বিধাতার হাতে লেখা গান – ৫২

– অভীক মুখোপাধ্যায় 

(একপঞ্চশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৫২ 

সন্দেহভাজন ২ :এডগার হুবার, ডিরেক্টর, এফ বি আই

ডাল্লাস থেকে এফ বি আই এজেন্ট তাঁর সংস্থার নির্দেশক এডগার হুবারকে ফোন করে বলেছিল, ‘রাষ্ট্রপতি কেনেডি হসপিটালে মারা গেছেন।’

হুবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘প্রেসিডেন্ট কেমন আছেন?’

‘আজ্ঞে, আমি বললাম তো উনি মারা গেছেন।’

‘রাষ্ট্রপতি কেমন আছেন?’

এডগার হুবার, মার্কিন রাজনীতির ইতিহাসের অমাত্য রাক্ষস। রাষ্ট্র নামক যন্ত্রের জন্যে সমর্পিত –প্রাণ ব্যক্তি। যোগ্য ব্যক্তি। নিজের কার্যকালে তিনি আটজন রাষ্ট্রপতিকে আসতে – যেতে দেখেছেন। কেনেডির মৃত্যুর পর যখন সমগ্র আমেরিকা শোকস্তব্ধ, তখন হুবারের মস্তিষ্ক পরবর্তী রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে ভেবে চলেছিল। যা গেছে, তা যাক। শোকে বৃথা সময় নষ্ট করে কী লাভ? টিভির পর্দায় হুবার দেখলেন উপ–রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসন বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। ছবিটা দেখেই তাঁর মনে শঙ্কাকুল হয়েছিল — জনসনের হার্ট অ্যাটাক হয়নি তো? তাই তিনি ডাল্লাসের এফ বি আই এজেন্টকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি কেমন আছেন?’ আসলে তিনি কেনেডির খবর নিতে প্রশ্নটা করেননি, নতুন প্রেসিডেন্টের কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন।

হুবার আর লিন্ডন জনসন ছিলেন সমবয়সী। অনেক পুরোনো বন্ধু। জন আর ববি কেনেডি এই দুজনের চোখে বড় লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলের বেশি কিছু ছিলেন না, হোয়াইট হাউজে কোনোক্রমে মাথা গলিয়ে ফেলা দুই ভাইকে এঁরা এই চোখেই দেখতেন। অভিভাবকের মতো আচরণ করতেন। ভুল দেখলে সাবধান করে শুধরে নিতে বলতেন। কেনেডি যখন একাধিক মহিলাকে নিয়ে নেকেড পুল পার্টি করতেন, তখন হুবার রাগ করতেন না। কিন্তু একটা বিষয়ে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকত, ওই মেয়েগুলোর মধ্যে কোনও কমিউনিস্ট বা সোভিয়েতের গুপ্তচর নেই তো? যদি কোনও গুপ্তচরের সন্ধান পেতেন, তখুনি কেনেডিকে বলতেন, অমুককে এবার দূরে সরিয়ে দাও। দুশ্চরিত্র রাজার অতন্দ্র এবং কুশল মহামন্ত্রীর ভূমিকা পালন করতেন হুবার।

কেনেডিকে হত্যা করার দায়ে যখন অসওয়াল্ডকে গ্রেফতার করা হল, তখন রিচার্ড নিক্সন হুবারকে ফোনে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘কোনও ক্ষ্যাপাটে দক্ষিণপন্থী নাকি?’

হুবার বলেছিলেন, ‘না… না… কমিউনিস্ট।’

কেস ফাইল এখানেই বন্ধ হয়েছিল।

পরদিন হুবার ঘোষণা করলেন, ‘পূর্ব রাষ্ট্রপতি কেনেডির হত্যা লি হার্ভে অসওয়াল্ড করেছে। সে মার্কসবাদী – লেনিনবাদী। একাই এই কাণ্ডটা ঘটিয়েছে। এই ঘটনায় কোনও বৈদেশিক বা অভ্যন্তরীণ এজেন্সির হাত নেই। লি নিহত হয়েছে। তাই এই তদন্ত এবার বন্ধ করে দেওয়া হল।’

সবাই চমকে উঠল। বলে কী? আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে দিনদুপুরে গুলি করে মারা হল, আর মাত্র দুদিনে তদন্ত সমাপ্ত? খুনিকে খুব কাছ থেকে চেনে নাকি?

খুব একটা ভুল প্রশ্ন ছিল না। অসওয়াল্ডের ওপরে বিগত একবছর ধরে নজর রাখা হয়েছিল। সে তিনবছর সোভিয়েতে কাটিয়ে আমেরিকায় ফিরেছিল। তখনকার দিনে সোভিয়েত থেকে ফিরে আসা প্রত্যেক ব্যক্তির পেছনে একজনও করে এফ বি আই এজেন্ট লাগিয়ে রাখা হতো। হোস্টি নামে একজন এজেন্ট তার গতিবিধ নখদর্পণে রেখেছিল। তবে সে খেয়াল করেনি যে, একদিন অসওয়াল্ডের স্ত্রী তার গাড়ির নাম্বারটা টুকে রেখে দেয়।

কেনেডিকে হত্যা করার দুসপ্তাহ আগে অসওয়াল্ড এফ বি আই অফিসে পৌঁছয়, সেখানে সেক্রেটারির হাতে একটা মুখবন্ধ খাম ধরিয়ে চলে আসে। তাতে লেখা ছিল — ‘আমার স্ত্রি’কে বিরক্ত করলে তোমার অফিস উড়িয়ে দেব।’

এই চিঠিকে কেউ আমল দেয়নি। বড় – বড় সরকারি দফতরে এমন হুমকি – ধমকি অনেক আসে। এছাড়াও এফ বি আই জানত যে লি-এর সঙ্গে মাফিয়াদের সম্পর্ক আছে। তারা একথাও জানত যে, লি এমন একটা বইয়ের গুদামে কাজ করে, যেটা রাষ্ট্রপতির কনভয় যাওয়ার রাস্তার পাশেই পড়ে।

যেহেতু জনগণের মনে প্রশ্ন আর ক্ষোভ সঞ্চারিত হচ্ছিল, তাই পরবর্তী রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসন কেনেডি হত্যা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি বসান। সেটাই ওয়ারেন কমিশন। কমিশনের পক্ষ থেকে হুবারকে তলব করা হয়।

হুবার কমিশনের সামনে বলেন, ‘আমরা অসওয়াল্ডকে নিয়ে যেসব তথ্য পেয়েছিলাম, সেগুলোকে বিশেষ জরুরি বলে মনে করিনি। তখন বোঝা যায়নি যে এই লোক প্রেসিডেন্টকে হত্যা করার মতো গুরুতর অপরাধ ঘটাতে পারে।’

যুক্তিতে ফাঁক ছিল না। টেক্সাসে কয়েকশ গুণ্ডা ছিল, অনেক কমিউনিস্টও ছিল। তাদের মধ্যে কে, কখন প্রেসিডেন্ট অব আমেরিকাকে হত্যা করার চেষ্টা করবে সেটা কে বলতে পারত? আর এমনিতেও রাষ্ট্রপতি কেনেডি দক্ষিণপন্থী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে হুমকি পাচ্ছিলেন, বামপন্থীরা কিছু বলেনি। তাই সেদিকে নজরও দেয়নি ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি।

আমেরিকার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সংস্থার বিরুদ্ধে আমেরিকার সবথেকে বিস্তৃত তদন্ত আরম্ভ হল। পঁচিশ হাজার সাক্ষাৎকার নেওয়া হল, তৈরি হল ছাব্বিশ ভলুমের রিপোর্ট। ফলাফল সেই একই রয়ে গেল। হুবার নিজের উত্তরে অনড় — অসওয়াল্ড একলাই কেনেডিকে মেরেছে। এই থিওরির বিরুদ্ধে কোনও প্রকার প্রমাণ মাথাচাড়া দিলে তাকে হারিয়ে দেওয়ার জন্যে হুবার একাই যথেষ্ট ছিলেন।

এফ বি আই যে তদন্ত করেছিল, তাতে শুধু ভুল ছিল তা-ই নয়, পাহাড়প্রমাণ গলদ ছিল। তিনটে বুলেটের কথা উঠেছিল। একটা গুলি ছিটকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক ব্যক্তির পাশ দিয়ে যায়। দুটো লাগে কেনেডির গায়ে। যে দুটো গুলি লেগেছিল, তার মধ্যে একটা ছিল ম্যাজিক বুলেট।

সেই জাদু – বুলেট কেনেডির পিঠ দিয়ে ঢুকে তাঁর গলা দিয়ে বেরিয়ে সামনে বসে থাকা কোনোলির বুকে গিয়ে লেগে ডান হাত দিয়ে গিয়ে লাগে বাম জানুতে। একটাই গুলি। সে ঘুরছে আর ঘুরছে। ইউ টার্ন নিচ্ছে। যেখানে সেখানে আঘাত করছে। বুলেটটা বেরোনোর পরেও চকচক করছিল। কার্যত অসম্ভব একটি ঘটনা। কিন্তু, হুবার বলে চলেছিলেন তিনটেই গুলি চালানো হয়েছিল, একজন শুটারই সবকটা গুলি চালিয়েছিল।

এফ বি আই –এর শুটাররা ওই বই-গুদামের জানলা থেকে টিপ করে দেখল, কেউ ওভাবে গুলি চালিয়ে নিশানায় হিট করতে পারল না। জানলা আর পথের মধ্যিখানে একটা গাছ ছিল, দেখতে সমস্যা হচ্ছিল। তাহলে হাজার – হাজার মানুষের ভিড়ের মধ্যে একটা চলন্ত গাড়ির সওয়ারিকে কীভাবে অব্যর্থ ভাবে গুলিবিদ্ধ করেছিল লি অসওয়াল্ড?

২২শে জানুয়ারি, ১৯৬৪। একটা তথ্য পেয়ে চমকে উঠল ওয়ারেন কমিশন। খুনি অসওয়াল্ড এফ বি আই –এর পে রোলে থাকা খোঁচর ছিল।

হুবার বললেন, এমন কিছুই ছিল না।

যেদিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি নিহত হয়েছিলেন, সেদিন এফ বি আই আধিকারিক গাই ব্যানিস্টার আর তাঁর এক সহকর্মী জ্যাক মার্টিন নিউ অরলিন্সের একটি বার-এ বসেছিলেন। দুজনের মধ্যে কোনও একটি বিষয় নিয়ে ঝগড়া শুরু হয়। অফিসে পৌঁছে ব্যানিস্টার মার্টিনকে নিজের রিভলভারের বাট দিয়ে মারতে শুরু করেন।

মার্টিন চিৎকার করতে থাকেন, ‘শালা মেরে ফেলল রে! মেরে ফেলল! যেভাবে কেনেডিকে মেরেছে!’

পরে মার্টিন এই ব্যাপারটা নিয়ে সাক্ষী দিয়েছেন। তবে তাঁর সাক্ষী দেওয়ার আগেই, ১৯৬৪ সালের জুন মাসে এজেন্ট গাই ব্যানিস্টার হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যান। এজেন্ট হোস্টিকে পরের তিনবছর চুপ করে থাকার নির্দেশ দেয়া হয়েছিল, নির্দেশ ঠিকভাবে না-মানায় হুবার তাঁর বদলির পর বদলি করেছিলেন।

সম্ভবত হুবার খুনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, কিন্তু তাঁর বায়োগ্রাফার লিখেছেন, ‘তিনি এই সম্পূর্ণ ঘটনাক্রমে বড় কিছু লুকোচ্ছিলেন।’

কী লুকোচ্ছিলেন?

কাকে লুকোচ্ছিলেন?

নিজের এজেন্সির গাফিলতিকে?

সি আই এ – কে?

নাকি (নতুন) রাষ্ট্রপতি লিন্ডন জনসনকে?

(ক্রমশ)