বিধাতার হাতে লেখা গান – ৪

অভীক মুখোপাধ্যায়

(তৃতীয় পর্বের পর)

পর্ব – ৪

সারা বিশ্বের লোকেই বলে, আইরিশদের রক্ত আসলে রক্ত নয়, মদ। মদের নেশায় তাদের জুড়ি মেলা ভার।

ভারতে পথে-ঘাটে সহজে মদ খাওয়ার জন্য আপনি কী খুঁজবেন?

পঞ্জাবী ধাবা।

ইউরোপে কী খোঁজা হয় বলুন তো?

আইরিশ পাব। বলা হয় যে, যে আইরিশের বাড়িতে মদে ভরা ট্যাঙ্ক নেই, সে খাঁটি আইরিশই নয়। সেইন্ট ব্রিজিটের কিংবদন্তী সকলের জানা—তিনি পথে পড়ে থাকা কুষ্ঠরোগীদের জন্য জলকেই বিয়ারে পরিণত করে দিয়েছিলেন। অস্কার ওয়াইল্ডের মতো বিশ্বখ্যাত সাহিত্যিক আইরিশ পাবে বসেই সৃষ্টির জাল বুনতেন। গিনিস বিয়ার আর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ হুইস্কি আয়ারল্যান্ডের অবদান।আইরিশ অফির কথা যারা জানেন, তাঁরা নিশ্চয়ই এটাও শুনেছেন যে আইরিশ হুইস্কি ছাড়া আইরিশ কফি তৈরি করা যায় না। তাহলে মদ যাদের জীবনধারায় এভাবে জড়িয়ে রয়েছে, সেই আইরিশরা স্বাভাবিক ভাবেই যখন আমেরিকায় পা-রাখল, তখন তাদের সঙ্গে মদও গেল।

কিন্তু এখানে মদের কথা কেন?

কারণ মদের ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন কেনেডির পূর্বপুরুষেরা। তাঁরা বস্টনে গিয়ে মদের ব্যবসা জমিয়ে বসলেন। আইরিশরা মদের ব্যবসা দারুণ ভাবে করবে এই কথা বলাই বাহুল্য। এটা তাঁদের প্লাস পয়েন্ট। বিত্ত বাড়ল। বাড়ল প্রতিপত্তি। বড়লোক, গরিবলোক সবাই একডাকে তাঁদের চিনত।

আর অর্থ, সম্মান এসব বাড়ার পরে মানুষ কী চায়?

ক্ষমতা চায়।

ক্ষমতা কীসে আসে?

নেতা হলে।

জন এফ কেনেডির ঠাকুরদা প্যাট্রিক জোসেফ কেনেডি এবার সেদিকেই ঝুঁকলেন। এখন যদি কেউ এঁর নাম উইকিপিডিয়াতে লিখে একটা সার্চ মারেন, তাহলে দেখবেন প্যাট্রিকের প্রোফাইলে পলিটিক্যাল পার্টির পাশে লেখা রয়েছে ‘ডেমোক্র্যাট’। বড়সড় নেতাই হয়ে গিয়েছিলেন। হাভার্ডের এক মহিলা চিকিৎসককে তিনি বিয়ে করেন। আর এভাবেই আয়ারল্যাণ্ড থেকে পালিয়ে আসা একটি পরিবার আমেরিকায় এসে অর্থে, সম্মানে এবং সবদিক দিয়ে সম্ভ্রান্ত একটি পরিবারে পরিণত হল।

মদের ব্যবসা করতে পারা ছাড়াও এই আইরিশদের আরেকটা গুণ আছে। মহাগুণও বলা চলে। রাজনীতির খেলায় অবশ্য এটাই প্রতিপক্ষকে মাত করে দেওয়ার জন্য সবথেকে মোক্ষম অস্ত্র। একজনের সঙ্গে কথা বলা, অন্যজনের হাতে হাত রাখা, আর তৃতীয় কোনও ব্যক্তির ওপরে নজর রেখে চলা। একে বলে আইরিশ সুইচ। আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ডের তাসের খেলা ব্ল্যাক জ্যাকের অপর নাম। সেখানে এই গুপ্ত পদ্ধতি মেনেই খেলতে হয়। আর জন এফ কেনেডির দাদু (মায়ের বাবা) জন ফ্রান্সিস ফিৎজেরাল্ড ছিলেন আইরিশ সুইচের মাস্টার। বলা হতো, পাখি উড়তে দেখলে নাকি তাকে দিয়েও নিজের পক্ষে ভোট দেওয়াতে পারেন জন ফ্রান্সিস। সেনেটর হওয়া তাই স্বাভাবিক ছিল। পরে বস্টনের মেয়রও হয়ে গেলেন।

গৃহযুদ্ধের পরে আমেরিকা কিন্তু লাফিয়ে-লাফিয়ে শক্তি বৃদ্ধি করছিল। আজকের এই যে বিজ্ঞান –নির্ভর মহাশক্তিকে আমরা দেখি, তারই প্রস্তুতিপর্ব চলছিল তখন। বস্টনের এম আই টি আর হাভার্ডের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে এঞ্জিনিয়ারিং-এর রথী -মহারথীরা জন্ম নিচ্ছিল। অ্যালিসা গ্রে এবং গ্রাহাম বেল তখন নিজেদের মধ্যে কম্পিটিশন চালাচ্ছেন—কে আগে টেলিফোন আবিষ্কার করবে। থমাস আলভা এডিসন প্রতিবছর একটা করে নতুন জিনিস আবিষ্কার করে চলেছিলেন। নিকোলা টেসলার প্রতিভা বিকশিত হচ্ছিল। রাইট ভ্রাতৃদ্বয় এরোপ্লেন বানিয়ে ফেললেন। আমেরিকার পেটেন্ট দফতরে তখন ফাইলের পর ফাইল আসছে, কটা করে নতুন আবিষ্কার এবং পেটেন্টের দাবীদার একজন করে আমেরিকান। ১৮৬৯ নাগাদ হেনরি ফোর্ড মার্কিন মুলুকে গাড়িও ছোটালেন।

আমেরিকা যখন বিজ্ঞানের হাত ধরে একের পর এক আবিষ্কারের পালক নিজের শিরোপায় গুঁজে চলেছিল, তখন ইউরোপ বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিল। আমেরিকা আর ইউরোপের ভৌগলিক ব্যবধান অনেকটাই। সেটাই কাজে লাগল। তোরা যা করছিস কর গে যা, আমি আমার মত মেতে থাকি—এই ভাবধারা নিয়ে আমেরিকা যুদ্ধবিগ্রহ থেকে দূরেই রয়ে গেল। আমেরিকার যুদ্ধ যেটুকু যা হল, গৃহযুদ্ধই। জেমস মুনরো এই সম্পর্কে একটা কথা বলেই দিয়েছিলেন, ‘আমরা ইউরোপের কোনো ঝামেলায় নিজেদের জড়াব না।’ ইতিহাসে এটাই ‘মুনরো ডক্ট্রিন’ নামে পরিচিত। কিন্তু নিয়তির ওপরে কারো হাত থাকে না। ইচ্ছে না-থাকলেও আমেরিকাকে না গলাতেই হল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের একদম শেষ দিকে জার্মানির সঙ্গে ভিড়ে গেল আমেরিকা। এরপর বিজ্ঞানকে যুদ্ধাস্ত্র তৈরির কাজে লাগাল আমেরিকা। কয়েক হাজার যুদ্ধবিমান বানিয়ে রাখল। শক্তি বেড়ে গেল। রাষ্ট্রপতি উডরো উইলসন যুদ্ধের পরপরই লীগ অব নেশন্স প্রতিষ্ঠা করলেন। এতদিন আমেরিকা শুধু নাকই গলাত, এবার গাইডেন্স দিতে শুরু করল। হয়ে উঠল বিশ্বগুরু।

উডরো উইলসন আরও একটা সাংঘাতিক কাজ করলেন। পাঠকবন্ধুরা হয়তো বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের কথা স্মরণ করবেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, উইলসন সাহেব আমেরিকাতে মদ নিষিদ্ধ করে দিলেন। ১৯২০ সালের ১৭ই জানুয়ারি থেকে আমেরিকাতে শরাব-বন্দি হয়ে গেল। ভাবুন, আমেরিকাতে মদ নিষিদ্ধ হয়ে গেল। জাস্ট কল্পনা করুন!

ভালো করলেন নাকি মন্দ তা বলার জন্য লিখতে বসিনি। তবে দুটো প্রাইমারী ইমপ্যাক্ট ছিল—এক, জনগণ হইহই করে উঠল। দুই, মদের কালোবাজারির ব্যবসায়ীরা ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগল। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হতে চলা জন এফ কেনেডির বংশের মদের ব্যবসার কথা আগেই লিখেছি। এই জন এফ কেনেডির বাবা তখন ব্যবসার হাল সবে ধরছিলেন। উডরো উইলসনের সিদ্ধান্তে ব্যবসা লাটে না-উঠে আরও বৃদ্ধি পেল।

আমেরিকার মাটিতে নতুন একটি শক্তিকেন্দ্র জন্ম নিচ্ছিল—মাফিয়া।

(ক্রমশঃ)