বিধাতার হাতে লেখা গান – ২৮

অভীক মুখোপাধ্যায়

(সপ্তবিংশতিতম পর্বের পর)

পর্ব – ২৮

রাজনীতিতে যখন পরিবারতন্ত্র ঢুকে যায়, তখন সেটা আর ফ্যামিলি থাকেনা। কোম্পানি হয়ে ওঠে। এন্টারপ্রাইজ। যত বড় পরিবার, তত বড় এন্টারপ্রাইজ। সেখানে কেউ ম্যানেজার, কেউ ফিনান্সার। যেমন জন এফ কেনেডির ম্যানেজার বলা চলে ভাই ববিকে। ফিনান্সার ছিলেন পাপা জো কেনেডি। ভোটের অঙ্ক দেখারও লোক ছিল, ভগ্নীপতি স্টিভ। বোনেরা সবাই প্রচারের দিকটা দেখতেন। আর গ্ল্যামার কুইন স্ত্রী জ্যাকি কেনেডির কথা নাবললেও চলে, সবাই জানে।

জন এফ কেনেডির একটি সাক্ষাৎকারের কিছুটা তুলে দিলাম:

  • সেনেটর, প্রতিটা ম্যাগাজিনের ফ্রন্ট কভারে আপনার ছবি ছাপা হচ্ছে, কিন্তু কেন? আপনি তো হলিউড সেলেব্রিটি নন?

  • একা আমারই ছাপছে নাকি? আমার স্ত্রী কত সুন্দরী তা তো দেখেইছেন, ওঁর পাশে থাকায় আমার ছবিটাও ছাপা হয়ে যাচ্ছে।

  • সবাই বলছে, আপনি প্রেসিডেন্টের পদের জন্য ভোটে দাঁড়ালে আপনার বাবা সব ভোট কিনে নিয়ে আপনাকে জিতিয়ে দেবেন।

  • (কেনেডি হেসে ফেললেন) না। সব ভোট কেন কিনবেন? আমার বাবা পাকা ব্যবসাদার, ঠিক যে ক’টা ভোট হলেই আমার জেতা কনফার্ম হয়ে যাবে, সে ক’টাই কিনবেন। তার থেকে একটাও বেশি নয়, একটাও কম নয়।

  • আপনার বাবা হিটলারের সমর্থক ছিলেন। আপনি?

  • কী বলছেন আপনি? আমি নিজে নেভিতে জয়েন করে হিটলারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি। আমার দাদা হিটলারের সেনার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে মারা গেছেন।

  • তাহলে আপনি বলছেন যে, আপনি নাৎসি নন? উদারপন্থী?

  • অবশ্যই। একথা আলাদা করে বলার মতো কিছু নয়।

  • আচ্ছা, আপনি কি জানেন যে এর আগে আমেরিকাতে কোনো ক্যাথলিক ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি হননি?

  • আমি তো একজন ক্যাথলিক হিসেবে ভোটে লড়ছি না, লড়ছি একজন ডেমোক্র্যাট নেতা হিসেবে। তবে এই কথা বলতেই পারেন যে যদি আমি জিতে যাই, তাহলে আমেরিকা এমন একজন রাষ্ট্রপতিকে পাবে, যে ক্যাথলিকও বটে।

  • এদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের পাদ্রীরা বলছেন, আপনি আসার পরেই এখানে পোপের রাজত্ব শুরু হয়ে যাবে। আপনি কি পোপের আদেশেই দেশ শাসন করবেন?

  • যদি হোয়াইট হাউজ থেকে ইতালি পর্যন্ত এমন কোনো সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়, তাহলে সেটাকে দেখাশোনা করার সব দায়িত্ব আমি ওঁদেরই দেব। চিন্তা করতে মানা করুন।

  • কিন্তু সেনেটর, এটা যে ক্যাথলিক রাষ্ট্র নয় সেকথা তো আপনাকে মানতেই হবে?

  • দেখুন, যে কথাগুলো বলছেন, সেসব থেকে আমরা অন্তত একশো বছর এগিয়ে এসেছি। মনে রাখবেন, আমেরিকার গভর্নমেন্টটাকে কিন্তু চার্চ চালাচ্ছে না, চালাচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক সরকার।

  • প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি হ্যারি ট্রুম্যান বলেছেন, পোপকে ভয় করার কারণ থাকলেও আপনার পপকে (পাপা জো কেনেডি) ভয় করার যথেষ্ট কারণ আছে।

  • উনি ভয় পান শুনে ভালো লাগল। আমি অবশ্য পাই না। না পোপকে, না পপকে।

১৯৫৬ সালে জন এফ কেনেডি ডেমোক্র্যাটিক পার্টির পক্ষ থেকে উপ রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দিলেন। এবং সেই ভোটে তিনি হেরেও গেলেন। ১৯৬০ সালে যখন উনি রাষ্ট্রপতি পদের জন্য মনোনয়ন পত্র জমা দিলেন, তখন নানা প্রশ্ন উঠল। প্রথমটাই ছিল কেনেডির ধর্মমত নিয়ে। তিনি ক্যাথলিক। একজন ক্যাথলিক প্রেসিডেন্টের ছবি কল্পনা করাটা আমেরিকানদের কাছে সত্যিই ভীষণ কঠিন কাজ ছিল।

কেনেডি ভার্জিনিয়া শহরে প্রোটেস্ট্যান্টদের ভিড়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেওয়া ভাষণে বললেন —

আমি জন্মসূত্রে একজন আইরিশ ক্যাথলিক। কিন্তু একজন ক্যাথলিক ব্যক্তি কি আমেরিকার রাষ্ট্রপতি হতে পারে না? যদি নাই পারে, তাহলে আমাকে সেনেটেই বা ঢুকতে দেওয়া হল কেন? আমেরিকার হয়ে যুদ্ধই বা করতে দেওয়া হল কেন? আমার দাদা দেশের জন্য কেন প্রাণ দিলেন? আপনারাই বলুন, আর কীভাবে, কতভাবে প্রমাণ করতে হবে যে আমি একজন আমেরিকান? দয়া করে আমার ধর্ম দেখবেন না, আমার কর্ম দিয়ে আমাকে বিচার করুন!’

কেনেডি আবেগমথিত ভাষণ দিয়ে চলেছিলেন। ভাই ববি তখন পুলিশকে, ভোটার লবিকে, বিপক্ষের লোকদের সেটিং করতে ব্যস্ত। ভদ্র ভাষায় বললে বলা চলে, ভোট কিনছিলেন ববি। রাষ্ট্রপতি পদের অন্যান্য দাবীদারদের কাছে এত তাকাই ছিল না যে তাঁরা জন এফ কেনেডির সঙ্গে লড়ে জিতবেন। মাফিয়া গ্যাংস্টারদের শহরের মেয়রদের ম্যানেজ করার কাজ চলছিল।

দলের সবথেকে ক্ষমতাবান তথা অভিজ্ঞ নেতা লিন্ডন জনসন জনের বিরুদ্ধে প্রায় জেহাদই ঘোষণা করে দিলেন। প্রকাশ্যে বিবৃতি দিলেন — ‘ও, এবার থেকে তাহলে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ভোট কিনে লড়া হবে? বাপ কোটিপতি হলে তার আনাড়ি ছেলেও রাষ্ট্রপতি হয়ে যাবে, শুধু টাকার জোরে, তাই তো?’

ববি এই সময়ে সাম – দাম – দণ্ড – ভেদ প্রয়োগ করলেন। কেনেডিকেই প্রার্থী হিসেবে বেছে নেওয়া হল। পিছিয়ে গেলেন লিন্ডন জনসন।

জন নাহয় রাষ্ট্রপতি হবেন। উপ – রাষ্ট্রপতি পদের জন্যে উপযুক্ত প্রার্থী বাছার দরকার ছিল। ববি এবারে সোজা চলে গেলেন লিন্ডনের কাছেই — ‘হতে পারে আপনি জ্যাক (জন)কে অপছন্দ করেন, কিন্তু দলের সবথেকে অভিজ্ঞ নেতা তো আপনিই। জ্যাক বলে পাঠিয়েছে যে, আপনাকে ছাড়া এই যুদ্ধ লড়ে ও জিততে পারবে না।’

এই কথা শুনেই জনসন আবেগে আটখানা হয়ে গেলেন — ‘সত্যি? জ্যাক এই কথা বলেছে? ও আমাকে নিয়ে লড়তে চায়? যদি এটাই হয়, তাহলে আমি নিজের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আজ ভবিষ্যৎবাণী করছি, আমেরিকার পরবর্তী রাষ্ট্রপতির নাম হবে জন ফিৎজেরাল্ড কেনেডি। সাউদ আমেরিকার সব ভোট যাতে জনের ঝুলিতেই পড়ে, তার দায়িত্ব আমার। তুমি উত্তর দিকটা দেখো।’

হোয়াইট হাউসের মোহ জনসনেরও ছিল, এবার উপ রাষ্ট্রপতি হিসেবেই নিজেকে সেখানে দেখতে চাইলেন। তবে বিধাতা সবার জন্যেই জায়গা ঠিক করে রেখেছিলেন। এরপর কেনেডি রাষ্ট্রপতি হলেও তাঁর গুপ্তহত্যা হবে, লিন্ডন জনসন নাচাইতেই রাষ্ট্রপতি হবেন।

(ক্রমশঃ)