বিধাতার হাতে লেখা গান – ৪৭

অভীক মুখোপাধ্যায়

(ষড়চত্বারিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৪৭

কেনেডি শ্বেতাঙ্গ ছিলেন। শুধু গায়ের রঙে নয়, মনে, এবং সম্ভবত রক্তেও। কেনেডির জীবনীকার রবার্ট ডালেক তাঁকে ‘আমেরিকান ব্রাহ্মণ’ বলছেন। অর্থাৎ, সমাজের উচ্চকোটির বাসিন্দা, যারা সমস্ত সুযোগ সুবিধে পেয়েই বড় হচ্ছে। (যদিও আমি এই নিয়ে দ্বিমত পোষণ করি। ব্রাহ্মণেরা সমাজের সুযোগ সুবিধে থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন এমন লক্ষ নিযুত উদাহরণ রয়েছে। যজমানি করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে থাকা বাউনটিকে কিন্তু প্রান্তিক মানুষ হিসেবেই গণ্য করা উচিত।) কেনেডি ভাইরা যখন বড় হয়েছেন, তখন তাঁরা কখনও কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গে পড়েননি, খেলেননি, ডিবেট করেননি, যুদ্ধে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েননি। এঁদের কেউই কৃষ্ণাঙ্গদের নিয়ে কোনও বৈপ্লবিক ভাবনাচিন্তার অবকাশ রাখেননি। নিগ্রোরা ছিল এঁদের পায়ের ধুলো। এঁরা মনিব, ওঁরা চাকর। জীবনের চরম সুখ নিয়ে মগ্ন থাকা কেনেডি ব্রাদার্সদের কাছে কালো মানুষগুলোর কোনও মূল্য একটা সময় অবধি ছিলই না। কিন্তু সেই বালক বা যুবক জন এফ কেনেডি আর পরবর্তীকালের রাষ্ট্রপতি কেনেডির মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখা দিল। যে ফারাকটা অনেক পরে ভারতের এক ভূতপূর্ব প্রধানমন্ত্রী একটি রাজ্যের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে উপদেশের মাধ্যমে বোঝাবেন, ‘রাজধর্ম কা পালন করেঁ।’  

আমেরিকার দক্ষিণে নিগ্রোরা ক্রমশ সোচ্চার হয়ে উঠছিলেন। ভোটের অধিকারের জন্যে লড়ছিলেন। রেস্তোরাঁ, দোকান এবং রেলওয়ে স্টেশনে শ্বেতাঙ্গ – কৃষ্ণাঙ্গ ভেদাভেদের বিরোধ তখন তুঙ্গে। নিউইয়র্ক স্টেটের ক্যাপিট্যাল সিটি আলবানিতে একটি সুসংবদ্ধ আন্দোলন দানা বাঁধছিল।

সাদা চামড়ার সাম্নতরা, গোঁড়া লোকজনেরা এই আন্দলনকে আমেরিকার সংস্কৃতির ওপরে আঘাত বলে গণ্য করছিলেন। কিছু ধনী তেল – ব্যবসায়ী তো রীতিমতো কৃষ্ণাঙ্গদের বিরুদ্ধে কয়েকটি গুপ্ত সংগঠনকে ওসকাচ্ছিলেন। ফান্ডিং করছিলেন। এরকমই একটি গুপ্ত সংগঠন ছিল কু ক্লুক্স ক্ল্যান। যে মিত্রোখিন আর্কাইভের কথা আগে উল্লেখ করেছি, তার হিসেব মতো কেনেডির হত্যায় আমেরিকার দক্ষিণের এসকল দক্ষিণপন্থী ব্যবসায়ীদের হাত ছিল। সম্ভবত নিগ্রোদের এহেন উত্থান দেখে তাঁরা ভয় পেতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা কেনেডির মধ্যে এমন এক ভারতীয়র ছায়া দেখছিলেন, যাকে ব্রিটিশ বিরোধীদের পরাকাষ্ঠা মানা হতো। কেনেডিকে তাঁরা ‘গান্ধী’ মনে করছিলেন। তাঁদের মনে হচ্ছিল কেনেডির তাপেই এই সামাজিক অচ্ছুৎ প্রথাটা বিলুপ্ত হয়ে যাবে। তাই তাঁকে হত্যা করার চক্রান্ত চলছিল। তবে যে যাই ভাবুন – না – কেন, কেনেডি নিজেকে গান্ধী ভাবেননি। তিনি সমাজ সংস্কারক হতে চেষ্টা করেননি। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকার সূত্র খুঁজেছিলেন মাত্র, সেটাও দায়ে পড়েই — আমেরিকান আইন তাঁকে মানতেই হতো, সংবিধানের অবমাননা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল না।

আমেরিকান কংগ্রেসে দেওয়া ভাষণে কেনেডি বললেন, ‘নিগ্রোদের দুটো গির্জা জ্বালিয়ে দেওয়া হল, মিসিসিপিতে গুলি চালানো হল। কেন? না, তাঁরা নিজেদের ভোটাধিকার চাইছেন। এর চেয়ে লজ্জা এবং কাপুরুষোচিত ঘটনা কি আর কিছু হতে পারে?’

জেমস হাওয়ার্ড মেরেডিথ নামক এক কৃষ্ণাঙ্গ সৈন্য মিসিসিপি ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্যে আবেদন জানিয়েছিল, কিন্তু সেখানে নিগ্রোদের ভর্তি হওয়ার অধিকার ছিল না। আসলে তিনি জন এফ কেনেডির এই ভাষণ শুনে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন এবং চেয়েছিলেন এমন কিছু করে দেখাবেন যাতে কেনেডির সরকার চাপে পড়ে আফ্রিকান – আমেরিকানদের সিভিল রাইটস নিয়ে কিছু – না – কিছু পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়। নিজের আবেদনপত্রে জেমস লিখলেন —

Nobody handpicked me…I believed, and believe now, that I have a Divine responsibility… I am familiar with the probable difficulties involved in such a move as I am undertaking and I am fully prepared to pursue it all the way to a degree from the University Of Mississippi.

মেরিডিথকে ভর্তি হতে দেওয়া হল না। একবার নয়, দু – দুবার তাঁর আবেদনপত্র নাকচ করা হল। তিনি ইউনাইটেড স্টেটস ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট অব দ্য সাদার্ন ডিস্ট্রিক্ট অব মিসিসিপিতে কেস ফাইল করলেন। জিতলেন। এবার ভর্তি হওয়ার পালা। বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথ আটকে দাঁড়ালেন স্বয়ং মিসিসিপির গভর্নর। ভদ্রলোক ভাবছিলেন যে, শ্বেতাঙ্গদের হয়ে বললে পরের ইলেকশনে লাভ মিলবে। কিন্তু সেখানে ততক্ষণে কয়েক হাজার শ্বেতাঙ্গ দাঙ্গাবাজ জড়ো হয়ে গিয়েছিল। তারা দাঙ্গা শুরু করে দিল। পুলিশকে আক্রমণ করল। কেনেডি মার্শাল পাঠালেন। ৫০০ জন। কিন্তু উন্মাদ ভিড়কে আটকায় কার সাধ্যি? ১০০ জনেরও বেশি মার্শাল আহত হলেন, একজন বিদেশি সাংবাদিকের মৃত্যু ঘটল। আজকের দিনে বসে হয়তো ভাবতে পারছেন না, কিন্তু তখনকার দিনে এটা বিরাট ব্যাপার। একজন নিগ্রোর ভর্তি হওয়াকে কেন্দ্র করে এমন দক্ষযজ্ঞ ঘটে গিয়েছিল। মেরিডিথের ভর্তি হওয়া আর হল না।

কেনেডি ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জের পর্যায়ে নিলেন। যে কেনেডি কিউবা – ক্রাইসিস সামলাচ্ছিলেন, সোভিয়েতকে থাবড়ে বসিয়ে দিচ্ছিলেন, চিনকে সমঝোতার পথে হাঁটতে বাধ্য করছিলেন, ভারতকে সাহায্য করছিলেন, পাকিস্তানকে লেজে খেলাচ্ছিলেন, সেই কেনেডি ধাক্কা খাছিলেন নিজের দেশের অভ্যন্তরীণ মামলায়, নিগ্রো ইস্যুতে। গোটা বিশ্বের বড়দা আমেরিকার কথা তাঁরই দেশের মাটিতে কেউ শুনছিল না। হয় হয়, অমনটাই হয়, ঘরামির চাল ফুটো প্রবাদটা কি আর এমনি এমনি এসেছে?    

পরের বছর জুন মাসে দুজন নিগ্রো ছাত্র বার্মিঙহাম ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির জন্যে গেল। আলাবামায়। এই আলাবামা আবার কু ক্লুক্স ক্ল্যান –দের দুর্গ। সেখানে আগেই নিগ্রো ফ্রীডম রাইডার্সদের ওপরে হামলা করার ঘটনা ঘটেছিল। আলাবামার গভর্নর ওয়ালেস, সে এক কট্টর শ্বেতাঙ্গ। বলে দিলেন, ‘নিগ্রোরা কোনোদিনই আমাদের সমকক্ষ ছিল না, হতে পারেনি, হবেও না।’

তবে ববি কেনেডি এবারে বেশ প্রস্তুত ছিলেন। আলাবামার পুলিশ এবং মার্শালদের কড়া নির্দেশ দিয়ে রাখা হয়েছিল। যেই না ওই দুই ছাত্র ইউনিভার্সিটির দোরগোড়ায় পৌঁছলেন, গভর্নর গিয়ে তাঁদের পথ আটকালেন। যেতে নাহি দিব। ববি অর্ডার দিলেন, গভর্নর নরম কথায় না – সরলে যেন ঘাড় ধরে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়।

রাজ্যের গভর্নরকে রাজ্যের পুলিশই এসে বলল, মহাশয় আপনি যদি নিজে থেকে না – সরে যান তবে আমরা আপনাকে গ্রেফতার করতে বাধ্য হবে। যাই হোক, চিৎকার চেঁচামিচি চালিয়ে গেলে তাঁকে সরতে হল।  

কেনেডি রাজধর্মের পালন করে দেখালেন। কৃষ্ণাঙ্গ দুই ছাত্র ভর্তি হল আলাবামার বিশ্ববিদ্যালয়ে। কু ক্লুক্স ক্ল্যান নিজের গুণ্ডাবাহিনী পাঠাল, কিন্তু গুণ্ডাদমনের জন্যে ববি যা বন্দোবস্ত রেখেছিলেন তাতে তাদের নিরস্ত হয়ে ফিরে আসতে হয়। স্বাভাবিক, ববি ছিলেন আমেরিকার সবসে বড়া গুণ্ডা। তিনি জানতেন কী করে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়।

আমেরিকান কিংবদন্তী বব ডিলান লিখলেন ‘The Times They Are A Changin’। আমি বাধ্য হচ্ছি পুরো গানটাকেই লিখতে। শুনলে আজও গায়ে কাঁটা দেয়…

 

Come gather ’round people
Wherever you roam
And admit that the waters
Around you have grown
And accept it that soon
You’ll be drenched to the bone
If your time to you is worth savin’
And you better start swimmin’
Or you’ll sink like a stone
For the times they are a-changin’

Come writers and critics
Who prophesize with your pen
And keep your eyes wide
The chance won’t come again
And don’t speak too soon
For the wheel’s still in spin
And there’s no tellin’ who
That it’s namin’
For the loser now
Will be later to win
For the times they are a-changin’

Come senators, congressmen
Please heed the call
Don’t stand in the doorway
Don’t block up the hall
For he that gets hurt
Will be he who has stalled
The battle outside ragin’
Will soon shake your windows
And rattle your walls
For the times they are a-changin’

Come mothers and fathers
Throughout the land
And don’t criticize
What you can’t understand
Your sons and your daughters
Are beyond your command
Your old road is rapidly agin’
Please get out of the new one
If you can’t lend your hand
For the times they are a-changin’

The line it is drawn
The curse it is cast
The slow one now
Will later be fast
As the present now
Will later be past
The order is rapidly fadin’
And the first one now
Will later be last
For the times they are a-changin’

লিংকনের স্বপ্ন পূর্ণ হল। মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের স্বপ্ন পূর্ণ হল। কেনেডির চ্যালেঞ্জ পূর্ণ হল। কৃষ্ণাঙ্গরা অনেক কিছুর দিকে একধাপ এগিয়ে গেলেন।

আর তারপর?

তা ঠিক চারমাস পরে কেনেডি নিহত হলেন। কেউ বা কারা কেনেডিকে গুলি করে মারল।

(ক্রমশ)