাহলে ঐ একগুঁয়ে জেদি লোকটা খুব অদূরদর্শী ছিল না। এই বাদাকাদাই এমন আধুনিকতার ছোঁয়া সেজে উঠবে কে ভেবেছিল। ইস্, এমন আনন্দের দিনে সে নেই!

আরও এক বছর ঘুরে গেল। সেই দোতলা এখন চার কোণে চারটি মিনারযুক্ত চাঁদ তারা শোভিত চারতলা হয়ে গিয়েছে। সেখানে লম্বা পাঞ্জাবী ও খাটো পাজামা পরা ছেলেছোকরা থেকে নানা বয়সী পুরুষরা আসে। বোরখাবৃতা বা মাথায় আঁটো করে করে ওড়না দেওয়া মেয়েদেরও অল্পবিস্তর দেখা যাচ্ছে। পাশে আর একটি বড়সড় নির্মাণ চলেছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ঐ জমির দখল চলে গেছে ওয়াকফ কমিটির হাতে, যেখানে ওরা মাদ্রাসা ও সংলগ্ন ছাত্রাবাস গড়ছে। শোনা যাচ্ছে এরপর পুরোপুরি নলেজ সিটি করার পরিকল্পনাও আছে।

তাহলে মৃণ্ময়ীর ফ্ল্যাট? শাহাবুদ্দিন ফোন করলে ধরে না। ওর পাঠানো মাস্তানরা এসে অশ্লীল হাসি ও প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে গেল। তাদের জবাব, “কেন পাঁস লাখ টাকা নিয়েই তো জ়মি বিক্রি করসেন।”

এদিকে করোনা মহামারীর জন্য লকডাউন ঘোষিত হয়েছে। জটলা করা নিষিদ্ধ বলে রাস্তায় একা সব্জি কিনতে বেরোলেও পুলিস মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে, আর দল বেঁধে মিছিল কিংবা শুক্রবারের দলবদ্ধ উপাসনায় ছাড়ের সঙ্গে নিরাপত্তা দিয়েছে, এমন নজির আছে। মৃণ্ময়ীদেবী মেয়েকে ফোন করে জানালেন।

নীহার শোনামাত্র থানায় গেল। যদিও লকডাউনে বেরোলে কাকে কখন ধরে ঠিক নেই। পুলিস এফআইআর নিল না, কারণ এখন কাগজে হাত দেওয়া যাবে না। শেষে একটা আবেদনপত্র লিখে টেবিলে রেখে দিল ঠিকই, কিন্তু তার প্রাপ্তিস্বীকার করল না। কারণ তার ফোটোকপিতে স্ট্যাম্প মারলেও নাকি পুলিসের করোনা হতে পারে। বোঝা গেল, থিকথিকে জনসমাবেশে পিঠে লাথি খেয়ে গলা জড়িয়ে ধরলে সংক্রমণের ভয় থাকে না, কিন্তু সাদা কাগজে একটা আবেদনপত্রে হাত দিলে সংক্রমণ অনিবার্য। ঝামেলা না করে মিটমাট করার পরামর্শ দিয়ে খেদিয়ে দিল মেজবাবু।

তার কয়েক ঘণ্টা পরে মৃন্ময়ীদেবী ফোন পেলেন স্বয়ং শাহাবুদ্দীনের কাছ থেকে। “পুলিসে কমপ্লেন করেছিস? পুলিস আবার বা- করবে। মা মেয়ে দিদিমা সবাইকে একসাথে গণচো-ন দেব বুঝলি? মুম্বাইয়ের রেন্ডীপাড়ায় সবচেয়ে বেশি মাল কোথা থেকে সাপ্লাই হয় জানিস?….” একটানা কানে নর্দমা ও মনে ভীতি বর্ষণ করে ফোন কেটে দিল। ওর ভাই-বেরাদরদের আচরণ যথেষ্ট উদ্ধত হলেও শাহাবুদ্দিন এর আগে কোনওদিন ‘মাসীমা আপনি’ ছাড়া কথা বলেনি।

উকিল যাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তারা মোটা দক্ষিণা নিয়ে শুধু এইটুকু পরামর্শ দিয়েছে, যে আরও দু-চার লাখ মতো ক্ষতিপূরণ যাতে পায়, আদালতের বাইরে কথা বলে তার ব্যবস্থা করে দিতে পারে। তবে এখন তো আদালত বন্ধ, তাই লকডাউন না ওঠা ও কোর্ট না খোলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

বাড়ি ফিরে দেখে শাশুড়িমা আলুথালু বেশ উস্খোখুস্কো চুলে তাদের বাড়িতে এসেছেন। নীহারকে দেখামাত্র চিন্ময়ী বলল, “জানো, শহাবুদ্দীন এখন বলছে অ্যাজ় পার এগ্রিমেন্ট মা যে এক কাটার ঘরটায় আছে, সেটাও ওকে দিয়ে দিতে হবে। এতবড় ফ্রড করেও শান্তি নেই, মাথা গোঁজার জায়গাটুকু থেকেও পুরোপুরি উৎখাত করতে চাইছে। আমি বলেছি মাকে, তুমি আমাদের কাছে এসে থাকতেই পারো; কিন্তু হকের সম্পত্তি ছাড়ব কেন? মগের মুলুক নাকি?” চিন্ময়ী উত্তেজিত।

মৃন্ময়ী কেঁদে ফেললেন। নীহার বলল, “মা, ভেঙে পড়বেন না। আমি এখনই আর একজনের সঙ্গে কথা বলছি।” একটা সুন্দর আবাসনে সপরিবারে থাকার স্বপ্ন তো সেও দেখতে শুরু করেছিল।

চিন্ময়ী বলল, “তোমার চেনাশোনা উকিল নেই? এর শেষ দেখে ছাড়ব। কী ভেবেছে কি ওরা?”

বেশ কয়েক দিনের চেষ্টায় নীহার নরেন্দ্রপুরে একজনের সাক্ষাৎকারের সময় পেয়েছে। এখন লকডাউনে অফিস বন্ধ। ট্রেনও চলছে না। মাস্ক, হেলমেট সব যথাবিধি পরে বাইক নিয়েই পৌঁছে গেল নরেন্দ্রপুর। ভদ্রমহিলা মূলত হাইকোর্টে প্র্যাক্টিস করেন। কিন্তু সব শুনে আশ্বস্ত করেছেন, নিম্ন আদালতে ওনার অধীনস্থ একজন জুনিয়ারকে দিয়ে বসিরহাট জেলা আদালতে কেসটা তোলাবেন। নিজেও সাহায্য করবেন। এইসব জমি মাফিয়াদের যা টাকা, কেসটা উচ্চ ন্যায়ালয়ে উঠবেই। তখন উনি নিজে লড়বেন। কোর্ট খোলা নেই। প্রচুর বকেয়া কেস পড়ে আছে। আপাতত যাতে স্থানীয় থানা এফআইআর নেয়, তার ব্যবস্থা করাবেন। বিল্ডারের বিরুদ্ধে শুধু সম্পত্তি হস্তান্তরে বিলম্ব, মাপ কম, প্রতিশ্রুত সুবিধা না দেওয়া – শুধু এই জাতীয় অভিযোগ থাকত, তাহলে কনজ়িউমার ফোরামে কেস করা যেত। কিন্তু জালিয়াতি মানেই ফৌজদারি। আর এখানে তো হিংসাত্মক হুমকিও দেওয়া হয়েছে।

দিন সাতেক ধরে নীহারের মনে জমে থাকা গুমোট ভাবটা কিছুটা কেটে গেল ক্ষণিকের জন্য। এই প্রথম কেউ সহানুভূতির সঙ্গে কথাগুলো শুনলেন, পাশে দাঁড়ানোর আশ্বাসটুকু তো দিলেন। বাড়িতে এটুকু জানিয়ে বাইকে উঠে পড়ল। যদিও খিদে পাচ্ছে কিন্তু এখন তৈরি খাবারের দোকান সব বন্ধ, আর দু চারটে বড় জায়গা খোলা থাকলেও বাইরে খাওয়া নিরাপদও নয়, মানসিক অবস্থাও নেই। মনটা খচখচ করছে, কেমন উচাটন লাগছে। পুলিস এফআইআর নেবে, তারপর মামলা আদালতে গৃহীত হবে, তারপর কত বছর পরে মামলার নিষ্পত্তি হবে – এত ঝামেলা ধকল খরচ পোষাবে তো? অবশ্য শাশুড়ির জমি না পেলে যে তাদের খেয়েপরে বেঁচে থাকতে সমস্যা হবে, তা নয়। কিন্তু খচখচানি কি শুধু এইজন্যই? ভেবেছিল নরেন্দ্রপুর আসছেই যখন, নিজেদের পাঁচ শরিকের বাড়িতে একবার ঢুঁ মেরে যাবে; ওদের অংশটা তালাবন্ধ পড়ে আছে। কিন্তু কেমন যেন ঝড় বইছে মনের ভেতর। সন্দেশখালি ফেরার পথই ধরল।

আসার পথে বেশ কয়েকবার ফোনটা বেজে বেজে বন্ধ হয়ে গেল। পকেট থেকে মোবাইলটা বার করবে ভেবেও বাইক থামাল না। থাক, এখন কথা বলে সময় নষ্ট না করে সোজা বাড়িই ফেরা যাক। পরে কলব্যাক করে নেবে। বাড়ি পৌঁছে পকেট থেকে চলভাষটি বার করতে যাওয়ার সময় সেটা নিজেই আবার বেজে উঠল। চিন্ময়ীর ফোন।

কেটে দিয়ে দরজায় বেল টিপল। দরজা খোলামাত্র চিন্ময়ীর চিৎকার, কী বলল বোঝা গেল না। মৃন্ময়ীদেবী হাওহাও করে বললেন, “সব আমার জন্য। না তোর বাবার জন্য। কত করে বলেছিলাম, এখানে নয়, অন্য কোথাও থাকি চলো। নিজে তো একটা দিনও জমি-বাড়ি অশান্তি কিচ্ছু ভোগ করল না। ডেভেলাপমেন্ট হবে, উন্নয়ন। তাই তো। উন্নয়ন রাস্তায় দাঁড়িয়ে ওঁৎ পেতে আছে!” ডুকরে উঠলেন তিনি।

নীহার প্রশ্ন করার আগেই চিন্ময়ী লুটিয়ে পড়ল, “নীহার টিকলি……। মাকে ওবাড়ি পৌঁছতে গিয়েছিলাম…সঙ্গে টিকলিও ছিল। গেটের সামনে থেকে কয়েকটা ছেলে ওকে তুলে নিয়ে গেল! আমাদের জমি ফ্ল্যাট কিচ্ছু চাই না, মেয়েটাকে যেখান থেকে পারো এনে দাও।….. থানায় জানাতে বলল… বলল, লকডাউনে দল বেঁধে বেরিয়েছেন কেন… হাঁ…তাও আবার বাচ্চা নিয়ে? ওদের সঙ্গে কেন লাগতে গেছি। ওগো! কেন উকিলে সঙ্গে কথা বলতে গেলে? মেয়েটাকে নিয়ে ওরা কী করবে? টিকলি সোনা মা আমার…”
মায়ের বুকফাটা আর্তনাদে আকাশের চিল শকুনের চোখেও বোধহয় জল চলে এল। জলের কুমীরও সত্যিকারের কেঁদে ফেলল। শুধু মাটির মানুষরা মেনে নিল, ‘এমন তো হয়েই থাকে’।