বকুল পলাশ

1
2113

শমীক লায়েক

বাজারের থলিটা রান্না ঘরে বকুলের কাছে নামিয়ে দিয়ে, একটা জলের বোতল নিয়ে গলায় আলগোছে কিছুটা জল ঢেলে নিল পলাশ। ঘেমে গেছে বেশ, বাইরে গরম আছে। বকুল ওর ক্লান্ত আর ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললো “হল ঘরে ফ্যানের নিচে বসো, আমি চা দিয়ে আসছি”।

দুবছর হলো পলাশ রিটায়ার্ড করেছে ওর সরকার অধিগৃহিত কোম্পানির চাকরি থেকে। সন্তোষপুরের এই ছোট ফ্ল্যাট টা পলাশ কিনেছিল আজ থেকে বছর বারো আগে। বকুলই বলেছিল সেসময় “একটা ছোট হলেও নিজেদের মাথাগোঁজার জায়গা হলে ভালো হয়, নয়ত ভাড়া বাড়িতে এই ভাবে সারা জীবন থাকা যায় নাকি”। আর এখন কিনবো ভাবলে ছোট একটা হোমলোন ও নিতে পারবে, নয়তো রিটায়ারমেন্টের পর পুরোটাই তোমার জমানো টাকা থেকে যাবে”। উচিৎ পরামর্শ বলে আর দেরি করেনি পলাশ।
পলাশ সারাজীবন চাকরি করেছে কোল ইন্ডিয়া লিমিটেডে, সেই সুবাদে, কোল ইন্ডিয়ার এর বিভিন্ন কোম্পানিতে যেমন পোষ্টেড ছিল, ঠিক তেমনি চাকরি জীবনের শেষ ১৫ বছর ছিল কোল ইন্ডিয়ার হেড অফিস কলকাতায় পোষ্টেড।

চাকরি জীবনের প্রথম দিকটায় তাই ঘুরেছে প্রচুর। শুরুতে ছিল কোল ইন্ডিয়ার অধীনস্থ সেন্ট্রাল কোলফিল্ডস লিমিটেডে বা সিসিএল এ। তার হেড‌অফিস ছিল রাঁচি। পলাশ রাঁচিতে যেমন কাটিয়েছে, তেমনি সিসিএল এর খনি অঞ্চল গিরিডি, বোকারো অঞ্চলেও কাটিয়েছে অনেকটা সময়।

এরপর কাটিয়েছে পশ্চিম বঙ্গের ডিসেরগড় অঞ্চলে, তখন সে ইস্টার্ন কোলফিল্ডস লিমিটেডের হেড অফিসে।

কলকাতার বাইরে চাকরি জীবনের অনেকটা সময় কোম্পানির কোয়ার্টারে কাটিয়েছে, কোনো অসুবিধা হয়নি। কলকাতায় আসার পর থেকেই বকুল চিন্তা শুরু করেছিল যে রিটায়ারমেন্টের পর, কলকাতাতেই থাকবে। তখন খোঁজ খবর করে সন্তোষপুরের এই ফ্ল্যাটটা কেনা হয়।

এসব পুরনো চিন্তার মাঝেই চায়ের কাপ আর জলখাবারের প্লেট নিয়ে পলাশ হলঘরে গিয়ে বসে। বকুল নিজের হাতে এগুলো নিয়ে এসে দিতে পারবে না, কোমরে স্পন্ডেলাইটিসের ব্যথা, নিচু হওয়া বারণ, বেশি হাঁটতে চলতে গেলেও অসুবিধা।
“আমার কোমরের ব্যথাটা আজ সকাল থেকেই বেড়েছে, আর এদিকে শান্তা আসেনি, তার নাকি শরীর খারাপ ….. কাজের লোক রেখেও রোজ দিন নিজে খেটে মর”। পলাশ কে বলতে বলতেই রান্না ঘরের দিকে এগোন বকুল। “তুমি একটু জামাকাপড় গুলো কেচে দিও, আমি পারবোনা আজ”।

হ্যাঁ হ্যাঁ….. খেতে খেতেই উত্তর দেয় পলাশ।

জলখাবার খেয়ে রান্নাঘরে কাপ প্লেট রাখতে ঢুকে পলাশ দেখলো বকুলের রীতিমতো কষ্ট হচ্ছে একটানা দাড়িয়ে থাকতে কোমরের ব্যথায়।

“বকুল” নরম গলায় ডাক দেয় পলাশ “বলছি এত ব্যথা নিয়ে রান্না করোনা, তুমি ঘরে গিয়ে রেস্ট নাও, আমি রান্নাটা করে দিচ্ছি”….. এই বলে আলতো করে বকুলের কাঁধে হাত দেয়।

একটা মিষ্টি হাসি নিয়ে বকুল ঘুরে তাকায় পলাশের দিকে, “অত মায়া করলে তোমাকে আজ সবই করতে হবে, আমি তাহলে সারাদিন বসে রেস্ট নেবো”।

“অসুবিধা নেই রাই সুন্দরী, আমার কাছে তুমি সবথেকে আগে”…… হেসে উত্তর দেয় পলাশ।

বকুলের কোমরের ব্যথা খুব বেড়েছিল, দাড়িয়ে থাকতে সত্যি কষ্ট হচ্ছিল, পলাশের কথায় রান্না ছেড়ে দিয়ে বাইরের ঘরে গিয়ে বসলো। স্পন্ডেলাইটিসের এই ব্যথা বকুলের বিগত ১০ বছরের সঙ্গী, সময়ের সাথে আসতে আসতে তা বেড়েছে, এখন সারাক্ষণ একটা ব্যথার অনুভূতি লেগেই থাকে। তবে পলাশ যতটা সম্ভব সাহায্য করে বকুলকে। রান্না, ঘরের কাজ কোনো কিছুতেই কোনো বিরক্তি নেই পলাশের। বললে পরে আজও সেই আগের মতই মায়াবী দৃষ্টি নিয়ে পলাশ বলে ওঠে, “সখী, তোমাকে ছাড়া আমি অর্ধেক মাত্র, তুমি আমি মিলে একসম্পূর্ন সত্তা”, এর ওপর বকুল আর কিছুই বলতে পারেনা।

বকুলের মনে পড়ে যায় বিয়ের পরের সেই সব দিন। তখন পলাশ পোষ্টেড ছিল গিরিডিতে, কিন্তু ওখানে অফিসের কোয়ার্টার পায়নি পলাশ। তাই উশ্রি নদীর তীরে গিরিডির যে জায়গাটি এখন প্রফেসর কলোনী বলে পরিচিত, সেখানেই ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতো পলাশ। গিরিডি তখন বিহার রাজ্যের অন্তর্গত। ছবির মত সুন্দর একটি পার্বত্য শহর আর পাশ দিয়ে বয়েচলা উশ্রী নদী, প্রথম দর্শনেই বকুলের মন জয় করে নিয়েছিল। বকুল খনি অঞ্চল আগে দেখেনি কখনো, কিন্তু গিরিডিতে পাথুরে রুক্ষতার সাথে সাথে এমন একটা কোমল ঔদার্য ছিল যা বড়ো আপন লেগেছিল বকুলের। খনি অঞ্চলের মানুষজন, তাদের আচার আচরণ, ব্যবহার, অভ্যাস প্রথম প্রথম একদম নতুন লাগত বকুলের, কিন্তু সবকিছুই সহজ হয়ে গেছিল পলাশের জন্য। এখনো মনে পড়ে, প্রথম দিন পলাশের সাথে ওর গিরিডির বাসায় গিয়ে পৌঁছেছিল যখন তখন দুপুর ১ টা।পৌঁছেই বকুল ব্যস্ত হয়ে পড়ছিলো রান্নাঘর আর দুপুরের রান্নার জন্য। পলাশ তখন হাসি মুখে এগিয়ে এসে বলে “তুমি আজ রেস্ট নাও, আর রান্না ঘরের দিকে আজ একদম আসবেনা, আজ এই অধমের হাতের রান্না কোনরকমে গলোদ্ঘরণ করো। তারপর কাল থেকে তুমি রান্নাঘরের দায়িত্ব বুঝে নিও”। বাধ্য মেয়ের মত মেনে নিয়েছিল বকুল, আর খেতে বসে চমৎকৃত হতে গেছিল পলাশের হাতের রান্না খেয়ে। জিজ্ঞাসা করেছিল এত ভালো রান্না সে শিখল কথায়। পলাশের কাছেই জানতে পারে, রান্নার পাঠ পলাশ নিজের ছোটবেলায় পেয়েছিল নিজের ঘরেই। পলাশের মার শরীর ভালো থাকত না প্রায়শই, বাবা ডিউটি তে থাকতেন, তখন একটু বড়ো হবার পর মাকে সাহায্য না করে পলাশ স্থির থাকতে পারত না, আর সাধ্য মত সাহায্য করতে গিয়েই আস্তে আস্তে রান্না শিখে ফেলে ওর মায়ের তত্ত্বাবধানে। তাই রান্না করে খাওয়াতে পলাশ ভালোইবাসতো।

নতুন বিয়ের পর, পলাশের সাথে এত দূরে গিরিডি যাবার সময় মনের মধ্যে একটা ভয় শঙ্কা ছিল বকুলের, কিন্তু গিরিডি গিয়ে দুজনে মিলে নিজেদের সংসারটা সাজিয়ে নিতে নিতে আবিষ্কার করে এক পলাশ অত্যন্ত সুন্দর মনের মানুষ যাকে ভালো না বেসে পারা যায় না, আর দুই পলাশ কে সে কখন যেনো ভালোবেসে ফেলেছে।

হঠাৎ পলাশের গলার শব্দে বকুলের চিন্তার জাল কেটে যায় “তোমার মনে আছে, আমাদের সেই পিকনিক গুলো, ডিসেরগড়ে থাকতে”।

মনে পড়ে যায় বকুলের সেই সব দিনগুলো, দামোদর নদের তীরে কলোনির সবাই মিলে গিয়ে প্রতিবছর পিকনিক। আর সেখানে পলাশ মধ্যমনি, রান্নার দায়িত্ব সব ওর। “বাবা, সে সব এক দিন ছিল। কলোনির সবাই কত মিলেমিশে থাকতো, জীবন এত জটিল ছিলনা”। নিজের মনেই বলে ওঠে বকুল।

“জানো, কাল সৌমাভ ফোন করেছিল। সৌমাভ কে মনে আছে তো, সি ১৩ তে থাকত”….. জিজ্ঞাসা করে পলাশ।

“হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে আছে খুব, ওর বউ সঙ্গীতা, একটা আলসেশিয়ান কুকুর ছিল ওদের”….. উত্তর দিতেগিয়ে একটুকরো হাসি খেলে যায় বকুলের ঠোঁটে।

কী বলছিল? জানতে চায় বকুল। “এমনি, খোঁজ খবর নিচ্ছিল, আজকাল ওরাও কলকাতায়, ফ্ল্যাট কিনেছে বেলঘরিয়া ঐদিকে” উত্তর দে পলাশ।

“বেলঘরিয়া, একদম ঐদিকে কেন কিনলো?”

“আরে সৌমাভর এক ভাই ওই দক্ষিণেশ্বরের ঐদিকে থাকেনা, ওর কাছাকাছি থাকবে বলে বেলঘরিয়ার ঐদিকে কিনেছে, আর সঙ্গীতার এক বোন ও থাকে বেলঘরিয়ায়। ও কিন্তু অনেকবার করে আমাদের যেতেও বলছিল”।

“সে যাওয়া যাবে একসময়। ভালই হবে আমাদেরও অনেকদিন কোথাও বেরোনো হয়না”। একটু যেনো বিষাদ খেলা করে যায় বকুলের গলায়, আর সেটা শুনেই সাবধান হয়ে যায় পলাশ। নিজের ওপরেই একটু বিরক্ত হয়ে ওঠে, ডিসেরগড়ের কথা না তুললেই ভালো হতো। তাড়াতাড়ি বলে “বকুল, তোমার সেই উশ্রির তীরে শস্ত্রীনগর রোড এর কাছে শিব মন্দির টা খেয়াল আছে। প্রথম দিন তোমাকে নিয়ে আমি সন্ধ্যে বেলায় ওখানে গিয়েছিলাম”। রান্না ঘর থেকে রান্নার ফাঁকে ভেসে আসে পলাশ এর গলা।

“হ্যাঁ, খুব মনে আছে। তোমার খুব প্রিয় জায়গা ছিল ওটা”, একটু হেসে উত্তর দেয় বকুল।

“একটা কথা তোমাকে বলা হয়নি কখনো জানো”।

“কি কথা” জানতে চায় বকুল।

ওই মন্দির, ওর লাগোয়া পরিবেশ, উশ্রীর ওই রূপ, সব মিলিয়ে যে এক রোমান্টিক ব্যাপার, সেটা আমি কিন্তু প্রথম যখন গিরিডি গেলাম, সেভাবে খেয়াল করিনি। প্রকৃতি আর পরিবেশ তার সমস্ত রোমান্টিসিজম নিয়ে আমার কাছে ধরা পড়লো যেদিন প্রথম তোমার ছবি হাতে পেলাম। একটা হলুদ চুড়িদার পরেছিলে তুমি সেই ছবিতে। মনে আছে তোমার?”

“হ্যাঁ, ওটা আমার সবথেকে পছন্দের চুড়িদার ছিল। যখন কথা হলো, তোমাদের বাড়ি ছবি পাঠানো হবে, আমি নিজে ওই ছবিটা বেছে দিয়েছিলাম।” বলতে বলতে রান্না ঘরের দরজায় এগিয়ে আসে বকুল, দেখে ততক্ষনে পলাশ এর রান্না প্রায় শেষ।

“বাহ, তুমি তো রান্না শেষ করে ফেলেছ দেখছি” হালকা গলায় পলাশ কে সে কথা বলতেই উত্তর পাওয়াযায় “বকুলপ্রিয়ে, আমার রান্নার সুখ্যাতি তো তুমি জানো গিরিডি, বোকারো, রাঁচি, ডিসেরগড় সবজায়গায় ছড়িয়ে, শুধু এই কলকাতায় এসে আমার প্রতিভা কোনো দাম পেলনা। বাঙালি এখনো পুরুষ মানুষের রান্না করার মধ্যে কোনো রোমান্টিসিজম খুঁজে পায়না। তার যত রোমান্টিসিজম নারীর আঁচলের হলুদ দাগে, আগুনের তাতে ঘেমে যাওয়া তোমাদের মাখন কোমরের ভাঁজে”।

“বাজে বোকোনা বেশি”, কপট রাগ দেখিয়ে বলে বকুল। “তোমার রান্নার প্রশংসক তো সমস্ত কলোনির যত বৌদি আর বন্ধু পত্নীরা। পলাশ একেবারে আদর্শ স্বামী, অপূর্ব রান্নার হাত….. উফফ ওরম স্তাবক গোষ্ঠী থাকলে আমিও রান্নায় দ্রৌপদী হতুম” বলেই মুচকি হাসে বকুল।

পলাশ কে রাগিয়ে দিতে এখনো বকুল খুব ভালোবাসে, তবে আগের সাথে তফাৎ হলো, এখন ওই সময়গুলোয় পলাশ আগের মত দামাল হয়না, দস্যিপনা করার জন্য আর বকুলের ওপর হামলে পড়তে পারেনা। পলাশের মনে পড়ে যায় সেসব দিনের কথা, কত অনুরাগ, ভালোবাসা আর আশ্লেষে ভরা ছিল সে দিন গুলো, একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে পলাশের বুক থেকে।

রান্না শেষ করে পলাশ ব্যালকনি তে গিয়ে একটা সিগারেট ধরায়, সারাদিন বকুল ওর জন্য বরাদ্দ করেছে তিন খানি সিগারেট, এটা দিনের প্রথম।

সিগারেট শেষ করে ব্যালকনি থেকে হলঘরে ফেরার সময় গেস্ট রুমের দেয়ালে টাঙানো ছবিতে চোখ পড়ে পলাশের। দুটো উজ্বল চোখ, একটা দামাল হাসি, মাথায় একরাশ কোঁকড়া চুল, একটাই আফশোষ, ছবির গলায় একটা শুকনো ফুলের মালা। হলঘরে গিয়ে পলাশ রক্তিম এর জন্য আনা জুঁই ফুলের মালা টা নিয়ে এসে ছবিতে পরিয়েদেয় আর শুকনো মালা টা খুলে ডাস্টবীনে ফেলে দেয়, একটা ধুপ জ্বালিয়ে দেয় ছেলের ছবির সামনে। মনে পড়ে যায় পলাশের এই ছবিটা রক্তিমের ১৩ বছরের জন্মদিনের ছবি।

ওটাই শেষ জন্মদিন ছিল ছেলেটার। রক্তিম কথা মনে পড়তেই খাটের ওপর বসে পড়ে পলাশ। একটাই ছেলে ছিল ওর আর বকুলের। বকুল আরেকটা বাচ্ছা চেয়েছিল, কিন্তু প্রথম প্রেগনেন্সির সময়ে বকুল যা কষ্ট পেয়েছিল, সেটা মনে করে আর সাহস হয়নি পলাশের, ও জানত বকুল আরেকবার ওরকম ধকল নিতে পারবে না। রক্তিম সারাদিন মাতিয়ে রাখতো বকুলকে। ওরা রক্তিমের যখন ৭ বছর বয়স তখন ডিসেরগড় যায়। খোলামেলা পরিবেশ, খেলার মাঠ, কোয়ার্টার থেকে দামোদর দেখাযায়, দামোদরের ওপাড়ে পঞ্চকুট পাহাড়। রক্তিমেরও খুব ভালো লেগে গেছিল জায়গা টা, খালি বলত “বাবা, আমি এখানেই থাকবো, এখান ছেড়ে কোথাও যাবো না”। কথা রেখেছিল রক্তিম, ডিসেরগড় ছেড়ে আর আসতে হয়নি ওকে। ওখানেই নদীর তীরে শ্মশানে রেখে এসেছিল সেই ১৩ বছরের দামাল ছেলেটাকে। সাইকেল চালাতে শিখেছিল রক্তিম, একটা হিরো সাইকেল কিনে দিয়েছিল পলাশ ওকে। ও আর সৌমাভর ছেলে জয়, বন্ধু ছিল খুব, রোজ দুই বন্ধু বিকেলে সাইকেল নিয়ে ঘুরতে বেরহতো কলোনির রাস্তায়।

রোজকার মত সেদিন রক্তিম বেরিয়েছিল, জয় যায়নি শরীর খারাপ ছিল বলে। হাল্কা বৃষ্টি পড়ছিল, কলোনী থেকে একটু দূরে চলে গেছিল রক্তিম, একটা কয়লা ভর্তি ডাম্পার ব্রেক ফেল করে পিষে দিয়ে যায় রক্তিমের ঝাঁকড়া চুলে ভরা মাথাটা। দুচোখ জলে ভরে আসে পলাশের, বাচ্চাটার মাথাটা বেলচা করে চেঁছে তুলতে হয়েছিল। বকুল কে সামলানো যাচ্ছিলনা। সৌমাভ আর সঙ্গীতা সে সময় পলাশের পাশে এসে না দাড়ালে বকুলকেও বোধহয় তখনই হারাতে হতো।

এসব ভাবতে ভাবতেই, হলঘর থেকে বকুলের ডাক শুনতে পায় পলাশ, “কি গো, স্নান সেরে নাও, আর কত দেরি করবে? এত দেরি করে রোজ খেলে শেষে গ্যাস অম্বলে ভুগে মরবে”।

চোখ মুছে তাড়াতাড়ি গিয়ে বাথরুমে ঢোকে পলাশ, স্নান সেরে বেরিয়ে দুপুরের খাওয়া সেরে নেয়। এবার একটু গল্পের বই নিয়ে বসবে সেই সন্ধ্যে পর্যন্ত, এটাই এখন পলাশের অবসর যাপনের মূল উপায়।

সন্ধ্যার সময় বকুলের ডাকে পলাশের চোখ খুলে যায়, কখন জানি চোখ লেগে গেছিল বুঝতে পারেনি।

শোবারঘরের থেকে বকুলের গলার আওয়াজ আসে, “একটু চা করবে, চা খেয়ে আমি রাত্রে রান্নার জোগাড় করবো”।

পলাশ এগিয়ে যায় ওদের শোবারঘরের দিকে, দেখে বকুল জানলার ধারে দাড়িয়ে নিচের রাস্তায় লোক দেখছে, বলে “চা আমি করছি, কিন্তু রাত্রে রান্নার জন্য তুমি চাপ নিওনা, শুধু একটু ভাত চাপিয়ে দিলেই হবে। সকালে মাছ আর তরকারি যা করেছিলাম এবেলা হয়ে যাবে। তুমি হলঘরে এসে বসো, আমি তাহলে তোমার সাথে কথা বলতে বলতে চা টা করে ফেলব”।

“চলো” বলে একটু হেসে এগিয়ে আসে বকুল। চা করতে করতে হলঘরে বকুলের দিকে তাকিয়ে পলাশের মনে পড়েযায় রক্তিম চলে যাবার পর বকুল একদম ভেঙে পড়েছিল মানসিক ভাবে। কোনো ভাবেই ওদের আর ডিসেরগড়ে থাকা সম্ভব হলনা, ডাক্তাররাও পরামর্শ দিলেন বকুলকে ওখান থেকে অন্য কোথাও নিয়ে যেতে।

সেই সময়েই চেষ্টা চরিত্র করে, কোল ইন্ডিয়া হেড অফিসে বদলি নিয়ে কলকাতায় চলে আসে পলাশ।

প্রথম দুবছর নিয়মিত বকুলকে দেখাতে নিয়ে যেত নাইটিঙ্গেল হসপিটালে একজন সাইক্রিয়াটিস্টের কাছে। বকুল কিছুতেই রক্তিমের চলে যাওয়া টা মানতে পারছিল না, চুপচাপ হয়ে গেছিল একদম, সবসময় নিজের নেতিবাচক চিন্তার মধ্যে ঘোরাফেরা করতো বকুল, রক্তিমের সাথে কথা বলতো নিজের মনেই, বকুলের প্রত্যেক কথায় রক্তিম এর কথা উঠে আসতো।কমপ্লিকেটেড গ্রিফ ডিসঅর্ডার, এটাই নাকি নাম ছিল বকুলের সমস্যার, জানতে পারে সেই সাইক্রিয়াটিস্টের কাছ থেকে। প্রায় দুবছর একটানা চিকিৎসা করানোর পর একটু উন্নতি হয় বকুলের, কলকাতা ছেড়ে আর যেতে চাইতো না অন্য কোথাও। ওই সময়েই বকুল বলে এখানেই একটা ফ্ল্যাট কেনার জন্য। বকুলের কথা রাখতেই এখানে ফ্ল্যাটটা কিনেছিল পলাশ।

চা করে নিয়ে গিয়ে বকুলের পাশে বসলো পলাশ, আলতো হাতে বকুলের মুখের ওপর এসেপড়া কয়েকগাছি চুল সরিয়ে দেয় তারপর বলে “তোমার মনে আছে বকুল আমি প্রথম কবিতা লিখেছিলাম তোমার জন্য”।

“সে আর মনে নেই, কিন্তু তোমার লেখা কি শুধুমাত্র আমার অনুপ্রেরণায় না তাতে শেষের কবিতার ও কিছুটা হাত আছে” প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে পলাশের দিকে তাকিয়ে থাকে বকুল।

চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উন্মনা হলে পড়ে পলাশ, বলে “হ্যাঁ, ঠিক সেকথা, কিন্তু এটাও ঠিক আমার হাতে শেষের কবিতা তুলে দিয়েছিলে কিন্তু তুমি, তাই আমার লেখা কবিতা সবটাই তোমার অঞ্জলী”।

“কি যেনো ছিল প্রথম কবিতাটা তোমার, একবার আবৃত্তি করো প্লিজ” আবদারের সুরে বলে বকুল।

বউএর আবদার ফেলতে পারে না পলাশ, মন্দ্র কণ্ঠে আবৃত্তি করে ওঠে

ভালোবাসার ভাড়ার ঘরে, তোর নামেরই কুলুপ আঁটা।
ইচ্ছেমত নিলেই পারিস, ভালোলাগে যখন যেটা।
ছড়িয়ে দিলে আঁচড়ে নেবে চিল, শকুনে সবটুকু টা,
বাঁচবে না একটুকুও, সেই ভয়েতেই কুলুপ সাঁটা।
ইচ্ছে নদীর প্রেমের ঘাটে, ছোট্ট এক নৌকা বাঁধা,
সেই খেয়া তেই উজিয়ে আসিস, আমার ঘাটে, ইচ্ছে যেমন।
ঘাটের পাশে একাই থাকি, আগলে রাখি ভাড়ারটুকুন,
আমার ঘাটে পূর্ণিমা চাঁদ, অপেক্ষায় আমারই মতন।
চাঁদের আলোয় ভিজিয়ে রাখি, ভালোবাসার অরূপরতন,
ভালোবাসার পাপড়ি সকল, বিছিয়ে রাখি তোর জন্যই;
উদাস মনে।
কোজাগরীর অপেক্ষাতে প্রহর গুনি ইন্দু সনে।

পলাশের মনে হয় যেন বকুলের চোখ গুলো আবার সেদিনের মত মায়াবী হয়ে উঠেছে। সেদিন বকুল কে উশ্রীর তীরে সেই শিব মন্দির এর কাছে নিয়ে গেছিল। বলেছিল “বকুল, তোমার জন্য একটা কবিতা লিখেছি, শুনবে”। কিছুটা অবাক হয়ে তাকিয়েছিল পলাশের দিকে, আগ্রহ ভরে বলেছিল “শোনাও”।

কবিতাটা কেমন হয়েছিল পলাশ জানে না, কিন্তু বকুল সেদিন ভিজেগেছিল পলাশের ভালোবাসায়। ওরা যেনো আরো কাছাকাছি চলে এসেছিল সেদিনের পর।

সেসব দিনের কথা মনে পরলে যেন আজ স্বপ্ন মনে হয় সব। পলাশ হাত বাড়িয়ে বকুলের হাত টা চেপে ধরে, “কি হলো” জিজ্ঞাসা করে বকুল, “কিছুনা, নিজের লাইফলাইন আঁকড়ে ধরছি” তরল হেসে উত্তর দেয় পলাশ।

রাত্রে খাওয়াদাওয়ার পর, সব বাসন পত্র ভিজিয়ে সিঙ্কে রাখে পলাশ। বকুল এসব করতে পারবেনা জানে। বকুলের থাকাটাই ওর কাছে সবটা, ওর বেশি কিছুই চায়না ও।

রাত্রে বকুল কে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে নিজে দুপুরের বইটা নিয়ে বিছানায় শোয়, পড়তে পড়তে কখন ঘুমিয়ে গেছে।

সকাল বেলা ঘুম ভাঙ্গলো কলিংবেলের আওয়াজে। তাড়াতাড়ি চোখ মুছতে মুছতে দরজার দিকে এগিয়ে যায় পলাশ, শান্তা এসেছে বোধ হয়। শান্তা কে দরজা খুলে দিয়ে ভেতরে চলে আসে পলাশ, ও জানে এরপর শান্তা চা করে ঠিক দিয়ে যাবে হলঘরে। সোজা গিয়ে বাথরুমে ঢোকে পলাশ।

শান্তা রান্নাঘর থেকে একটা খবরের কগজের প্যাকেট নিয়ে ভেতরের ঘরে যায়, রক্তিমের ছবির মালা টা বদলে দেয়। প্যাকেটের অন্য মালাটা নিয়ে হলঘরের দিকে যায়। ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে ঢুকেই বকুলের অনিন্দ্য সুন্দর মুখের একটা বিশাল পোট্রেট, হাতের অন্য মালাটা বকুলের ছবিতে পরিয়ে দেয় শান্তা, যেমন সে পরিয়ে আসছে গত এক বছর ধরে।