বিধাতার হাতে লেখা গান – ৫৩

অভীক মুখোপাধ্যায়

(দ্বাপঞ্চশত্তম পর্বের পর)

পর্ব – ৫৩

সন্দেহভাজন ৩ :কে জি বি

সোভিয়েত – আমেরিকা টানাপোড়েনের মধ্যেই কেনেডি একবার বলেছিলেন, ‘আমরা এই পৃথিবীর দুটি বড় দেশ। আমাদের একই রকম দেখতে। একই জল পান করি। একই বায়ুতে শ্বাস নিই। এবং সবথেকে বড় কথা হল আমরা তো কেউ অমর নই। তা কিছুদিন একসঙ্গে থাকতে পারব না?’

কেনেডি ধীরে – ধীরে মস্কোর প্রিয়পাত্রে পরিণত হয়েছিলেন। ক্রুশ্চেভ আর কে জি বি চাইছিল মার্কিন রাষ্ট্রপতির পদে কেনেডিই থেকে গেলে ভালো হয়। পরের নির্বাচনে কেনেডিকে জেতানোর জন্যে নাকি মস্কো অনেক চেষ্টাও চালাচ্ছিল। এই খবরটা সি আই এ – এর কাছে ছিল। আমেরিকার অনেক দক্ষিণপন্থীই কেনেডিকে সোভিয়েত এজেন্ট বলছিল। এখন প্রশ্ন হল যদি কেনেডি মস্কোর প্রিয় হন, ক্রুশ্চেভের পছন্দের হন, কে জি বি-এর নয়নমণি হয়ে ওঠেন, তাহলে কি কে জি বি কেনেডিকে মারার পিছনে থাকতে পারে? ষড়যন্ত্র করতে পারে?  

এই প্রসঙ্গে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিন্দুটি ছিল কেনেডির হত্যাকারী লি হার্ভে অসওয়াল্ড সোভিয়েতে তিন – তিনটে বছর কাটিয়ে আমেরিকায় ফিরেছিল। এটা এমন একটা সময়কালের কথা, যখন কোনও আমেরিকান সোভিয়েতে গিয়ে রাত কাটিয়ে এলে পড়েই তাঁকে কমিউনিস্ট, দেশদ্রোহী বলে দাগিয়ে দেওয়া হতো। তুমি সোভিয়েতে গেছ কী আর ভালো নেই। পয়েন্ট অব নো রিটার্ন। ফেরাই যেত না আমেরিকায়। অসওয়াল্ড যখন মস্কো পৌঁছয়, সে-ও ওখানে গিয়ে শরণার্থী রূপে নাগরিকত্ব নেওয়ার জন্যে আবেদন জানিয়েছিল। কারণ অন্য সকলের মতো সে-ও জানতে যে, তার আর আমেরিকা ফেরা হবে না।

কিন্তু মাত্র উনিশ বছরের একজন মার্কিন সৈনিক সোভিয়েতে কেন যেতে গেল?

অসওয়াল্ডের শৈশব, কৈশোর আর যৌবন ছিল হতাশায় ভরা। ছত্রভঙ্গ গোছের। তিরিশটা স্কুলে ঘুরে – ঘুরে পড়েছিল অসওয়াল্ড। আজ এখানে, কাল ওখানে, পরশু আবার সেইখানে। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়। নিউইয়র্ক শহরে বেশ কিছু ছোটখাটো অপরাধের সঙ্গে অসওয়াল্ডের নাম জড়িয়ে গিয়েছিল। মানসিক ভাবে সে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে একটা সময়ে। মনোরোগের চিকিৎসা চলেছিল। সেইসব রিপোর্টে অসওয়াল্ডকে ক্ষ্যাপাটে, বদরাগী বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।  

সেইসময়ে মার্কিন যুবকদের জীবনের কিছুটা সময় বাধ্যতামূলক ভাবে সেনাবাহিনীতে কাটাতে হতো। সরকার চাইলে সবই করতে হয়। মাত্র সতেরো বছর বয়েসে অসওয়াল্ড সান ডিয়েগোতে ট্রেনিং শুরু করল। সেখানে এম – ওয়ান রাইফেল চালাতে শিখে গেল সে। মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যেই সে হয়ে উঠল বাহিনীর সবচাইতে নির্ভরযোগ্য শার্পশুটার। নিখুঁত টিপ। দুশো গজ দূরত্ব থেকেও একেবারে বুলস আই হিট করা কোনও ব্যাপার ছিল না। অসওয়াল্ডের বন্ধুবান্ধব ছিলই না বলা চলে। মেয়েদের কাছে সে ঘেঁষত না। পরের দিকে একটা সূত্র উঠে আসে যে সে সমকামী ছিল। অসওয়াল্ডের সঙ্গে যারা ট্রেনিং করেছিল, তারা ওর ওপরে বেশ চড়াও হতো।

একাকীত্ব কাটাতে সে বই পড়তে শুরু করলে। মার্ক্সের থিওরি, লেনিনের কথা। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলে, ব্যাটা দু – চারটে পাতা পড়েই শুয়ে পড়ত। হলে কী হবে, ওই অল্প বিদ্যে নিয়েই কিন্তু অসওয়াল্ড ভয়ঙ্কর মতাদর্শবাদী হয়ে উঠেছিল। বড় – বড় কথা বলতেও সে পিছপা হতো না।

একবার এক আধিকারিক অসওয়াল্ডকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘তুমি এসব বামপন্থী সাহিত্য কেন পড়ছ?’

‘আমি শত্রুর মাথার মধ্যে কী চলছে সেটা বুঝতে চাইছি।’

ছোটবেলাকার বদরাগী ভাবটা কিন্তু ওর মধ্যে আবার চাগাড় মারছিল। এল টোরো-তে ট্রেনিং করার সময় অসওয়াল্ড মারপিটে জড়িয়ে পড়েছিল একাধিকবার। দুবার তাকে কোর্ট মার্শাল করা হয়। রাডার অপারেশন থেকে সরিয়ে নিয়ে টয়লেট সাফাইয়ের কাজে নিযুক্ত করা হয়েছিল।

তাহলে কি একটা খারাপ শৈশব এবং সেনাবাহিনীতে বছর দুয়েক কাটানোর ফলে অসওয়াল্ড আমেরিকাকে ঘেন্না করতে শুরু করেছিল? জীবনে বঞ্চনা, অবহেলা দেখতে – দেখতে বড় হয়েছিল বলেই কি কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর মধ্যে সে স্বর্গ দেখতে পেয়েছিল? মার্কসবাদী বইপত্রই কি তার বাইবেল হয়ে উঠেছিল তখন? সে আমেরিকা থেকে ফ্রান্স হয়ে চলে যায় ফিনল্যান্ড। তারপর সেখান থেকে কয়েক সপ্তাহের ভিসা পারমিশন নিয়ে সোজা মস্কো। সোভিয়েত অসওয়াল্ডের শরণার্থী হওয়ার আর্জি নাকচ করে দেয়। অসওয়াল্ড হোটেলের কামরায় ফিরে নিজের হাতের শিরা কেটে আত্মহত্যার চেষ্টা করে।

নিকিতা ক্রুশ্চেভ তখন সদ্য আমেরিকা থেকেই ফিরেছেন, আর এদিকে তাঁরই রাজত্বে একজন মার্কিন নাগরিক আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন, দুইয়ে – দুইয়ে চার করে যদি কেউ মিলিয়ে দিত তাহলে হইচই পড়ে যেত। তাহলে কি আদৌ এত কিছু ঘটেছিল? নাকি পরে এসব খবর কেউ বা কারা প্লান্ট করে দেয়? কে জি বি বলছে, অসওয়াল্ড অকম্মার ঢেঁকি। এটাও কি পুরোপুরি সত্যি?

মার্কিন সেনাবাহিনীর একজন শার্পশুটার কি কোনো কাজের জন্যেই উপযুক্ত ছিল না?

আচ্ছা, কে জি বি কি অসওয়াল্ডকে প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করেছিল?

কীসের প্রশিক্ষণ?

ধ্যাত্তেরি, এ তো সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে সীতা রামের মাসী গোছের মন্তব্য!

না…না, সুধী পাঠক, এত রাগারাগি করবেন না। আমি ঠিক প্রশ্নই করেছি। কারণ অসওয়াল্ডকে যে সময়ে মস্কো (যদি আদৌ) প্রশিক্ষিত করেও থাকে তাহলে কীসের জনেয় করেছিল?

আপনি বলবেন, কীসের জন্যে আবার…কেনেডিকে মারার জন্যে।

আর ওখানেই যত রকমের অসঙ্গতি। কেনেডি তখন কোথায়? তিনি তো প্রেসিডেন্টই হননি। তাঁকে হত্যার পরিকল্পনা করার প্রশ্নই ওঠে না।

যেটা নিয়ে কোনও দ্বিমত নেই, তা হল অসওয়াল্ডকে মস্কো থেকে ভাগিয়ে দেওয়া হয় মিন্সক শহরে। মিন্সক এখন বেলারুসের রাজধানী। সেখানকার একটা টিভি – রেডিও তৈরীর ফ্যাক্টরিতে কাজ দেওয়া হয়। রাশিয়ান শেখানোর জন্যে একজন প্রশিক্ষকের অধীনে রাখা হয়েছিল অসওয়াল্ডকে। সোভিয়েতে তখন ইংরেজি জানা লোক খুব কম ছিলেন। অসওয়াল্ডের রাশিয়ান শিক্ষকের নাম ছিল শুস্কেভিচ। আমরা যে সময়ের কথা লিখছি, তখন এই শুস্কেভিচ একজন সাধারণ দোভাষী ছাড়া আর কিছুই ছিলেন না, কিন্তু বিধাতা কার জন্যে কী লেখেন তা কে-ই বা আগে থেকে জানে বলুন দেখিনি। পরে যখন বেলারুস একটি দেশে পরিণত হবে, তখন শুস্কেভিচ সেদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হবেন।  

অসওয়াল্ডের হাতে মালকড়ি ভালোই আসছিল। সে নিজের ডায়েরিতে লিখে রেখে গিয়েছে, দুহাতে দেদার খরচা করার মতো আয় করলেও মিন্সক শহরে অত খরচ করার কোনও উপায় ছিল না। খরচের রাস্তা থাকবেই বা কী করে? বিশ্বযুদ্ধের প্রকোপে জর্জরিত একটা শহর, ধীরে – ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু মিন্সক –এ অসওয়াল্ডের সঙ্গে কাজ করা এক ব্যক্তি জানাচ্ছেন, অসওয়াল্ড সেখানেও রাইফেল শুটিং কম্পিটিশনে অংশগ্রহণ করত, কিন্তু তাক লাগাতে পারত না। একজন রাশিয়ান রমণীর সঙ্গে তার বিয়ে হয়। মেয়েটির নাম মেরিনা। একটি কন্যা সন্তানের জন্মও দিয়েছিলেন মেরিনা।  

তিন বছর ওখানে কাটানোর পর সম্ভবত অসওয়াল্ড বোর হয়ে গিয়েছিল। তখন নিজের আমেরিকান পাসপোর্ট দেখিয়ে সে নিজের স্ত্রী’র মার্কিন নাগরিকত্ব আদায় করে নেয়। এবং ১৯৬২ সালে সপরিবারে চলে যায় ডাল্লাস, ইউ এস।

এর ঠিক পরের বছর মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডি অসওয়াল্ডের হাতে নিহত হলেন।

এফ বি আই কেনেডি হত্যা সংক্রান্ত যে সব ফাইল সার্বজনীন করেছে, সেখানে পাওয়া যাচ্ছে কেনেডিকে মারার দুমাস আগে সে মেক্সিকোর সোভিয়েত দূতাবাসে ফোন করেছিল। সেই ফোন ট্যাপ করা হয়েছিল। অসওয়াল্ড ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘ওয়াশিংটনের টেলিগ্রামের ব্যাপারটা এগোলো?’

এর একটা সহজ ব্যাখ্যা আছে। তার স্ত্রী মেরিনা চাইছিল সোভিয়েতে ফিরে যেতে হবে। তাই সে দূতাবাসে কন্টাক্ট করেছিল। কিন্তু এই ঘটনার আরও একটি পক্ষ ছিল। অসওয়াল্ড যার সঙ্গে কথা বলেছিল, তিনি একজন উচ্চপদস্থ আধিকারিক ছিলেন। নাম ছিল কাস্তিকোভ।

পরে এফ বি আই –এর ডিরেক্টর হবার যখন এসব তথ্য জানতে পারেন, তখন তিনি বলেন, ‘এ নিয়ে বেশি জলঘোলা করে কোনও লাভ নেই। সোভিয়েতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক খারাপ হবে।’

আসলে এই কাস্তিকোভ নামক অফিসারের পুরো নাম ছিল ভ্যালেরি কাস্তিকোভ। তিনি দূতাবাসে চাকরি করলেও তাঁর একটি অন্য পরিচয়ও ছিল। তিনি ছিলেন কে জি বি এর থার্টিনথ ডিভিশনের ইনচার্জ। কে জি বি-এর এই থার্টিনথ ডিভিশন ছিল স্যাবোটেজ অ্যাণ্ড অ্যাসাসিনেশন – এর স্পেশালিস্ট বিভাগ।

(ক্রমশ)