‘পলান্ন, মাংসদন’ অপভ্রংশ ‘বিরিয়ানি’

0
441

তৃতীয় পর্বের পর


কুমারসম্ভবম্

অধ্যায় ৪ — যাজ্ঞসেনীর পিপ্পলি

বিশ্বের সর্ববৃহৎ এবং সর্বপ্রাচীন ভারতীয় ঐতিহাসিক মহাকাব্যে তথা বৈদিক ইতিহাসে এবং সাহিত্যে যে পলল বা পলান্ন সংক্রান্ত ইতিবৃত্ত পাওয়া গেছে তা অবশ্যই বর্তমানের বিরিয়ানির ন্যায় এত তীব্র মশলাযুক্ত বা ঝাল হত না। মহাভারতে অসাধারণ রন্ধনশৈলী পটু যাজ্ঞসেনী (অর্থাৎ দ্রৌপদী) ঝালের ব্যবহার সম্পর্কে বলেছিলেন, “ঝাল ব্যবহার করলে ব্যঞ্জন হবে অত্যন্ত তীব্র তথা কটু স্বাদের এবং সেই তীব্র ব্যঞ্জন ভক্ষণ হবে উদর জ্বালাকর”, তাই তিনি রন্ধনে কিঞ্চিৎ স্বাদের তীব্রতা বৃদ্ধির জন্য পিপ্পলি ব্যবহার করতেন, কিন্তু তিনি লঙ্কা ব্যবহার করতেন না কারণ সেই যুগে ভারতবর্ষে লঙ্কার কোন প্রচলনই ছিল না।

প্রায় ৮৫০০ বছর পূর্বে মক্সিকোর পুয়েব্লা অঞ্চলের তেহুয়াকান উপত্যকার তথা মধ্য আমেরিকায় ‘লঙ্কার’ ব্যবহার শুরু হয়েছিল। তার প্রায় আড়াই হাজার বছর পরে, অর্থাৎ আজ থেকে প্রায় ৬১০০ বছর পূর্বে মক্সিকোর মূল নিবাসীগণের মধ্যে লঙ্কার দৈনন্দিন ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়েছিল।

বর্তমানে আমরা যাকে ‘লঙ্কা’ বা ‘মরিচ’ বলে জানি, প্রাচীন ভারতবর্ষে তার কোন প্রচলন ছিল না তাই ফলনও হত না। খাদ্যে ব্যবহারের জন্য উৎপন্ন এবং ব্যবহার হত ‘পিপ্পলি’, গোলমরিচ ইত্যাদি এবং বিভিন্ন ব্যঞ্জনে প্রধানত পিপ্পলি’র ব্যবহার হত।

রন্ধনে তীব্র ঝাল ব্যবহারে রীতি প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসে কোনকালেই ছিল না, যা মধ্য এশিয়া বা আরবের রুক্ষ মরু অঞ্চল থেকে মুসলমানরা ভারতবর্ষ লুঠ করতে আসার পরে ক্রমশ তাদের তীব্র লঙ্কা ব্যবহৃত রুক্ষ মাংস রন্ধনের সুবাদে প্রচলন হয়ে গেছে।

ঠিক তেমনই প্রায় ৫২৪ বছর পূর্বে, ১৪৯৮ সনে পোর্তুগিজ লুঠেরারা লুঠ করতে আসার সময় ভারতবর্ষে লঙ্কা আমদানি করেছিল, কারণ তারা ৬ হাজার বছর পূর্ব থেকেই তীব্র ঝাল ব্যঞ্জনে অভ্যস্ত ছিল।
ভারতবর্ষ থেকে উৎকৃষ্ট মশলাপাতি বা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে সম্পদ এবং খাদ্যশস্য লুঠপাট করার জন্য দীর্ঘ দিন সমুদ্র ভ্রমণ ছিল তাদের জন্য অবশ্যম্ভাবী। সমুদ্রে দীর্ঘদিন ভ্রমণের সময় খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের জন্য ঝলসানো মাংস তথা ভবিষ্যতের ব্যবহারের জন্য কাঁচা মাংসকে পচন থেকে রক্ষা করতে গেলে, তাতে পর্যাপ্ত পরিমানে শুকনো লঙ্কার গুঁড়ো এবং বিভিন্ন গরম মশলা মাখিয়ে রাখলে সেই মাংসে বা খাদ্যে শীঘ্র পচন ধরে না, তাই তাদের দ্বারাই ভারতবর্ষের বিভিন্ন রন্ধনে লঙ্কার ব্যবহার শুরু হয়েছিল।

রন্ধনে দৈনন্দিন ক্রমাগত লঙ্কার ব্যবহার পাকস্থলীতে ‘ঘাত’ তথা ক্ষতের সৃষ্টি করে, তাই মহাভারতে অসাধারণ রন্ধনপটু যাজ্ঞসেনী ব্যঞ্জনে তীব্র ঝাল ব্যবহার থেকে বিরত থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন। উপরন্তু প্রাচীন ভারতবর্ষের যেহেতু লঙ্কার ব্যবহার হত না, হত পিপ্পলি’র ব্যবহার, তাই পলল বা পলান্ন জাতীয় খাদ্যদ্রব্য আহারের পরে হজমের কোন অন্তরায় সৃষ্টি হত না; বরং তা ছিল স্বাস্থ্যের পক্ষে উপকারী।