বিধাতার হাতে লেখা গান – ৮

অভীক মুখোপাধ্যায়

(সপ্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৮

যখন জো জুনিয়র কেনেডির জন্ম হয়, তখন পাপা জো কেনেডি বলেছিলেন—‘আমার ছেলে রাষ্ট্রপতি হবে।’

আচ্ছা, বলে নাহয় দিলেন। কিন্তু রাষ্ট্রপতি করে তোলাটাও তো আর সহজ ব্যাপার নয়। রাজনীতি জানা-বোঝা ছাড়াও চাই আরেকটা জিনিস—গ্রুমিং।

বন্ধুরা, এই জায়গাটাতে এসে কিন্তু আপনারা কেনেডি পরিবারের সঙ্গে আমাদের দেশে গান্ধী-নেহরু পরিবারটির একটা তুলনা করতে পারেন। শ্রদ্ধেয় শ্রী মতিলাল নেহরুর সময়কাল থেকেই নেহরু পরিবারে গ্রুমিং শুরু হয়ে গিয়েছিল। এবং কেনেডিদের থেকে নেহরুরা কিন্তু তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি সফল, কারণ তাঁদের পরিবার থেকে পরপর তিনটি প্রজন্ম ভারতের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। গান্ধী-নেহরু পরিবারের কথা বলুন কিংবা কেনেডি ফ্যামিলি, এখানে সন্তানেরা সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম নেয়। এবং এই লেখার একেবারে প্রথম পর্বে অদ্ভুত মৃত্যুগুলোকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত বলে একটা কথা বলেছিলাম, সেটা মাথায় রেখে আবারও লিখছি—কেনেডি পরিবার ও গান্ধী-নেহরু পরিবারের মধ্যে গুলি করে হত্যা তথা প্লেন অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যুর মতো ব্যাপারগুলোতেও অসম্ভব রকমের মিল রয়েছে।

জো কেনেডি জুনিয়র আর জন এফ কেনেডি এই দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাইয়ের যোগ্যতা বেশি বলেই মনে করা হতো। পড়শোনায় এগিয়ে। খেলাধূলায় এগিয়ে। এবং এগিয়ে ছিলেন রাজনীতিতেও। স্কুল-কলেজ সব জায়গাতেই বড় ভাইয়ের ছায়ায় চলতো ছোট ভাই। আর পিঠোপিঠি দুই ভাইয়ের মধ্যে নানা ব্যাপার তো চলেই। দাদা ছিল দাপুটে। ছোট ভাইকে চড়চাপড় ধরিয়ে দেওয়া কোনো ব্যাপারই ছিল না। খেলায় বা কোনো বাজিতে হারিয়ে সবার সামনে উপহাস করার মতো ঘটনা আকছার ঘটত। ছোট ভাই জন বেশিরভাগ সময়টাই অসুস্থ থাকতেন। রোগা রোগা চেহারা। বোর্ডিং স্কুলে পড়তে পাঠানো হতো বটে, কিন্তু অসুস্থ হয়ে বাড়িতেই পড়ে থাকতেন প্রায় সবসময়। তাই সব দিক দিয়ে বিচার করলে বড়দা জো জুনিয়র থাকতে জনের রাষ্ট্রপতি হতে পারার কোনো চান্সই ছিল না।

কেনেডিরা ক্যাথলিক আগেই লিখেছিলাম। স্বাভাবিক ভাবে অনেক বৈষম্যের মুখে পড়তে হয়েছিল পাপা জো-কে। আগেই উল্লেখ করেছি যে, আমেরিকা চিরকালই প্রোটেস্ট্যান্টদের শক্ত ঘাঁটি। সেখানে জন এফ কেনেডির আগে বা পরে কোনো ক্যাথলিক প্রেসিডেন্ট আসেননি। সেই মাটিতে দাঁড়িয়ে একজন ক্যাথলিকের, নিজের ছেলেকে রাষ্ট্রপতি করে তোলার স্বপ্ন দেখা মানে কিন্তু সহজ কথা ছিল না। পাপা জো চাইছিলেন জুনিয়র জো হয়ে উঠবেন শ্রেষ্ঠতম। টপ ক্লাস! সবকিছুতে সেরার সেরা! এবং জুনিয়র জো তা-ই ছিলেন। ওদিকে জন এফ কেনেডিও দাদার পিছু পিছু হার্ভার্ড অবধি পৌঁছে গেলেন।

ভাবুন, কুড়ি –বাইশ বছরের ছেলেরা কেরিয়ার নিয়ে ভাবছে। আর আলটিমেট লক্ষ্য কী? রাষ্ট্রপতির পদ। জন একটু পিছিয়ে পড়লেও মেয়েমহলে কিন্তু দারুণ পপুলার ছিলেন। অবশ্য শুনলে কী বলবেন জানি না, এটা ছিল পাপা জো-র ট্রেনিং-এর একটা পার্ট। তিনি নিজে ন’ সন্তানের বাবা হওয়ার পরেও বেশ বুড়ো বয়েসেই হলিউডের স্বপ্নসুন্দরীকে শয্যাসঙ্গিনী করতেন।

বাপ কা বেটা, সিপাহী কা ঘোড়া।

বহুত নহিঁ তো থোড়া থোড়া।।

ছেলেরাও একই চরিত্র পেলেন। শোনা যায়, জন এফ কেনেডির পার্টিতে আসা প্রত্যেকটি মেয়ে তাঁকে একান্ত আপন ভাবে চাইত। হবে না-ই বা কেন? ধনদৌলত, সৌম্য – সুদর্শন যুবক, হার্ভার্ডের ছাত্র, আইরিশ রক্ত আর আমেরিকান স্টাইল—মারকাটারি কম্বিনেশন।

পাপা জো কেনেডি লবি করতে-করতে ইংল্যান্ডে আমেরিকান রাজদূত হয়ে গেলেন। আইরিশদের সঙ্গে আবার ইংল্যান্ডের সাপে-নেউলে সম্পর্ক, কিন্তু পাপা জো পাকা খিলাড়ি—আমেরিকার রাজদূত হয়ে ওখানে যেতেই ভোল বদলে এলিট হয়ে গেলেন। সেখানকার মহারাজা-মহারানিদের সঙ্গে লাঞ্চ-ডিনার সারছিলেন। আবার ইচ্ছে হলে ভ্যাটিকানে গিয়ে পোপের সঙ্গে দেখাও করে আসছিলেন।

আর আমাদের কথার কেন্দ্রীয় চরিত্র জন এফ কেনেডি? তিনি তখন কী করছিলেন, বলুন তো? বাবার সঙ্গে গোটা ইউরোপ ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। নিজের ডায়েরিতে টুকে রাখছিলেন প্যারিসের সন্ধ্যার সৌন্দর্য, হিটলারের বর্বরতার কাহিনি, মুসোলিনির ফ্যাসিজম। ফ্রান্সের স্নিগ্ধতা দেখে জনের মনে হয়েছিল এখানে যুদ্ধ হতেই পারে না। আবার জার্মানিতে উগ্র রাষ্ট্রবাদী ভাবনায় ‘হেইল হিটলার’ বলা লোকেদের দেখে ভয় পেয়েছিলেন জন—এখানে যুদ্ধ কে আটকাবে? পাপা জো পাকা মাথার লোক। তাঁর বক্তব্য ছিল যুদ্ধ বাঁধলে হিটলার ইংল্যান্ডের পক্ষ নেবেন। আর অপরিণত বুদ্ধির জন এফ কেনেডি বলছিলেন, ‘না, তা হবে না।’

দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে দিগগজ হয়ে ওঠা (দাদা) জো জুনিয়রকে দানে মাত দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে মহাদিগগজ হয়ে উঠছিলেন জন এফ কেনেডি। তাঁর কথা শুনলে মনে হতো যে তিনি চোখের সামনে সবকিছু দেখতে পাচ্ছেন। যেমন বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন, হিটলারের উচ্চাশা, রাশিয়ার সাম্যবাদে শেষ আঘাত, হিটলারের অবশ্যম্ভাবী পতন, এবং মহাশক্তি রূপে আমেরিকার উত্থান।

জনের মধ্যেকার এই পরিবর্তন টের পেতে শুরু করেছিলেন পাপা জো। তিনি বলেছিলেন—‘আমি যা করতে পারিনি, সেটা আমার বড় ছেলে করে দেখাতে পারবে। আর জন হবে আমার আসল উত্তরাধিকারী।’

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আসছিল। আর কেনেডিদের জীবনে ঝড় আসতে চলেছিল। শুরু হতে চলেছিল তাঁদের মৃত্যুর শৃঙ্খলা।

(ক্রমশঃ)