বিধাতার হাতে লেখা গান – ২৭

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ষড়বিংশতিতম পর্বের পর)

পর্ব – ২৭

‘বিশ্বের সবথেকে বড় শক্তি সাম্যবাদও নয়, পুঁজিবাদও নয়। হাইড্রোজেন বোমাও নয়, মিসাইলও নয়। সবথেকে বড় শক্তি হল মানুষের স্বাধীনতা। কোনো দেশকে জয় করতে গেলে, তার ওপরে রাজত্ব করলে চলবে না। তাকে স্বাধীনতা দিতে হবে।’

–জন এফ কেনেডি, সেনেট ভাষণে, জুলাই / ১৯৫৭।

কিউবা। তখন লাতিন আমেরিকার লাস ভেগাস ছিল ওটাই। কিউবার সুন্দরী সৈকতে আমেরিকানরা ছুটি কাটাতে যেত। মদের ফোয়ারা আর চুরুটের ধোঁয়ায় মস্তি করত। ক্যাসিনোতে জুয়া খেলত। আর কিউবার সুন্দরীদের নিয়ে চলত স্বপ্ন – সহবাস। কিউবার আদ্ধেকের বেশি সম্পত্তির ওপরে আমেরিকানদের অধিকার ছিল। প্রায় সবক’টা খাদান আর তেল কোম্পানির মালিক ছিল আমেরিকানরাই। আমেরিকান ইতালিয়ান মাফিয়া লান্সকি আর লুসিয়ানো ছিল ওখানকার শের। তখন কিউবার একনায়ক ছিলেন বাতিস্তা। সেই বাতিস্তাকেও এই লান্সকি আর লুসিয়ানো নিজেদের পকেটে রাখত। আর জনগণ? তারা তখন ভগবান -ভরসায় দিনগত পাপক্ষয় করছিল। কেনেডি নিজের একটি ভাষণে একবার বলেছিলেন যে, বাতিস্তা নিজের সাত বছরের রাজত্বকালে কুড়ি হাজার কিউবান নাগরিককে হত্যা করেছিলেন।

১৯৫৯ সালের পয়লা জানুয়ারি তেত্রিশ বছর বয়সী এক তরুণ উকিল ফিদেল কাস্ত্রো ট্যাংক আর নিজের গেরিলা বাহিনী নিয়ে কিউবার রাজধানী হাভানাতে ঢুকে গেলেন। কেউ কোথাও কোনো বাধা দিল না। বাতিস্তা নিজের মন্ত্রীদের নিয়ে এক সপ্তাহ আগেই ফেরার হয়ে দিয়েছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন পাঁচশো মিলিয়ন ডলার। উন্মত্ত জনতা রাস্তায় নেমে ভাঙচুর করছিল। লুটতরাজ চলছিল। এরই মধ্যে দিয়ে কাস্ত্রোর বাহিনী হাত নাড়াতে নাড়াতে, ট্যাঙ্ক চালিয়ে রাজধানীর দখল নিল। কাস্ত্রো শুধু শুধুই ট্যাংকে চড়ে গিয়েছিলেন। তার বদলে যদি সাধারণ একটা গাড়িতে করেও যেতেন ওঁকে কেউ আটকাত না। এই গেরিলা বাহিনীর ভয় দেখিয়েই বাতিস্তা আমেরিকার থেকে লাখ লাখ ডলার আদায় করত। টাকা হাতে এলেও কাস্ত্রোর বাহিনীর বিরুদ্ধে কোনোদিনই বাতিস্তার সেনাদল সেভাবে লড়াইটাই করেনি।

কাস্ত্রো ক্ষমতায় আসতেই জমিদারদের কাছ থেকে জমি কেড়ে নিয়ে সেইসব জমি রাষ্ট্রের নামে করে দিলেন। শিক্ষা আর স্বাস্থ্য পরিষেবা চিরদিনের জন্য বিনামূল্যের হয়ে গেল। ক্যাসিনো আর জুয়ার ঠেক বন্ধ করে দেওয়া হল। মাফিয়া আর গ্যাংস্টারেরা কিউবা ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হল। এখানে মজার ব্যাপার হল, এরাই কিন্তু কাস্ত্রোর এই অভ্যুত্থানে অর্থের জোগান দিয়েছিল। তবে কাস্ত্রো এসব তামাশা খুব বেশিদিন চালাননি। কিছুদিন পরে তিনি আবার সব ক্যাসিনো খুলিয়ে দিলেন। মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর কথা আগেই বলেছি। তাদের সঙ্গেও কিন্তু কাস্ত্রোর সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন হয়নি।

কাস্ত্রো এবং ওঁর এক সহযোদ্ধা মিলে পুরোনো সরকারের বেশ কিছু সমর্থকদের গুলি মেরে হত্যা করে মৃত্যুদণ্ড দিলেন।

কে এই সহযোদ্ধা?

চে। চে গুয়েভেরা।

তিনি একজন চিকিৎসক। আর্জেন্টেনিয়ান মূলের এক যুবক। বিপ্লবের পোস্টার বয়। তিনি বিপ্লবকেই রাজনীতি মনে করতেন।

আর কাস্ত্রো?

আপাদমস্তক একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তামাম দুনিয়া কাস্ত্রোকে সাম্যবাদী ভাবলেও তিনি নিজেকে কোনোদিনই সাম্যবাদী বলে ঘোষণা করেননি। তিনি ভাবতেন রাজনীতিই বিপ্লব আনতে পারে।

এপ্রিল মাস, ১৯৫৯ সাল। কাস্ত্রো গেলেন আমেরিকায়। তিনি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ারের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করেছিলেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট পাত্তাই দিলেন না। চলে গেলেন গলফ খেলতে। দেখা হল না। রিপোর্টারেরা যখন কাস্ত্রোর মুখের সামনে বুম – মাইক ধরল, তখন কাস্ত্রো বললেন — ‘ও কোনো ব্যাপারী নয়। আমরা আমেরিকার জন্যে অপেক্ষা করে বসেও নেই। আমাদের নিজেদের দেশকে আমরা নিজেরাই দাঁড় করাব।’

পরের বছর কাস্ত্রো ইউনাইটেড নেশনস্-এর সম্মেলনে গেলেন। সেখানে সাড়ে চার ঘণ্টার ভাষণ দিলেন তিনি। আজ পর্যন্ত এটাই দীর্ঘতম ভাষণের বিশ্ব রেকর্ড হিসেবে অটুট রয়ে গেছে। ওখানে আমেরিকান রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ারের মুখোমুখি হলেও তিনি কাস্ত্রোর সঙ্গে কোনো কথাই বললেন না।

কিন্তু কারো কারো কপালে এমন যোগাযোগ লেখা থাকে, যা তাঁকে সর্বোচ্চ সাহায্য প্রাপ্তির দিকে এগিয়ে দিতে পারে। কাস্ত্রোর সঙ্গে প্রথমবারের জন্য দেখা হল নিকিতা ক্রুশ্চেভের। রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি কাস্ত্রোকে আলিঙ্গন করে বললেন — ‘আপনার যা সাহায্য লাগলে আমরা তা করব। দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলুন।’

সোজা হিসেবটা ছিল, আমেরিকার প্রতিবেশী একটি দেশের সর্বশক্তিমান নেতা নিজে রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। ওই নেতা খানিকটা সমাজবাদী চিন্তাধারা রাখেন, তাই তাঁকে কমিউনিস্ট বানিয়ে ফেলা এমন কোনো কঠিন কাজ ছিল না। কেউ কেউ আবার বলে, এই সম্পর্কের শুরুটা ইউ এন সম্মেলনে হয়নি; রাশিয়াই নাকি কিউবার গেরিলা যুদ্ধের ফান্ডিং করে কাস্ত্রোকে ক্ষমতায় এনেছিল।

কিন্তু কোথায় কিউবা, আর কোথায় সোভিয়েত রাশিয়া। অত দূর থেকে কতই বা সাহায্য করবে রে বাবা! এদিকে আইজেনহাওয়ার কিউবার ওপরে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা জারি করছিলেন। কাস্ত্রোও সাধ্যমতো পালটা চাল দিলেন। কিউবাতে আমেরিকান তেল কোম্পানি কিংবা ফিনান্সিয়াল ইনস্টিটিউশনগুলোর রাষ্ট্রায়ত্তকরণ আরম্ভ করলেন। আমেরিকার বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞা কিউবাকে আর্থিক ভাবে দুর্বল করলেও স্বনির্ভর করে তুলছিল।

আমেরিকার বল আর কৌশলের পাশাপাশি ছিল মারাত্মক ছল। কিছু গোপন ষড়যন্ত্র চলছিল। কিউবা থেকে আমেরিকায় পালিয়ে আসা লোকদের সাউদ ফ্লোরিডাতে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছিল। সি আই এ রাতারাতি চক্রান্ত করে কিউবাতে বহু খেতের ফসলে আগুন ধরিয়ে সব নষ্ট করে দিল। একটি তেল কোম্পানিতে ভয়াবহ আগুন লাগল। গুয়াতেমালাতে কিউবার সঙ্গে লড়াই করার জন্যে ট্রেনিং হচ্ছিল।

যখন এসব চলছিল, তখন জন এফ কেনেডি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে লড়ছিলেন। নিজের নির্বাচনী ভাষণে তিনি বলছিলেন—

‘সাম্রাজ্যবাদের দিন শেষ। আলজিরিয়া বলুন, ভিয়েতনাম বলুন, কিউবা বলুন কিংবা জার্মানি। আমাদের ভূমিকা শুধু এটুকুই হবে যে তারা যে সরকারকে বাছবে, তাদের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখা। আমাদের সমস্ত সাহায্য শুধু এই কাজটার জন্যেই করে যেতে হবে। তাদের ওপরে আক্রমণ করে তাদের ওপরে রাজত্ব করব, প্রভুত্ব করব এমন মানসিকতা বর্জন করাই শ্রেয়।’

আশা করি, সুধী পাঠকদের মনে পড়ছে যে কেনেডিকে এই গুরু-জ্ঞান কে, কখন দিয়েছিলেন। তিনি কিন্তু এক ভারতীয়ই ছিলেন। পণ্ডিত নেহরু। কেনেডি ভালো – ভালো কথা বলছিলেন বটে, কিন্তু অদৃষ্টে হাসছিলেন বিধাতা। কারণ কেনেডি জানতেন না তিনি ক্ষমতায় আসার পরেই কিউবার ওপরে গুপ্ত আক্রমণ চালানোর রণনীতি নির্ধারিত হবে। যা তিনি চাইছেন না, সেই কাজগুলোই তাঁকে দিয়ে জোর করে করানো হবে।

কে করাবে?

সে কথাই তো বলব। একটু – একটু করে।

কোল্ড ওয়ার আমেরিকা আর সোভিয়েত দেশে এমন কিছু গোপন সংস্থার জন্ম দিয়েছিল, যাদের ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। তাদের চলার পথে রাষ্ট্রপতি বাধা দিলে সেই কাঁটাটিকেও উপড়ে ফেলতে কসুর করবে না তারা।

জন এফ কেনেডি তখন হোয়াইট হাউসের স্বপ্ন দেখছিলেন। তিনি জানতেন না যে, তাঁর স্বপ্নের হোয়াইট হাউস বাইরে থেকে দেখতে যতখানি সাদা, ভেতর থেকে ঠিক ততটাই কালো।

(ক্রমশঃ)