বিধাতার হাতে লেখা গান – ৩

অভীক মুখোপাধ্যায়

(দ্বিতীয় পর্বের পর)

পর্ব – ৩

আমেরিকার মাটিতে কিন্তু শুধুই শ্বেতাঙ্গদের অধিকার ছিল না। সেখানকার আদি বাসিন্দা রেড ইন্ডিয়ানরা তো ছিলই। হ্যাঁ, এই কথা সত্যি যে, তাদের সংখ্যা কমে আসছিল। অষ্টাদশ শতক যখন শেষ হল, তখন রেড ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা কত দাঁড়াল বলুন দেখি?

২%। আজ্ঞে হ্যাঁ, মাত্র দুই শতাংশ।

কিন্তু তাদের থেকেও বড় একটা কমিউনিটি ছিল। আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গরা। মোট জনসংখ্যার কত শতাংশ?

১৫%। কিন্তু তাদের কাউন্টিং কেউ করতই না। কারণ তারা ছিল দাস। গোলাম। আইরিশ মজদুরদের বদলে আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গদের ব্যবহার করার প্রচলন অনেক আগেই হয়ে গিয়েছিল। ক্ষমতা দূরের কথা, ন্যূনতম অধিকারটুকুও তাদের ছিল না। তাদের মজদুর করে রাখার এই প্রক্রিয়াটা আবার আইনগত ভাবে বৈধ ছিল। দুশো বছর ধরে কালো মানুষগুলোকে আমেরিকার মাঠে খাটানো হচ্ছিল। এরাই আমেরিকার রাজধানীতে আকশচুম্বী ইমারত দাঁড় করাচ্ছিল, আমেরিকাকে বিশ্বসেরা বাণিজ্যকেন্দ্র করে তুলছিল। প্রজন্মের-পর-প্রজন্ম ধরে।

তাহলে এই কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের মুক্ত করার ব্যাপারে কে প্রথম ভাবলেন?

আব্রাহম লিঙ্কন?

না, বন্ধুরা। আরও একটু আগে ফিরে যেতে হবে আমাদের। সালটা ১৮২২। আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জেমস মুনরো এদের মুক্ত করার ব্যাপারে বেশ জোর দিয়েই ভাবনা চিন্তা আরম্ভ করেছিলেন। উত্তর দিকের রাজ্যগুলোতে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার কাজ শুরুও হল। মুক্তি নাহয় পেল, কিন্তু যাবে কোথায়? মার্কিন মুলুকে মাথা গোঁজার জায়গা নেই। তাহলে আফ্রিকা? সেখানে এই কয়েক প্রজন্ম পরে কি আর নিজের ঠাকুরদার বাপ-ঠাকুরদার গ্রাম-জেরাত খুঁজে পাওয়া সম্ভব ছিল? জেমস মুনরো হাল ধরতে এগিয়ে এলেন। পাশে পেলেন আমেরিকার কয়েকজন ধনী সামন্তপ্রভুকেও। তাঁরা পশ্চিম আফ্রিকায় জমি কিনলেন। একটা দেশই গড়ে ফেললেন। নাম দিলেন –লিবেরিয়া। এখানে একটা ফান্ডা আছে, এই লিবেরিয়া নামটা কিন্তু এসেছে লিবারেশন শব্দ থেকে। আশা করি, মানে বলে দিতে হবে না। রাজধানী স্থির হল জেমস মুনরো’র নামে—মুনরোবিয়া। সেই দেশের জাতীয় পতাকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ফ্ল্যাগের অসম্ভব মিল। আজও। মুক্তিপ্রাপ্ত কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের লিবেরিয়াতে পাঠানো হচ্ছিল। কিন্তু মানুষ অভ্যাসের দাস। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাস হিসেবে কাটানো একটি সম্প্রদায় হঠাৎ করে এত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারল না। তারা একজন মালিক খুঁজছিল, যে তাদের আদেশ দেবে। তারা এমন কাউকে পেল না। তাদের স্বপ্নভঙ্গ হল। প্রথম কয়েক খেপ যাওয়ার পরে আর কেউ যেতে চাইছিল না লিবেরিয়াতে। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমেরিকা থেকে যাওয়া কৃষ্ণাঙ্গদের বংশধরের সংখ্যা সেখানে মাত্র ৫%।

কয়েক বছর পরে আয়ারল্যান্ডে দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। ১৮৪০ সালে। আলুর নাবিধ্বসা রোগ। ফসল নষ্ট হতে থাকল। গ্রাম কে গ্রাম মানুষ না-খেতে পেয়ে মরছিল। এবার আয়ারল্যান্ড থেকে মানুষ পালাতে শুরু করল। ওই সময়েই দুজন চাষি আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছালেন। একজনের নাম ছিল প্যাট্রিক কেনেডি। আর একজনের নাম থমাস ফিৎজেরাল্ড। এই দুই কর্তা ভাবছিলেন, নিয়তি আমাদের কোথায় নিয়ে এল? আর বিধাতা হাসছিলেন। অলক্ষ্যে। তিনি তখন নিজের লেখা গানে সুর দিতে ব্যস্ত। কে জানত যে, প্যাট্রিক আর থমাসদের অসহায় ক্যাথলিক পরিবার দুটির মিলনেই সৃষ্টি হতে চলেছে আমেরিকার সবথেকে শক্তিশালী পরিবার?

অপরদিকে ইলিনোয়িসের এক উকিল নাগাড়ে খেটেখুটে রাজনীতিতে নিজের জায়গা পোক্ত করার চেষ্টা করে চলেছিলেন। রবার্ট ব্রুশের গল্পটা মনে আছে তো? উনি সেভাবেই লড়ছিলেন আর হারছিলেন। কিন্তু হাল ছাড়ছিলেন না। এবং রবার্ট ব্রুশের মতোই একটা সময়ে তিনি জিতেও গেলেন। ১৮৬১ সালে ভদ্রলোক আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হলেন। দ্য নেম ওয়াজ আব্রাহম লিঙ্কন। এবং রাষ্ট্রপতির জুতোয় তাঁর পা-গলানো মাত্রই আমেরিকার আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব যুদ্ধের রূপ ধারণ করল।

তখন উত্তর দিকের রাজ্যগুলোতে শিল্পের প্রসার বাড়ছিল। দক্ষিণে তখনও চলছিল খেতখামারের কাজকর্ম, চাষবাস। উত্তর প্রগতিশীল, দক্ষিণ মৌলবাদী। উত্তরের রাজ্যগুলো দাসদের মুক্তি দিয়ে দিয়েছিল। আর দক্ষিণ? তার নিজের অন্নই তখনও কৃষ্ণাঙ্গ মজদুরের মেহনতি হাতের ওপরে নির্ভরশীল। দক্ষিণ আস্তে আস্তে উত্তর থেকে দূরে সরছিল। লিঙ্কন বসতে বসতে দূরত্ব অনেক বেড়েও গিয়েছিল। দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল আমেরিকা। এবং একটি ভাগ লিঙ্কনের উপস্থিতিতেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে আরেকজনের নাম বেছে নিল –জেফারসন ডেভিস।

পাঁচ বছর ধরে লিঙ্কন শুধু যুদ্ধই লড়লেন। ১৮৬৩ সালে গেটিসবার্গে হাজার-হাজার মৃত মানুষের স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন:

‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা এমন একটি দেশের কল্পনা করেছিলেন, যেখানে স্বাধীনতা থাকবে, সব মানুষ সমান হবে। আজ এই যুদ্ধের আবহে আমাদের দেশ কঠিন পরীক্ষার মুখে পড়েছে, আমরা কি আমাদের পূর্বপুরুষদের সেই ধারণাটাকে অক্ষত রাখতে পারব? শহিদদের রক্ত কি তবে ব্যর্থ হয়ে যাবে? আমরা প্রতিজ্ঞা করছি, ঈশ্বরের আশীর্বাদ নিয়ে আমরা একটি নতুন দেশের নির্মাণ করব; এই সরকার হবে জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার এবং জনগণের জন্য গঠিত সরকার; এবং আমাদের আমেরিকা এই পৃথিবীর বুক থেকে কখনও হারিয়ে যাবে না।’

লিঙ্কন সাহেবের কিন্তু কোনো দৈব ক্ষমতা ছিল না। একজন সাধারণ উকিল ছিলেন। কিন্তু রাজনীতিক হিসেবে তাঁর দক্ষতা ছিল অসামান্য। অত্যন্ত চালাক কূটনীতিজ্ঞ। সমস্ত রকমের প্যাঁচপয়জার ব্যবহার করে তিনি গৃহযুদ্ধ জিতে গেলেন। নিজের পক্ষ সমর্থকের সংখ্যা কম থাকা সত্ত্বেও দাসত্ব প্রথার বিরুদ্ধে সংবিধানে জরুরি রদবদল ঘটিয়ে ফেললেন তিনি। বিপক্ষের লোকজনদের মধ্যে কাউকে প্রলোভন দিয়ে কিনলেন, কাউকে আবার ভোটিং-এর সময়ে অনুপস্থিত করে দিলেন। ভারতের রাজনীতিতে আজ এসবের দেখা মিললেও তখন এসব কোথায় কী?

উকিল মানুষ ছিলেন তো, তাই কথায় উকিলের প্যাঁচ থাকতই। মার্কিন সংসদে একটি ভাষণে বলেছিলেন –‘শ্বেতাঙ্গ এবং কৃষ্ণাঙ্গরা এক নয়। এমনকি সব শ্বেতাঙ্গও সমান নয়। মানুষ জাতিটাই এমন যে সেখানে সবাই সমান হতে পারে না। এই ভেদাভেদ থাকবেই। থাকতে বাধ্য। কিন্তু, দেশের আইনের চোখে সবাইকে সমান ভাবেই দেখতে হবে।’

এর একশো বছর পরে ববি কেনেডি কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকার নিজের বক্তৃতা রেখেছেন। তখন হয়তো আমেরিকার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শ্বেতাঙ্গরা তাঁর বিরুদ্ধে বলেছে –‘লিঙ্কনও তো নিগ্রোদেরকে আমাদের সমান সমান ভাবত। তাতে কিছু বদলেছে কি?’

আমেরিকার মাটিতে এই সাদা-কালোর যুদ্ধ এরপরেও চলবে। লিঙ্কনকে গুলি মেরে হত্যা করা হয়েছিল। কেনেডিদেরও তা-ই। লেখার প্রথম পর্বেই লিখেছিলাম একটা হত্যা অনেক সময় অন্য আরেকটা হত্যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে। জাস্ট ওটাই আসল ব্যাপার। আর কিচ্ছু নয়।

(ক্রমশঃ)