বাঙালির সুপ্রাচীন উদার প্রগতিশীল সংস্কৃতির উৎস বামপন্থা নয় অধ্যাত্মবাদ

0
1548

অদ্বৈত সেনগুপ্ত

 

বাঙালিদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য় কি? এই প্রশ্ন যদি অন্য কোনো রাজ্যের বাসিন্দাদের করা হয় তাহলে কি উত্তর আসবে ? বাঙালিরা প্রগতিশীল, উদার, সংস্কৃতিবান, ধর্মনিরপেক্ষ এবং সর্বোপরি বামমনস্ক । অনেকেই আবার আপনাকে বলবে যে বাঙালিরা বামমনস্ক বলেই তারা প্রগতিশীল, উদার, সংস্কৃতিবান ও ধর্মনিরপেক্ষ । উত্তরদাতা আবার যদি কোনোভাবে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগে সমাজবিজ্ঞানের পাঠ নিয়ে থাকেন তাহলে তিনি নিশ্চিতভাবে আপনাকে জানাবেন যে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কৃতি ভারতের বাকি রাজ্যের থেকে ব্যতিক্রমী কারণ বামমতাদর্শের প্রভাব থাকার ফলে বাঙালিরা জাতীয়তাবাদ, হিন্দুত্ব এবং জাতি রাজনীতির মতো false consciouness (মিথ্যা বা ভুয়ো চেতনা) দ্বারা প্রভাবিত ও প্রতারিত হয় না। তারা প্রকৃতঅর্থেই উদারবাদী, প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ। কেতাবী রচনায় এই প্রবণতাকে ‘West Bengal exceptionalism ‘ নামক শব্দবন্ধ দ্বারা ভূষিত করা হয়েছে। ভারতীয় সমাজবিজ্ঞান চর্চায় এই ধরণের আকর্ষণপূর্ণ ও কৌতূহলোদ্দীপক শব্দবন্ধের প্রয়োগ সচরাচর করা হয়। এদের আপাতদৃষ্টিতে অত্য়ন্ত নিষ্পাপ ও নিহিতার্থহীন মনে হলেও তা নয়। এদের বহুল ব্যবহারের মাধ্যমে জনমানসের সাধারণ চিন্তন প্রভাবিত করার প্রয়াস করা হয়। যেমন ‘West Bengal exceptionalism ‘-এই আপাত নিরপেক্ষ ও অপাপবিদ্ধ শব্দবন্ধের মাধ্যমে ভারতের মূলধারার সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনার সাথে বাংলার নিবিড় যোগাযোগকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়েছে ।

স্বাধীনোত্তর পশ্চিমবঙ্গের সমাজ ও রাজনীতির সাথে বামপন্থার সম্পর্ক অস্বীকার করা যায় না। তবে উদারবাদ, প্রগতিশীলতা, ধর্মনিরপেক্ষতা ইত্যাদি গুণাবলী যা বাঙালি মননের বৈশিষ্ট্য় বলে আমরা গর্ববোধ করি তা কি শুধুই বামপন্থার ফলশ্রুতি? এই প্রশ্নের উত্তর হল যে উদারবাদ, প্রগতিশীলতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো গুণাবলী বাংলার মহান মনীষীদের জাতীয়তাবাদী ও দেশজ ভাবধারার পরিণতি। একইরকম ভাবে বাঙালির রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক চেতনা ভারতীয়ত্বের সাথে সম্পূর্ণ সামঞ্জস্যপূর্ণ বলেই জাতীয়তাবাদের বীজ বাংলার উর্বর ভূমিতেই প্রথম রাজনৈতিক মহীরুহে পরিণত হয়েছিল। মহাষষ্ঠীর পুণ্য লগ্নে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই বিস্মৃত সত্যকেই সমগ্র বাঙালি জাতির সম্মুক্ষে উপস্থাপিত করেছেন । এক অসামান্য প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষণের মাধ্যমে বঙ্গ সংস্কৃতির ও বঙ্গমনিষীদের সুমহান ঐতিহ্যকে তিনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। সেইসঙ্গে বাঙালির পারম্পরিক সংস্কৃতির স্বরূপকে উত্থাপিত করে আমাদের এক নতুন দিশার ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা সমগ্র বাঙালি জাতিকে আগত সময়ে আত্মসমীক্ষার উপাদান যোগাবে

 

শাশ্বত ভারতীয়ত্ব ও বঙ্গ চেতনা

প্রথমতঃ, প্রধানমন্ত্রী আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন যে বাঙালিরা শুধু দেবীকে মাতৃরূপে বন্দনা করে না; দেবীকে কন্যারূপে স্নেহও করে। দেবীর আগমনকে এখানে ঘরের মেয়ে উমার শশুরালয় থেকে নিজের পিত্রালয়ে যাত্রা হিসেবে কল্পনা করা হয়। স্ত্রীজাতির প্রতি এই গভীর শ্রদ্ধা ও স্নেহশীলতার মনোভাব বাঙালি মননের সহজাত প্রগতিশীলতাকেই নির্দেশ করে; এবং এই প্রগতিশীলতা বঙ্গসংস্কৃতির প্রাচীন ও পরম্পরাগত অঙ্গ, কোনও আধুনিক বিচারাধারার ফলশ্রুতি নয় । অর্থাৎ উগ্র পিতৃতন্ত্রের প্রতিকারের রসদ বঙ্গসংস্কৃতির প্রাচীন সাংস্কৃতিক পরিসরেই মজুদ রয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে উঠে এসেছে বঙ্গসংস্কৃতির সাথে ভারতীয় জাতীয়তাবোধের আত্মিক যোগ। বাংলার আধ্যাত্মিক ভাবনা ও সাংস্কৃতিক পরম্পরা অনেকাংশে ইংরেজবিরোধী ভারতীয় জাতীয়তাবাদের অভিমুখ নির্ধারণ করেছে। তাই বর্তমান ভারতীয় জাতীয়তাবোধের চরিত্র অনুধাবন করতে হলে বাংলার আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক পরম্পরার তাৎপর্য উপলদ্ধি করা আবশ্যক।

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের চরিত্র কি ? বামপন্থীদের মতে ভারতীয় জাতি একটি ‘imagined community’ (কাল্পনিক সম্প্রদায়) যা একটি modern artificial invention (আধুনিক কৃত্তিম উদ্ভাবন)।তাদের মতে ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে ভারতীয় জাতিসত্ত্বা গড়ে ওঠেনি। বিভিন্ন সংকীর্ন সম্প্রদায়ে বিভক্ত হয়ে থাকার ফলে ভারতীয়দের মধ্যে নানা ধরণের গোষ্ঠীভিত্তিক চেতনা উপস্থিত ছিল। কোনো ভারতীয় বা হিন্দু জাতীয়তাবোধের জন্ম হয়নি। সুতরাং আধুনিক ভারতের উদ্ভব ঘটেছে ব্রিটিশ কতৃক প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক একত্রীকরণের ফলে। অর্থাৎ ভারত রাষ্ট্র একটি অতীতহীন আধুনিক নির্মাণ। এরূপ চিন্তার মূলত দুপ্রকার উৎস রয়েছে – ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ধারণা ও আধুনিক পাশ্চাত্য রাজনৈতিক দর্শন। ব্রিটিশরা মনে করতো যে ভারত শুধুমাত্র বিশ্ব মানচিত্রের একটি ভূখণ্ড মাত্র, কোনো নেশন বা জাতি নয়। বিখ্যাত ব্রিটিশ প্রশাসক স্যার জন স্যাট্রেচে প্রশিক্ষণরত প্রশাসকদের প্রশিক্ষণ দেবার সময় তার বক্তব্যের শুরুতেই বলতেন – “The first and most important thing to learn about India is that there is not and never was an India”.

পবর্তীকালে জাতীয়তাবাদ সম্পর্কিত পাশ্চত্যের তাত্ত্বিক আলোচনা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের ভারত সম্পর্কিত ধারণাকেই বৌদ্ধিক মান্যতা প্রদান করে। এই তাত্ত্বিক সাহিত্যের মূল বক্তব্য হলো যে জাতীয়তাবাদ আধুনিকতার ফসল। আর্নেস্ট গেলনারের মতে আধুনিক শিল্পায়নের ফলে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছে। অন্যদিকে বেনেডিক্ট এন্ডারসনের মতে print capitalism বা আধুনিক প্রকাশনা শিল্পের প্রভাবে জাতীয়তাবোধ গড়ে উঠেছে, যা আদতে ‘imagined political community’ কারণ ‘the members of even the smallest nation will never know most of their fellow members, meet them or ever hear of them’। ভারতের পরিপ্রেক্ষিতে যদি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ও আধুনিকতার মধ্যে যোগসূত্র মেনে নেওয়া হয় তাহলে স্বভাবতই আমরা এই উপসংহারে উপনীত হবো যে ব্রিটিশ শাসনের পূর্বে ভারতে জাতীয় চেতনার জন্ম হয়নি কারণ ব্রিটিশদের হাত ধরেই তথাকথিত পাশ্চাত্য আধুনিকতার আগমন ভারতবর্ষে হয়েছে

কিন্তু ভারতীয়ত্বের ধারণা শতাব্দী প্রাচীন, প্রাক ঔপনিবেশিক প্রাক আধুনিক সময়ে তার অস্তিত্ব ছিল বাংলার মনীষীদের জাতীয়তাবাদী চিন্তাতে প্রাচীন ভারতীয়ত্বের ধারণা স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ভাষণে বাঙালি মনন এই প্রাচীন ভারতীয়ত্বের ধারণার আত্মিক সংযোগকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন, যা বর্তমান সময়কার ভারতীয় জাতিয়তাবাদের উৎস নিরূপনের ক্ষেত্রে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ

শতাব্দী প্রাচীন ভারতীয়ত্বের ধারণার প্রকাশ ঘটেছে আধ্যাত্মিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের সার্বজনীন উপল্বদ্ধির মাধ্যমে এই আধ্যাত্মিক সাংস্কৃতিক ঐক্যের ধারণা বুঝতে হলে জাতি জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে প্রভেদ করা প্রয়োজন আধুনিক রাজনৈতিক দর্শন জাতি জাতিরাষ্ট্রের মধ্যে প্রভেদ করে না এবং তার ফলে পাশ্চাত্য রাজনীতিক দর্শন দিয়ে ভারতীয়ত্বের ভাবনা বোঝা সম্ভব নয় প্রখ্যাত ঐতিহাসিক রজত কান্ত রায়ের মতে প্রাকআধুনিক যুগে জাতির ধারণা আধুনিক সময়ের চেয়ে ভিন্ন ছিল, যাকে তিনি ‘felt community’ (অনুভূত সম্প্রদায়) বলে আখ্যায়িত করেছেন একটিঅনুভূত সম্প্রদায়তার অস্তিত্যের জন্য আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের কাঠামোর ওপর নির্ভর করে না কারণ এটি সাংস্কৃতিক বা ভাষাগত সমজাতীয়করনের সুচিন্তিত ইচ্ছাকৃত প্রয়াসের মাধ্যমে উত্থিত হয় না এটি একটি জনগোষ্ঠীর আবেগ এবং একাত্মতার অনুভূতির সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সাংস্কৃতিক সম্প্রদায়, যার ইতিহাস আধুনিক জাতীয়তাবাদ সমজাতীয় পরিচয়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা জাতিরাষ্ট্রের ধারণার চাইতে বহু দীর্ঘ কয়েক হাজার বছর ধরে ভারতীয়রা একটিঅনুভূত সম্প্রদায়রূপে বিরাজ করছে তাদের সমষ্টিগত একাত্মতার একটি বিশিষ্ট বৈশিষ্ট্য হল যে তারা তাদের বসবাসের ভূমির সাথে পবিত্রতা সংযুক্ত করে এবং কিছু সাধারণ অভিন্ন সাংস্কৃতিক এবং আধ্যাত্মিক অর্থ মেনে চলে

 স্বনামধন্য ভারত বিশেষজ্ঞ ডায়ানা এল এক তার গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ ইন্ডিয়া: স্যাক্রেড জীওগ্রাফিতে বলেছেন যে ভারত শুধু একটি ভূখণ্ড নয়, ভারত একটি স্যাক্রেড বা পুণ্যভূমি যার নদী, পর্বত থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে দেবত্বের প্রকাশ কল্পনা করা হয়েছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে রয়েছে অগণিত তীর্থ ক্ষেত্র এবং প্রত্যেক তীর্থক্ষেত্রের সাথে প্রাচীন দৈব কাহিনী জড়িয়ে রয়েছে সব চাইতে তাৎপর্যপূর্ণ হলো যে এই সকল কাহিনী একে ওপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত, যা এক সর্বপরিব্যাপ্ত একক অখণ্ড সাংস্কৃতিক চেতনার অস্তিত্বকে নির্দেশ করে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা ৫১ টি (কোন কোন মতে ১০৮ টি ) শক্তিপীঠ মা শক্তির বিভিন্ন রূপের বহিঃপ্রকাশ একই রকম ভাবে কাশী, সাতটি মোক্ষ প্রদানকারী শহরের মধ্যে একটি মাত্র শহর, অন্য ছয়টি হল অযোধ্যা, মথুরা, হরিদ্বার, কাঞ্চি, উজ্জয়িনী এবং দ্বারকা এটি আবার বারোটি জায়গার মধ্যে একটি যেখানে ভগবান শিব জ্যোতির্লিঙ্গ হিসাবে প্রকাশ করেছিলেন অনুরূপভাবে যে নদীকে আমরা গঙ্গা নদী বলি তা ভারতের স্বর্গীয় উৎস সম্পন্ন সপ্ত গঙ্গার অন্যতম নর্মদা, গোদাবরী কাবেরী নদীকেও গঙ্গা হিসেবে সম্বোধন করা হয়েছে অর্থাৎ সারা ভারত ভূখণ্ড জুড়ে অভিন্ন সাংস্কৃতিক আধ্যাত্মিক ধারণার সন্ধান পাওয়া যায়, যা এক অভিন্ন সাংস্কৃতিক আধ্যাত্মিক চেতনার পরিচায়ক

বাঙালি মনীষীদের চিন্তায় এই শতাব্দী প্রাচীন সাংস্কৃতিক আধ্যাত্মিক ঐক্যের উপল্বদ্ধি ফুটে উঠেছে স্বামী বিবেকানন্দ এই চিরন্তন সাংস্কৃতিক ঐক্যকে অনুভব করে বলেছিলেন

‘ The problems in India are more complicated than the problems in any other country because of its enormous diversity. There are people of many races, religions and languages which come together to make a nation. Still we have one common ground that is our sacred tradition, our religion.…….. By one religion I do not mean one religion as held among the Christians, or the Mohammedans, of the Buddhists. We know that our religion has certain common grounds, common to all our sects’. 

বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা এই শতাব্দী প্রাচীন সাংস্কৃতিক আধ্যাত্মিক ঐক্যের মধ্যেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রকৃত স্বরূপ খুঁজে পেয়েছেন। ঋষি অরবিন্দ তাই তার বিখ্যাত উত্তর পাড়া ভাষণে ঘোষণা করেছিলেন– 

‘I spoke once before …… that nationalism is a creed, a religion, a faith. I say it again today, but I put it in another way. I say no longer that nationalism is a creed, a religion, a faith; I say that it is Sanatana Dharma which for us is nationalism’

প্রাক উপনিবেশিক স্বাদেশিকতা আধ্যাত্বিক ঐক্যের উপল্বদ্ধির ফলেই বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা মাতৃভূমিকে দেবীরূপে কল্পনা করেছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দেমাতরম কবিতায় তাই মাতৃভূমির আবির্ভাব ঘটেছে দেবী দুর্গা রূপে:

ত্বং হি দুর্গা দশপ্রহরণধারিণী

কমলা কমলদলবিহারিণী

বাণী বিদ্যাদায়িণী

নমামি ত্বাং

আবার অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার চিত্রকলায় ভারতমাতাকে গৈরিক বসনধারী দেবী রূপে উপস্থাপনা করেছেন মাতৃভূমির দেবী রূপ কল্পনাকে যে প্রাক উপনিবেশিক সাংস্কৃতিক আধ্যাত্মিক একাত্মতার অনুভূতি চালিত করেছিল তা স্বাধীনতা সংগ্রামী বিপিন চন্দ্র পালের রচনায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে তিনি তারসোল্ অফ ইন্ডিয়াগ্রন্থে লিখেছেন

‘The highest philosophical speculations of the Hindus have posited two ultimate principles , or more correctly speaking , two final principles in the universe; one is called the Purusha, the other Prakriti……….In Vedantic Philosophy, Purusha is called Isvara and Prakriti Maya: the former representing the noumenal and the latter the phenomenal aspect of Reality. In the system of the Vaishnavas, Sree Krishna is Purusha and Prakriti is Radha. In the thought of the Shaivaites, Purusha is Shiva and Prakriti is Shakti. The conception of Mother associated with our geographical habitat is filiated to this old, old, universal Hindu conception of Prakriti; but of Prakriti conceived especially as Shakti.’ 

অর্থাৎ এই আলোচনা থেকে স্পষ্ট যে বাংলায় জাতীয়তাবাদী চেতনার মূল আধার ছিল প্রাক উপনিবেশিক স্বাদেশিকতা শতাব্দী প্রাচীন আধ্যাত্মিক ঐক্যের উপলব্ধিতাদের স্বদেশ চেতনা কোনো কৃত্রিম রাজনৈতিক নির্মাণ ছিল না

 

জাতীয়তাবাদ ও অর্থনৈতিক চিন্তা

বাংলার জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা মার্কসবাদের মতো বস্তুবাদী ছিল না এটি ঐতিহাসিক বস্তুবাদের মতো জটিল এবং কেতাদুরস্ত অর্থনৈতিক তত্ত্বের অধিকারী ছিল না তবে তার একটি সহজ সরল বাস্তববাদী অর্থনৈতিক কর্মসূচি ছিল যা মানুষের মৌলিক প্রয়োজনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ ছিল এই অর্থনৈতিক কর্মসূচি প্রধানমন্ত্রী খুব সরল হৃদয়স্পর্শী বাংলায় প্রকাশ করেছেন যা অন্নদামঙ্গল কাব্যের একটি পংক্তি – ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে আবার তিনি জাতীয়তাবাদী কবি রজনীকান্ত সেনের গানের একটি পংক্তিও উল্লেখ করেছেন– ‘মায়ের দেয়া মোটা কাপড় মাথায় তুলে না রে ভাই’

জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক চিন্তার মূল বার্তা ছিল আত্মনির্ভরতা আত্মশক্তি যার উল্লেখ প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণেও করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তারঅবস্থা ব্যবস্থা প্রবন্ধেআত্মশক্তির কথা বলেছেন যার মাধ্যমে তিনি গঠনমূলক উন্নয়ন কর্মসূচির প্রতি দিকনির্দেশ করেছেন এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে তিনি গ্রামীণ স্বশাসন, জাতীয় শিক্ষা, ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্প, সল্প সুদে ঋণ প্রকল্পের মতো পদক্ষেপ প্রস্তাবনা করেছেন ঋষি অরবিন্দও একই কথা বলেছেন। ১৯০৭ সালে বন্দেমাতরম পত্রিকায় তিনি লিখেছেন

“Our policy is self-development and defensive resistance. But we would extend the policy of self-development to every department of national life; not only Swadeshi and National Education, but national defence, national arbitration courts, sanitation, insurance against famine or relief of famine”.

সর্বোপরি অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কতৃক অঙ্কিত ভারতমাতা তার চার হস্তে ধানের শীষ, শ্বেত বস্ত্র, একটি বই রুদ্রাক্ষের জপমালা বহন করেছেন যা যথাক্রমে অন্ন্য, বস্ত্র (বা শান্তি) , জ্ঞান আধ্যাত্মিকতার প্রতীক অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্য যে বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার অন্তর্ভুক্ত এই চিত্রই তার মূর্ত প্রমাণ

 

ধর্মনিরপক্ষেতা বাঙালির জাতীয়তাবাদ

বাঙালির উদার স্বদেশ চেতনা ধর্ম, বর্ণ জাতপাতের বিভাজন দ্বারা প্রভাবিত হয়নি প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছেন হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুর পঞ্চানন বর্মার মতো মনীষীদের অবদানের কথাও হরিচাঁদ ঠাকুর, গুরুচাঁদ ঠাকুরের মতো নিম্নবর্ণের অন্তর্ভুক্ত বঙ্গ মনীষীরা উচ্চ নিচ ভেদাভেদের বিরুদ্ধে লড়াই করলেও জ্যোতিবা ফুলে বা পেরিয়ারের মতো হিন্দু সংস্কৃতির সঙ্গে নিজেদের আত্মিক বন্ধন ছিন্ন করবার প্রচেষ্টা করেননি কারণ বাংলায় মূলধারার জাতীয়তাবাদী আদর্শ সামাজিক সংস্কারের মধ্যে কোনো বিরোধ ছিল না স্বামী বিবেকানন্দ উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন

হে ভারত, ভুলিও নানীচজাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই হে বীর সাহস অবলম্বন কর, সদর্পে বলআমি ভারতবাসী, ভারতবাসী আমার ভাই বলমূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চণ্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই সদর্পে ডাকিয়া বল, ভারতবাসী আমার ভাই, ভারতবাসী আমার প্রাণ, ভারতের দেবদেবী আমার ঈশ্বর, ভারতের সমাজ আমার শিশুশয্যা, আমার যৌবনের উপবন, আমার বার্ধক্যের বারানসী বল ভাইভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ ভারতের কল্যাণ, আমার কল্যাণ

ধর্ম নিরপেক্ষতা উদারতার চূড়ান্ত নিদর্শন স্থাপন করে স্বামীজিই আবার শিকাগো ধর্ম মহাসম্মেলনে দাঁড়িয়ে মুক্ত কণ্ঠে বলেছিলেন– “I am proud to belong to a religion which has taught the world both tolerance and universal acceptance. We believe not only in universal toleration, but we accept all religions as true.” 

প্রখ্যাত ইতিহাসকার সুগত বসু তারনেশন এস মাদারগ্রন্থে দেখিয়েছেন যে বাঙালি জাতীয়তাবাদীরা মাতৃভূমিকে হিন্দু দেবী রূপে কল্পনা করলেও তাদের অন্য কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি কোনো বিরূপ বা বৈষম্যমূলক মনোভাব ছিল না; এবং বাঙালি মুসলিমরাও বাঙালি হিন্দুদের মাতৃবন্দনার ঐতিহ্যে সক্রিয়ভাবে সামিল না হলেও তাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেনি উদাহরণস্বরুপ তিনি দেখিয়েছেন যে বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম তার কাণ্ডারী হুশিয়ার কবিতায় একজায়গায় লিখেছেন

অসহায় জাতি মরিছে ডুবিয়া, জানে না সন্তরণ

কাণ্ডারি! আজ দেখিব তোমার মাতৃমুক্তি পণ

হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?

কাণ্ডারি! বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার

আবার কবিগুরুর গানবাংলাদেশের হৃদয় হতে১৯৭১এ মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় অত্যন্ত্য জনপ্রিয়তা লাভ করেছিল বলার অপেক্ষা রাখে না যে এই গানটি মাতৃভূমিকে দেবী রূপে কল্পনা করেছে

আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি

তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!

ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে

ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে, বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,

দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ

ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!

তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে

পরিশেষের বক্তব্য

প্রধানমন্ত্রী তার অসাধারণ ভাষণে বঙ্গসংস্কৃতির সুমহান জাতীয়তাবাদী চরিত্র আমাদের সামনে উত্থাপিত করেছেন এই জাতীয়তাবাদী চরিত্র কোনো কাল্পনিক আধুনিক নির্মাণ নয়; তা ভারতের শাশ্বত আধ্যাত্মিক সাংস্কৃতিক ধারণা এবং বঙ্গভূমির প্রাক উপনিবেশিক প্রাক আধুনিক দেশাত্মবোধের দ্বারা উদ্বুদ্ধ অনুপ্রাণিত হয়েছে কিন্তু অনাধুনিক হলেও তা উদার, প্রগতিশীল, উন্নয়নমুখী এবং ধর্মনিরপেক্ষ উদারতা, প্রগিতিশীলতা, উন্নয়নশীলতা ধর্মনিরপেক্ষতার পাঠ বাংলা বামপন্থা থেকে নেয়নি তা বাংলার শাশ্বত স্বদেশবোধ পরম্পরাগত আধ্যাত্মিক চেতনায় সদা বিরাজমান