বিধাতার হাতে লেখা গান – ৪৮

অভীক মুখোপাধ্যায়

(সপ্তচত্বারিংশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৪৮

It is an unfortunate fact that we can secure peace only by preparing for war.জন এফ কেনেডি।

অর্থাৎ, কেনেডি যুদ্ধবাজ ছিলেন না। যে লোকটা কিউবার বে অব পিগস – এ গেরিলা সৈন্য পাঠিয়েছে, ভিয়েতনামে লড়েছে, সেই লোকটার মুখে কি এসব মানায়?

কিন্তু উলটো দিক থেকে ভাবা যাক। যে লোকটা কিউবা – সোভিয়েত কম্বিনেশনের যুদ্ধকে এড়িয়ে যেতে পেরেছে (যা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে চলেছিল) কিংবা ভারত – চিন যুদ্ধ বন্ধ করতে ভূমিকা নিয়েছিল সেই লোকটার মুখেই কি এসব কথা মানায় না?

তাই না?

কেনেডির মৃত্যুর একমাস আগে তিনি একটি বক্তৃতায় বলেন, ‘যুদ্ধের সমস্ত প্রস্তুতি আমরা নিয়ে রাখব, কিন্তু ব্যবহার করব শান্তির সমস্ত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে গেলে।’

বলা হয়, প্রস্তুতি ছাড়া, মন থেকে কেউ যখন কোনও কথা বলে, তখন তা সত্যের সবথেকে বেশি কাছাকাছি হয়। কেনেডি নিজের ভাষণ আগে রেডি করতেন। প্রতিটা বক্তৃতার ড্রাফট একাধিক বার দেখে বুঝে কারেকশন করে নিয়ে তবেই বলতেন। বলার আগে রীতিমতো রপ্ত করতেন। তবেই ডায়াসে সেই ভাষণ দিতেন কেনেডি। নিজেকে প্রেজেন্টেবল বানিয়ে তোলার কোনও কসুর বাকী রাখতেন না তিনি। তাঁর দীর্ঘ রোগভোগের কথা সবার জানা। ইঞ্জেকশন নিতে হতো। নিলেই মুখ ফুলে যেত। এমন বহুবার হয়েছে, যখন শরীর খারাপ থাকা সত্ত্বেও, যন্ত্রণা ভোগ করা সত্ত্বেও ভাষণ আছে বলে তিনি ইঞ্জেকশন নেননি, কারণ ফোলা মুখ নিয়ে ভাষণ দিতে গেলে তা ভালো দেখাবে না।    

১৯৬৩ সালে নিগ্রো ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার ঘটনার পরে তিনি প্রথমবার টেলিভিশনের পর্দায় কোনও পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই ভাষণ দিলেন। এই ভাষণটিকে মার্টিন লুথার কিং জুনিয়রের ‘I Have A Dream’ ভাষণের সঙ্গে তুলনা করা হয়। কেনেডি এই ভাষণে বললেন, ‘আমরা আজ এক নৈতিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে চলেছি। ধর্মগ্রন্থ থেকে শুরু করে মার্কিন সংবিধান, সর্বত্র লেখা আছে আমেরিকার সকল নাগরিক যেন সমান অধিকার, সমান সুযোগ পায়। প্রেসিডেন্ট লিংকন একশো বছর আগে ক্রীতদাসদের মুক্তি দিয়েছিলেন, কিন্তু আজও তাঁদের বংশধরেরা স্বাধীনতা পাননি। অন্যায় থেকে আজও তাঁদের মুক্তিলাভ ঘটেনি। আজও তাঁরা সামাজিক এবং অর্থনৈতিক নিপীড়নের শিকার।

যতদিন এদেশের নাগরিকেরা স্বাধীন ভাবে বাঁচতে পারবেন না, ততদিন এই দেশকে স্বাধীন বলা যাবে না, যাবে কি? তবে এবার সময় এসেছে, আমরা আমাদের দেশকে স্বাধীনতা দেব। পূর্ব থেকে পশ্চিমে, উত্তর থেকে দক্ষিণে ছড়িয়ে পড়বে স্বাধীনতা।

আমি কংগ্রেসের সামনে এই প্রস্তাব রাখতে চলেছি যে, মার্কিন জীবনে, এবং আইনে বর্ণবিদ্বেষের কোনও স্থান নেই। আর এটা শুধু আমার নয়, আপনাদের সবার সম্মিলিত কর্তব্য।’  

রাষ্ট্রপতি কেনেডির এই ভাষণ দেওয়ার ঠিক পরদিনই একজন নিগ্রো কার্যকর্তা ম্যডগার এবর্সকে তাঁর পরিবারের লোকেদের চোখের সামনে গুলি করে মারা হল। এবর্স দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির বিরুদ্ধে লড়ে জেতা মার্কিন বাহিনীতে ছিলেন।

এই ঘটনার পরে কেনেডি একেবারে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মার্কিন সংসদে ‘সিভিল রাইটস বিল’ পাস করাতে উঠে পড়ে লাগলেন। কেনেডির নিজের লোকেরাই বলতে লাগল ওঁর এসব কাজের ফলে উনি পরের বারে ভোটে হেরে যাবেন। কেনেডি বললেন, আমি পরোয়া করি না। যে বিল তিনি আনতে চলেছিলেন, তা আমেরিকার মাটি থেকে বর্ণভেদ প্রথাকে চিরকালের জন্যে মুছে দিতে চলেছিল। এরপরে কৃষ্ণাঙ্গরা যে কোনও হোটেলে খেতে বসতে পারবেন, যে কোনও সিনেমাহলের দরজা তাঁদের জন্যে খোলা থাকবে, বাসে উঠুন বা ট্রেনে কেউ আলাদা করতে পারবে না তাঁদের। এবং কাউকে কোনও কৈফিয়ত না – দিয়েই তাঁরা ভোট দিতে পারবেন।  

তিনি নিজের প্রতিপক্ষ আইজেনহাওয়ারের কাছেও চলে গেলেন। বললেন, আসুন, মতপার্থক্য ভুলে আমরা এই বিলটাকে পাস করাই। এই বিলের কাজ যখন চলছিল, তখন কেনেডি আরও একটি কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

কী বলুন তো?

কোল্ড ওয়ারের ইতি টানার কাজে।

সোভিয়েত যখন কিউবা থেকে মিসাইল ফিরিয়ে নিল, তখন আমেরিকা তুরস্ক থেকে নিজেদের অস্ত্র সরিয়ে নিয়েছিল। ভালো কাজই বলা চলে। এর পর থেকেই পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের ব্যাপারটা নিয়ে কাজ বেশ দ্রুত এগোতে থাকে। নিকিতা ক্রুশ্চেভ বললেন, এখন থেকে আমরা আর মাটির ওপরে কোনও পরমাণু পরীক্ষণ করব না। এখান থেকেই এল মাটির নীচে পারমাণবিক অস্ত্রের শক্তি পরীক্ষণের কনসেপ্ট। এটাই পরে নিয়ম হয়ে দাঁড়াবে। এই নিয়ম মেনেই ভারতের বুকেও দু – দুবার বুদ্ধ হাসবেন।  

কেনেডি হোয়াইট হাউজ থেকে একটি ভাষণ দিলেন, ‘পারমাণবিক আক্রমণের ভয়, মিসাইল রেসের গালগল্প আর সোভিয়েত – ষড়যন্ত্রের কথা শুনতে আর আমার ভালো লাগে না। যদি আমাদের হাতেই রক্ত লেগে থাকে, তাহলে আমরা কোন মুখে শান্তির কথা বলব? আশা করি আমরা কেউ কবরের শান্তি চাইছি না।

সাম্যবাদকে আমি আজও ভুলই বলব, কিন্তু তাই বলে রাশিয়ান সংস্কৃতি, বিজ্ঞান, স্পেস – সায়েন্স এবং তাঁদের সেনাবাহিনীর সাহসকে অসম্মান করার কোনও অবকাশ নেই।

যদি কখনও ভুল করেও আমাদের দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হয়, তাহলে আমরা সেইসব কিছুই হারিয়ে ফেলব যা কয়েক শতাব্দী ধরে অর্জন করেছি। আমরা কেন যুদ্ধের দিকে এগোচ্ছি?’  

সাদা চোখে এটা ছিল ভাষণ। একটা বক্তব্য। কিন্তু ইতিহাসবিদেরা পরে বলেছেন, এটাই ছিল কেনেডির ডেথনোট। ইন্দিরা গান্ধীও এরকমই একটা ডেথনোট দিয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। শীত যুদ্ধের সময় যেখানে সবাই যুদ্ধ চাইছে, সেখানে একজন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট সোভিয়েতকে ঘৃণা করছেন না, এটাই কি তাঁর মরার জন্যে উপযুক্ত কারণ নয়? মৃত্যুর কারণ না হোক, এটুকু পরিষ্কার যে তিনি ওই পদের পক্ষে উপযুক্ত নন। আমেরিকা চায়নি তার রাষ্ট্রপতির এই ভাষণ বিশেষ প্রচারিত, প্রসারিত হোক। মিডিয়ার পক্ষ থেকে এই বক্তব্যকে চেপে দেওয়ার সবরকম চেষ্টা করা হয়। বেশি কথাই তোলা হয়নি।

কিন্তু মজার কথা হল যে ভাষণ আমেরিকায় প্রচার পেল না, সেটাই সোভিয়েতে পেল। রাশিয়ান অনুবাদ করে এটাকেই মস্কোতে সম্প্রসারিত করা হল। এবং এই ভাষণের পরেই মস্কোতে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’র ওপর থেকে ব্যান সরিয়ে নেওয়া হল।

ক্রুশ্চেভ বড়মুখ করে বললেন, ‘রুজভেল্টের পর আমেরিকা এই প্রথম একজন জাঁদরেল রাষ্ট্রপতি পেয়েছে।’ কেনেডি উদারবাদী ভাষণ দিলেও এটা সবার জন্যে ঔদার্য প্রকাশ করছিল না। তাঁর নিজের সহযোগীদের ক্ষেত্রে, মার্কিন সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে, সি আই এ – এর ক্ষেত্রে এটা ছিল সম্পূর্ণ পরিপন্থী ভাষণ। সত্যিই তিনি রুজভেল্টের মতো ভাষণ দিয়েছিলেন। নির্ভীক চিত্তে। কাউকে মাথায় না – রেখে মনের কথা বলেছিলেন। পক্ষের কথা ভাবেননি, প্রতিপক্ষের কথা চিন্তাই করেননি। আর এসবের মধ্যেই কেনেডি আরও একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ নিলেন। শুরু হল এমন একটি বিশেষ ব্যবস্থা, পরবর্তীকালে যার মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মাথারা নিজেদের মধ্যে সিকিওরড ভাবে, সরাসরি কথা বলবেন। আজ্ঞে হ্যাঁ, কেনেডিই হটলাইন চালু করেছিলেন।

১৯৬৩ সালের আগে হোয়াইট হাউজ আর ক্রেমলিনের মধ্যে সোজাসুজি কথা বলার কোনও ব্যবস্থাই ছিল না। মার্কিনরা কোডেড মেসেজ পাঠাত সোভিয়েত এমব্যাসিকে, সেটাকে ডিসাইফার করতে বসত সোভিয়েত দূতাবাস। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় হয়ে যেত। তারপরে সেটা যেত স্বস্থানে। কিউবা – ক্রাইসিসের সময় ক্রুশ্চেভ যে চিঠি পাঠিয়েছিলেন, তা ডিকোড হতে বারো ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। ততক্ষণে পরমাণু বোমায় সারা বিশ্ব ধ্বংস হয়ে যেতে পারত।    

৩০শে আগস্ট, ১৯৬৩ কেনেডি যখন প্রথমবার হটলাইন চালু করলেন, তখন যে মেসেজটা সোভিয়েতে পাঠানো হল, সেটা পেয়ে ক্রেমলিন মাথা খুঁড়ে মরে — শালারা কী লিখেছে রে বাবা? যুদ্ধের কথা? নাকি শান্তির বাণী? এর চাইতে আমাদের ওই কোডিং আর ডিকোডিং সিস্টেম বেটার ছিল।

তারপর মার্কিনরা বলল, আরে ভাই চিন্তার কিছু নেই। সব অক্ষর পৌঁছচ্ছে কিনা সেটা টেস্ট করে দেখলাম। সোভিয়েতরা সেকথা শুনে হেসেই খুন।

আমি কিংবা আপনিও এই বাক্যটা বহুবার পড়েছি — A quick brown fox jumps over the lazy dog’s back 1234567890.

সোভিয়েত পাঠিয়েছিল সূর্যাস্তের কাব্যমূলক ব্যাখ্যা। পরে যখন শীতযুদ্ধ থেমে যায়, তখন আমেরিকানরা বেসবল খেলার স্কোর পাঠাত, আর সোভিয়েতরা পাঠাত কবিতা।

(ক্রমশ)