হিন্দু রাষ্ট্রের অনুধ্যান – ৪

0
2506

হিন্দুত্ববুক্স ও বঙ্গদেশ পত্রিকার যৌথ উদ্যোগে আমরা আভাস চ্যাটার্জী, আই এ এস, দ্বারা লিখিত The Concept of Hindu Nation বইটির বঙ্গানুবাদ প্রকাশ করছি। অনুবাদ করেছেন অঙ্কুশা। আমরা অনুমতির জন্য ভয়েস অফ ইণ্ডিয়ার কাছে ঋণী।

হিন্দু রাষ্ট্রের অনুধ্যান

– আভাস চ্যাটার্জী

 

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পরিশিষ্ট

শ্রী অরবিন্দের ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি

..১ হিন্দু রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে

১৯০৪ (?)

দেশ কীসের জন্য? আমাদের মাতৃভূমি কী? এটি কোনো মাটির টুকরো নয়, কোনো ভাষ্যরূপ নয় বা মনের কল্পনাও নয়। এটি একটি মহৎ শক্তি হতে পারে যা সমস্ত লক্ষ লক্ষ একক শক্তি দিয়ে নির্মিত, ঠিক যেমন সমস্ত দেবতার শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে ভবানী মহিষমর্দিনীর মহাশক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। ভারতকে আমরা যে শক্তি বলি, সেই ভারতের ভবানী ভারতী ত্রিশ কোটি মানুষের শক্তি, তথাপি তিনি নিজ পুত্রদের জড়তা এবং অবহেলার জন্য নিষ্ক্রিয়, তামসের যাদুবৃত্তে বন্দী।

১৯শে জুন, ১৯০৭

স্বাভাবিক টান ছাড়াও যেকোনো ব্যক্তির তাঁর নিজের দেশের সাহিত্য, ঐতিহ্য, রীতিনীতি ও ব্যবহার একটি জাতীয় সভ্যতার উৎকর্ষতার মাত্রায় বাড়তি অনুপ্রেণার সঞ্চার করে। এত দোষ থাকা সত্ত্বেও ইংরেজরা যদি ইংল্যান্ডকে তাদের সমস্ত কিছু দিয়ে ভালবাসতে পারে, তবে আমরা কেন ভারতবর্ষকে ভালোবাসতে ব্যর্থ হব যার একমাত্র ভুল ছিল একটি অপ্রতিরোধ্য শক্তিকে ক্রমাগত টেনে নীচে নামানো যতক্ষণ না বিদেশীরা এই দেশ অধিকার করে এর সমস্ত সমাজকে একেবারে অচল করে দেয়? কিন্তু সমগ্র বিশ্বজুড়ে এরূপ একটি সভ্যতার ধারক ও বাহক হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করা তো দূর হস্ত, আমরা আমাদের নিজস্ব মাতৃভূমিতে পর্যন্ত নিজেদের ঐক্য বজায় রাখতে অক্ষম। এটা বিশ্বাসঘাতকতারই সামিল। এটা সবচেয়ে খারাপ ব্যাপার। আমরা আমাদের এই মূল্যবান দানপ্রাপ্ত স্থানকে আমরা কিছুই দিয়ে উঠতে পারিনি; এর বিপরীতে আমরা নিজেদের এবং এমনকি অনাগত শিশুদেরও তাদের বৈধ ঐতিহ্যের পূর্ণ ভোগের অধিকার থেকে দূরে সরিয়ে রাখছি….

সিজউইকের মতে, আধ্যাত্মিক বিস্তারের বাসনা থেকে দৈহিক প্রসার ঘটে এবং ইতিহাসও এই দাবি সমর্থন করে। তবে কেন ভারত বিশ্বের প্রথম শক্তি হবে না? বিশ্বজুড়ে আধ্যাত্মিক আধিপত্য বিস্তারের অবিসংবাদিত অধিকার আর কার আছে? এটিই ছিল স্বামী বিবেকানন্দের প্রচারের পরিকল্পনা। দেশমাতৃকাকে তাঁর আধ্যাত্মিকতার এই কালজয়ী মাহাত্ম্যের উপলব্ধি আবার একবার করিয়ে তাঁকে তার মহিমার কথা স্মরণ করিয়ে দিতে হবে। এই মহত্ত্বের অনুভব সমস্ত দেশপ্রেমের মূল উৎস। কেবল এটিই সমস্ত আত্মঅবক্ষয়ের অবসান ঘটাতে পারে এবং লুপ্ত স্থান পুনরুদ্ধারের জন্য একটি তীব্র আকাঙ্ক্ষার জন্ম দিতে পারে।

৭ই অক্টোবর, ১৯০৭

এই মহান ও প্রাচীন দেশ এক সময় মানবসভ্যতার উৎস ছিল, মানব সভ্যতার চূড়োমণি ছিল, সাহস ও মানবতার দৃষ্টান্ত ছিল, একটি যথাযথ আদর্শ প্রশাসন ও সুস্থিত সমাজ ছিল, সকল ধর্মের জন্মদাত্রী ছিল, সমস্ত প্রজ্ঞা এবং দর্শনের পথপ্রদর্শক ছিল। বর্বর ও আদিম প্রজাতির মানুষের জন্য এই দেশের অনেক ক্ষতি হয়েছে, রাতের গভীর আঁধার ছেয়ে ফেলেছে আমাদের দেশকে এবং প্রায়শই মৃত্যুর যন্ত্রণা উপলব্ধি করেছে। ভারতের অহংকারকে ধূলিকণায় পরিণত করা হয়েছে ও তার গৌরব পদদলিত হয়েছে। ক্ষুধা, দুর্দশা ও হতাশা এই পবিত্র পাহাড়, এই প্রাচীন নদীগুলি এবং এই শহরগুলির জীবনকাহিনীকে সেই প্রাগৈতিহাসিক দিনে ফিরে নিয়ে গিয়ে তাদের সর্বময়ী কর্ত্রী হয়ে ওঠে। তবে কি আপনি মনে করেন যে ঈশ্বর আমাদের সম্পূর্ণভাবে ত্যাগ করেছেন এবং চিরকালের জন্য পশ্চিমী দেশগুলি ও তাদের ব্যবসা এবং ভক্ষকদের বিলাসিতা ও অহংকারের পাত্র হিসেবে আমাদের উৎসর্গ করে দিয়েছেন?

৩০শে মে, ১৯০৯

(বিখ্যাত উত্তরপাড়া অভিভাষণ থেকে)

[ইংল্যান্ড থেকে শ্রী অরবিন্দর ফিরে আসার পরে] আমি যখন ঈশ্বরের কাছে গিয়েছিলাম তখনই তাঁর প্রতি আমার বিশ্বাস ছিল না। আমার অজ্ঞেয়বাদী সত্তা, আমার নাস্তিক সত্তা, আমার সন্দেহবাদী সত্তা এবং আমি স্বয়ং নিশ্চিত ছিলাম না যে ঈশ্বর আছেন কিনা। তবুও কিছু একটা জিনিস আমাকে বেদের সত্য, গীতার সত্য এবং হিন্দু ধর্মের সত্যের দিকে আকৃষ্ট করেছিল। আমি অনুভব করেছি যে এই যোগের মধ্যে কোথাও একটা মহৎ সত্য রয়েছে, বেদান্তের উপর ভিত্তি করে একটি মহাশক্তিশালী সত্য এই ধর্মে লুক্কায়িত আছে। সুতরাং আমার ধারণা সঠিক ছিল কিনা তা খুঁজে বের করার জন্য আমি যোগের দিকে মনোনিবেশ করি, এটি অনুশীলন করার সিদ্ধান্ত নিই। আমি এই মর্মে এর অনুশীলন করেছিলাম এবং তাঁর কাছে এই প্রার্থনা দিয়ে করেছিলাম যে, ” আপনি যদি থাকেনন, তবে আপনি আমার হৃদয় জানবেন। আপনি জানবেন যে আমি মুক্তির জন্য প্রার্থনা করছিনা, আমি এমন কিছু চাই না যা অন্যরা সচরাচর চায়। এই দেশের উন্নয়নের জন্য আমি কেবল আপনার থেকে শক্তি চেয়েছি, আমি যেসব মানুষকে ভালোবেসেছি এবং যাদের জন্য আমি আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই আমি যেন তাদের সঙ্গে সারাজীবন থাকতে পারি এবং তাদের জন্য কাজ করতে পারি। আমি যোগা অনুশীলন করার দীর্ঘ প্রচেষ্টা করেছি এবং কিছুটা হলেও তা করতে পেরেছি, তবে আমি যা চেয়েছিলাম সেই নিরিখে আমি সন্তুষ্ট হইনি। তারপর কারাগারের নির্জনতায়”, নির্জন কক্ষে আমি আবার এর প্রার্থনা করেছিলাম এবং বলেছিলাম, “আমাকে আদেশ দিন। আমি জানি না কী করতে হবে বা কীভাবে করতে হবে। আমাকে একটি বার্তা দিন।

যোগের প্রথম আলাপচারিতায় দুটি বার্তা উঠে আসে। প্ৰথম বার্তায় বলা হয়েছে, “আমি তোমাকে একটা কাজ দিয়েছি এবং সেটি হচ্ছে এই জাতির উত্তোলনে সাহায্য করা। শীঘ্রই এমন সময় আসবে, যখন তোমাকে কারাগারের বাইরে যেতে হবে; তবে আমার ইচ্ছে এমন নয় যে এবার তুমি হয় দোষী সাব্যস্ত হও অথবা অন্যান্যরা যেভাবে দেশের জন্য কষ্ট সহ্য করে সময় অতিবাহিত করছে, তোমাকেও সেরূপ করতে হবে। আমি তোমাকে কাজের জন্য ডেকেছি এবং তুমি যে আদেশ চেয়েছিলে এটি তাই। আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি তুমি এগিয়ে যাও এবং আমার আদেশ সম্পন্ন কর। দ্বিতীয় বার্তায় বলা হয় এক বছর নির্জনতায় রেখে তোমাকে এমন কিছু দেখানো হয়েছে যা নিয়ে তোমার সন্দেহ ছিল এবং তা হল হিন্দু ধর্মের সত্যতা।  এই ধর্মটিকেই আমি জগতের সামনে তুলে ধরছি।  ঋষি, সাধু ও অবতারদের মধ্য দিয়ে এই ধর্মটিকে আমি নিখুঁতভাবে গড়ে তুলেছি এবং যাতে এঁরা আমার বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে এগিয়ে যেতে পারে। যেখানে বলা হচ্ছে যে একদিন ভারতের উত্থান হবে, তার অর্থ একদিন সনাতন ধর্মের উত্থান হবে। যখন বলা হয় যে ভারতবর্ষ একদিন শ্রেষ্ঠ হবে, তখন বোঝানো হয় যে সনাতন ধর্ম একদিন শ্রেষ্ঠ হবে। যখন বলা হয় যে ভারতবর্ষ নিজের বিস্তার স্বয়ং করবে, তখন আসলে বলা হয় যে সনাতন ধর্ম বিকাশলাভ করবে ও নিখিল বিশ্বে নিজেকে ব্যপ্ত করবে। ইহা কেবল ধর্মের জন্য এবং ধর্মের জন্যই ভারতবর্ষের অস্তিত্ব আছে…”

কিন্তু হিন্দু ধর্ম কি? কোন ধর্মকে আমরা সনাতন বা চিরকালীন বলব? এটি একমাত্র হিন্দুধর্ম কারণ, হিন্দু জাতি এই মর্যাদাকে ধরে রেখেছে, কারণ এই উপমহাদেশে এই ধর্ম সমুদ্র ও হিমালয়ের নির্জনতায় বৃদ্ধি পেয়েছে, কারণ বহুযুগ ধরে এই পবিত্র ও প্রাচীন ভূমি রক্ষার দায়ভার আর্যজাতির ওপর ন্যস্ত ছিল ।   কিন্তু এটি একটি দেশের সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না এবং এটি কখনই বিশেষভাবে চিরকালের জন্য পৃথিবীর একটিমাত্র সীমাবদ্ধ অংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল না।  সেই জন্যই বলা হয়, হিন্দু ধর্ম চিরকালীন ধর্ম, কারণ এটিই সর্বজনীন ধর্ম যা অন্যান্য ধর্মকেও সাদরে গ্রহণ করে। যদি কোনো ধর্ম সর্বজনীন না হয় তাহলে তা সনাতনও নয়। একটি সংকীর্ণ ধর্ম, একটি গোঁড়ামিপূর্ণ ধর্ম এবং একটি স্বতন্ত্র ধর্ম কেবলমাত্র সীমিত সময় ও সীমিত উদ্দেশ্যের জন্য টিকে থাকতে পারে।  এটিই একমাত্র ধর্ম যা বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও দর্শনচিন্তার মাধ্যমে বস্তুবাদকে পরাজিত করে জয়লাভ করতে পারে। এই একটিমাত্র ধর্মই মানবজাতির উপর ঈশ্বরের সঙ্গে মানুষের নৈকট্যের ছাপ রেখে যায় এবং মানুষের ঈশ্বরের কাছে পৌঁছানোর উপায়গুলিকে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে। এটিই একমাত্র ধর্ম যা সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তা অন্যান্য সকল ধর্ম স্বীকার করে যে তিনিই সর্বভূতে বিরাজমান এবং তাঁর মাধ্যমেই আমরা চলি এবং আমাদের জীবন কাটাই। এটিই একমাত্র ধর্ম যা কেবল আমাদের এই সত্যকে বুঝতেই সাহায্য করে, তা নয় বরং নিজের সমস্ত সত্তা দিয়ে একে বিশ্বাস ও অনুভব করতেও সাহায্য করে। এই একটিমাত্র ধর্মই বিশ্বকে স্বরূপ দর্শন করায় অর্থাৎ বাসুদেবের লীলার দর্শন। এই একমাত্র ধর্ম যা আমাদের পথপ্রদর্শন করে যে আমরা ধর্মের সূক্ষাতিসূক্ষ রীতিনীতি এবং এর পবিত্র নিয়মাবলী পালন করে কীভাবে ঈশ্বরের লীলাখেলার মধ্যে নিজেদের কর্তব্যটুকু পালন করতে পারি। এই ধর্ম কখনই জীবনকে ধর্মের কোনো সূক্ষ্ম বিষয় থেকেও আলাদা করেনা। এটি জানে অমরত্ব কী এবং আমাদের থেকে মৃত্যুর সত্যতাকে সম্পূর্ণভাবে দূরে সরিয়ে রাখে।

আমি বলেছিলাম [গতবছর] যে এই আন্দোলন রাজনৈতিক আন্দোলন নয় এবং সেই জাতীয়তাবাদ রাজনীতি নয় কিন্তু এটা একটা ধর্ম, ধর্মীয় মত এবং একটি বিশ্বাস।  আজ আবারও সেই একই কথা বলছি, কিন্তু অন্যভাবে। আমি আর বলিনা যে জাতীয়তাবাদ একটি ধর্মমত, একটি ধর্মএকটি বিশ্বাস; আমি বলি এটি হল সনাতন ধর্ম যা আমাদের জন্য জাতীয়তাবাদ……….সনাতন ধর্মই হল জাতীয়তাবাদ। এই বক্তব্যই আমার আপনাদের উদ্দেশ্যে বলবার ছিল।

৬ই নভেম্বর, ১৯০৯

মুসলিমরা বিচ্ছিন্নতাকে ভিত্তি করে প্রথমে ভারতীয় হিসেবে নিজেদের গণ্য করতে অস্বীকার করে এবং একই জন্ম ও রক্ত হওয়া সত্ত্বেও পরবর্তীকালে আমাদের তুলনায় মুসলিম রাষ্ট্রগুলির অস্তিত্বের সঙ্গে নিজেদের সাদৃশ্য খুঁজে পায়। হিন্দুদের সেই অর্থে কোনো উৎস নেই। ভালো হোক বা মন্দ, তারা কেবলমাত্র নিজ ভূমির প্রতি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তারা তাদের দেশমাতৃকাকে অস্বীকার করতে পারবে না, তাকে বিভক্ত করতেও পারবে না। অতএব ভারতের যে জাতীয়তাবাদ আমাদের আদর্শ, তা ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে  বৃহত্তর অর্থে হিন্দু, কারণ হিন্দুরাই এই ভূমি ও জনগণকে তৈরী করেছে এবং অতীতের মাহাত্ম্য দ্বারা স্থায়ীভাবে তার সভ্যতা , তার সংস্কৃতি ও তার অজেয় পৌরুষকে ধরে রেখেছে, কিন্তু আবার বিস্তীর্ণভাবে মুসলিমকেও স্থান দিয়েছে এবং তার সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেও হিন্দুরা ধারণ করেছে।   

অগাস্ট, ১৯১৮

যখন আমরা ভারতের অতীতের দিকে তাকাই, যা যা আমাদের আশ্চর্য করে দেয় তা হল তার অসীম প্রাণশক্তি, অদম্য জীবনীশক্তি ও জীবনের স্ফূর্তি, তার অকল্পনীয় উর্বর সৃজনশীলতা। অন্তত তিন হাজার বছর ধরে ——– যা আদতেই অনেকটা  সময় – দেশমাতা তাঁর অক্ষয় প্রতিভার দ্বারা সমৃদ্ধভাবে ও অবিরাম প্রচুর সৃষ্টি করে চলেছেন প্রজাতন্ত্র, রাজ্য, সাম্রাজ্য, দর্শন ও সৃষ্টিতত্ত্ব, বিজ্ঞান এবং ধর্মমত এবং শিল্প এবং কবিতা ও সর্বপ্রকারের স্থাপত্য, প্রাসাদ, মন্দির এবং মানবগোষ্ঠী, সমাজ ও ধর্মীয় নীতি, আচার, ভৌত বিজ্ঞান, আত্মিক বিজ্ঞান, যোগ পদ্ধতি, রাজনীতি ও প্রশাসনিক পদ্ধতি, আধ্যাত্মিক শিল্প, পার্থিব শিল্প, বাণিজ্য, চারুকলা এই তালিকা সীমাহীন এবং প্রত্যেকটি বিষয়ে কর্মকাণ্ডের আধিক্য বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়।   তিনি সৃষ্টি করেন কিন্তু সন্তুষ্ট হন না; তিনি সৃষ্টি করেন কিন্তু ক্লান্ত হন না; তাঁর সৃষ্টির  শেষ নেই, বিশ্রামের জায়গা নেই, নিষ্ক্রিয়তার ও শয়নের সময় অবধি নেই।  তাঁর সৃষ্টি অসীমে বিস্তৃত; তাঁর জাহাজ মহাসাগর পার করে এবং তাঁর প্রচুর সম্পদ জুডিয়া এবং ইজিপ্ট এবং রোম জুড়ে ছড়িয়ে পরে; তাঁর উপনিবেশ তাঁর শিল্প, মহাকাব্য, ধর্মমতকে সুদূর আর্চিপেলাগোতে ছড়িয়ে দেয়; মেসোপটেমিয়ার মরুভূমিতেও তাঁর চিহ্ন পাওয়া যায়, তাঁর ধর্মমত চীন ও জাপানকে অধিকার করে এবং সুদূর পশ্চিমে প্যালেস্টাইন ও আলেজান্দ্রিয়ায় ছড়িয়ে পরে, উপনিষদের চরিত্র ও বৌদ্ধদের বাণী খ্রিস্টের মুখে অনুরণিত হয়। তাঁর সমস্ত মৃত্তিকা ও তাঁর কর্ম এক অদ্ভুত জীবনীশক্তিতে পরিপূর্ণ।   

প্রকৃতপক্ষে, এই পর্যাপ্ত জীবনীশক্তি ও পর্যাপ্ত বোধশক্তি ছাড়া ভারত কোনোদিনই কিছু করতে পারত না, যেমনটা সে তার আধ্যাত্মিক প্রবৃত্তি দ্বারা করতে পেরেছে।  এটি অনুমান করা ভুল যে  আধ্যাত্মিকতা কেবল একটি অর্ধমৃত জীবনীশক্তি সম্বলিত, নিরুৎসাহিত প্রজ্ঞাযুক্ত ও আতঙ্কিত কোনো দরিদ্র দেশের মাটিতেই প্রসার লাভ করে। আধ্যাত্মিকতা যদি এভাবে উদ্ভূত হয়ে থাকে, তবে তা কিছুটা হলেও অস্বাস্থ্যকর, ক্ষতিকর এবং বিপজ্জনক প্রতিক্রিয়ার বহিঃপ্রকাশ। আসলে আধ্যাত্মিকতার বিকাশ তখনই হয়, যখন কোনো জাতি ধনঐশ্বর্যে পরিপূর্ণ হয় এবং গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করে আধ্যাত্মিকতার উৎকর্ষতা ও গভীরতা, স্থিরতা এবং বহুমুখী সার্থকতা খুঁজে পায়।

মে, ১৯১৯

[হিন্দুত্ব] একটি অঔদ্ধত্যপূর্ণ সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রথম স্থানে আছে এবং যদি তারা এই পদ্ধতিগুলি সহ্য করতে পারত, তাহলে হয়তো ইসলাম ও খ্রিস্ট ধর্মকেও নিজের অন্তর্ভুক্ত করে নিত।

অগাস্ট, ১৯১৯

হিন্দু ধর্মের নামে যে ধর্মীয় সংস্কৃতি বর্তমানে প্রচলিত – তার কিন্তু নিজস্ব কোনো নাম নেই কারণ সে নিজেকে কোনো সাম্প্রদায়িক গন্ডিতে আবদ্ধ রাখেনি; কোনো সর্বজনীন আনুগত্যের দাবি রাখেনি,   অভ্রান্ত মত হিসেবে জাহির করার চেষ্টা করেনি; নিস্তারলাভের উপায় হিসেবে কোনো সঙ্কীর্ণ পথের সৃষ্টি করেনি। এটি কোনো ধর্মমত বা ধর্মানুষ্ঠানের থেকেও অনেক বেশি করে একটি ক্রমবর্ধমান ঐতিহ্য যেখানে মানুষের সত্তা ঈশ্বর অভিমুখে বিলীন হওয়ার প্রচেষ্টা চালায়। এটি আত্মিক গঠন ও আত্মঅনুসন্ধানের প্রকাণ্ড ও বহুমুখী সুযোগ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে এবং এটি যে একমাত্র নাম যে জানত, অর্থাৎ সনাতনধর্ম, চিরকালীন ধর্ম তার সম্পর্কে নিজের বক্তব্য রাখার কিছু অধিকার তার ছিল।   

১৯শে অক্টোবর, ১৯৩৫

যদি বক্তব্যের অর্থ হিসেবে বলা হয় যে ধর্ম স্থায়ী এবং অপরিবর্তনীয়, তাহলে তা গ্ৰহণযোগ্য নয়।  কিন্তু যদি ধর্ম অর্থে ব্যক্তির সঙ্গে ঈশ্বরের সংযোগকে তুলে ধরা হয়, তবে এটি সত্য যে, যে কোনো কিছু যা অন্তরাত্মায় বিলীয়মান, তা ব্যক্তিগত, সামাজিক বা পার্থিব সুবিধার্থে বাড়ি বা ছদ্মবেশের মতো কখনই পরিবর্তন করা যায় না। যদি কোনো পরিবর্তন করতেই হয়, তবে তা কেবল আভ্যন্তরীণ আধ্যত্মিক কারণের জন্য হতে পারে, অন্তর থেকে কোনো উন্নতির আকাঙ্ক্ষায় হতে পারে। কোনো ব্যক্তি কোনো নির্দিষ্ট ধর্ম বা বিশেষ কোনো মত বা প্রথার প্রতি কেউ আবদ্ধ নয়, কিন্তু কেউ যদি বাহ্যিক কোনো কারণের জন্য তার পূর্বের স্বীকৃত ধর্মকে অন্য কোনো ধর্মের জন্য অস্বীকার করে নতুন ধর্ম গ্রহণ করে, তবে অন্তরের দিক থেকে তার আর কোনো ধর্মই রইল না এবং তার নতুন ধর্মটি কেবল একটি ফাঁপা সূত্র হয়েই থেকে যাবে। শেষের এই বক্তব্য আমাদের কোন পথে নিয়ে যাচ্ছে তা আমি বুঝতে পারছি।  সত্যের অন্যরকম উপস্থাপনভঙ্গিমা বা নিজের অন্তরের অনুভব প্রকাশের বাসনার যে মনোবাঞ্ছা, তা এই মহাত্মার অভিযোগ অনুসারে এইরূপ পরিবর্তনের সুপারিশ করার উদ্দেশ্য নয়; যে প্রতিবাদ করা হয়েছিল [ : আম্বেদকর কর্তৃক] তা হল যে – এটি অর্থ ও বিবাহের খাতিরে একটি রূপান্তর ছাড়া আর কিছুই নয় এবং এর ফলে যে সামাজিক প্রতিপত্তি ও গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে তা আর একটি আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্যে সীমাবদ্ধ নেই; যদি কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম না থাকে, ঘটাতে তাহলে সে যে কোনো উদ্দেশ্যেই তার পৈতৃক জীবিকার পরিবর্তন ঘটাতে পারে; যদি তার ধর্ম থাকে, তবে সে এ কাজ করতে পারবে না; সে কেবলমাত্র অন্তরাত্মার আভ্যন্তরীণ চাহিদা থাকলে তার পরিবর্তন করতে পারে।   যদি কৃষ্ণ রূপে কোনো ব্যক্তির ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি থাকে, তবে সে কখনোই বলবে না আমি সামাজিক শ্রদ্ধালাভের উদ্দেশ্যে কৃষ্ণের পরিবর্তে খ্রিস্টকে মান্য করব

১৯শে সেপ্টেম্বর, ১৯৩৬

ধর্ম চিরকালই খুঁতসম্পন্ন, কারণ এটি মানুষের আত্মা ও তার প্রচেষ্টার মেলবন্ধন যা তার নিম্নরুচিকে প্রভাব খাটিয়ে সংশোধনের চেষ্টা করে।   হিন্দুধর্ম আমার কাছে ক্যাথিড্রালমন্দিরের সমান, যার অর্ধেক ধ্বংসস্তূপ, জনগণের কাছে পবিত্র, প্রায়ই খুঁটিনাটিগত ভাবে অসাধারণ কিন্তু অবশ্যই তার একটি তাৎপর্য আছে কোনো স্থানে এটি ক্ষয়প্রাপ্ত বা জরাজীর্ণ হতে পারে, কিন্তু একটি ক্যাথেড্রালমন্দির, যেখানে এখনো অবধি অদৃশ্য শক্তির সেবা করা হয় এবং যারা সেখানে যায়, তারা যদি শুদ্ধচিত্তে প্রবেশ করে, তবে সেখানে তারা তাঁর উপস্থিতির প্রমাণ পায়। এই প্রস্তাবের উদ্দেশ্যে প্রণীত বাহ্যিক সামাজিক কাঠামোটি আবার একেবারে অন্য একটি বিষয়।  

মুসলিম সমস্যা প্রসঙ্গে

১৩ ই সেপ্টেম্বর, ১৯০৬

মুসলমান সভাপতি নির্বাচনের পরিকল্পনা যে কংগ্রেসবিরোধী মুসলমানদের সন্তুষ্ট করবে তা স্পষ্টত একটি ব্যর্থ ধারণা যা কালক্রমে অভিজ্ঞতার মাধ্যমে উন্মোচিত হয়েছে।   

১৯ শে জুন, ১৯০৯

মুসলমান প্রতিপক্ষকে আমরা ভয় পাই না; যতদূর পর্যন্ত এটি একটি স্বদেশী অনুচ্ছেদ এবং শিলং বা সিমলায় লিখিত নয়, এটিকে আমরা জীবন ও আকাঙ্ক্ষার নিদর্শনরূপে স্বাগত জানাই। আমরা একে এড়িয়ে যাব না, আমরা ভারতে ইসলামের জাগরণ চাই যদিও এর প্রথম অপরিপক্ব পরিকল্পনাগুলি আমাদের বিরুদ্ধেই পরিচালিত হবে; সমগ্র শক্তি, সমগ্র তেজ, সমগ্র কর্ম সম্মিলিত হয়ে তারা জাতির নির্মাতাকে পিষে ফেলতে তৈরী। আমরা সেই বিশ্বাস নিয়ে তৈরী যখন আমাদের রাজনৈতিক ময়দানে মিলিত হওয়ার সুযোগ আসবে, মুসলমানদের সঙ্গে মত বিনিময় হবে, তখন তার ইচ্ছেমতোই কাজ হবে – হয় আমরা দুই ভাইয়ের মতো সজোরে হাতে হাত মেলাব অথবা আমরা মল্লযোদ্ধার ন্যায় স্থিরচিত্তে করমর্দন করব

একটি বিষয় নিশ্চিত যে হিন্দুমুসলমান ঐক্যের উপর কংগ্রেসের চাটুকারিতা বা রাজনৈতিক বোঝাপড়া – কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না। এর অনুসন্ধান মন ও মস্তিষ্কের অনেক গভীরে গিয়ে করতে হবে কারণ যেখানে অনৈক্য থাকবে, সেখানে আমাদের অবশ্যই প্রতিকারেরও খোঁজ করতে হবে। আমাদেরই এটা মনে রেখে সুষ্ঠুভাবে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করতে হবে যে  ভুল বোঝাবুঝিই আমাদের বিভেদের জন্য সর্বাপেক্ষা বেশি দায়ী। আমাদের মনে রাখতে হবে যে ভালোবাসাই একমাত্র ভালোবাসতে বাধ্য করে এবং শক্তিই অপর শক্তিকে প্রশমিত করতে পারে। অধিকতর উৎকৃষ্ট জ্ঞান ও সহানুভূতির দ্বারা আমাদের এই ভুল বোঝাবুঝির কারণগুলিকে সম্পূর্ণ মুছে দেওয়ার জন্য আমাদের অবশ্যই লড়াই করতে হবে। আমাদের মুসলমান ভাইদের মধ্যে দেশভক্তির অকৃত্রিম ভালোবাসা ছড়িয়ে দিতে হবে; মনে রাখতে হবে তার মধ্যেও নারায়ণের বাস এবং আমাদের মা তাকে নিজ হৃদয়ে স্থান দিয়েছেন; কিন্তু আমাদেরও তাদের মিথ্যা প্রস্তাব দেওয়া বা কোনো ক্ষুদ্র স্বার্থের দুর্বলতা অথবা কাপুরুষতা থেকে তাদের চাটুকারিতা করা উচিত নয়। আমরা মনে করি এই বিপদের বিরুদ্ধে লড়াই করার এটিই একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হিন্দুমুসলিমদের সমস্যায় আমাদের একেবারেই কোনো আগ্রহ নেই, কিন্তু এটা যদি জাতীয় সমস্যার ব্যাপার হয়, তবে এর গুরুত্ব সর্বাধিক।

৪ ঠা সেপ্টেম্বর, ১৯০৯

দৃষ্টান্ত হিসাবে যে যে পদক্ষেপগুলি নিলে তা বেশ কিছু সংখ্যক মুসলমানদের অভিযোগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে, সেগুলিকে এখন নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে কারণ এগুলির জন্য শান্তি বিঘ্নিত হবার আশঙ্কা থেকে যায়। আর কেউ কেউ এখন সেই আশঙ্কাও করছেন যে এরকম চলতে থাকলে এই পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে কোনদিন জানি হিন্দু মন্দিরে পূজাপাঠ করাও নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।

২০ শে নভেম্বর, ১৯০৯

পূর্বে, ভারতে কেবলমাত্র দুটি শ্রেণী ছিল উৎকৃষ্ট ইউরোপীয়ান এবং নিকৃষ্ট ভারতীয়; কিন্তু বর্তমানে তিনটি শ্রেণী আছে উৎকৃষ্ট ইউরোপিয়ান, উৎকৃষ্ট মুসলমান এবং নিকৃষ্ট হিন্দু

১৮ই এপ্রিল, ১৯২৩

তাদের হিন্দুমুসলিম ঐক্যকে ছেলেখেলায় পরিণত করার জন্য আমি দুঃখিত। এই বিষয়টিকে একেবারেই উপেক্ষা করা যায় না। কোনোদিন হয়তো হিন্দুদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে লড়াইএ নামতে হবে এবং এর জন্য তাদের তৈরী থাকতে হবে। হিন্দু মুসলিম ঐক্যের অর্থ হিন্দুদের পরাধীনতা নয়। হিন্দুদের কমনীয়তা বারবার তাদের সেই পথ করে দিয়েছে। এর সবচেয়ে ভাল সমাধান হচ্ছে, হিন্দুদের নিজেদের ভালোভাবে প্রস্তুত হওয়ার অনুমতি দেওয়া এবং তারপর হিন্দুমুসলিম ঐক্য ঠিক নিজেই নিজের ব্যবস্থা করে নেবে। ইহা স্বয়ং সমস্যার সমাধান করে নেবে। অন্যথায়, আমরা একটি জটিল সমস্যার সমাধান করে ফেলেছি ভেবে মিথ্যা সান্ত্বনা নিয়ে থাকব – যেখানে আদতে আমরা সমস্যাটিকে স্রেফ এড়িয়ে গেছি।

২৩ শে জুলাই, ১৯২৩

যে ধর্মের নীতি সহিষ্ণুতা, তাদের সঙ্গে আপনি নির্বিবাদে থাকতে পারবেন। কিন্তু যে ধর্মের নীতি আমি তোমাকে সহ্য করব না” – তার সাথে কীভাবে শান্তিপূর্ণ ভাবে থাকা যায়? কীভাবে ওই মানুষজনদের সাথে ঐক্য বজায় রাখা যায় ? মুসলমানরা ক্রমাগত হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করে যাবে কিন্তু হিন্দুদের মুসলমানদের ধর্মান্তরিত করার কোনো অধিকার নেই – এইরকম পরিস্থিতিতে অনিবার্য কারণেই হিন্দুমুসলিম ঐক্য সম্ভব না। এভাবে আপনি ঐক্য প্রতিষ্ঠা করতে পারবেন না। হয়ত একটিমাত্র উপায়েই মুসলমানদের অহিংস করে তোলা যায় তা হল তাদের ধর্মপালন  থেকে বিরত করা। ১০ 

১২ ই সেপ্টেম্বর, ১৯২৩

মুসলমান বা ইসলামীয় সংস্কৃতি বিশ্বকে এমন কিছুই দেয়নি যার কোনো মৌলিক তাৎপর্য আছে বা কোনো নিজস্বতা আছে; ইসলামীয় সংস্কৃতি আসলে অন্যান্যদের থেকে ধার করা সংস্কৃতি। তাদের গণিত ও জ্যোতির্বিদ্যা এবং অন্যান্য বিষয় ভারত ও গ্রীস থেকে নেওয়া। এটা সত্যি যে তাঁরা কিছু ক্ষেত্রে এ জিনিসগুলিকে একটি নতুন মাত্রা দিয়েছেন, তবে তাঁরা খুব বেশি কিছু সৃষ্টি করেননি। তাদের দর্শন ও ধর্মও ভীষণ সহজ এবং তারা যাকে সুফিবাদ বলে সেটি আসলে পারস্যের আধ্যাত্মিকতার একটি বহিঃপ্রকাশ এবং যুক্তিগত দিক দিয়ে ভাবলে এই মতবাদটি প্রকৃতপক্ষে বেদান্তর বাণী দ্বারা অধিক মাত্রায় প্রভাবিত।

যাইহোক, আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি [ ভারতীয় সংস্কৃতির উৎস –তে] যে ইসলামীয় সংস্কৃতি ইন্দোসারসিনিক স্থাপত্য থেকে ভারতীয় সংস্কৃতিতে তার অবদান রেখেছে। আমার হয় না যে এটি ভারতের জন্য বা ভারতের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষতা বৃদ্ধির জন্য আর বিশেষ কিছু অবদান রেখেছে। এটি শিল্প ও কাব্যকলায় কিছু নতুন আঙ্গিকের জোগান দিয়েছিল। এর রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলি সর্বদা অর্ধবর্বর ছিল।

১৮ই মে, ১৯২৬

ভারতীয় রাজনীতিবিদদের দিকে লক্ষ্য কর: সমস্ত পরিকল্পনা, সমস্তটা – তাঁরা সকলে পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত। আমি জানি না কেন আমাদের রাজনীতিবিদরা গান্ধীজির খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন জানালেন” ১১। একজন সাধারণ মুসলমানের মানসিকতা থাকলে যে প্রতিক্রিয়া হওয়ার ছিল, তাই হয়েছে : আপনিই এই শক্তিকে ইন্ধন জুগিয়েছেন, , এটি শক্তি সঞ্চয় করেছে এবং কিছু দাবি দাওয়া রাখতে শুরু করেছে যাতে হিন্দুদের উঠে দাঁড়াতেই হয় এবং তীব্র প্রত্যাখ্যান জানাতে হয়।

এর জন্য কোনো বৌদ্ধিক চিন্তাধারার প্রয়োজন নেই বরং সাধারণ বোধশক্তির প্রয়োজন । তারপর, কলকাতায় মুসলমান ও হিন্দুদের প্রকৃত সত্য পরস্পরের মুখোমুখি হবে। ১২ নেতারা এই সমস্যাগুলির মুখোমুখি না হয়ে তাঁদের ভ্রান্ত পরিকল্পনা দিয়ে এগুলিকে এড়িয়ে যাচ্ছিলেন

২৯ শে জুন, ১৯২৬

এই সমস্ত বিবদমান উপাদানগুলির একত্রীকরণই যদি ভারতের ভবিতব্য হয় তবে মুসলিম সম্প্রদায়কে একত্রিত করাও কি সম্ভব?

কেন নয়? ভারত গ্রীস, পারস্য ও অন্যান্য দেশ থেকে বিভিন্ন উপাদানকে অঙ্গীভূত করেছে কিন্তু সে তখনই সেগুলিকে গ্রহণ করেছে তখনই যখন তাঁর কেন্দ্রীয় সত্যকে বিপক্ষ উপলব্ধি করতে পেরেছে এবং এই সমন্বয় সম্পন্ন হওয়ার সময় তারা এমনভাবে মিশে গেছে যে তাদের আর বিদেশী বলে চিহ্নিত করা যায় না, তাদের নিজের বলেই বোধ হয়। দৃষ্টান্ত হিসাবে আমরা গ্রীক স্থাপত্য, পারসিক চিত্রকলা থেকে নানান উপাদান গ্রহণ করেছি।

মানসিকভাবে অনেকাংশেই মুসলমানদের আত্মীকরণ সম্ভবপর হয়েছিল এবং হয়ত অদূর ভবিষ্যতে আরো হত। কিন্তু এই পদ্ধতিটির সম্পূর্ণ করার জন্য মুসলিমদের মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন ছিল। প্রকৃত অর্থে সমস্যাটা ছিল বাহ্যিক জীবনের – যতক্ষণ না পর্যন্ত মুসলিমরা সহনশীলতার পাঠ গ্রহণ করে, আমার মনে হয় না এরূপ আত্মীকরণ সম্ভব হবে।

হিন্দুরা পরধর্মসহিষ্ণুতার জন্য প্রস্তুত। তারা নতুন চিন্তাধারা গ্রহণ করতে রাজি এবং তাদের সংস্কৃতিতে সমন্বয়ের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এটা তখনই হবে, যখন ভারতের কেন্দ্রীয় সত্য পরিচিতি পাবে।

১ অগাস্ট, ১৯২৬

মুসলিমদের আশ্বস্ত করার প্রচেষ্টা একটা ভ্রান্ত কূটনীতি ছিল। হিন্দুমুসলিম ঐক্যসাধনের সরাসরি প্রচেষ্টার পরিবর্তে হিন্দুরা যদি নিজেদের জাতীয় কার্যের প্রতি নিজেদের নিবেদিত করত, তবে হয়ত মুসলমানরাও ধীরে ধীরে মাথা তুলে দাঁড়াত। মুসলিম সম্প্রদায় তবে ধীরে ধীরে স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবে। এভাবে ঐক্যস্থাপনের প্রচেষ্টার জন্য মুসলিমদের অতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়ে গেছে – এটাই সমস্ত সমস্যার মূল কারণ।

অজ্ঞাত দিনাঙ্ক (১৯৩৪)

হিন্দুমুসলিম সম্পর্কের জন্য ভারতের মহান অতীত গৌরব ও আধ্যাত্মিকতাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার কোনো মানেই হয় না। এভাবে মুসলিমদের সন্তুষ্ট করার প্রচেষ্টাটি ব্যর্থ, কারণ মুসলমানরা কোনোদিন এরকম কোনো নীতির মাধ্যমে সন্তুষ্ট হয়নি। স্বদেশী আন্দোলন কখনই হিন্দুমুসলিমের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করেনি, কিন্তু কংগ্রেস কর্তৃক সাম্প্রদায়িক নীতিগ্রহণ ( এখানেই তিলক সবচেয়ে বেশী ভুল করেছিলেন ), খিলাফত আন্দোলনের মাধ্যমে তাদের শান্ত করার চেষ্টাই তাদের ভুল পথে চালনা করেছিল। লখনৌতে তাদের সাম্প্রদায়িক নীতিগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর থেকেই তারা ভারতের একটি স্থায়ী রাজনৈতিক সত্তায় পরিণত হয়, যেটা কোনোদিন হবার ছিল না; খিলাফত আন্দোলন সেই পৃথক রাজনৈতিক সত্তাকে একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ পৃথক রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করে।

ভারতের জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে শ্রী অরবিন্দের দৃষ্টিভঙ্গি

৩০ শে ডিসেম্বর, ১৯৩৯

(একজন শিষ্য : ) কিছু লোক আছেন যাঁরা বন্দেমাতরম্কে জাতীয় সঙ্গীতরূপে মানতে আপত্তি করেছেন এবং কংগ্রেসের কিছুজন এই গানের কিছু অংশ বাতিল সমর্থন করছেন।

এই ক্ষেত্রে হিন্দুদের নিজস্ব সংস্কৃতি ত্যাগ করা উচিত।

বিতর্কের বিষয় হল যে গানটিতে হিন্দু দেবদেবীর উল্লেখ রয়েছে যেমন দেবী দুর্গা এবং এটি মুসলিমদের পক্ষে আপত্তিকর।

কিন্তু এটা কোন ধর্মীয় সংগীত নয়, এটি জাতীয় সংগীত এবং দুর্গাকে ভারতের মাতা জ্ঞান করা হয়। মুসলিমরা কেন এটা মেনে নিতে পারছে না? এটা সামান্য একটা প্রতীকী যা কবিতাতেও ব্যবহৃত হয়। ভারতের জাতীয়বাদী ধারণায় স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দুদের দৃষ্টিভঙ্গি থাকবে। যদি তা এখানে স্থান না পায় তবে হিন্দুদেরও তাদের সংস্কৃতি ত্যাগ করা উচিত। হিন্দুরা তো আল্লাহ হোআকবর‘ –এর বিরোধিতা করেনি।

হিন্দুরা কেন তাদের নিজের দেবতার আরাধনা করবে না? অন্যথায়, হিন্দুরা হয় মুসলিম সংস্কৃতিকে মেনে নেবে অথবা ইউরোপীয়ান সংস্কৃতিকে নতুবা তারা নাস্তিকে পরিণত হবে …..

আমি সি.আর.দাস [১৯২২] কে বলেছিলাম যে হিন্দু মুসলিম সম্পর্কিত সকল সমস্যার ইংরেজদের দেশত্যাগের আগেই সমাধান করে ফেলতে হবে, না তো গৃহযুদ্ধের আশঙ্কা থেকে যাবে। তিনি এ ব্যাপারে সমর্থন করেছিলেন এবং এর সমাধান করতেও চেয়েছিলেন ….

প্রয়োজনীয় কাজের পরিবর্তে কংগ্রেস জিন্নার সাথে সমঝোতার ভান করতে চেষ্টা করছিল এবং জিন্নাহ স্বভাবতই ভেবেছিলেন তিনি তাঁর উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল থাকবেন। তাঁরা যত বেশি চেষ্টা করবেন, জিন্না ততই একরোখা হয়ে উঠবেন।

২৮ শে মে, ১৯৪০

গান্ধীজি একজন সংবাদদাতার প্রশ্নের উত্তরে কী বলেছিলেন, তা কি আপনি পড়েছেন? তিনি বলেছেন যে আট কোটি মুসলিম একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের দাবি করে, তবে পঁচিশ কোটি হিন্দুর আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কী বা উপায় থাকতে পারে ? অন্যথায় গৃহযুদ্ধ শুরু হবে।

(একজন শিষ্য ) আমি আশা করি তিনি এরকম সমঝোতার কথা ভাবছেন না।

তিনি ভাবছেন না, আপনি বলছেন? আসলে তিনি এটাই বলছেন এবং নিজে স্বীকারও করেছেন। আপনি যদি আগেই অপরপক্ষের কাছে বশ্যতা স্বীকার করে নেন, স্বাভাবিক ভাবেই তারা তাদের দাবিতে কঠোরভাবে অনড় হয়ে থাকবে। অর্থাৎ, সংখ্যালঘুরা শাসন করবে এবং সংখ্যাগুরুরা বশ্যতা স্বীকার করে নেবে। সংখ্যালঘুরা আমরা হলাম শাসক আর তোমরা আমাদের দাস। আমাদের কথাই আইন এবং তোমাদের সেটা মেনে চলতে হবে। ” – বলার অধিকার পাবে। এটা একটা অদ্ভূত মানসিকতার প্রকাশ। আমার মনে হয় এই ধরণের মানুষদের সামান্য মস্তিষ্ক বিকৃতি আছে।

২১ শে জুন, ১৯৪০

কাশ্মীরে সর্বত্র হিন্দুদের একাধিপত্য রয়েছে। এখন যদি মুসলিমদের দাবি মেনে নেওয়া হয়, তবে হিন্দুদের সমস্ত অস্তিত্ব ঘুচে যাবে।

৭ ই অক্টোবর, ১৯৪০

(একজন শিষ্য 🙂 ব্রিটিশদের বিভাজনমূলক শাসননীতির কারণে আমরা কখনই একত্রিত হতে পারিনি।

অর্থহীন কথা! ব্রিটিশ শাসনের আগে কি ভারতের একতা ছিল?

কিন্তু এখন আমাদের জাতীয় চেতনা যত গড়ে উঠেছে, ততই ঐক্যের সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পেয়েছে, তবে যদি ব্রিটিশরা জিন্না ও তার মুসলিম সম্প্রদায়ের দাবিগুলিকে প্রশয় না দেয় একমাত্র তবে।

জিন্না কি একতা চান? তিনি যেটা চান তা হল মুসলিমদের স্বাতন্ত্র্য এবং সম্ভব হলে ভারতের ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করা। এটাই তাঁর পুরানো জেদ….কিন্তু এটা কেন আশা করা হচ্ছে যে মুসলিমদের সাথে সমঝোতা করা সম্ভ? সর্বত্র সংখ্যালঘুরা তাদের অধিকারের দাবি জানাচ্ছে। অবশ্যই, কিছু মুসলমান আছেন যারা একেবারে অন্যরকম, অত্যন্ত স্বদেশভক্ত, যদিও স্বাধীনতার নিজস্ব শর্ত আছে। সে প্রথমে শুধুমাত্র ভারতীয় ঐক্যকেই দেখে, পরে শর্তগুলির মীমাংসা করে।

১৯ শে অক্টোবর, ১৯৪৬

(একটি চিঠিতে এক শিষ্য বিশেষত অধুনা বাংলাদেশের নোয়াখালি ও টিপ্পেরায় হিন্দুদের উপর মুসলমানদের অকথ্য অত্যাচারের কথা, তিনি যন্ত্রণার সহিত বর্ণনা করেছেন – এই শৃঙ্খলাবদ্ধ অত্যাচার জিন্নার “ সরাসরি নীতি”পরিকল্পনার একটি অংশ ছিল, যাকে ব্রিটিশ সরকার একেবারেই রোধ করার চেষ্টা করেননি। এটি হিন্দু ও মুসলমানদের একত্রে বাস করা যে অসম্ভব, তা ব্যক্ত করার জন্য করা হয়েছিল, যার অন্তিম পরিণতি হয় – পাকিস্তান। )

বাংলার প্রসঙ্গে বলতে গেলে, এখানে যা ঘটছে তা অত্যন্ত খারাপ। হিন্দুদের অবস্থা সেখানে ভয়ংকর। দিল্লিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার থাকলেও বিষয়টি খারাপের দিকে এগোচ্ছে। তবে যেটা ঘটছে সেটা আমার কাছে আশ্চর্যজনক নয়। আমি এটা পূর্বেই বুঝেছিলাম যখন আমি বাংলায় ছিলাম এবং সেখানের জনগণকে সতর্ক করেছিলাম যে এরকম একটা পরিস্থিতি আসতে পারে এবং তাদের এই পরিস্থিতির জন্য তৈরি থাকা উচিত। সেইসময় এ কথায় কেউ গুরুত্ব দেয়নি, যদিও পরে কিছুজন মনে রেখে সম্মত হয়েছে। যখন প্রথম বিপদের শুরু হয়েছিল তখন আমি হয় ঠিকই বলেছিলাম; একমাত্র সি.আর.দাস উপলব্ধি করেছিলেন এবং এমনকি তিনি যখন পণ্ডিচেরীতে এসেছিলেন, আমায় বলেওছিলেন যে তিনি একেবারেই চাইছিলেন না যে এই ভয়ংকর সমস্যার সমাধান যতক্ষণ না হয়, তার আগে ব্রিটিশরা ভারত থেকে চলে যাক। কিন্তু যা ঘটছে তার মধ্যেও আমি একবারও মনোবল হারিয়ে ফেলিনি কারণ আমি জানি এবং শতাধিকবার উপলব্ধি করেছি যে এই ঘোরতর অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের মধ্যেই একজন রয়েছেন যিনি স্বয়ং একজন দিব্যাস্ত্র – তিনি আমাদের জয়ের আলোকবর্তিকা হাতে নিয়ে পথ দেখান। এর আগে বিশ্বে কোনো কিছু ঘটবার জন্য আমার এত দৃঢ় ও অবিচল ইচ্ছাশক্তি আর কখনও ছিল না আমি নিজের ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে বলছি না এর পরিণতি এত সহজে ঘটবে না। দীর্ঘ সময়, পরাজয় ও বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে এটি আসবে। একটা সময় ছিল যখন হিটলার সারা বিশ্বে অপরাজেয় ছিলেন এবং হঠাৎই মনে হয়েছিল যেন একটা মহিষাসুর সমগ্র পৃথিবীর ওপর জেঁকে বসেছে। কিন্তু আজ কোথায় সেই হিটলার? আর কোথায় তাঁর শাসন ? মানব জাতির ইতিহাসে বার্লিন এবং নুরেমবার্গ সেই ধ্বংসাত্মক অধ্যায়ের বহন করে। অন্যান্য অন্ধকার যা আমাদের ছেয়ে ফেলার হুমকি দেয় এমনকি তা মানবজাতিকেও গ্রাস করে ফেলে কিন্তু যেদিন দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটবে, সেগুলিও শেষ হয়ে যাবে।

১৫ই অগাস্ট, ১৯৪৭

ভারত স্বাধীন হয়েছে কিন্তু একতা অর্জন করতে পারেনি। শুধুমাত্র একটা ফাটল ধরা চূর্ণবিচূর্ণ স্বাধীনতা সে পেয়েছে। হিন্দুমুসলিমের পুরাতন সাম্প্রদায়িক বিভাজন আরো দৃঢ়ভাবে দেশের একটি স্থায়ী রাজনৈতিক বিভাজনে পরিণত হয়েছে। এটা আশা করা যায় যে, কংগ্রেস এবং জাতি এই নির্ধারিত সত্যটিকে চিরকালীন সত্য হিসাবে কোনোদিন স্বীকার করবে না। তাঁরা এটিকে একটি অস্থায়ী কৌশলের চেয়ে বেশি কিছু মনে করেন না। যদি এটি টিকে যায়, তবে ভারত হয়ত গুরুতর ভাবে দুর্বল হয়ে পড়বে এমনকি পঙ্গুও হয়ে যেতে পারে: নাগরিকদের মধ্যে সদাসর্বদা কলহ লেগে থাকার সম্ভাবনা থেকে যায়, এমনকি নতুন করে আক্রমণ বা বিদেশীদের আধিপত্য বিস্তারও অসম্ভব কিছু নয়। দেশ বিভাজন হওয়া আবশ্যক রাষ্ট্র সমূহের মধ্যে উত্তেজনা শিথিল করার জন্য প্রয়োজন, শান্তি ও ঐক্যের খাতিরে  উন্নয়নশীল পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য, যৌথ সম্মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারা ক্রমাগত চাহিদা মেটানোর জন্য এবং এমনকি এই উদ্দেশ্যে ঐক্যসাধনের মাধ্যম হিসাবেও দেশ ভাগ অপরিহার্য। এই পথেই যে কোনো রূপে ঐক্য আসবেই এই যথার্থ রূপের রাষ্ট্রীয় প্রয়োগ থাকলেও কোনো মৌলিক তাৎপর্য নেই। কিন্তু যাই হয়ে যাক, এই বিভাজন চলছে এবং একে চলতেই হবে। কারণ এটা না হলে ভারতের জনঘনত্বে খুবই বৈষম্য দেখা যাবে যা এক কথায় খুবই দুশ্চিন্তার বিষয় ! এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ১৫

১৯৪৭ (?)

 ভারতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ধারণা হল জিন্নার স্বার্থসিদ্ধির জন্য এবং প্রকৃত সত্যকে ধামাচাপা দেবার জন্য নবনির্মিত একটি মত। ৯০% এর বেশি ভারতীয় মুসলিম ধর্মান্তরিত হিন্দুদের উত্তরসূরী এবং তারা হিন্দুদের মতই ভারতবর্ষের অধিবাসী। ধর্মান্তরীকরণের এই প্রক্রিয়া সর্বত্রই চলছিল; জিন্না নিজে একজন হিন্দুর বংশধর যিনি সাম্প্রতিক কালে ধর্মান্তরিত হন জিন্নাভাই নামে এবং এরূপ অনেক খ্যাতিমান মুসলমান নেতারই জাতিগত উৎস এই একই।

ভারতের ভবিষ্যত প্রসঙ্গে

১৩ ই জুলাই, ১৯১১

এই মান্ধাতা আমলের রাজনীতিকে এড়িয়ে চলতে হলে অতি যত্ন সহকারে আমার নির্দেশ পালন করুন। আধ্যাত্মিকতাই হল ভারতের একমাত্র রাজনীতি, সনাতন ধর্মের পরিপূর্ণতাই হল স্বরাজ। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক ধারণা যেভাবে এখানে বলবৎ হয়েছে, তার থেকে নিস্তার পেতে গেলে আমি নিশ্চিত যে আমাদের সাংসদীয় পদ্ধতির মধ্য দিয়ে যেয়ে হবে। ভারত জাতীয় যোগের প্রাথমিক স্তরের মধ্যে রয়েছে। এটি ১৯০৫ সালের দৈবশক্তির সুতীব্র বেগে প্রবেশের ধারণা দ্বারা অধিগত হয়েছে এবং সম্পূর্ণ তামসিক আজনানাম অথবা সম্পূর্ণ অজ্ঞতার স্তর থেকে ধীরে ধীরে এইরূপ ধারণ করেছে। কিন্তু, সাধারণতঃ ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে সমস্ত অশুভ শক্তি, ভুল প্রভাব, অন্যায় আবেগ এবং অন্যায় মানসিক ও নৈতিক অভ্যাস প্রভৃতিও এর সাথে সাথে বেড়ে ওঠে এবং দৈব ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটায়। তাই এ সমস্ত রাজনৈতিক বর্বরতা, গণতান্ত্রিক উদ্দীপনা, সভাসমিতি, মিছিল, পরোক্ষ প্রতিরোধ এবং সবশেষে বোমা, রিভলবার ও জবরদস্তিমূলক আইনঈশ্বর এ সব কিছুকে ভেঙে চুরে ধ্বংস করে দিয়েছেন। মধ্যপন্থা ইংরেজ উদারনীতিবাদের জারজ সন্তান ! জাতীয়তাবাদ ইউরোপ ও এশিয়ার যৌথ সন্তান; সন্ত্রাসবাদ বাকুনিন ও মাজ্জিনির ব্যর্থ সন্তান এটি তখনই সম্ভব যখন কোনো উপায়ে ভারতের সাত্ত্বিক ভাবমূর্তি ও একটি অত্যন্ত শক্তিশালী আধ্যাত্মিক আন্দোলন একত্রে কার্যকরী হয়ে ভারতের নবজাগরণের সূচনা করবে – তখনই এসব বোকামির অবসান ঘটবে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, আমরা প্রচুর বিপত্তি ও গোলযোগের সম্মুখীন হতে পারি, কিন্তু আমরা সঠিক পথে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ার একটা সুযোগ পেয়েছি। আমি সর্বতোভাবে বিশ্বাস করি, ভগবান আমাদের এর জন্য সঠিক পথপ্রদর্শন করবেন, প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা দেবেন এবং প্রয়োজনীয় পরিস্থিতির জন্য আমাদের প্রস্তুত করে তুলবেন।

ডিসেম্বর ১৯১৮

রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পাশ্চাত্যকরণ ও তার পরবর্তীতে একইরকম সামাজিক পরিবর্তন আমাদের সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক মৃত্যু ডেকে আনে…হয় ভারতবর্ষ সমস্ত স্বীকৃতি নিয়ে যুক্তিবাদী ও শিল্পসমৃদ্ধ হবে আর নয় তো ভারত আর বেশীদিন আর ভারত হয়ে থাকবে না। আর না তো ভারতবর্ষ পাশ্চাত্যের নতুন প্রবণতাগুলিকে আমাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে সংযুক্ত করে বিশ্বের নবযুগের পথপ্রদর্শক হবে এবং মানবজাতিকে আধ্যাত্মিকতার মার্গ দর্শন করাবে। এই বিষয়ে এটিই একটি প্রাথমিক ও শাণিত প্রশ্ন। ভারতবর্ষ যে আধ্যাত্মিক আন্দোলন জগতের সম্মুখে উপস্থাপন করে, তা কি কোনোদিন ইউরোপে প্রভাব বিস্তার করতে পারবে ? ভারত কি পশ্চিমপ্রদেশে সমমনস্ক নতুন সাংস্কৃতিক আঙ্গিক তৈরি করতে পারবে? না কি ইউরোপীয়ান যুক্তিবাদ ও বাণিজ্যিকীকরণ ভারতীয় ঘরানার সংস্কৃতিকে একেবারে নিঃশেষিত করে দেবে?

এপ্রিল, ১৯২০

আমি বিশ্বাস করি ভারতের দুর্বলতার মূল কারণ পরাধীনতা নয়, দারিদ্র্য নয়, আধ্যাত্মিকতা বা ধর্মের অভাব ও নয়, কিন্তু আসল কারণ হল চিন্তাশক্তির অভাব ও জ্ঞানের বিস্তারের ক্ষেত্রে অবহেলা। সর্বত্রই আমি দেখি মানুষ চিন্তা করতে অক্ষম বা তার প্রচণ্ড অনিচ্ছা – একে চিন্তাশক্তির অসামর্থ্য অথবা চিন্তাভীতি বলে। মধ্যযুগে যাই ঘটে থাকুক, এখনও এই ধারণা থাকা চরম অবক্ষয়ের নিদর্শন। মধ্যযুগ হল অন্ধকারাচ্ছন্ন যুগ। জ্ঞানবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে আধুনিক যুগ হল বিজয়ের যুগ। একমাত্র যিনি সমগ্র বিশ্বের সত্যকে জানবার জন্য গভীরভাবে আরো চিন্তা করবেন, আরো অনুসন্ধান করবেন, আরো পরিশ্রম করবেন – কেবল তিনিই অধিক শক্তি অর্জন করতে পারবেন। ইউরোপকে পর্যবেক্ষণ করলে আপনি দুটি বিষয়ে দেখতে পাবেন একটি হল, অনন্তে বিস্তৃত সুগভীর চিন্তাসমুদ্র আর একটি প্রকাণ্ড এবং অতিদ্রুত অথচ শৃঙ্খলাবদ্ধ শক্তি। ইউরোপের সমগ্র শক্তি এখানেই কেন্দ্রীভূত রয়েছে। এই শক্তির জোরেই তারা সমগ্র পৃথিবীকে গ্রাস করেছে, ঠিক যেমন আমাদের অতীতের তপস্বীরা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের দেবতাদেরও বিস্ময়ে, উৎকণ্ঠায় এমনকি আটক করেও রাখতে পারতেন…

৮ই অগাস্ট, ১৯২৬

গ্রীকরা, খ্রিস্টানরা অর্থাৎ যাঁরা তাদের ধর্মান্তরিত করেছিল, তাদের থেকে অনেকাংশে বেশি জ্ঞানপ্রাপ্ত ছিল; সেই সময় গ্রীসে অধ্যাত্ম্য রহস্যবাদ ছিল, আর তারা যেটা গড়ে তুলল সেটা ছিল অজ্ঞানতাবাদ এবং সেটাই পরবর্তীকালে চলতে থাকল। খ্রীস্টানরা জ্ঞানালোকের পরিবর্তে অজ্ঞানতার অন্ধকার এনেছিল।

এটি সদাসর্বদাই একটি আক্রমণাত্মক ধর্ম – তারা বিশ্বকে পদদলিত করতে চায়। যেখানে অপরপক্ষে হিন্দুরা অত্যন্ত নিষ্ক্রিয় – আর সমস্যাটা ঠিক সেখানেই

১৬ই সেপ্টেম্বর, ১৯৩৫

(একজন শিষ্য ) এটা শুনে আমার আরোই মনোবল ভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে যে কিছু মুসলিম, বাংলার হিন্দু পরিবারের ওপর এত নৃশংস আচরণ করেছে ! স্বাধীনতা আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি আশা করছি যে এসব কিছুও বন্ধ হয়ে যাবে… আপনার পরিকল্পনা অনুযায়ী কি মনে হয়, আপনি কি স্পষ্ট চোখে স্বাধীন ভারতকে দেখতে পাচ্ছেন …?

এ সমস্ত স্থির হয়ে আছে। এখন শুধু এটা কার্যকর হওয়ার অপেক্ষা। এখন জিজ্ঞাস্য হল ভারত তার স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কি করতে চলেছে? পূর্বোক্ত ঘটনার পুনরাবৃত্তি? বলশেভিকতাবাদ? গুন্ডারাজ? ব্যাপারটা ভীষণ আশঙ্কাজনক।

ডিসেম্বর, ১৯৪৮

হিমালয় ও সমুদ্রের ভিন্ন অস্তিত্ব দ্বারা আবদ্ধ এই ভারতবর্ষ এমন সব আশ্চর্য মানুষের বাসস্থান, যারা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যের জন্য অন্যদের থেকে স্বতন্ত্রভাবে পরিচিত যাদের নিজস্ব সভ্যতা রয়েছে, নিজস্ব জীবনধারণ পদ্ধতি আছে, অন্য ধারার আধ্যাত্মিকতা রয়েছে, একটি পৃথক সংস্কৃতি এবং শিল্প ও সমাজ নির্মাণ পদ্ধতি রয়েছে। এর মধ্যে যারা যারা অনুপ্রবেশ করেছে, তার সমস্ত কিছু ভারত প্রাণভরে গ্রহণ করেছে, তার উপরে ভারতীয় শিলমোহর যুক্ত করেছে, সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ উপাদানগুলিকে এক সুতোয় বেঁধেছে। এটি কিন্তু প্রচুর বৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষ, ভূমি, রাজত্ব এবং আরো আগে বিভিন্ন রাজ্য, বিচিত্র জাতি, উপজাতির ক্ষেত্রেও তাদের নিজস্বতার ছাপ, তাদের স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যে লক্ষ করা যায় তারা বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ শ্রেণী, সভ্যতা, সংস্কৃতি, অনেক স্থাপত্য ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে যার মধ্যে অনেকগুলি এখনো পর্যন্ত ভারতের সাধারণ সভ্যতা ও সংস্কৃতির সাথে অভিযোজিত হয়ে নিজেদের স্থায়ী স্থান দখল করেছে। সমগ্র ভারতের ইতিহাস তার প্রবণতা এবং নিত্যপ্রচেষ্টার দ্বারা প্রতিনিয়ত এই বিচিত্র উপাদানগুলিকে একত্রিত করে কেন্দ্রীয় শাসনাধীন একক রাজনীতির অধীনে আনার চেষ্টা করেছে যাতে ভারত রাজনৈতিকভাবে এবং সাংস্কৃতিকভাবে এক হতে পারে। মুসলমান জাতি তার ভিন্ন ধর্ম ও সামাজিক কাঠামো নিয়ে আকস্মিকভাবে আক্রমণ করে ফাটল সৃষ্টি করার পরেও ভারতে ক্রমাগতভাবে জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে তাদের সংস্কৃতির মিশ্রণ ঘটিয়ে তাদের রাজনৈতিকভাবে সংঘবদ্ধ করার চেষ্টা চলেছে যাতে তাদের পারস্পরিক প্রভাবেরও মিলন ঘটানো যায়; এমনকি কিছু খুব সাহসী পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে যাতে এই দুটি আপাত শত্রুমনোভাবাপন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি সাধারণ ধর্ম আবিষ্কার করা যায় বা উদ্ভাবন করা যা। বলা বাহুল্য, এখানেও পারস্পরিক প্রভাব ছিল

এই সময়ে, স্বাধীনতার দ্বিতীয় বছরে আমাদের দেশকে বিবেচনাধীন জটিল সমস্যার সমাধানের জন্য, সুবিশাল সম্ভাবনার সদ্ব্যব্যবহারের জন্য জাগ্রত হতে হবে কারণ এখানে বিপদ ও জটিলতাও থাকতে পারে যদি বুদ্ধিমত্তার সাথে এটির মোকাবিলা করা না যায়, তবে কালক্রমে এটি ভয়ংকর হতে পারে … ভারতের জন্য আরো অনেক গভীর সমস্যা রয়েছে – কিছু প্রলুব্ধকারী নির্দেশ মান্য করে ভারত অন্যান্য দেশের মত সমৃদ্ধশালী শিল্প বাণিজ্যক্ষেত্র, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে একতি ক্ষমতাশালী সাংগাঠনিক ক্ষেত্র, বিপুল সামরিক শক্তি, উচ্চ সাফল্যের সহিত রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শনের অনুশীলন, অত্যন্ত সন্তর্পণে তার সম্পদ ও তার স্বার্থকে রক্ষা করতে এবং বিস্তৃত করতে পারে এবং এমনকি পৃথিবীর সিংহভাগ অংশকে সে পদানতও করতে পারে – কিন্তু এসব আপাত তুখোড় অগ্রগতির আড়ালে হয়ত ভারত নিজের স্বধর্মকে স্বচ্ছায় ত্যাগ করে ফেলছে। তৎকালীন ঐতিহ্যবাহী অতীতের ভারত এবং তার অন্তরাত্মা একত্রে অন্তর্হিত হয়ে যেতে পারে এবং তার ফলে আমরা অন্যান্য দেশের মতই শুধুমাত্র সাধারণ একটা দেশ হয়ে থেকে যাব। এর ফলে না তো বিশ্বের কিছু প্রাপ্তি ঘটবে আর না তো আমাদের। এখানেই একটা প্রশ্ন আসে যে ভারত কি তার অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও দৃঢ় আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানকে হারিয়েও বাহ্যিকভাবে উন্নতি লাভ করতে পারে ? সমগ্র বিশ্বের অন্যান্য মানুষ যখন ভারতের কাছে আধ্যাত্মিক সাহায্য প্রার্থনা করছে এবং একটু জ্ঞানের আলো চাইছে, এমত পরিস্থিতিতে যদি ভারতকে তার আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য ত্যাগ করতে হয়, তবে ভারতের ক্ষেত্রে এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক প্রতিপন্ন হবে। এটা কোনোভাবেই হওয়া উচিত নয় এবং নিশ্চয়ই এমনটা ঘটবেও না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায় না যে বিপদ একেবারেই নেই। আরো অসংখ্য জটিলতর সমস্যা এদেশের এখনই আছে অথবা অদূর ভবিষ্যতে সে তার মুখোমুখি হতে চলেছে। এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে এক্ষেত্রেও আমরা বিজয়ী হব। কিন্তু আমরা আমাদের নিজেদের কাছে কখনই সত্য গোপন করব না যে এই দীর্ঘ সময়ের পরাধীনতা এবং তার রুদ্ধ প্রকৃতির ক্ষতিকর প্রভাব আমাদের অন্তরের ও বাহ্যিক স্বাধীনতার ওপর সমান ভাবে পড়েছে এবং আমাদের পরিবর্তিত করেছে। যদি আমরা ভারতকে সত্যকারের নিয়তি প্রদান করতে চাই তাহলে ব্যাপক আত্মিক ও বাহ্যিক উৎকর্ষসাধন প্রয়োজন।

গ্রন্থ সম্পর্কিত প্রকাশকের বক্তব্য

শ্রী আভাস চট্টোপাধ্যায় প্রারম্ভেই কিছু ব্যাপক ভ্রান্ত ধারণাকে স্পষ্ট করে দিতে চেয়েছিলেন, যেমন – ‘হিন্দুশব্দটি একটা ভৌগোলিক ধারণা, আমাদের জাতিগত পরিচয় ‘ ভারতীয়’, যেসব মানুষ বিদেশী ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছে, তাদের ক্ষতিকর মতাদর্শ হলেও তারা জাতীয় নাগরিক‘, ভারতের সংস্কৃতি মিশ্র সংস্কৃতি ‘, এবং আমরা হলাম একটি ‘ উন্নয়নশীল দেশ’।

এরপর তিনি জাতির সংজ্ঞা নির্ধারণ প্রসঙ্গে সমস্ত উপলব্ধ বিষয়গুলিকে বিবেচনাধীন করেছেন, যেমন ভূগোল, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য এবং নিমোক্ত দৃঢ় সিদ্ধান্তগুলিতে এসে পৌঁছেছেন :

  • আমরা হিন্দুরা একটা জাতি, কোন ধর্মীয় সংগঠন নই। আমাদের জাতীয় পরিচয় হল হিন্দু, ভারতীয় নয়।

  • আমাদের জাতীয়তাবোধের স্বাতন্ত্র্যসূচক বৈশিষ্ট্য হল সনাতন ধর্ম। বিদেশী ও শত্রুভাবাপন্ন মতাদর্শ যেমন ইসলাম, খ্রিস্টান এবং নেহরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতা প্রভৃতি কোনোটাই আমাদের ঐতিহ্যের অংশ নয়।

  • অবিভক্ত ভারত আমাদের পৈতৃক বাসভূমি। আমরা ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বিভাজন মেনে নিতে পারি না। যত সময়সাপেক্ষই হোক না কেন, আমাদের লক্ষ্য হল পৈতৃক জন্মভূমিকে পুনরায় সম্পূর্ণ একত্রিত করা।

  • হিন্দু সংস্কৃতি হল আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি, হিন্দু সমাজ আমাদের জাতীয় সমাজ, হিন্দু সাহিত্য আমাদের জাতীয় সাহিত্য এবং হিন্দু শিল্পকলাই আমাদের জাতীয় শিল্পকলা।

  • হিন্দুদের ইতিহাস হল আমাদের জাতীয় ইতিহাস। আমরা কোনো মুসলিম বা ব্রিটিশ যুগকে স্বীকার করি না। এই যুগগুলি ছিল মুসলিম আক্রমণকারী এবং ব্রিটিশ ঔপনিবেশকতাবাদীদের বিরুদ্ধে আমাদেরজাতীয় সংগ্রামের ইতিহাস। এই সংগ্রাম এখনো চলছে।

  • যেসব জনগণ ভিনদেশীয় ও শত্রুভাবাপন্ন মতাদর্শ গ্রহণ করেছে, তারা ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, হিন্দুদের মতো জাতীয় নাগরিক নয়। আমাদের লক্ষ্যই হল যে মতবাদ আমাদের নিজেদের মানুষদের আমাদের থেকে আলাদা করে দিয়েছে, তার বিলোপ সাধন করে সংখ্যালঘু জাতিকে আবার জাতীয়তাবাদের মূলস্রোতে ফিরিয়ে আনা।

  • আমাদের জাতীয় ভাষা হল সংস্কৃত এবং তার সমগোত্রীয় ভাষা ও তার নানা শাখাপ্রশাখাগুলি।

  • আমরা হিন্দুরা এখনও নেহরুবাদী ধর্মনিরপেক্ষতার দ্বারা পরাধীন এক জাতি, ক্রীতদাস এবং বৈষম্যের শিকার। আমরা আমাদের এই মাতৃভূমিকে বৈদেশিক দমননীতির হাত থেকে স্বাধীন করব, আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে এবং আমাদের নিজস্ব জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বর্তমানে হিন্দুদের যেটা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন তা হল একটি বৌদ্ধিক এবং সাংস্কৃতিক জাগরণ। শুধুমাত্র নিজেদের নয়, উপরন্তু হিন্দুদের যে সকল বৈদেশিক মতাদর্শ এত সহস্র শতাব্দী ধরে নির্যাতন করে এসেছে, তাদেরও হিন্দুদের স্বচক্ষে দেখতে হবে।

(সমাপ্ত)

পাদটীকা

 

১। এই সংক্ষিপ্তসারটি নেওয়া হয়েছে ভারতের পুনর্জন্ম, মহীশূর, ১৯৯৩ থেকে।

২। যখন শ্রী অরবিন্দ এটি লিখেছিলেন, তখন ভারতীয় জনসংখ্যার মধ্যে বর্তমানের পাকিস্তান ও বাংলাদেশকেও গণ্য করা হত এবং সম্পূর্ণ জনসংখ্যা ছিল ত্রিশ কোটি।

৩। লেখক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার সপক্ষে বলেছেন, “সভ্য সমাজে শিক্ষিত নাগরিকরা শাসনাধিকারের ভাল দিকগুলি অনুভব করে এবং উন্নত মানের সমাজ গঠনে রাষ্ট্রের ভূমিকার জন্য গর্ব বোধ করে

৪। এটি উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে শ্রী অরবিন্দ ভারতীয় প্রসঙ্গে তিনি ধর্ম শব্দটি সংকীর্ণভাবে গোপনে ব্যবহার করেননি, বরং ধর্ম সম্পর্কে বৃহত্তর অর্থে হিন্দু দৃষ্টিভঙ্গির কথা বলেন।

৫। ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে শ্রী অরবিন্দ কলকাতার আলিপুর কারাগারে ছিলেন।

৬। শ্রী অরবিন্দ কোনোদিনই আর্যদের ভারত আক্রমণের তত্ত্বটি মেনে নেননি; বরং তিনি এই তত্ত্বটিকে জোর দিয়ে অস্বীকার করেছিলেন। যখন তিনি আর্যজাতিশব্দটি ব‍্যবহার করেছেন তখন তিনি হিন্দু জাতির কথা বুঝিয়েছেন। তিনি কখনোই আর্য ও দ্রাবিড়দের মধ্যে কোনো অবাস্তব বিভাজন মেনে নেননি : পরবর্তী কালে বেদের গোপন তত্ত্ব” – এ তিনি লেখেন, “আমি আর্য ও দ্রাবিড়দের একটি অভিন্ন জাতি হিসাবে বিবেচনা করি ।

৭।  গান্ধীজির প্রত‍্যুত্তরটি ড: আম্বেদকরের হিন্দুধর্ম ব‍্যতীত অন‍্যান‍্য ধর্মে নিপীড়িত শ্রেণীর ধর্মান্তরীকরণের দাবির প্রসঙ্গে দিয়েছিলেন।

৯। হিন্দুমুসলিম দাঙ্গার পরে ১৯২০২২ সালে স্বল্পকালের খিলাফত আন্দোলনের উদ্দেশ্যে শ্রী অরবিন্দের বক্তব্য

১০। এই অনুচ্ছেদের শেষে বাঁকা অক্ষরে লেখা দুটি পংক্তি, এ বি পুরানী রচিত ইভনিং টকস্ উইথ শ্রী অরবিন্দ“, ১৯৭৪, বইটির দ্বিতীয় খণ্ডের পৃষ্ঠা নং ৪৮ এ সম্পূর্ণ পংক্তিটি মেলে ।

১১। প্রথম থেকেই মহাত্মা গান্ধী পরিষ্কারভাবে বলেছেন, তাঁর চোখে খিলাফত স্বরাজের থেকেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও আপৎকালীন । তিনি লেখেন, “মুসলমানদের কাছে স্বরাজের অর্থ কার্যকরীভাবে খিলাফতের মুখোমুখি হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের ক্ষমতা…….এই মনোভাবের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন না করা প্রায় অসম্ভব….. খিলাফতের স্বার্থে যদি আমরা আরো এগিয়ে যেতে পা্রি, তাহলে আমি সানন্দে সকলকে স্বরাজ আন্দোলন স্থগিত করার জন্য অনুরোধ করব”।

১২। গত মাসে কোলকাতায় ঘটে যাওয়া কিছু গুরুতর দাঙ্গার প্রেক্ষিতে

১৩। উল্লেখিত অংশে বলা হয় যে, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লিগের মধ্যে ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল । এই চুক্তিতে মুসলিমদের পৃথক নির্বাচক মণ্ডলী ও আইনসভায় তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদের দাবিকে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছিল। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে লোকমান্য তিলক এটিতে স্বাক্ষর করেছিলেন।

১৪ অন্তবর্তী সরকার ব্রিটিশ ও কংগ্রেসের মধ্যে যে মধ্যস্থতা করেছিল এবং যেখানে মুসলিম লিগ যোগ দিতে সম্মত হয়েছিল, সে প্রসঙ্গে।

১৫ নবনির্মিত পাকিস্তান দু’মাস পরেই কাশ্মীর আক্রমণ করে. ভারতীয় সেনারা তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল  এবং কাশ্মীর সীমান্ত থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের প্রায় বিতাড়িত করে ফেলেছিল, ঠিক তখন নেহেরু সাময়িক ভাবে যুদ্ধ থামিয়ে দেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সম্মুখে এই বিতর্কটি উত্থাপন করেন এর ফলস্বরূপ কাশ্মীর এখনও দ্বিখণ্ডিত এবং পাকঅধিকৃত অংশটি ভারতের প্রতি ঘটে চলা সমস্ত  সন্ত্রাসবাদের আঁতুড়ঘর। এই অংশটিই পাকিস্তানি নেতাদের কাছে ভারতের দ্বিতীয় বিভাজনের প্রয়োজন‘-এর উদ্দেশ্যে গৃহীত প্রস্তুতির অন্যতম কারণ ।