বিধাতার হাতে লেখা গান – ৩০

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ঊনত্রিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৩০

কত রাষ্ট্রপতি আমেরিকার মসনদে বসলেন এবং বিদায়ও নিলেন, কিন্তু আমেরিকার ইতিহাসে প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে অবিসংবাদিত ভাবে রাজত্ব করলেন অপর একজন ব্যক্তি। ঠিক যেভাবে চেয়েছেন, সেভাবেই করেছেন। যখন চেয়েছেন, তখনই। যতটা চেয়েছেন, ততটাই। আমেরিকানরা ওঁকে চেনেন ‘টপ কপ’ হিসেবে। তবে টপ কপের ভারতীয় প্রতিভূ রূপে যেন ‘র’-এর রামনাথ কাও’কে ভেবে বসবেন না। আর এন কাও-এর ভাবমূর্তি তুলনামূলক ভাবে অনেক স্বচ্ছ। বরং আমেরিকার এই মহাশয়ের মতো ভারতে কোনো টপ কপ জন্ম নিলে তাকে বলা হবে ‘বর্দি ওয়ালা গুণ্ডা’। ওঁর বক্তব্য ছিল — ‘মাফিয়ার সঙ্গে লড়তে হলে আমাদের মাফিয়াই হতে হবে। যে আমাদের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে, তাকে সরিয়ে দাও।’

কার কথা বলা হচ্ছে বলুন তো?

এফ বি আই –এর প্রথম ডিরেক্টর — জন এডগার হুবার।

কেনেডি যখন হোয়াইট হাউসে যান, তখন সেখানেই তাঁর সঙ্গে হুবারের সাক্ষাৎ হয়। কেনেডির মনে হয়েছিল, সিংহের গুহায় পা রেখেছেন। অবশ্য এই ভাবনাটা মোটেই ভুল ছিল না।

হুবার আটজন রাষ্ট্রপতি দেখেছিলেন, দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ দেখেছিলেন, আরও কত কী দেখেছিলেন তার কোনো ইয়ত্তা ছিল না। তবে যা দেখেছিলেন, তার অনেক কিছু হুবারের মৃত্যুর পরে সামনে আসে — গোপন ফাইলে বন্দি ছিল, হাজার হাজার ফাইলে।

হুবার বড় হয়ে উঠেছিলেন আমেরিকার শক্তি-কেন্দ্র ‘ক্যাপিটাল হিল’-এ। ওঁর ঠাকুরদা ছিলেন দিনমজুর। মিস্ত্রির কাজ করতেন। ঠাকুরদা নিজের হাতে একদা হোয়াইট হাউস আর সেনেটের ইট গেঁথেছিলেন। হুবারের জীবনযাপনটা একটু দেখে নেওয়া যাক। ভদ্রলোক বিয়েথা করেননি। ওয়াশিংটনে বসবাস করেছেন। ওখানেই মৃত্যু হয়। দিনচর্যা ছিল অদ্ভুত নিয়মনিষ্ঠ। সকালে রোজ একই সময়ে ঘুম থেকে উঠতেন, প্রতিদিন একই সময়ে খেতেন, এবং রাতে একেবারে ঘড়িধরা সময়ে ঘুমোতে যেতেন। আর রোজই একই খাবার খেতেন। যিনি ১৯২৪ সালে ওঁর সেক্রেটারি হয়েছিলেন, তিনিই ১৯৭২ সাল পর্যন্ত ছিলেন — ওঁর মৃত্যু না-হওয়া পর্যন্ত একই সেক্রেটারি।

হুবার কিন্তু পুলিশ ছিলেন না। ছিলেন একজন পাতি কেরানি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে যখন রাশিয়া থেকে সাম্যবাদের ঢেউ উঠছে, তখন উনি সাম্যবাদীদের মিটিং অ্যাটেন্ড করতেন। মার্ক্স আর লেনিনের সম্পর্কে পড়তেন। এসবকিছু করলেও উনি কিন্তু সাম্যবাদী ছিলেন না। এসবই ছিল ওঁর নিজস্ব গুপ্তচরবৃত্তির একটা অঙ্গ। হুবার নিজে কমিউনিস্টদের নামের একটা তালিকা বানিয়েছিলেন। হুবার কমিউনিস্টদের ঘেন্না করতেন, কিন্তু ওইসময়ে হুবারের কোনো ক্ষমতা ছিল না, তাই কিছু করতেও পারতেন না।

ঠিক তখনই আমেরিকার আটটি শহরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটল। একইসঙ্গে। একটি বোমা ফাটল অ্যাটর্নি জেনারেল পামরের বাড়ির ঠিক বাইরেটাতেই। ভবিষ্যতের রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট এবং মিসেস রুজভেল্ট পাশের পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন সেইসময়, তাঁরা দৌড়ে গেলেন পামরের বাড়ি। ৩৬ জন সেনেটর ও আধিকারিকদের বাড়িতে ডাক মারফত লেটারবম্ব পাঠানো হয়েছিল। একজন সেনেটরের বাড়ির পরিচারিকার হাতে একটি বোমা ফেটেও যায়।

আমেরিকায় আবার উপ-রাষ্ট্রপতির থেকে অ্যাটর্নি জেনারেলের ক্ষমতা বেশি। পামরের ওপর আক্রমণ হয়েছিল। তিনি বললেন — এসব কমিউনিস্টদের কাজ। সবকটা’কে ধরো!

ব্যাস! হুবারের হাতে সুবর্ণ সুযোগ এসে গেল। বলতে গেলে সাম্যবাদ – বিরোধী একটা লেঠেল বাহিনী তৈরি করে হুবার বেরিয়ে পড়লেন। ট্রেড ইউনিয়ন লিডার, ইতালিয়ান কিংবা মেক্সিকান কিংবা যাকেই আমেরিকানদের মতো দেখতে নয়, তাকেই ধরে জেলে ভরে দেওয়া শুরু হল।

সংসদে নিন্দার ঝড় উঠল। আর হুবার? হুবার সাহেব মামুলি ক্লার্ক থেকে পদোন্নত হতে হতে মাত্র তিরিশ বছরেই ডিরেক্টর হয়ে গেলেন।

ডিরেক্টর হওয়ার পরেই হুবার এমন একটি তরুণ মুখ খুঁজতে লাগলেন, যে হবে এনকাউন্টারে দক্ষ। সেই সময়ে মার্কিন মুলুক দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আল কাপোনের মতো মাফিয়া এবং ডিলিঞ্জারের মতো ব্যাঙ্ক ডাকাতের দল। আল কাপোনের কথা আগেই বলেছি। ডিলিঞ্জারকে নিয়েই হলিউডে সিনেমা তৈরি হয়েছে। এদেশে যেমন গব্বরের কথা বলে শিশুদের ঘুম পাড়ানো হতো, ওদেশে তেমনই একটি নাম ছিল ডিলিঞ্জার। বাচ্চারাও নিজেদের মধ্যে চোর পুলিশ খেলার সময়ে ডিলিঞ্জার সাজত।

এফ বি আই-তে তখন এনকাউন্টার ম্যান ছিলেন পারবিস। বিভিন্ন গ্যাংস্টারদের খতম করার জন্য তিনি যথেষ্ট নামযশ করে ফেলেছিলেন। ডিলিঞ্জারকে এই পারবিসই শেষ করেন।

পারবিস দুর্দান্ত গতিতে এগোচ্ছিলেন, আর পাশাপাশি হয়ে উঠছিলেন হুবারের পথের কাঁটা। এনকাউন্টার স্পেশালিষ্ট রূপে তিনি তখন অতি জনপ্রিয় এবং এফ বি আই-এর মুখ। হুবারকে সেনেট থেকে প্রশ্নই করা হয় — ‘আপনি নাকি আমেরিকার টপ কপ? নিজের হাতে কখনো কোনো অপরাধীকে ধরেছেন? সব কাজ তো পারবিস আর তাঁর টিমই করছে।’

দক্ষ প্রশাসকের মতো প্রথমেই হুবার পারবিসকে ফিল্ড থেকে তুলে এনে ডেস্কজবে বসিয়ে দিলেন। পারবিস তখন চাকরি ছেড়ে দিলেন। রিটায়ার্ড এফ বি আই কর্তা একটি প্রাইভেট গোয়েন্দা সংস্থা খুলেছিলেন। তারপর একদিন পারবিসের বাড়িতে তাঁর ঘর থেকেই তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। মাথায় গুলি লেগেছিল। পাশেই পড়েছিল বন্দুকটা — ওই বন্দুকেই ডিলিঞ্জারকে গুলি করে মেরেছিলেন পারবিস। বলা হল, তিনি আত্মহত্যা করেছেন। ফাইল বন্ধ হয়ে গেল।

পারবিসকে সরানোর আগেই অবশ্য হুবার সাহেব নিজের নামে কিছু কীর্তি স্বর্ণাক্ষরে লিখিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। ভাগ্য আবার উদ্যোগী পুরুষের সাহায্য করে থাকে। এক ধনী তৈল ব্যবসায়ীর কন্যাদের অপহরণ কাণ্ড ঘটল। অপহরণকারী ছিল এক দম্পতি। সকলে তাদের চিনত ‘মেশিনগান কেলি’ বলে। মেশিনগান কেলিরা বেশ কুখ্যাত ছিল। তাদের নিয়ে সিনেমাও তৈরি হয়েছিল। হুবারের টিম মেম্ফিস নামক জায়গায় তাদের গ্রেফতার করে। মিডিয়ার সামনে পুরো ব্যাপারটাকে বেশ রং লাগিয়ে নাটকীয় ভাবে বলেন হুবার — ‘আমাদের টিম মেম্বাররা যখন ওদের ঘিরে ফেলেছিল, তখন ওরা কাকুতি মিনতি করছিল—আমাদের ছেড়ে দাও জি-মেন (G-Men)।’ জি-মেন মানে হল গান – মেন। এরপরে হলিউডে জি-মেন নিয়ে সিনেমা বানানো আরম্ভ হয়ে গেল। সিনেমায় জি-মেন’রা-ই গিয়ে অপরাধীদের ধরত।

আস্তে – আস্তে ঘাঁটি গেড়ে বসছিলেন হুবার। শুধু অপরাধজগতের মাথার ওপরেই নয়, রাজনীতিকদের শিয়রেও। সেনেটরদের সেক্স টেপ থেকে আরম্ভ করে দুর্নীতির সমস্ত ফাইল ছিল হুবারের কবজায়। রুজভেল্ট বলুন, কেনেডি বলুন, নিক্সন বলুন কত রাষ্ট্রপতি এলেন এবং গেলেন, কিন্তু হুবার অটল অজেয় অনড়। কেউ চেষ্টা করলে তাঁকেই হয়তো সরিয়ে বা উড়িয়ে দিতেন হুবার। হয়তো দিয়েওছিলেন।

(ক্রমশঃ)