বিধাতার হাতে লেখা গান – ৪২

অভীক মুখোপাধ্যায়

(একচত্বারিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৪২

ভারত আর চিনের মধ্যে কিছুটা আগুন লেগেছিল, কিছুটা লাগানো হয়েছিল।

দলাই লামাকে তিব্বত থেকে কে বা কারা এদেশে এনেছিল?

উত্তর হল আমেরিকান সিক্রেট সার্ভিস এজেন্সি সি আই এ। তারা ভারত আর চিনের সম্পর্কে কী অবনতি ঘটছে তার প্রত্যেক মুহূর্তের রিপোর্ট আমেরিকাতে পাঠাচ্ছিল। সবকিছু সাজিয়ে গুছিয়ে চালাচ্ছিল আমেরিকা। যদি ভারতের সঙ্গে চিনের সম্পর্কের অবনতি ঘটানোর ইচ্ছে না-ই থাকত, তবে তারা দলাই লামাকে নিজেদের বন্ধু – রাষ্ট্র পাকিস্তানে নিয়ে গিয়ে তুলল না কেন? দলাই লামাকে ভারতে নিয়ে চলে আসা একটি ষড়যন্ত্রের অংশ ছিল। তারা জানত, ভারত কাউকে ফেরাতে পারবে না। ভারত দলাই লামাকে শরণ দিতে বাধ্য হয়েছিল।

ভারত – চিন যুদ্ধের এই তৃতীয় কোণ এখন সবার সামনে স্পষ্ট। আমেরিকাই আগুন লাগিয়েছিল। কেন লাগিয়েছিল তা-ও এখন সবার জানা। কিন্তু যেটা আজও অজানা হয়ে রয়ে গেছে, তা হল ভারতের কী লাভ হয়েছিল? একটাই লাভ সাদা চোখে দেখতে পাওয়া যায় — বুদ্ধের ভূমিতে বুদ্ধের শিষ্যকে শরণ দেওয়াতে বিশ্ববাসীর কাছে ভারতের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছিল। পরম সহিষ্ণু রাষ্ট্র রূপে ভারতের নাম উঠে এসেছিল বিশ্বের দরবারে। কিন্তু যখন মার্কিন কূটনীতি দুই দেশের সম্পর্ককে নষ্ট করে দিতে আগ্রহী, তখন সহিষ্ণুতার পর্দা দিয়ে বাকী দিকগুলো ঢেকে রাখাটা মূর্খের পরিচয় হয়।

১৯৫৯ সালে আইজেনহাওয়ার পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে আসেন। তখন ফিল্ড মার্শাল আয়ুব খান পাকিস্তানের সর্বেসর্বা। আয়ুবকে আইজেনহাওয়ার বললেন, ‘রাজধানী পালটে ফেলো। এত ভিড় এখানে!’

আমেরিকার কথা পাকিস্তান মেনে চলে বলে যে কথাটা হাওয়ায় ভাসে, সেটা এই প্রস্তাবের কার্যকর হয়ে যাওয়ার পর কিঞ্চিৎ সত্যের দিকেই পা বাড়িয়েছিল। আয়ুব খান রাজধানীটিকে করাচি থেকে তুলে নিয়ে চলে এসেছিলেন ইসলামাবাদে।

পাকিস্তান থেকে আইজেনহাওয়ার সোজা চলে গেলেন কাবুলে। সেখানে তখন প্রধানমন্ত্রী দাউদ খান। দাউদকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিজ্ঞেস করলেন, ‘সোভিয়েতদের পক্ষ থেকে কোনও ভয় নেই তো?’

দাউদ উত্তর দিলেন, ‘আমাদের শুধু একটা দেশকেই ভয়। আপনাদের প্রিয় পাকিস্তান।’

এরপর ঘুরেফিরে এলেন ভারতে। বিষয় তখন চিন। ভারত গোপন সূত্রে খবর পেয়েছিল যে, চিন তিব্বত পর্যন্ত একটা রাস্তা বানিয়েছে। সেই পথ আকসাই চিন হয়েই গিয়েছে। আইজেনহাওয়ার বললেন, ‘দলাই লামার সঙ্গে দেখা করতে চাই।’ নেহরুজি সোজা ‘না’ বলে দিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, এধরণের সাক্ষাৎকারে কথা উঠবে যে ভারত আমেরিকার সাহায্য নিয়ে দলাই লামাকে ভাগিয়ে নিয়ে এসেছে। কিন্তু ব্যাপারটা সেটা নয়, দলাই লামাকে আমেরিকাই ভারতে নিয়ে এসেছিল, ভারত নিয়ে আসতে বলেনি।

নেহরুজি চাউ এন লাইকে আকসাই চিনের ওপর দিয়ে চিনের বানানো সড়ক নিয়ে অভিযোগ জানাতেই চাউ এন লাই বার্তা পাঠালেন, ‘ওই এলাকাটা এমনিও তোমাদের কোনও কাজে লাগবে না। তোমরা বরং অরুণাচলের দিকটা নিয়ে নাও, ওটাও আমাদেরই জায়গা।’

নেহরুজি এইবার অনুভব করলেন যে চিন তাঁর পিঠে ছোরা বসিয়ে দিয়েছে। তিনি শুধু শুধুই এতদিন ‘হিন্দি – চিনি ভাই – ভাই’ গোছের স্লোগানে বিশ্বাস করতেন। চাউ এন লাই নেহরুজিকে বেজিং –এ আমন্ত্রণ জানালেন। নেহরুজি গেলেন না। সাফ জানিয়ে দিলেন, কোনও ধরণের সমঝোতা করা হবে না। চাউ এন লাই এবং পণ্ডিত নেহরু ভালো বন্ধু ছিলেন, কিন্তু বন্ধুত্বের মধ্যে ফাটল ধরে গিয়েছিল। সন্দেহের বীজ যে কোনও সম্পর্ককে নষ্ট করে দেয়। এক্ষেত্রেও তা- ই হচ্ছিল।

আর ঠিক এই সময়েই আমেরিকায় কেনেডি এলেন।

কেনেডি কিন্তু প্রথম থেকেই ভারতের গুরুত্ব বুঝেছিলেন। নিজের প্রায়োরিটি লিস্টেও ভারতকে যথেষ্ট ওপরে রেখেছিলেন তিনি। তিনিই প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি বলেছিলেন ভারত পরবর্তীকালে ইকোনমিক সুপার পাওয়ারে পরিণত হবে। আগেও লিখেছি, এবং এখন আবার লিখছি, ঠিক এই কারণেই তিনি নিজের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তথা প্রখ্যাত ইকোনমিস্ট জে কে গালব্রেথকে ভারতের অ্যাম্বাস্যাডর করে পাঠিয়েছিলেন।

তবে এসব পদক্ষেপ দেখে একথা ভাবার দরকার নেই যে কেনেডি ভারতের বিরাট শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে কাজগুলো করছিলেন। এহেন ভুল ধারণা একদমই পোষণ করা উচিত নয় যে আমেরিকা বা সোভিয়েত নিঃস্বার্থ ভাবে কোনও দেশের ভালো চাইতে পারে। সে দেশটার নাম কিউবা হোক, চিলি হোক, পাকিস্তান হোক কিংবা ভারত হোক। চিন সোভিয়েতের মতোই কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হয়েও সোভিয়েতের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে চলতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিল।

২০২০ -২০২১ এ দাঁড়িয়ে আমরা ভারত – চিন সংঘর্ষ দেখছি, কেনেডি সাহেব ১৯৫৯ সালে দাঁড়িয়ে এই নিয়ে একটি অমোঘ ভবিষ্যৎবাণী করে গিয়েছেন — ‘আগামী পৃথিবীতে একটাই দ্বৈরথ নজর কাড়বে। সেই ডুয়েলটা কিন্তু আমেরিকা – সোভিয়েতের ডুয়েল নয়। তা হবে এশিয়ার দুই মহাশক্তি ভারত আর চিনের দ্বন্দ্বযুদ্ধ। আমাদের একটাই চেষ্টা থাকবে, কমিউনিস্ট চিন আর গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের মধ্যে টক্করটা যেন সমানে – সমানে হয়। এখন চিন এগিয়ে আছে। আমাদের ভেবে দেখতে হবে যে, চিনকে আটকানোটা সোজা, নাকি ভারতকে উন্নত করে তোলাটা সহজ।’

একটা কথা কেনেডি খুব ভালো করে বুঝেছিলেন যে পাকিস্তান একটি অতি সাধারণ দেশ, মধ্যমেধার ছাত্রের মতো, তার কাছে অসাধারণ কিছু প্রত্যাশা করাটা মূর্খের কাজ। কেনেডির পরে রিচার্ড নিক্সন আবার উল্টো সুর ভাঁজতেন, ‘পাকিস্তান আমাদের জন্যে সবকিছু করতে পারে্, কিন্তু ভারতকে বিশ্বাস করা যায় না।’

কেনেডি ক্ষমতায় আসার পরেও কিন্তু অনেক তিব্বতীয়দের গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে তিব্বতে ইমপ্ল্যান্ট করা হচ্ছিল। নেপালের সীমান্ত এলাকায় মাস্তাং তিব্বতীয়দের বাস ছিল। চিন এবার তাদের ধরে – ধরে জেলে পুরছিল, মেরে ফেলছিল। কারণ তাদের কাছে খবর ছিল প্রশিক্ষিত গেরিলারা পূর্ব পাকিস্তান হয়ে নেপাল দিয়ে ঢুকছে। চিনারা পাকিস্তান নিয়ে কিছু বলছিল না, তারা জানত পাকিস্তান আমেরিকার বন্ধু দেশ। তাদের বক্তব্য ছিল উড়োজাহাজে করে গেরিলাদের নিয়ে যাওয়ার সময় ভারতের ওপর দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলেও ভারত কিছু বলছেই না। এবং তিব্বতীয়দের রাজা তাঁর অনুসারীদের সঙ্গে নিয়ে ভারতের ধর্মশালায় বাস করছেন। রাজা যেখানে থাকবে, রাজার সৈন্যরাও সেখানেই থাকার কথা। তাহলে গেরিলারা ভারতের সাহায্য পেয়েই চিনের সাথে লড়তে যাচ্ছিল। কথাটা বাস্তবে সত্য নাহলেও টেকনিক্যাল দিক থেকে চিনের কথায় ভুল কিছু ছিল না।

গালব্রেথ কেনেডিকে বললেন, ‘এসব বন্ধ করো। এক তো এসব করে তিব্বতীয়দের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছ। অন্য দিকে ভারত আর চিনের মধ্যেকার সম্পর্ক খারাপ হচ্ছে।’

এতদিন দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের মধ্যে শুধু আগুন জ্বলছিল, এবার তাতেই ঘৃতাহুতি দিলেন কেনেডি। ভারতকে এক বিলিয়ন ডলার অর্থ সাহায্য পাঠালেন। ভারতের বুকে আই আই টি কানপুরের মতো প্রতিষ্ঠান জন্ম নিতে শুরু করল। অথচ বন্ধু – রাষ্ট্র পাকিস্তান, সে ব্যাটা কিছুই পেল না। আয়ুব খান রেগে গেলেন। তিনি বলে দিলেন আমেরিকান ফৌজ আর এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের এয়ারস্ট্রিপ ব্যবহার করতে পারবে না।

কিন্তু সবারই একটা মূল্য থাকে। কেউ এক টাকায় বিক্রি হয়, কেউ হয় এক বিলিয়নে। আবার কাউকে কিনতে শুধু সম্মান প্রদর্শনটুকুই যথেষ্ট। আয়ুব খানকে জ্যাকলিন কেনেডি একটি ভোজে আমন্ত্রণ করলেন। ভোজ বললে ভুল হয়, সে তো মহাভোজ। আয়ুব খান গেলেন। তাঁর মন জিতে নিলেন মিসেস কেনেডি। জর্জ ওয়াশিংটনের বাড়িতে, মাউন্ট ভারনানে, এমন এক মহাভোজ ইতিহাসে শুধু এক এবং অদ্বিতীয় আয়ুব খানের জন্যেই রাখা হয়েছিল। যে দেবতা যে ফুলে পুজো পেয়ে তুষ্ট হয়, আয়ুব খান মহাভোজেই আনন্দ পেলেন। আর ডলারের স্রোত এবার ভারতের দিকেও বইতে শুরু করেছিল।

যৌথ পরিবারে এমন বহু বার ঘটে যে, ক -এর সাথে খ –এর ঝগড়া হয়েছে। ক গিয়ে গ-এর সাথে গল্প করতে লাগল। তখন খ ভাবল তাকে নিয়েই সমালোচনা করছে বা ফন্দি আঁটছে। খ সেই থেকে গ – কে শত্রু ভাবতে শুরু করে দিল। বিশ্বে পরিবারেও কতকটা এমনই ঘটছিল। স্বাধীনতার পর অবনতির দিকে যেতে থাকা অর্থনীতি নিয়ে জেরবার নেহরুজির হাতে যখনই আর্থিক সাহায্য আসতে আরম্ভ করে দিল, তখনই তিনি ‘সাতেপাঁচে থাকি না’ বলাটা বন্ধ করে দিলেন। ভারত আনুষ্ঠানিক ভাবে আমেরিকার বন্ধুত্ব স্বীকার করে নিল। চিন এতদিন শুধুই সনেধ করছিল। এবার বিশ্বাস করতে শুরু করল যে আমেরিকার ষড়যন্ত্রে ভারত মদত দিচ্ছে। দামামা বাজছিল। যুদ্ধ হবে – হবে রব।

(ক্রমশ)