মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত – বাঙ্গালী বণিক যিনি মালয়েশিয়াতে উপনিবেশ স্থাপন করেন

স্নেহাংশু মজুমদার

আপনারা সকলেই বাঙ্গালার সিংহপুর রাজ্যের যুবরাজ বিজয়সিংহের ৭০০ নৌকা নিয়ে লঙ্কাবিজয় ও সিংহল রাজ্যস্থাপনের কাহিনীর বিষয়ে অবগত । বিশেষত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশে প্রাচীন বাঙ্গালীদের অভিযান ও উপনিবেশ বা স্বাধীন রাজ্যস্থাপনের একাধিক নিদর্শন পাওয়া যায় । বস্তুত বাঙ্গালীদের মাধ্যমেই সেখানে ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশগুলিতে আৰ্যত্ব তথা হিন্দু সভ্যতার প্রবেশ ঘটেছে। যার প্রভাব দেখা যায় সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর মন্দির-স্থাপত্যে গৌড়ীয় শৈলীর অবিচ্ছিন্ন প্রভাব ।

পৃথিবীর সর্ববৃহৎ মন্দির ওঁঙ্কারনাথ (আঙ্করভাট) বা বরভূধর (বোরোবুদূর) মন্দিরের মতো একাধিক বৃহৎ মন্দিরের নির্মাতা বাঙ্গালী স্থপতিবিদগণ। তাই কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত গর্ব করে বলেছিলেন – “শ্যাম কম্বোজে ওঁঙ্কারধাম মোদেরই প্রাচীন কীর্ত্তি”। শ্রীলঙ্কায় বিজয় সিংহ রাজ্য স্থাপন করেন, আবার এদিকে নাগ উপাসক বং-লং (বঙ্গালম) গোষ্ঠীর রাজা লাক-লম (লক্ষ্মণম?) গিয়ে ভিয়েতনামে রাজ্য স্থাপন করেন, কম্বোডিয়ার ফুনানে রাজ্য স্থাপন করেন কৌণ্ডিন্য পন্ডিত – ঠিক সেভাবেই বাঙ্গালার রক্তমৃত্তিকা থেকে গিয়ে মালয়েশিয়াতে রাজ্য স্থাপন করেছিলেন এক বাঙ্গালী বণিক মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত ।

১৮৩৪ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সেনানায়ক জেমস লো মালয় উপদ্বীপে অবস্থিত তৎকালীন ওয়েলেসলি রাজ্যের (বর্তমান মালয়েশিয়ার পেনাং রাজ্যের সেবেরাং পেরাই) উত্তরাংশে এক প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দিরের অবশেষ থেকে একটি স্লেট পাথরের উপর উৎকীর্ণ লেখ খুঁজে পান। ১৮৩৫ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি এই লেখটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিকে উপহার দেন। বর্তমানে কলকাতার ভারতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত এই প্রস্তরফলকটি ৬৬ সেমি দীর্ঘ ও ৮-৯ সেমি প্রশস্ত। এর একদিকে একটি স্তূপের প্রতিকৃতি খোদিত, আর এই স্তূপের প্রতিকৃতির দুই পাশে উপর থেকে নিচে প্রাচীন পল্লব ব্রাহ্মী লিপিতে সংস্কৃত ভাষায় উৎকীর্ণ লেখের বাণী। পাথরের ফলকের নিচের অংশটি ভেঙে গেলেও লেখটি প্রায় সম্পূর্ণ ও বোধগম্য।

মালয়েশিয়ায় বুদ্ধগুপ্তের যে শিলালিপিটি আবিষ্কৃত হয়, তাতে লেখা ছিলঃ

“অঞ্জনাচ্চীয়তে কর্ম জন্মনঃ কর্ম কারণ (ম) জ্ঞানানুচীয়তে (কর্ম কর্মাভাবান্ন জায়তে) মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তস্য রক্তমৃত্তিকা বাস (ৎ ব্যস্য) সর্বে প্রকারেণ সর্বাস্মিণ সর্বথা স(র)ব সিদ্ধ যাত (রঃ) সন্তু।”

এই শিলালিপি থেকে মহানাবিক বুদ্ধগুপ্ত এবং তাঁর বাসস্থান রক্তমৃত্তিকা বা আজকের রাঙামাটি সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যায়। পরবর্তীতে রক্তমৃত্তিকা বা রাঙামাটি এবং রাজবাড়ীডাঙা তে খনন করে রাজা শশাঙ্কের রাজধানী কর্ণসুবর্ণ আবিষ্কৃত হয়।

আধুনিক বিদ্বানরা অক্ষরের ছাঁদ দেখে এই লেখটিকে পঞ্চম শতকের বলে অনুমান করেছেন। এই লেখে কোনও একটি বৌদ্ধ সংঘের দ্বারা মহানাবিক বুদ্ধগুপ্তের বাণিজ্যযাত্রা সর্বত সিদ্ধকাম হবার প্রার্থনা লিপিবদ্ধ; সম্ভবত এই মঙ্গলসূচক প্রস্তরফলকটি বাণিজ্যপোতে বহন করা হত। এই লেখে উল্লিখিত মহানাবিক অর্থাৎ পোতাধ্যক্ষ বুদ্ধগুপ্তের বাসস্থান ছিল রক্তমৃত্তিকা। এখনও পর্যন্ত রক্তমৃত্তিকা জনপদের এটিই প্রাচীনতম উল্লেখ। এই লেখটি থেকে অনুমান করা যায় সাধারণাব্দের পঞ্চম শতকের রক্তমৃত্তিকা থেকে ভাগীরথীর বাণিজ্যপথ ধরে তাম্রলিপ্ত হয়ে বাংলার বণিকরা ভারত মহাসাগরের পথে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাণিজ্যে যেতেন। সম্ভবত বুদ্ধগুপ্তের মত প্রাচীন বাংলার তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সমৃদ্ধ বণিকদের পৃষ্ঠপোষকতায় রক্তমৃত্তিকা জনপদে গড়ে উঠেছিল এক বা একাধিক তান্ত্রিক বৌদ্ধ শাস্ত্রচর্চার প্রতিষ্ঠান।

খ্রিস্টীয় প্রথম থেকে পঞ্চম শতক পর্যন্ত, বেশ কয়েকটি বাণিজ্যিক বন্দররাজ্য (entrepot) মালয় উপদ্বীপ এবং অন্যান্য অংশে আবির্ভূত হয়েছিল । দক্ষিণ – পূর্ব এশিয়া ও তাদের কিছু এলাকায় অবস্থিত উপকূলরেখা বা নদীর মুখ, যদিও কিছু রাজ্য ছিল যেগুলো আরও অভ্যন্তরীণ এলাকায় অবস্থিত। সেই রাজ্যের মধ্যে চিহ্ তু (লাল মাটির দেশ) বা ‘Red Earth Land’ এর অবস্থান নিয়ে বিতর্ক ছিল । পণ্ডিতদের মধ্যে, কিন্তু অধিকাংশ মনে করেন যে চিহ তু রাজ্যের অবস্থান উপদ্বীপীয় মালয়েশিয়ার পূর্ব উপকূলে অবস্থিত যা তানাহ মেরাহে অবস্থিত কেলান্তান।

যদিও চিহ-তু রাজ্যের নথি সপ্তম শতাব্দীতে চীনা উৎস “চি তু গৌজি”-তে পাওয়া যায়, তবে বিশ্বাস করা হয় যে এই রাজ্যটি সেই তারিখের আগে থেকেই বিদ্যমান ছিল। বুজং উপত্যকায় একটি শিলালিপি আবিষ্কারের মাধ্যমে এই বিবৃতিটি প্রমাণিত হয়, যা বুদ্ধগুপ্ত শিলালিপি, যা তানাহ মেরাহ নামে পরিচিত একটি স্থান থেকে বুদ্ধগুপ্তের ভ্রমণের কথা বলে, তার উৎস ভারতীয় উপমহাদেশের পূর্বদিকে অবস্থিত গৌড়দেশের রক্তমৃত্তিকা অঞ্চল, যাকে Red Earth Land বলা হয়েছে । ‘চি তু’ শব্দের অর্থ লাল মাটি, ‘গৌজি’ র অর্থ গৌড়দেশ।

মহারাজ বুদ্ধগুপ্ত ভারতের বাইরে ভারতীয় সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় আপামর ভারতবাসীর কাছে চিরস্মরণীয় । তাঁর গৌরব প্রচারে ভারতীয় প্রশাসনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় । ২০১৮ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন ভারত-সিঙ্গাপুর যৌথ বৈঠকের সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রী নরেন্দ্র মোদি সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন লুং কে ষষ্ঠ শতকের মহারাজ বুদ্ধগুপ্তের সেই প্রস্তরলেখের রেপ্লিকা উপহার প্রদান করেন, যা আন্তর্জাতিকভাবে বাঙ্গালী জাতির ইতিহাস প্রচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ।

তথ্যসুত্র:

1. Chhabra, B. Ch., “Expansion of Indo-Aryan Culture during Pallava Rule” in Journal of the Royal Asiatic Society of Bengal, Vol. 1, 1935; Calcutta: The Royal Asiatic Society of Bengal 1936, pp. 16-20.

2. Beal, Samuel, Si-Yu-Ki, Buddhist Records of the Western World: Translated from the Chinese of Hiuen Tsiang (AD 629), Vol. 2; London: Trübner & Co., 1884, pp. 201-204. . Beal, Samuel, The Life of Hiuen Tsiang by the Shaman Hwui Li; London: Kegan Paul, Trench, Trübner & Co., 1911, pp. 131-132.

3. Das, Sudhir Ranjan, Rajbadidanga: 1962 (Chiruti: Jadupur: An Interim Report on Excavations at Rajbadidanga and Terracotta Seals and Sealings), Reprint; Kolkata: The Asiatic Society, 2003 (1968).

4. Kerajaan Chih-Tu : Kerajaan Awal Yang Yujud de Negeri Kelantan ~ Zuliskandar Ramli

5. The Kingdom of Red Earth (Chitu Guo) in Cambodia and Vietnam from the Sixth to Eighth Centuries ~ Tatsuo Hoshino